ঢাকা, মঙ্গলবার, ১৮ ফাল্গুন ১৪৩১, ০৪ মার্চ ২০২৫, ০৩ রমজান ১৪৪৬

অন্যান্য

দূষণ মোকাবিলায় বসছে বাতাস পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র, ব্যয় ১০৯ কোটি টাকা

এস এম এ কালাম, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯১৮ ঘণ্টা, মার্চ ২, ২০২৫
দূষণ মোকাবিলায় বসছে বাতাস পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র, ব্যয় ১০৯ কোটি টাকা

ঢাকা: বায়ুদূষণ মোকাবিলায় বড় প্রকল্প হাতে নেওয়ার পরিকল্পনা করছে সরকার। এ প্রকল্পের আওতায় সড়কের পাশে নিরবচ্ছিন্ন বাতাস পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র (কন্টিনিউয়াস এয়ার মনিটরিং স্টেশন-সিএএমএস) স্থাপন করা হবে।

শুরুতে আটটি সিএএমএস স্থাপন করতে মোট ব্যয় হবে প্রায় ১০৯ কোটি টাকা।

বিভিন্ন কারণে প্রতিনিয়ত দূষিত হচ্ছে রাজধানীর বাতাস। প্রায় প্রতিদিনই পৃথিবীর সবচেয়ে দূষিত বাতাসের শহরের তালিকায় শীর্ষে উঠে আসছে ঢাকা। শীত মৌসুমে টানা কয়েক সপ্তাহ এ শহরের বাতাসের মান ছিল ‘খুবই অস্বাস্থ্যকর’।

টানা ‘খুবই অস্বাস্থ্যকর’ বাতাসের কারণে ঢাকা ছাড়া বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত ৫টি শহরের মধ্যে আছে চীনের বেইজিং, উজবেকিস্তানের তাসখন্দ, ইরাকের বাগদাদ ও প্রতিবেশী দেশ ভারতের দিল্লি।

জানা গেছে, প্রকল্প বাস্তবায়নে জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা-জাইকা দেবে ৬৭ দশমিক ৮৪ কোটি টাকা। আর সরকার ব্যয় করবে ৪১ দশমিক ১১ কোটি টাকা।

গুরুত্বপূর্ণ এ উদ্যোগের মাধ্যমে ঢাকা ও চট্টগ্রামের মত বড় শহরগুলোর দূষণ মোকাবিলার লক্ষ্য স্থির করেছে সরকার। সিএএমএস স্থাপনের সময়সীমা ২০২৫ থেকে ২০২৮ সাল নির্ধারণ করা হয়েছে।

এ ব্যাপারে পরিকল্পনা কমিশনের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বাংলানিউজকে বলেন, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় ‘এয়ার পলিউশন মনিটরিং উন্নয়ন প্রকল্প’ শিরোনামে একটি প্রকল্প প্রস্তাব পরিকল্পনা কমিশনে জমা দিয়েছে। প্রকল্পটির মোট বাজেট ১০৮ দশমিক ৯৫ কোটি টাকা, যার মধ্যে সরকার দেবে ৪১ দশমিক ১১ কোটি টাকা ও জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা (জাইকা) অনুদান দেবে ৬৭ দশমিক ৮৪ কোটি টাকা। প্রকল্পটি ২০২৫ সালের মার্চ থেকে ২০২৮ সালের জুন পর্যন্ত পরিবেশ অধিদপ্তরের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা হবে।

জানা গেছে, বর্তমানে দেশে স্থাপিত দূষণ পর্যবেক্ষণের ৩১টি স্টেশনের তুলনায় নতুন কেন্দ্রগুলো বেশি কার্যকর হবে। নতুন কেন্দ্রগুলো শহরের প্রধান সড়কে স্থাপন করা হবে। যেখানে যানবাহন থেকে নির্গত গ্যাস ও রাস্তার ধুলা একযোগে বায়ু দূষণ তৈরি করে। নতুন এই স্টেশনগুলো সরকারের দূষণ নিয়ন্ত্রণ নীতিতে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সরবরাহ করবে।

পরিবেশ অধিদপ্তরের এয়ার কোয়ালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের পরিচালক মো. জিয়াউল হক জানান, আটটি স্টেশনের মধ্যে পাঁচটি ঢাকায় ও দুটি চট্টগ্রামে স্থাপন করা হবে। অন্যটি হবে ভ্রাম্যমাণ। প্রয়োজন অনুযায়ী সেটা যেকোনো স্থানে স্থাপন করে বাতাসের মান পরিমাপ করা যাবে।

বায়ু দূষণের বর্তমান পরিস্থিতি

বাংলাদেশে বায়ু দূষণ পরিস্থিতি অত্যন্ত উদ্বেগজনক। ২০১৯ সালে বায়ু দূষণের কারণে অকাল মৃত্যুর সংখ্যা প্রায় ১ লাখ ৬৯ হাজার, যা দেশের অর্থনীতিতে ৪ দশমিক ৭৭ শতাংশ ক্ষতি হয়েছে। দেশের বাতাসে ক্ষতিকর উপাদানের মাত্রা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বেঁধে দেওয়া সীমার চেয়ে ১৫ গুণ বেশি, যা বাংলাদেশের বায়ু মানকে বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত বায়ু অঞ্চলের একটি করে তুলেছে।

স্বাস্থ্যগত প্রভাব

বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করছেন, এ পরিস্থিতি যদি অব্যাহত থাকে, তবে তা দেশের জনগণের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার বাংলানিউজকে বলেন, যদি এখনই পদক্ষেপ না নেওয়া হয়, তাহলে বায়ু দূষণ বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য বড় বিপদ হয়ে দাঁড়াবে।

বায়ু দূষণের উৎস ও রোধকল্পে করণীয় বিষয়ে জানতে চাইলে জলবায়ু পরিবর্তন বিশেষজ্ঞ ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও ইমেরিটাস প্রফেসর ড. আইনুন নিশাত বাংলানিউজকে বলেন, যেসব পরিকল্পনা রয়েছে সেগুলো যথেষ্ট। কিন্তু সেটা বাস্তবায়ন করবে কে? পুরোনো গাড়ি ওভারলোডেড হলে কালো ধোঁয়া নির্গত হয়। একটা বাসে ওঠার কথা ৩০ জন, সেখানে আমাদের রাজধানীতে চলাচল করা বাসে ওঠে ৬০ জন। ট্রাকে ৫ টন লেখা থাকলেও পরিবহন করে ১২ টন বা তার চেয়েও বেশি। ফলে ইঞ্জিন থেকে কালো ধোঁয়া নির্গত হয়।

তিনি বলেন, যেখানেই নির্মাণ কাজ চলছে ইট, বালু সবকিছুই খোলা অবস্থায় রাখা হচ্ছে। এসব থেকে অতি ক্ষুদ্র কণা বাতাসে মিশে যাচ্ছে। নির্মাণ সামগ্রী ঢেকে রাখলেই দূষণ কমবে। ইটভাটাগুলো থেকে প্রচুর কালো ধোঁয়া নির্গত হয়। আমাদের রাস্তাঘাটেও প্রচুর ধুলাবালি থাকে। উন্নত দেশে ভোরের দিকে রাস্তা ভিজিয়ে দেওয়া হয় যেন ধুলাবালি না ওড়ে। দূষণের এসব উপাদান নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেই হয়।

প্রফেসর ড. আইনুন নিশাত আরও বলেন, দূষণ রোধে অনেক স্টাডি ও পরিকল্পনা আছে। পরিবেশ অধিদপ্তর বিশ্বব্যাংকের সহযোগিতায় অনেক স্টাডি করেছে। প্রচুর মেশিনারি ও যন্ত্রপাতি এনেছে। দূষণ রোধে প্রস্তুতির ক্ষেত্রে যা প্রয়োজন তা আমাদের আছে, এখন কাজটা করা দরকার।

প্রায় ২৫ বছর ধরে বায়ুদূষণ নিয়ে গবেষণা করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক আব্দুস সালাম। বায়ু দূষণ রোধে আমাদের কার্যকর পদক্ষেপ কতটুকু জানতে চাইলে তিনি বাংলানিউজকে বলেন, ১০-১৫ বছর ধরে বায়ু দূষণের মাত্রা বেড়েই চলেছে। সরকার কিছু কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। তারপরও দূষণ কমছে না। কারণ পদক্ষেপ যথেষ্ট নয়। আরও বেশি কার্যকর ব্যবস্থা নিলে বায়ু দূষণ কমে যাবে।

তিনি আরও বলেন, বায়ু দূষণ প্রতিরোধে আরও অনেক পদক্ষেপ গ্রহণ করা বাকি রয়েছে। যেমন শীতকালে বিভিন্ন আবর্জনা পোড়ানো হয়, এগুলো বন্ধ করতে হবে। রাস্তাঘাট থেকে যে ধুলাবালি ওড়ে সেগুলো বন্ধের ব্যবস্থা করতে হবে। ভালো মানের জ্বালানি তেল ব্যবহার করতে হবে। আমাদের অল্টারনেটিভ ফুয়েলের বিষযয়ে ভাবতে হবে। রাস্তায় ট্রাফিক জ্যাম কমাতে হবে। শিল্প কারখানা, জেনারেটর ও গাড়ি কালো ধোঁয়া বন্ধ করতে হবে। পাশাপাশি আমাদের রাস্তাঘাট এবং গাছপালা, জলাধারের পরিমাণ বাড়াতে হবে। পরিকল্পিত শহর গড়ে তুলতে হবে। আন্তঃদেশীয় দূষণও কমানোর ব্যবস্থা করতে হবে। এসব ব্যবস্থা নিলেই বায়ু দূষণ কমে যাবে।

দূষণ কমানোর অর্থনৈতিক প্রভাব

কেন্দ্রীয় গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর রিসার্চ অন এনার্জি অ্যান্ড ক্লিন এয়ারের (সিআরইএ) তথ্য অনুযায়ী যদি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কঠোর গাইডলাইন (৫ µg/m³) অনুসরণ করা হয়, বছরে ৮১ হাজার ২৮২ প্রাণ বাঁচানো সম্ভব। দূষিত বাতাসের প্রভাবে দেশে প্রতি বছর ৬ লাখ ৭০ হাজার মানুষ শ্বাসকষ্টজনিত (অ্যাজমা) রোগে আক্রান্ত হয় বলেও গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, নানা স্বাস্থ্য ঝুঁকির কারণে প্রতি বছর দেশের প্রায় ১১ বিলিয়ন ডলার অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়, যা জিডিপির প্রায় ৫ শতাংশ।

বাংলাদেশ সময়: ০৯১৫ ঘণ্টা, মার্চ ০২, ২০২৫

এসএমএকে/এমজে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।