ঢাকা: কেউ বেঞ্চে না বসে দাঁড়িয়ে আছেন, কেউ আবার বেঞ্চে উঠে দাঁড়িয়েছেন নিজের কান ধরে। যেন স্কুলের শিক্ষক পড়া না পারায় বা কোনো ভুলের জন্য শিক্ষার্থীদের শাস্তি দিচ্ছেন।
রাজধানীর পুরান ঢাকায় অবস্থিত আরমানিটোলা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের ১২০ বছর পূর্তি উদযাপন ও প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের পুনর্মিলনী উপলক্ষে স্কুল প্রাঙ্গণের মাঠে তৈরি করা হয়েছে একটি প্রতীকী শ্রেণিকক্ষ। সেই শ্রেণিকক্ষ পেয়েই যেন আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়েন প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা।
তবে আজ সেই শ্রেণিকক্ষে নেই কোনো শিক্ষক, নেই কোনো ভুলের জন্য শিক্ষাগুরুর শাসন। তারপরও স্মৃতিচারণ করে কানে ধরার অভিনয় করছেন কেউ কেউ। জীবনের বেশিরভাগ সময় পার করে আজ যেন কান ধরে দাঁড়াতে লজ্জা নেই কারো। উল্টো তা হয়ে উঠেছে আনন্দের বহিঃপ্রকাশ।
শুধু কানে ধরার অভিনয় নয়, কেউ কেউ পড়ার অভিনয়ও করেছেন। সেসব আবার ফ্রেমবন্দি করছেন স্কুল জীবনের সহপাঠীরা। প্রতীকী শ্রেণিকক্ষের আরেক পাশে তৈরি করা হয়েছে স্কুল ড্রেসের ফটো ফ্রেম। কাঁধে কাঁধ লাগানো সেই ফটো ফ্রেমের পেঁছনে দাঁড়ালেই তরুণ হয়ে উঠছেন এই বয়োবৃদ্ধরা!
স্কুল জীবনের পুরনো বন্ধু, সিনিয়র-জুনিয়রদের পেয়ে হাসি, আড্ডায় মেতে উঠেছেন সবাই। তাদের গল্পে উঠে আসছে স্কুল জীবনের স্মৃতি। পুরনো বন্ধুদের কাছে পেয়ে একে অন্যকে জড়িয়ে ধরছেন। স্কুল শেষের পর এই প্রথম দেখা হয়েছে কারো কারো। অনেকের মধ্যে থাকা মনোমালিন্যও দূর হয়ে গেছে এই পুনর্মিলনীতে এসে। আবার অনেকে হারানো বন্ধুদের কথা ভেবে মন খারাপ করছেন।
দেশের মাধ্যমিক শিক্ষায় আলোকবর্তিকা হয়ে আছে পুরান ঢাকার আরমানিটোলা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়। ১২০ বছর ধরে আলো ছড়িয়ে যাচ্ছে রাজধানীর এই প্রাচীনতম বিদ্যাপীঠ। এই উপলক্ষে দুই দিনব্যাপী বর্ষপূর্তি উদযাপন ও প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। শুক্রবার (১৭ জানুয়ারি) পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানে বর্তমান ও সাবেক শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের পদচারণায় মুখরিত হয়ে ওঠে বিদ্যালয় প্রাঙ্গণ।
স্কুল মাঠে পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে ছবি তুলছিলেন পুরান ঢাকার ব্যবসায়ী এম এ ফরহাদ। তিনি বলেন, প্রায় ১৭ বছর পর আবার স্কুলে পা রেখেছি। পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে দীর্ঘদিন পর দেখা। সবাই সবার সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যুক্ত থাকলেও সরাসরি দেখা হতো না। আজ সবার দেখা হয়ে গেছে। আবার অনেক বন্ধুকে আমরা হারিয়ে ফেলেছিলাম। আজ আবার খুঁজে পেয়েছি। সবাই মজা করছি, স্মৃতিচারণ করছি। অনেকের মধ্যে মনোমালিন্য ছিল। সেগুলো আজ দূর হয়ে গেছে। যেন আমরা আবার স্কুল জীবনে ফিরে গেছি।
আরমানিটোলা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের ১৯৬৫ ব্যাচের শিক্ষার্থী ইকবাল আহমেদ তার নাতিকে নিয়ে পুনর্মিলনীতে এসেছেন। তিনি এখন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী। ইকবাল আহমেদ বলেন, স্কুলের শতবর্ষ উদযাপনের সময় এসেছিলাম। আজ আবার ২০ বছর পর এসেছি। পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হয়েছে। আবার যারা আজ আমাদের মধ্যে নেই তাদের কথা ভেবে খারাপও লাগছে।
এই স্কুলেই পড়েছেন অবিভক্ত পাকিস্তানের জাতীয় হকি দলের তারকা খেলোয়াড় আব্দুস সাদেক। তিনি ১৯৬২ ব্যাচের ছাত্র ছিলেন। তিনি বলেন, লেখাপড়া হোক বা খেলাধুলা হোক, সবই এই স্কুলে শিখেছি। এই স্কুলের সঙ্গে অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে।
বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খানও এই স্কুলে পড়েছেন। স্কুলের ১২ দশক পূর্তিতে অতিথি হয়ে আসেন তিনি। প্রধান অতিথির বক্তব্যে ড. আব্দুল মঈন খান বলেন, আরমানিটোলা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের ১২০ বছর পূর্তি অনুষ্ঠানে উপস্থিত হতে পেরে আমি নিজেকে গর্বিত মনে করছি। গর্বিত কারণ আমি একদিন এই স্কুলের ছাত্র ছিলাম। এই স্কুলের স্মৃতি আমি বর্ণনা করে শেষ করতে পারব না।
তিনি আরও বলেন, আমরা এমন একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষা লাভ করেছি, যার সুফল আমরা সারাজীবন পেয়েছি। একজন মানুষের জীবনে স্কুলের যে শিক্ষা সেই শিক্ষা কিন্তু মানুষের জীবনে শেষ দিন পর্যন্ত কাজ করে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীও এই স্কুলে এক বছর পড়েছেন। পুনর্মিলনীতে এসে তিনি বলেন, স্কুলের প্রাঙ্গণে ঢোকার সময় আমার স্কুলের আসার দিনগুলোর কথা মনে পড়ে গেছে। আমি মাত্র এক বছরের জন্য এই স্কুলে পড়েছি। বাংলাদেশের অনেক বিজ্ঞজন এই স্কুলে পড়েছেন, যারা জীবনে সফল হয়েছে।
বাংলাদেশ সময়: ১৫৩৮ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৭, ২০২৫
এসসি/এমজেএফ