কাঁচাপথের মসৃণতাটুকু চলে গেছে সুদূরের পানে। তাতে শুধুই বালু আর ভারসাম্যহীনতার প্রকাশ।
গায়ে গায়ে লেগে থাকা চা গাছেদের রয়েছে অন্যরকম এক প্রাকৃতিক সৌন্দর্য! মনকে খুব সহজেই নাড়া দেয়। যা চা-শিল্পের দেড়শ বছরের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের ধারক। শুধু এই জাগছড়া বাগানই নয়; বাংলাদেশের প্রতিটি চা বাগানেই এ ইতিহাস আপন মহিমায় সমুজ্জ্বল ও সুবিস্তৃত।
জাগছড়া চা বাগানের টিলাময় একটি উপত্যকায় তখন সবুজের দারুণ প্লাবন! সৌন্দর্য যেন ঢেউ খেলে খেলে মিলে গেছে এদিক-ওদিক। হঠাৎ ঘন সবুজের এমন আরণ্যক প্রেক্ষাপট থেকে একটি বাঁশির সুর ভেসে আসছে। কিন্তু তখনও দৃশ্যটি ধরা পড়েনি চোখে। এ যেন শুধুই স্বর্গীয় এক উপলব্ধির মৃদু প্রকাশ।
এক সময় সেই বাশির সুর তীব্র হয়ে কাছে এলো। বাঁশি তার স্পষ্ট মায়াময় কণ্ঠে জানান দিলো বাঁশির সুর চিরসুধাময়। সেই বাঁশিওয়ালা তরুণটি আপন মনে বাঁশি বাজিয়ে যাচ্ছেন। সবুজের আহ্বানে এ যেন সুরের প্রতিধ্বনি। চা বাগানের এক দুপুরে কথা হয় এই বাঁশিওয়ালার সঙ্গে।
এ তারুণ্যদীপ্ত বাঁশিওয়ালার নাম আবুল হোসেন। চা শ্রমিকের সন্তানরা তাদের পেশা পরিবর্তন করে আজ বিভিন্ন পেশায় যুক্ত হয়ে পড়েছেন। বাবা চা শ্রমিক ছিলেন বলেই যে সন্তানকে চা শ্রমিকই থাকতে হবে এখন এমন ধারণা থেকে দূরে সরে আসছে নতুন প্রজন্মের তরুণেরা। তারা চা বাগানে কাজ না করে শহরের বিভিন্ন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান, অফিস, কলকারখানা প্রভৃতিতে নিজের পছন্দের কাজটি বেছে নিচ্ছেন।
বাবার পেশা পরিবর্তন করে নিজের পেশায় জড়িত হওয়ার চা শ্রমিক সন্তানদের সফল প্রতিনিধি আবুল হোসেন। তিনি জাগছড়া চা বাগানের শ্রমিক মৃত শুকুর আলীর ছেলে। বর্তমানে বেঁচে থাকার তাগিয়ে বাবার পেশা পরিবর্তন করে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় প্যারাডাইস ক্যাবল কোম্পানিতে অ্যাসিসট্যান্ট অপারেটর পদে কর্মরত। পাঁচ দিনের ছুটিতে বাগানে বেড়াতে এসেছেন।
আলাপচারিতায় আবুল হোসেন বলেন, বাঁশি বাজাতে আমার ভীষণ ভালো লাগে। বিশেষ করে চা বাগানের এমন নির্জনতায় আরো বেশি ভালো লাগে। বাঁশির সুর আমার মনের সব দুখ-কষ্ট, যন্ত্রণা, হতাশাকে দূর করে। মনকে আনন্দে ভরিয়ে দেয়।
‘আজ থেকে পনের বছর আগে আমার বাবা মারা যায়। তারপর সংসারে অভাব-অনটন-অশান্তি নেমে আসে। তখন মাত্র পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েই কাজে নেমে পড়ি। বাবা মারা যাওয়ার পর আমার পড়াশোনাটা চিরতরে বন্ধ হয়ে যায়। দুই ভাই, এক বোন। বোনটির বিয়ে হয়ে গেছে। ছোটভাই শাহজাহান ঢাকার কাঁচপুরে শরীফ মেলামাইন কোম্পানিতে চাকরি করে। মাকে দেখতে মাঝে মধ্যে বাড়ি আসি। ’
বাঁশি সম্পর্কে তিনি আরো বলেন, তিন বছর ধরে আমি এক ওস্তাদের কাছে বাঁশির তালিম নিচ্ছি। আসলে সময় তো পাই না। দিনরাত দশ-বারো ঘণ্টা কাজ করার পর বাসায় এসে ক্লান্ত হয়ে পড়ি। তারপরও সময় করে মাঝে মধ্যে বাঁশি নিয়ে বসি। খুব ভালো লাগে এই ভেবে যে, অবসর যেটুকু সময় পাই খারাপ কাজে আমি সেই সময়টুকু ব্যয় না করে বাঁশিতে সময় কাটাচ্ছি।
বাবার পেশা পরিবর্তন করে নিজের পছন্দের পেশা সম্পর্কে আবুল হোসেন বলেন, মানুষ ভালো করে বেঁচে থাকার তাগিদে, একটু উন্নত জীবনের তাগিদে অপেক্ষাকৃত ভালো আয়-রোজগারে পথে হাঁটেন। আর বেলাতেও তাই। ’
বাংলাদেশ সময়: ১৯৫৮ ঘণ্টা, জুন ০৫, ২০১৯
বিবিবি/এএ