একবিংশ শতাব্দীর সামাজিক প্রবৃদ্ধি তথা বৈশ্বিক গতিশীলতা মন্থর করতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে অপরাধ। একই সঙ্গে সহায়ক ভূমিকা রাখছে মাদক।
যেমন প্রশ্ন হচ্ছে, অপরাধের বৈচিত্র্য কি মাদকের উপস্থিতি জরুরি করে অপরাধ ও মাদকমুক্ত সমাজ গঠনে করণীয়তোলে? নাকি মাদক অপরাধজগতে নতুনত্বের জন্ম দেয়? অপরাধবিজ্ঞানী, সমাজবিজ্ঞানী, নীতিনির্ধারক, সমাজসংস্কারক—সবার ভাবনায়, চিন্তায়, সর্বোপরি গবেষণায় অপরাধ ও মাদক বিশ্লেষিত হচ্ছে বহুমুখী দৃষ্টিকোণ থেকে, যেখানে বর্তমান সমাজের প্রেক্ষাপট অনুযায়ী নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থাই মুখ্য। উল্লেখ্য, কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের পূর্বে যেকোনো সমস্যার কার্যকারণ, তত্ত্বগত বিশ্লেষণ, সমসাময়িক ধরন, গতি-প্রকৃতি তথা সামগ্রিক পর্যালোচনা যথার্থ দাবি রাখে।
বর্তমান সমাজের অপরাধ পরিক্রমার ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরতে পুলিশ সদর দপ্তরের অপরাধভিত্তিক পরিসংখ্যান উন্মোচন হওয়া জরুরি, যা সমাজের কুৎসিত চেহারা তুলে ধরছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৩ সালে দেশে তিন হাজার ২৮টি হত্যা এবং পাঁচ হাজার ২০২টি ধর্ষণের মতো গুরুতর অপরাধ সংঘটিত হয়েছে।
প্রতিদিন গড়ে আটটির বেশি হত্যা এবং ১৪টির বেশি ধর্ষণের অভিযোগ পাওয়া গেছে। ধর্ষণের পাশাপাশি অন্যান্য নারী নির্যাতনের অভিযোগও আসত দিনে ৩০টির বেশি এবং চূড়ান্তভাবে মামলাও হয়েছে ১১ হাজার ৩৭টি। ২০২৩ সালে এক হাজার ৩৮৪টি ডাকাতির ঘটনাও রেকর্ড করেছে পুলিশ। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এককভাবে সবচেয়ে বেশি মামলা হয়েছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে।
গত ১২ বছরে প্রায় ২০০ মা-বাবা খুন হয়েছেন তাদের মাদকাসক্ত ছেলে-মেয়ের হাতে, যা জোরালোভাবে মাদকের ভয়াল থাবায় বিপর্যস্ত সামাজিক ভঙ্গুরতা প্রকাশ করছে। অন্যদিকে কমছে না সমাজের অন্যান্য প্রচলিত গুরুতর অপরাধও। যেমন—২০২৩ সালে অপহরণের ঘটনা ঘটেছে ৪৬৬টি। একই সঙ্গে চোরাচালানের মামলা হয়েছে দুই হাজার পাঁচটি। পুলিশে জনবল বাড়ছে।
নতুন নতুন ডিজিটাল প্রযুক্তি যোগ হচ্ছে, তবু কমছে না অপরাধ। উল্টো বাড়ছে এবং যুক্ত হচ্ছে নতুন নতুন অপরাধ। অনলাইন অপরাধ, ই-কমার্স নামে প্রতারণা, অনলাইন জুয়া খেলা, এবং বিভিন্ন ধরনের সাইবার ক্রাইম, যেমন—সাইবার বুলিং, হ্যাগিং, ফিশিং, স্প্যামিং, সফটওয়্যার পাইরেসি, কুম্ভিলকবৃত্তি ইত্যাদি সবাইকে ভাবাচ্ছে গভীরভাবে।
আঠারো শতকের প্রাক্কালে ইউরোপে অপরাধবিজ্ঞানের বিকাশকাল থেকে শুরু করে পরবর্তীকালে আধুনিক, উত্তর আধুনিক সময়কাল পর্যন্ত সব অপরাধবিজ্ঞানীর প্রচেষ্টা ছিল অপরাধের ধরন, কার্যকারণ, গতি-প্রকৃতি, প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা অন্বেষণ করা। এই সময়কাল জুড়ে অপরাধকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করার নিমিত্তে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে কিছু দৃষ্টিভঙ্গি।
যেমন—জৈবিক, মনস্তাত্ত্বিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, ভৌগোলিক, প্রাতিষ্ঠানিক, রাষ্ট্রীয় ইত্যাদি। অপরাধের সুনির্দিষ্ট কার্যকারণ খুঁজতে অপরাধবিজ্ঞানীদের প্রথম প্রয়াস ছিল জৈবিক ত্রুটি চিহ্নিত করা। পরে অবশ্য এই তালিকায় যুক্ত হয়েছে মানসিক ভারসাম্যহীনতা, সামাজিক অসংগতি, অর্থনৈতিক বৈষম্য; এমনকি অপরাধ এখন বিবেচ্য হচ্ছে শাসকশ্রেণির দমনমূলক আচরণের বহিঃপ্রকাশরূপে। একই সঙ্গে সমাজ থেকে অপরাধ নির্মূল করতেও একই পদ্ধতি কার্যকর হবে না। আলাদা আলদা অপরাধের জন্য ভিন্ন ভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। যার প্রথম পদক্ষেপ হবে সুনির্দিষ্ট সামাজিক অসংগতি খুঁজে বের করা। যেমন—কেন কিশোর-কিশোরী থেকে শুরু করে প্রাপ্তবয়স্ক, অশিক্ষিত থেকে শিক্ষিত, পুরুষ থেকে নারী ক্রমে মাদকের প্রতি আসক্ত হচ্ছে, তার কারণ অনুসন্ধান করতে হবে। ভৌগোলিক এলাকায় বা সমাজে জনসংখ্যার আধিক্য, দরিদ্রতা, বেকারত্বসহ নানামুখী সামাজিক সমস্যা অধিক হারে থাকবে, সেই সমাজে মাদকের ব্যবসা ও অপব্যবহারও বেশি হবে এবং মাদককে কেন্দ্র করে গুরুতর অপরাধও দিন দিন বাড়তে থাকবে। এই তত্ত্ব অনুযায়ী অপরাধের কারণ হিসেবে আরো কিছু কারণকে উল্লেখ করে; যেমন—সামাজিক অস্থিরতা ও নিরাপত্তাহীনতা, যথাযথ নিয়ন্ত্রণের অভাব, পারিবারিক বিশৃখলা ও উদাসীনতা এবং বৈরী পারিপার্শিক অবস্থা।
শুধু তত্ত্বগত বিশ্লেষণের ওপর ভিত্তি করে নয়, বর্তমান সমাজের প্রেক্ষাপট, জীবনযাত্রার ধারা, গতি-প্রকৃতি, অসংগতিসহ চতুর্মুখী দৃষ্টিভঙ্গি বিবেচনায় আনতে হবে অপরাধ বিশ্লেষণে। কেননা অপরাধমুক্ত সমাজ গঠন করতে চাইলে নিয়ন্ত্রণ বা প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধমূলক ব্যব্যস্থাকে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। বিশ্বের উন্নত রাষ্ট্রগুলোও এখন সামাজিক উন্নয়নের মাধ্যমে অপরাধ প্রতিরোধের প্রতি বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। বৈশ্বিক অপরাধবিজ্ঞানের ট্রেন্ডও এখন পুলিশ, কোর্ট, কারাগার বা সংশোধনাগারের উন্নয়ন থেকে সামাজিক অসংগতি নির্মূলে বেশি মনোনিবেশ করছে। যেমন—ইংল্যান্ডে ১৯৮৩ সালে পার্লামেন্টে সব দলের উপস্থিতিতে সামাজিক অপরাধ প্রতিরোধে কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া যায় তার একটা রূপরেখা দাঁড় করায়। সেখানে উল্লেখ করা হয় যে অপরাধ প্রতিরোধে তারা ঝুঁকিপূর্ণ এবং বিশৃঙ্খল পরিবার খুঁজে বের করে পরিবারের সদস্যদের মাঝে সম্পর্ক উন্নয়ন বিষয়ক শিক্ষা ও কর্মসূচি গ্রহণ, বৈবাহিক সম্পর্কের উন্নয়ন, প্যারেন্টিং বিষয়ক পদক্ষেপ নেবে। একই সঙ্গে কিশোর-কিশোরীদের মানসম্মত শিক্ষা, বাসস্থান ও কাজের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে উদ্যোগ নেবে।
বাংলাদেশের অপরাধের হার কমিয়ে আনতেও নিতে হবে সমষ্টিগত পদক্ষেপ, যেখানে সমাজের একজন সাধারণ নাগরিক থেকে শুরু করে অবদান থাকবে সরকারের নীতিনির্ধারকসহ সবার। সামাজিক কার্যকর কর্মসূচি, যেমন—প্রতিবেশীর নজরদারি টিম গঠন, ভবঘুরে ও মাদকাসক্তদের বাসস্থান ও কাজের নিশ্চয়তা, পারিবারিক সহিংসতা নিরসন, সামাজিক-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা, সেবামূলক কাজের প্রসার ইত্যাদি পরিচালনা করতে কাজ করতে হবে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়কে। সবার জন্য মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে, শিক্ষাকে আরো আনন্দায়ক করতে, ঝরে পড়া শিশুদের পুনরায় শিক্ষাজীবন ফিরিয়ে দিতে কাজ করতে হবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে। বেকার যুবকদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা কিংবা উদ্যোক্তা হতে সহায়তা করতে হবে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়কে। সামাজিক-ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে মূল্যবোধ ও নৈতিক শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। মাদকের নিয়ন্ত্রণ আনতে এর সহজলভ্যতা সংকুচিত করতে হবে। সীমান্ত এলাকা দিয়ে মাদকের প্রবেশ রুখে দিতে সোচ্চার থাকতে হবে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা ও সীমান্তরক্ষী বাহিনীকে।
অন্যদিকে শহরভিত্তিক অপরাধ নিরসনে শহর পুনর্গঠনে পদক্ষেপ নিতে হবে, বিশেষ করে শিল্প এলাকা ও আবাসিক এলাকায়। বিশাল এলাকা মনিটরে রাখতে ছোট ছোট জোনে ভাগ করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। শহর কিংবা গ্রাম সমগ্র বাংলাদেশে অপরাধ নিয়ন্ত্রণে পুলিশকে কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে। কেননা এরই মধ্যে যে অপরাধসমূহ সংঘটিত হয়ে গেছে তা নিয়ন্ত্রণে এবং পুনরাবৃত্তি ঠেকাতে নিতে হবে নিয়ন্ত্রণমূলক ও প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা।
পুলিশ বিভাগকে দুর্নীতিমুক্ত ও গতিশীল করতে অভ্যন্তরীণ ক্ষুদ্র বিষয় থেকে বৃহৎ কর্মসূচিতে পরিবর্তন আনতে হবে এবং তাদের প্রকৃতই জনগণের সেবকে পরিণত করতে হবে। এ উদ্যোগ শুধু বিভাগীয়ভাবে নিলেই হবে না; ব্যক্তি পুলিশকেও মানসিকভাবে পরিবর্তন হতে হবে। সাইবার স্পেসের অপরাধ রুখে দিতে পুলিশকে অধিক হারে প্রযুক্তিগত বিষয়ে দক্ষ করে গড়ে তোলার পাশাপাশি অপরাধী যেন যথার্থ প্রমাণের অভাবে বিচারকার্যকে বুড়ো আঙুল দেখাতে না পারে সে বিষয়েও পদক্ষেপ নিতে হবে। সর্বোপরি অপরাধ ও মাদকমুক্ত সমাজ গঠনে নীতিনির্ধারকরা পরিকল্পনা গ্রহণ করবেন, আর বাস্তবায়ন করতে হবে সংশ্লিষ্ট সবাইকে। সব দায় সরকারের বিবেচনা করলে কখনোই সমাজ থেকে অপরাধ দূর হবে না। একজন সুনাগরিক হিসেবে প্রত্যেক বিবেচক মানুষকেই সমাজ বিনির্মাণে অংশগ্রহণ করত হবে।
লেখক: অধ্যাপক, ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স (সিপিএস) বিভাগ, মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
বাংলাদেশ সময়: ১৩০৫ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৩, ২০২৫
জেএইচ