১৬ ফেব্রুয়ারি রবিবার বাংলাদেশে জেলা প্রশাসক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। তিন দিনের এ সম্মেলন শেষে জেলা প্রশাসকরা তাদের নিজ নিজ জেলায় ফিরে গেছেন।
এক সপ্তাহে দেশের বিভিন্ন স্থানে জেলা প্রশাসনের কর্মকাণ্ড বিশ্লেষণ করে দেখা যায় যে, তারা দ্রুত সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। অনেক জায়গায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতির জন্য তারা সমন্বয় সভা করছেন এবং প্রশাসনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে যে স্থবিরতা তা দূর করার জন্য তারা নতুন উদ্যমে কাজ করছেন। একটি সম্মেলন কীভাবে টনিকের মতো কাজ করে তার বড় প্রমাণ হতে পারে জেলা প্রশাসক সম্মেলন। জেলা প্রশাসকরা এ সম্মেলনের সবচেয়ে বড় উদ্দীপনা হিসেবে দেখছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নীতিনির্ধারণী বক্তৃতা। জেলা প্রশাসকরা নিজেরাই বলছেন যে, এই প্রথম সরকারের প্রধান নির্বাহী এমনভাবে বক্তব্য দিলেন যাতে মনে হচ্ছে যে আমরা সত্যিকারের একটি দিকনির্দেশনা পেয়েছি। জেলা প্রশাসকদের এ সম্মেলনে প্রথমেই ড. মুহাম্মদ ইউনূস নিজেকে প্রধান অতিথি হিসেবে অভিহিত করায় অভিমান প্রকাশ করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন যে, প্রধান অতিথি বলে আমাকে দূরে ঠেলে দেওয়া হলো। এরপর ড. মুহাম্মদ ইউনূস যে মূল বক্তব্যটি দেন, সেই বক্তব্যে তিনি পুরো প্রশাসনকে (মাঠ প্রশাসন থেকে প্রধান উপদেষ্টা পদ পর্যন্ত) একটি টিম হিসেবে চিহ্নিত করেন। তিনি খেলার সঙ্গে তুলনা করে বলেছিলেন যে, একটি টিমে সবাই যদি ঠিকঠাক মতো কাজ না করতে পারে, তাহলে যেমন দল ভালো করতে পারে না, তেমনি প্রশাসন সমন্বিতভাবে খেলতে না পারে, প্রত্যেকের মধ্যে যদি সমন্বয় না থাকে তাহলে প্রশাসন ঠিকমতো কাজ করে না।
৫৩ বছর ধরে আমরা দেখেছি যে প্রশাসনকে ব্যবহার করা হয়েছে দলীয় স্বার্থের জন্য। ক্ষমতাসীনরা ক্ষমতায় থাকার জন্য প্রশাসনকে ব্যবহার করছেন। প্রশাসন হয়েছে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের হাতিয়ার। আর এ কারণেই প্রশাসনের মধ্যে একটি বড় অংশ তাদের ক্যারিয়ারের জন্য এবং নানা রকম উচ্চাকাক্সক্ষা পোষণের জন্য সরকারি দলের লেজুড়বৃত্তি করেছে। এর ফলে নৈতিকতাহীন মোসাহেবি প্রশাসন কায়েম হয়েছিল গোটা দেশে। কারণ প্রশাসনের কাছে সুস্পষ্ট একটা বার্তা শুরুতেই ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকে দেওয়া হতো যে, তারা যত সরকারের অনুগত হবে, তাতে তাদের পদোন্নতি হবে, ভালো পোস্টিং হবে। দলীয় আনুগত্য নির্ভর প্রশাসন যে দেশসেবা করতে পারে না, তার প্রমাণ নিকট অতীতেই আমরা পেয়েছি। যার কারণে আমরা দেখি প্রশাসনের মধ্যে একটি ভয়াবহ রাজনৈতিক প্রবণতা। প্রশাসনের কর্মকর্তাদের যে মেধা, দক্ষতা এবং সৃজনশীল শক্তি সেটি তারা কাজে লাগায় না। বরং সবসময় রাজনৈতিক অভিপ্রায় বাস্তবায়নের জন্য তাদের কাজ করতে হয়েছে। এ কাজ না করলে তাদের শাস্তি পেতে হয়েছে। আমরা সম্প্রতি দেখলাম যে, ২০১৮ সালের রাতের ভোটে নির্বাচনে যারা রিটার্নিং অফিসারের দায়িত্ব পালন করছিলেন, সেসব রিটার্নিং অফিসারকে প্রথম ওএসডি এবং বেশ কয়েকজনকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে। দায়িত্ব পালনে অযোগ্য এবং অক্ষম কর্মকর্তাদের যাদের চাকরির বয়স ২৫ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে, তাদের বিদায় করা হয়েছে।
অনেকে প্রশ্ন করতে পারেন প্রশাসনের দোষ কী? তারা তো সরকারের অনুগত আজ্ঞাবহ হবেই। সর্বোচ্চ মহলের নির্দেশনা মানার বিকল্প কি ছিল তাদের হাতে? সরকার তাদের নির্বাচন পরিচালনার জন্য যেভাবে নির্দেশনা দিয়েছে সেভাবেই তো তারা কাজটি করবেন। কিন্তু বাস্তবতা যে এমনটি নয়, সেটি ড. মুহাম্মদ ইউনূসের রাষ্ট্র চিন্তা দর্শন থেকেই সুস্পষ্টভাবে বোঝা গেল। ১৬ ফেব্রুয়ারি তিনি জেলা প্রশাসক সম্মেলনে সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারীদের ‘প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। তাদের ভয় ভীতির ঊর্ধ্বে উঠে কাজ করার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি কারও রক্তচক্ষুকে ভয় না পাওয়ার জন্য নির্দেশনা দিয়েছেন। অর্থাৎ প্রশাসনের দায়িত্ব সম্পর্কে একটি সুবিন্যস্ত রূপরেখা এই প্রথমবারের মতো একজন সরকারপ্রধান উপস্থাপন করলেন।
প্রজাতন্ত্রের একজন কর্মচারী রাষ্ট্রের কর্মচারী। কোনো সরকার বা কোনো রাজনৈতিক দলের না। এটি প্রশাসনের কর্মকর্তাদের প্রথম বুঝতে হবে। জনগণের জন্য আইন অনুযায়ী যেটি করণীয় সেটাই তাদের করতে হবে। ‘রাতের ভোট’ আদেশ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না। এটি সুস্পষ্ট ভাবেই তার চাকরির শর্ত ভঙ্গ। কারণ সরকারি কর্মকর্তারা জনগণের কাছে দায়বদ্ধ। জনগণের ট্যাক্সের টাকায় তাদের বেতন হয়। আর এ কারণেই সেই সময় যে সব জেলা প্রশাসক রিটার্নিং অফিসের দায়িত্ব পালন করছিলেন, তাদের উচিত ছিল এ ধরনের ব্যবস্থার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো, প্রতিবাদ করা। এমনকি কিছু না পারলে দায়িত্ব থেকে সরে যাওয়ার জন্য আবেদন করা। কিন্তু সেটি তারা করেননি। এটি না করার কারণ হলো যে, দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক সংস্কৃতি। ২০১৮ নির্বাচনের পরে আমরা দেখেছি প্রশাসন যেন ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের একটি শাখায় পরিণত হয়েছে। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল যেভাবে প্রশাসনকে পরিচালনা করতে চেয়েছে, প্রশাসন ঠিক সেভাবেই কাজ করেছে। পুরো প্রশাসন যেন ক্ষমতাসীন দলের অঙ্গসংগঠনে পরিণত হয়েছিল। প্রশাসনের ভিতর যারা চাটুকার, তেলবাজ, দুর্নীতিবাজ, অযোগ্য তারাই বিভিন্ন জায়গায় পদোন্নতি পেয়েছিলেন তাদের আনুগত্যের জন্য। এ অবস্থা থেকে অবসানের জন্য বাংলাদেশের দরকার ছিল একটি সুনির্দিষ্ট রূপ পরিকল্পনা, একটি দর্শন। আর সেই দর্শনটিই উপস্থাপন করলেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এটি দেশের প্রশাসনের জন্য একটি মাইলফলক।
একজন প্রশাসনের কর্মকর্তা প্রথম থেকে যদি মনে করেন যে, তিনি প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী এবং এই রাষ্ট্র তাকে নিয়োগ দিয়েছে আইন অনুযায়ী কাজ করার জন্য, আইনের ব্যত্যয় যদি কোনো কাজ হয় সেই কাজটি তিনি করতে বাধ্য নন তাহলে কিন্তু প্রশাসনে সুস্পষ্ট শৃঙ্খলা ফিরে আসে।
ড. মুহাম্মদ ইউনূস তার ভাষণে চারটি দিকনির্দেশনামূলক বক্তব্য রেখেছেন, যেটি পরবর্তী সরকারগুলো এবং বাংলাদেশের প্রশাসনের জন্য একটি গাইডলাইন এবং অবশ্য পালনীয়। বাংলাদেশের প্রশাসন যদি পরবর্তী সময়ে এ নির্দেশনা বা দর্শনটি মেনে চলে তাহলে বাংলাদেশের রাষ্ট্রব্যবস্থা পাল্টে যেত। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের এ চার দফা দর্শনে কী আছে? প্রথমত, প্রশাসনকে নির্মোহ এবং নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে হবে। ড. মুহাম্মদ ইউনূস কখনো বলেননি যে, এখন অন্তর্বর্তী সরকার আছে, অন্তর্বর্তী সরকার যা বলবে সেই কাজটিই করতে হবে। তিনি বলেননি যে, অন্তর্বর্তী সরকারের স্তুতি করতে হবে, অন্তর্বর্তী সরকারের চাটুকারিতা করতে হবে। তিনি সুস্পষ্টভাবে বলেছেন যে, প্রশাসনকে নির্মোহ এবং নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে হবে। অর্থাৎ প্রশাসন যদি মনে করে যে, একটি সরকার ভুল সিদ্ধান্ত নিচ্ছে বা একটি ভুল নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে সেটি সরকারের গোচরে আনা এবং ভুলটা শুধরে দেওয়ার জন্য তার জায়গা থেকে উদ্যোগ গ্রহণ করার জন্য তিনি সুস্পষ্ট বার্তা দিয়েছেন।
দ্বিতীয়ত, তিনি প্রশাসনকে জনবান্ধব হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। আমরা স্বাধীনতার ৫৩ বছর পর দেখি প্রশাসনের সঙ্গে জনগণের একটা দুস্তর দূরত্ব রয়েছে। জনগণ প্রশাসনের কাছে অনেক সময়ই ঠিকঠাক মতো সেবা পান না। নানারকম হয়রানি তাদের পোহাতে হয়। বিশেষ করে ভূমি, জন্মনিবন্ধন ইত্যাদি ক্ষেত্রে জনভোগান্তির কথা সর্বজনবিদিত। একারণেই যথার্থভাবে ড. মুহাম্মদ ইউনূস চিহ্নিত করে প্রশাসনকে জনবান্ধব হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। একজন প্রশাসক বা সরকারি কর্মকর্তা যদি জনবান্ধব হন তাহলে তিনি নির্মোহ এবং নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে বাধ্য। একটি আরেকটির সঙ্গে সমন্বিত। যখন তিনি জনবান্ধব হবেন তখন তিনি জনগণের মনের কথাগুলো বুঝতে পারবেন, জনগণের আকাক্সক্ষাগুলোকে ধারণ করতে পারবেন। জনগণ কী চাচ্ছে সেটা উপলব্ধি করতে পারবেন। এ উপলব্ধি তাকে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং নির্মোহভাবে কাজ করতে বাধ্য করবে। অর্থাৎ একজন প্রশাসক যদি জনবান্ধব হন এবং জনগণের সমস্যাগুলো দ্রুত সমাধানের জনগণের কাছাকাছি থাকেন, তাহলে তিনি কোনো অন্যায় করতে পারেন না- এ বার্তাটি ড. মুহাম্মদ ইউনূসই প্রথম জাতির কাছে উপস্থাপন করলেন।
তৃতীয়ত, ড. মুহাম্মদ ইউনূস প্রশাসনকে সৃজনশীলতায় এবং উদ্ভাবনী শক্তি প্রয়োগের জন্য পরামর্শ দিয়েছেন। বাংলাদেশে যারা প্রশাসন ক্যাডারে কাজ করেন, তারা সবাই সৃজনশীল এবং মেধাবী। বাংলাদেশে যে পরীক্ষা কাঠামোয় সরকারি কর্মচারীদের নিয়োগ হয় তাতে, মেধাবী শিক্ষার্থীরাই সরকারি চাকরিতে প্রবেশ করেন। অথচ সরকারি চাকরিতে গিয়ে তারা তাদের ‘সৃজনশীলতা’ ব্যবহার করেন না নানা বাস্তবতায়। একটি ‘কেরানি কর্মের’ মধ্যে তারা নিজেদের যুক্ত করেন। কিন্তু তারা যদি তাদের সৃজনশীলতা এবং উদ্ভাবনী শক্তি প্রয়োগ করেন, তারা যদি তাদের মেধাকে প্রশাসনিক কাজে লাগান, তাহলে অনেক দক্ষ হয়। লাল ফিতার আমলাতান্ত্রিক দৌরাত্ম্য থেকেও আমরা মুক্ত হতে পারি। বিশেষ করে এখন উদ্ভাবনীর যুগ। আইটিসহ বিভিন্ন বিষয়ে সৃজনশীলতার মাধ্যমে একদিকে যেমন জনসেবা দ্রুত দেওয়া যায় তেমনি সমস্যা সমাধানেও দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যায়। আর এ কাজটি করার জন্য ড. মুহাম্মদ ইউনূসের যে খোলা বার্তা, সেই বার্তাটা অনেক বড় টনিক হিসেবে কাজ করেছে প্রশাসনের কর্মকর্তাদের মধ্যে।
চতুর্থত. ড. ইউনূস সব সিদ্ধান্তের জন্য ওপরের দিকে না তাকিয়ে সক্রিয় এবং স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা তুলে দিয়েছেন মাঠ প্রশাসনের হাতে। অর্থাৎ গত ৫৩ বছর আমরা যে প্রশাসন সংস্কার দেখেছি তা ছিল খুবই কেন্দ্রীভূত প্রশাসনব্যবস্থা। কেন্দ্র থেকে আরও নির্দিষ্ট করে বললে সচিবালয় থেকেই সবকিছু নিয়ন্ত্রিত হয়। সচিবালয় থেকে যেভাবে সিদ্ধান্ত দেওয়া হয় সেভাবেই একজন জেলা প্রশাসক কাজ করেন। জেলা প্রশাসক সিদ্ধান্তের জন্য মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের দিকে তাকিয়ে থাকতে হয়। কিন্তু সেই রীতি ভেঙে দেওয়ার ডাক দিয়েছেন সরকাপ্রধান। তিনি সুস্পষ্টভাবে বলেছেন যে, স্থানীয় যে সমস্যা সেটি স্থানীয়ভাবেই সমাধানের জন্য কাজ করতে হবে। সেটি যদি তারা করতে পারেন তাহলে একদিকে যেমন দ্রুত সিদ্ধান্ত দেওয়া সম্ভব হবে অন্যদিকে মাঠ প্রশাসনের দক্ষতাও বৃদ্ধি পাবে।
এ চারটি নির্দেশনার মাধ্যমে তিনি জেলা প্রশাসকদের নয়, পুরো প্রশাসনের জন্যই একটি নতুন কর্ম কৌশল দিয়েছেন। একজন প্রশাসক তিনি জনগণের কর্মচারী, তিনি জনসেবার জন্য এ দায়িত্ব পালন করছেন। জনগণের বিপক্ষে আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে কোনো রাজনৈতিক দলকে তুষ্ট করার জন্য কোনো কাজ কখনো সরকারি কর্মকর্তা করবেন না, যদি তিনি এ পরামর্শগুলো মেনে চলেন। প্রশাসন যদি স্বাধীন, নিরপেক্ষ এবং সৃজনশীলভাবে কাজ করতে পারে তাহলেই একটি জনবান্ধব প্রশাসন গড়ে উঠতে পারে। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের এ দর্শন আগামী দিনে প্রশাসনের জন্য একটি সুপ্রসারী ভূমিকা রাখবে বলে মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা মনে করেন। আর এ প্রভাব প্রশাসনের উচ্চ পর্যায়ে পৌঁছে যাবে, তখন সত্যি সত্যি আমরা একটি কার্যকর, নিরপেক্ষ এবং জনবান্ধব প্রশাসন পাব।
বাংলাদেশ সময়: ০৯৪৯ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৪, ২০২৫
এসআই