ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

বাংলার প্রাণের কাছে

বৈশাখ ঘিরে দক্ষিণ মোড়াকাঠি গ্রামে তালপাখা তৈরির ধুম

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৫২১ ঘণ্টা, এপ্রিল ৭, ২০১৮
বৈশাখ ঘিরে দক্ষিণ মোড়াকাঠি গ্রামে তালপাখা তৈরির ধুম তৈরি হচ্ছে হাতপাখা। ছবি: বাংলানিউজ

বরিশাল: যেসব এলাকায় বিদ্যুতের সংযোগ নেই, গরমের দিনে সেইসব এলাকায় হাতপাখার কোনো বিকল্প নেই। এইতো, কয়েকবছর আগেও বাংলার গ্রামেগঞ্জের প্রতিটি বাড়ির একটি অপরিহার্য সরঞ্জামের নাম হাতপাখা। তবে তালপাতার হাতপাখার ব্যাপারটা যেন অন্যসবের তুলনায় আলাদা। কারণ এতে বাতাসের পাশাপাশি যোগ হয় শীতলতাও।

তবে বর্তমান বাজারে প্লাস্টিকের একছত্র অধিপত্যে তালপাখার কদর এখন অনেকটাই কমে গেছে। তাছাড়া কাঁচামাল সংকট ও মুনাফা কম হওয়ায় পেশাও পাল্টে ফেলছেন হাত পাখার কারিগররা।

যারা এখনও রয়েছেন তাদের অবস্থা তেমন ভালো নয়। কোনোরকম টিকে থাকার জন্য প্রতিনিয়ত করতে হচ্ছে সংগ্রাম। আবার কেউ কেউ বাংলার বিভিন্ন উৎসবকে ঘিরে বাংলার হাজার বছরের ঐতিহ্যকে সম্বল করে তৈরি করছেন তালপাখা।  

আসছে বৈশাখ। আর বৈশাখী মেলার অন্যতম প্রধান একটি অনুষঙ্গ তালপাখা। তাই বর্ষবরণকে সামনে রেখে বরিশালের উজিরপুর উপজেলার দক্ষিণ মোড়াকাঠি গ্রামের বাড়িতে বাড়িতে ধুম লেগেছে তালপাখা তৈরির।

বংশ পরম্পরায় তালপাখা তৈরি করে গ্রামটির অন্তত ২০টি পরিবার। তবে গরমের সময় দুই মাস তালপাখা তৈরির ২ মাস কাজ থাকলেও সারা বছর- নানা ধরনের কাজ করেই সংসার চালাতে হয় তাদের।
মোড়াকাঠি গ্রামের সবাই মিলে এভাবেই হাতপাখা বোনার কাজে যুক্ত।  ছবি: বাংলানিউজ
গ্রামের বাসিন্দা ও নারী কারিগর মাসুমা বেগম জানান, তিনি ৩৫ বছর ধরে তালপাখা বুনছেন। আগে তার শাশুড়ি, দাদী-শাশুড়িও একই কাজ করতেন। সেই হিসেবে শতবছরেরও বেশি সময় ধরে এ গ্রামে পাখা বোনা হয়ে আসছে।  

আগে পুরো গরমকাল জুড়ে পাখা বোনার কাজে ব্যস্ত থাকা লাগলেও, এখন মাত্র দুই মাস (১৫ মাঘ থেকে ২৯ চৈত্র) কাজ করেন তারা। বাকি সময় কেউ বর্গা চাষী হিসেবে, কেউ দিনমজুর হিসেবে কাজ করে আয় করেন। আবার কেউ কেউ অন্যরকম কারিগরি পেশাকে বেছে নিচ্ছেন।

তবে শুধু বৈশাখকে ঘিরে যে পরিমাণ চাহিদা থাকে সেই অনুসারে কাঁচামালের যোগান না থাকায় পর্যাপ্ত তালপাখা তৈরি করা সম্ভব হয়না বলে জানান রহিমা বেগম নামে আরেকজন কারিগর।

মাসুমা বেগমের স্বামী আয়নাল হক হাওলাদার বলেন, হাতপাখার জন্য তালপাতা আগে এমনিতেই পাওয়া যেত, আর টাকা দিয়ে কিনতে হলেও তা ছিলো খুবই নগণ্য। কিন্তু এখন একটি পাতা ১২ টাকা দিয়ে কিনতে হয়।

তিনি জানান, একটি পাতা দিয়ে দু’টি পাখা হয়। পুরো একটি পাখা বানাতে ব্যয় হয় ১০ থেকে ১২ টাকার মতো। আর সেইসব পাখা মাথায় করে নিয়ে ঘুরে ঘুরে বিক্রি করলে ১৫ থেকে ২০ টাকার মধ্যে বিক্রি করা যায়। পাইকাররা নিলে তো আরও কম দাম দেয়।

পাখা তৈরির বিষয়ে হনুফা বেগম বলেন, প্রথমে পাতা এনে শুকাতে হয়। এরপর পাতাটাকে পাখার মতো আকার দেওয়া হয়। পরে তা সুতার সাহায্যে বাঁধাই করা হয়। এরপর হাতল ও পাখার বাড়তি অংশ কেটে ফেলে, রং করলেই তা বিক্রির জন্য তৈরি।

হাতপাখা তৈরির প্রথম ধাপে শুকানো হচ্ছে তালপাতা।  ছবি: বাংলানিউজ
লাল মিয়া হাওলাদার নামে এক ব্যবসায়ী জানান, পাখা সেলাইকরাসহ যাবতীয় সব কাজ করতে হয় গ্রামের গৃহবধুদের। আর তা হাট বা মেলায় নিয়ে বিক্রি করেন পুরুষরা। তবে নিজেদের মনের-মাধুরী মিশিয়ে তালপাখা তৈরি করলেও দারিদ্রের কোন হেরফের হয় না কারিগরদের।

সুলতান হাওলাদার নামের পাখা ব্যবসায়ী বলেন, পাঁচজন মিলে যদি সারাদিন কাজ করে, তবে দৈনিক ১০০ পাখা বানানো সম্ভব। সুতরাং, প্রতিবছর মৌসুমে ৫ থেকে ৭ হাজার পাখা তৈরি করতে পারে একটি পরিবার।

তিনি বলেন, প্লাস্টিকের হাতপাখা বের হওয়ার পর তালপাতার হাতপাখার কদর একটু কমে গেছে। তবে তার চেয়েও বেশি সমস্যা হচ্ছে তাল গাছ কমে যাওয়ায়। সবমিলিয়ে পাখা তৈরিতে দেখা দিয়ে নানান প্রতিবন্ধকতা। তাই অনেকেই ছেড়ে দিয়েছেন এ কাজ। আর যারা করছেন তারা হয়তো পারিবারিক ঐতিহ্য ধরে রাখতে নয়তো পেটের দায়ে রয়ে গেছেন।

বাংলাদেশ সময়: ১১০৪ ঘণ্টা, এপ্রিল ০৭, ২০১৮
এমএস/এনএইচটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

বাংলার প্রাণের কাছে এর সর্বশেষ