দেশের অর্থনীতি এখন লেজেগোবরে। গত সাড়ে তিন দশকে কখনো এমন সংকটে পড়েনি দেশ।
অর্থনীতি সমিতির এক বড় নেতা, যিনি অর্থনীতির একজন স্বনামধন্য গবেষক ও লেখক, সম্প্রতি তিনি দেশের অর্থনীতির চরম সংকটের চিত্র তুলে ধরে হতাশা প্রকাশ করেছেন। বলেছেন, দেশের ব্যবসাবাণিজ্য খাদের কিনারে। শিল্প বিনিয়োগ বহু দিন ধরে বন্ধ প্রায়। ব্যবসায়ীদের অবস্থা ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি। আওয়ামী লীগের পৌনে ১৬ বছরের দুঃশাসন থেকে মুক্তি চেয়েছিল সারা দেশের মানুষ। ব্যবসায়ীরা ভেবেছিলেন, স্বৈরাচারের পতনে ব্যবসাবাণিজ্যের পরিবেশ সৃষ্টি হবে। কিন্তু তার বিপরীত চিত্র এখন দেশজুড়ে। আগে ছিল ভোটচুরির সরকার। বর্তমান সরকার নির্বাচিত নয়, তবে এ সরকার এসেছে দেশের ১৮ কোটি মানুষের সমর্থন নিয়ে। জুলাই গণ অভ্যুত্থানের সুফল নিশ্চিত করতে যেখানে সারা দেশে কর্ম উদ্যোগ সৃষ্টির আশা করা হচ্ছিল, তার বদলে চলছে ব্যবসাবাণিজ্য স্তব্ধ করার অশুভ কর্মকাণ্ড ।
পতিত স্বৈরাচারের আমলে দেশজুড়ে চাঁদাবাজি ও ঘুষকাণ্ড ছিল ওপেন সিক্রেট। এখন আরও বেশি চাঁদাবাজি চলছে। চলছে ঘুষকান্ড। ব্যবসাবাণিজ্যের অবস্থা কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে, তা ভাবতেও কষ্ট হয়। মাত্র পাঁচ মাসে রাজস্ব ঘাটতির পরিমাণ ৫৩ হাজার কোটি টাকা। রাজস্ব আয় দিয়েই সরকার চলে। সরকারি কর্মচারী-কর্মকর্তাদের বেতন দেওয়া হয়। উন্নয়নকাজও চলে সে অর্থ দিয়ে। দেশে ব্যবসাবাণিজ্যের প্রসার ঘটলে আকাশছোঁয়া রাজস্ব ঘাটতির প্রশ্ন উঠত না। দেশের অর্থনীতির জন্য অভিশাপ হয়ে দেখা দিত না। অবস্থা এতই নাজুক যে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড দূরে থাক, এখন সরকার চালাতেই হাজার হাজার কোটি টাকার ঋণ নিতে হবে।
সরকার ব্যাংক থেকে ঢালাওভাবে ঋণ নেওয়ায় বেসরকারি উদ্যোক্তাদের ঋণ পাওয়া দুষ্কর হয়ে পড়ছে। যেসব শিল্পপতি ঋণখেলাপি হওয়াকে ঘৃণার চোখে দেখতেন তাঁরাও এখন পরিস্থিতির শিকার। বিশাল দেনার মধ্যে আকণ্ঠ ডুবে থেকে অনেকে আপসে নিজেদের শিল্পকারখানা ছেড়ে দিয়ে বাঁচতে চাচ্ছেন। শিল্পকারখানা পরিচালনার জন্য প্রয়োজন নিরাপত্তার পরিবেশ। তা এখন অনুপস্থিত। কলকারখানা চালাতে প্রয়োজন গ্যাস ও বিদ্যুৎ, যার অভাব প্রকট। সরকারের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় সহায়তাদানের চেষ্টা চলছে, এ কথা ঠিক। তবে তা খুবই ধীরগতিতে। পতিত ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলেই শিল্পকারখানা ও কৃষি-প্রাণিসম্পদ খামারশিল্প প্রয়োজনীয় সুবিধাদি থেকে বঞ্চিত হয়ে আসছিল। স্বৈরাচারী সরকারের মন্ত্রী ও নেতাদের প্রধান লক্ষ্য ছিল- বিদেশ থেকে ঋণ এনে মেগা প্রকল্প করা। সেগুলো থেকে মেগা দুর্নীতির মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটে পকেট ভারী করা।
অন্তর্বর্তী সরকারের শিল্প মন্ত্রণালয় শিল্প খাতের সমস্যার সমাধানের বদলে ‘কানে দিয়েছি তুলো পিঠে বেঁধেছি কুলো’ নীতি গ্রহণ করেছে। সম্প্রতি একজন পরিশ্রমী ও দক্ষ শিল্পোদ্যোক্তা তাঁর চারটি কারখানা একসঙ্গে বন্ধ করে দিয়েছেন। তাঁর টেক্সটাইল শিল্পের চার কারখানায় ৫ হাজার শ্রমিক-কর্মচারী এক দিনে বেকার। এর পাশাপাশি রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাকশিল্পের প্রায় ১০০ কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে, গত কয়েক মাসে। জানা গেছে, চারটি সুপ্রতিষ্ঠিত কারখানা বন্ধ হওয়ার মূল কারণ তাদের প্রোডাক্টগুলোর ক্রেতা গার্মেন্ট-কারখানাগুলোর বেশির ভাগ বন্ধ হয়ে যাওয়া এবং প্রয়োজনীয় ব্যাংকঋণের অভাব এবং কাঁচামালসংকট। এ ছাড়া আরও অনেক শিল্পকারখানার মালিক একই ধরনের সংকটে পড়ে উৎপাদন বন্ধ করে দিতে বাধ্য হচ্ছেন। অনেক ফ্যাক্টরিই প্রয়োজনীয় গ্যাস সরবরাহ, বিদ্যুৎ না পাওয়াসহ অন্য সব লজিস্টিক সাপোর্ট সংকটে পড়েছে। এগুলোর সমাধানের প্রথম দায়িত্ব শিল্প মন্ত্রণালয়ের। এ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা শিল্পমালিকদের সঙ্গে বিদ্যমান সমস্যার সমাধানে বৈঠকে বসারও প্রয়োজন বোধ করেননি। এমনকি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপদেষ্টা নিজে একজন বড় মাপের শিল্পোদ্যোক্তা হওয়া সত্ত্বেও পারিপার্শ্বিক বাস্তবতায় দেশের শিল্পকারখানার দুরবস্থার অবসানে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিতে পারছেন না। ব্যবসাবাণিজ্য বাধাগ্রস্ত হয়ে পড়ায় সরকারের সাফল্য প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। ফলে দেশে বেকার জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর স্টাডি অনুসারে সাম্প্রতিককালে কর্মসংস্থানহীন মানুষের সংখ্যা ২৬ লাখ ৬০ হাজার বলে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে। অভিজ্ঞ অর্থনীতিবিদদের মতে, দেশে কর্মপোযোগী পুরোপুরি বেকার মানুষের সংখ্যা এক কোটি বা তার কাছাকাছি। আর ছদ্মবেকার (অপর্যাপ্ত উপার্জনের বিকল্প কর্মসংস্থান) সংখ্যাও প্রায় আরও এক কোটি হবে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
দেশ থেকে বিতাড়িত শেখ হাসিনার সরকার সাড়ে পনেরো বছরে অবকাঠামো উন্নয়নের নামে চীন, রাশিয়া ও জাপান বা অন্য দেশ থেকে মেগা প্রকল্পে বিশাল ঋণের অর্থ এনে মেগা দুর্নীতির মাধ্যমে লাখ লাখ কোটি টাকা লুণ্ঠনে ব্যস্ত ছিল।
বিভিন্ন মেগা প্রকল্পে বিদেশি নাগরিকদের কর্মসংস্থান হয়েছে; কিন্তু বাংলাদেশি বেকারদের কর্মসংস্থান হয়েছে খুবই কম সংখ্যায়। আর যেসব শিল্পকারখানা বা কৃষি ও প্রাণিসম্পদ খামার প্রতিষ্ঠার দ্বারা ব্যাপক জনশক্তির কর্মসংস্থান সম্ভব সেগুলোতে দেশিবিদেশি বিনিয়োগকারীদের আগ্রহী করার উদ্যোগই নেয়নি তারা। সস্তা প্রচারের লক্ষ্যে বেশ কিছু রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতকরণ অঞ্চল ও বিশেষ শিল্পাঞ্চল প্রতিষ্ঠা বা অবকাঠামো তৈরির ঢাকঢোল পেটানো হলেও লক্ষ্যমাত্রার ভগ্নাংশ সাফল্যও আসেনি। মূল কারণ, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা। আমলাদের ওপর নির্ভরশীলতায় কাক্সিক্ষত সাফল্য আসেনি। গ্যাস, বিদ্যুৎ সরবরাহ এবং শিল্পের প্রয়োজনীয় কাঁচামাল ও ক্যাপিটাল মেশিনারি আমদানির পর্যাপ্ত বৈদেশিক মুদ্রা বরাদ্দের ক্ষেত্রে কোনো উন্নতি নেই।
বেকারদের আশু কর্মসংস্থানের রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ সম্প্রসারণের লক্ষ্যে অবিলম্বে দেশের শিল্প বিনিয়োগ পরিস্থিতির উন্নয়ন এবং এ ক্ষেত্রের সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর উদ্দেশ্যে অন্তত ১০ জন অর্থনীতিবিদ ও শিল্প বিনিয়োগ বিশেষজ্ঞ এবং ১১ জন শিল্পোদ্যোক্তাকে নিয়ে ২১ সদস্যের উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন কমিশন গঠন করা যেতে পারে। কমিশন সদস্যরা দেশের শিল্পাঞ্চলগুলো ঘুরে সরেজমিন পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে রিপোর্ট প্রদান ও প্রতিকারের সুপারিশগুলো পেশ করবেন। তবে সেই রিপোর্টের অপেক্ষা না করেই ব্যবসাবাণিজ্যের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের তিন-চারজন উপদেষ্টাকে সরাসরি সংকটগ্রস্ত শিল্পকারখানাগুলোর মালিক/মালিকগোষ্ঠীর সঙ্গে আলোচনা করে বিদ্যমান সমস্যার সমাধানের উদ্যোগ নিতে হবে।
শিল্প, বাণিজ্য, কৃষি ও প্রাণিসম্পদ এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টাদের সরাসরি মনোযোগ না পেলে শিল্পমালিকরা হতাশার মধ্যে ডুবে যাবেন। ইতোমধ্যে আনোয়ারুল আলম চৌধুরীর নেতৃত্বে বেশ কয়েকজন শিল্প উদ্যোক্তার একটি প্রতিনিধিদল বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুরকে শিল্পকারখানার সমস্যাগুলোর বিষয়ে বক্তব্য জানিয়ে এসেছেন। তাঁরা সরকারকে ‘শিল্প বাঁচানোর উদ্যোগ দ্বারা উপযুক্ত ব্যবস্থা করা অথবা তাঁদের প্রতিষ্ঠানগুলোর দায়দেনা থেকে মুক্তির জন্য সেফ এক্সিট’ দাবি করেছেন। সমস্যাগুলো জানেন দেশের অর্থনীতি ও শিল্প বিশেষজ্ঞ এবং সরকারের নেতারা। শিল্প খাতের সমস্যাগুলোর মধ্যে রয়েছে ব্যাংকঋণের সুদ ক্রমান্বয়ে বাড়ানো, গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানিসহ সব লজিস্টিক সাপোর্ট ব্যবস্থাপনায় সরকারের দায়দায়িত্ব এড়িয়ে চলা, ব্যাপক চাঁদাবাজি, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ সব শ্রেণির আমলা ও কর্মচারীদের ‘ঘুষ-বাণিজ্য’ কর্তৃত্ববাদী সরকারের পতনের পরও না বদলানো, শিল্পের প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম এবং কাঁচামাল আমদানির পর্যাপ্ত বৈদেশিক মুদ্রার ব্যবস্থাপনায় চরম ব্যর্থতা আর নতুন দেশিবিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য ‘ওয়ান স্টপ সার্ভিস’ বাস্তবায়নে অসাফল্য। ব্যবসায়ীদের রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনার ভুল পথ থেকেও সরে আসতে হবে। ব্যবসায়ীদের বড় পরিচয় তাঁরা দেশের উন্নয়নের কান্ডারি। তাঁরা কর্মসংস্থানের পথ রচনা করেন। কর্তৃত্ববাদী শাসনে তাঁরা বঞ্চনার শিকার হয়েছেন প্রত্যক্ষভাবে। ব্যবসাবান্ধব নীতি গ্রহণের মাধ্যমে সরকার ব্যবসায়ীদের উৎসাহিত করলে দেশ এগিয়ে যাবে। স্বস্তি আসবে জনমনে।
♦ লেখক : বিএনপির সাবেক তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক
বাংলাদেশ সময়: ০৯৩৪ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৬, ২০২৫
এসআই