ঢাকা: রাজধানীর নিকুঞ্জ এলাকায় অবস্থিত মারজান টেকনিক্যাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে চলছিল রাশিয়া গমনেচ্ছু ব্যক্তিদের বাচাই পরীক্ষা। গত ৬ ফেব্রুয়ারি ওই পরীক্ষায় অন্যদের সঙ্গে অংশ নেন চাঁপাইনবাবগঞ্জের সদর থানার রেহাইচর এলাকার নির্মাণ শ্রমিক নিয়ামত আলী।
থাকা-খাওয়া, চিকিৎসাসহ আনুষঙ্গিক সব দায়িত্ব কোম্পানির। এ সুযোগ হাতছাড়া করে কে! তাই স্থানীয় দালালের এক প্রস্তাবেই রাজি হতে দুইবার চিন্তা করেননি এ তরুণ।
যুদ্ধদাস তৈরির নতুন ফাঁদপরীক্ষা দিতে আসা বেশির ভাগই দিনমজুর কিংবা স্বল্পবিদ্যায় ধাতস্থ। স্থায়ী কোনো চাকরি জোটে না বিধায় দৈনিক কিংবা মাসিক চুক্তিতে বিভিন্ন ধরনের কাজে যুক্ত।
রাশিয়ায় বেশি অর্থ আয়ের প্রলোভনে রাজি হয়ে যান প্রথম ভাবনাতেই। নিকুঞ্জের এই পরীক্ষাকেন্দ্রে উপস্থিত প্রায় ৪০০ ব্যক্তিকে রাশিয়ায় পাঠাতে চায় আল-সৌরভ ওভারসিজ নামের একটি রিক্রুটিং এজেন্সি। তবে সম্প্রতি কর্মী ভিসায় পাঠানোর কথা বলে রাশিয়ায় মানবপাচার চক্রের কাছে বিক্রি করে দেওয়ার বেশ কিছু অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে আল-সৌরভ ওভারসিজের তরফে রাশিয়ায় কর্মী পাঠানোর এ তোড়জোড় সন্দেহ জাগায়।
প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী কর্মকর্তা জিয়াউর রহমানের দাবি, রাশিয়ায় লিমিটেড লায়াবিলিটি কোম্পানি স্টোরি স্ট্রাকচারের কাছ থেকে ৪০০ জন কর্মীর ওয়ার্ক পারমিট পেয়েছেন। এরপর ৪ ফেব্রুয়ারি প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার কাছে নিয়োগ পরীক্ষার অনুমতি চেয়ে আবেদনও করা হয়েছে। যদিও তিনি এ সংক্রান্ত কোনো নথিপত্র দেখাতে পারেননি।
দূতাবাসের প্রথম সচিব (শ্রম) মাজেদুর রহমান সরকার জানান, নিয়ম অনুযায়ী রাশিয়ার কোনো প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ থেকে কর্মী পেতে চাইলে আগে দূতাবাসে চাহিদাপত্র পাঠাতে হয়। দূতাবাস ওই প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে খোঁজখবর নিয়ে পরবর্তী পদক্ষেপ নেয়। কিন্তু লিমিটেড লায়াবিলিটি কোম্পানি স্টোরি স্ট্রাকচার নামের কোনো প্রতিষ্ঠান দূতাবাসে কোনো ধরনের চাহিদাপত্রই দেয়নি। এ বিষয়ে তিনি কিছুই জানেন না।
জানা গেছে, রাশিয়ায় বিভিন্ন ধরনের কাজের ভিসায় পাঠানোর চুক্তি করে সহজ-সরল ব্যক্তিদের ইউক্রেন যুদ্ধে ঠেলে দিচ্ছে একটি চক্র। সম্প্রতি এ বিষয়ে ধারাবাহিক অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ হয়। এতে দেখা যায়, ট্রাভেল এজেন্সির মাধ্যমেও ঘটছে এই পাচারের ঘটনা। দেশের বিভিন্ন এলাকায় অগণিত তরুণ-যুবক উন্নত জীবনের খোঁজে রাশিয়ায় গিয়ে যুদ্ধদাসের পরিণতি বরণ করেছেন। এমনকি ইউরোপে পাঠানোর কথা বলেও অনেককে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে রাশিয়ার চক্রের কাছে। এরই মধ্যে একজন যুদ্ধক্ষেত্রে নিহত এবং অনেকের আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাশিয়ায় মানবপাচারের ঘটনা ঘটছে অনেকটা ঢাকঢোল পিটিয়ে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক ও হোয়াটসঅ্যাপে প্রকাশ্যে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হচ্ছে। সেখানে দেওয়া হচ্ছে চাকচিক্যময় জীবনের হাতছানি। এ ছাড়া স্থানীয় পর্যায়ে নিযুক্ত রয়েছে বিশাল দালালচক্র।
আরও জানা গেছে, বিদেশি কর্মী নিয়োগের ক্ষেত্রে সরকারি নীতিমালাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাচ্ছে দেশের রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো। নিজেদের ইচ্ছামতো কর্মী নিয়োগে দূতাবাসের অনুমোদন না নিয়েই নামসর্বস্ব কোম্পানিতে লোক নিয়োগের অপচেষ্টা চালানোর অভিযোগ উঠেছে। সরকারের অনুমোদন ছাড়াই রাশিয়ায় কর্মী নিয়োগের অপচেষ্টা করছে আরেক রিক্রুটিং এজেন্সি জান্নাত ওভারসিজ। ফেসবুক ও হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপের মাধ্যমে বিভিন্ন এজেন্সিকে যুক্ত করে গোপনে কর্মী নিয়োগ পরীক্ষা নিচ্ছে প্রতিষ্ঠান দুটি।
জান্নাত ওভারসিজের কর্মী নিয়োগের একটি বিজ্ঞাপনে বলা হয়, রাশিয়ার লিমিটেড লায়াবিলিটি কোম্পানিতে ৪২৫ জন্য কর্মীর জরুরি নিয়োগ। থাকা, খাওয়া, ইনস্যুরেন্স, চিকিৎসা ফ্রিসহ সর্বনিম্ন বেতন ৮০০ মার্কিন ডলার। এর মধ্যে নির্মাণ শ্রমিক থেকে হেলপার—সবাই সমপরিমাণ বেতন পাবেন বলে বিজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয়।
এরই ধারাবাহিকতায় গত ৩ ও ৪ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর সাঁতারকুল প্রধান সড়কে সৌদি-বাংলা ট্রেনিং অ্যান্ড টেস্টিং সেন্টারে ইন্টারভিউ নেওয়ার দিনক্ষণ চূড়ান্ত করে জান্নাত ওভারসিজ। এ বিষয়ে তথ্য জানতে চাইলে যোগাযোগ করা হলে নতুন কৌশলের আশ্রয় নেয় প্রতিষ্ঠানটি। ওই রাতেই জরুরি ঘোষণা দিয়ে বলা হয়, সময়মতো রাশিয়ান এম্বাসিতে সব কাগজপত্র না পাওয়ার কারণে আমাদের সব কার্যক্রম সাময়িক সময়ের জন্য বন্ধ করা হয়েছে। পরবর্তীতে ইন্টারভিউয়ের তারিখ জানিয়ে দেওয়া হবে।
বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও অভিবাসী আইন ২০১৩-এর ৩২ ধারা অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি বা রিক্রুটিং এজেন্ট সরকার বা ব্যুারোর পূর্বানুমোদন ছাড়া বৈদেশিক কর্মে নিয়োগের উদ্দেশ্যে বা অভিবাসনবিষয়ক কোনো বিজ্ঞাপন প্রকাশ বা প্রচার করলে তা অপরাধ বলে গণ্য হবে এবং তার জন্য অনধিক এক বছর কারাদণ্ড এবং অন্যূন ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
এদিকে প্রাথমিক কর্মী নিয়োগ পরীক্ষা গ্রহণে ব্যর্থ হয়ে জান্নাত ওভারসিজ জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) দ্বারস্থ হয়। গত ১০ ফেব্রুয়ারি বিএমইটির প্রশিক্ষণ পরিচালনা শাখার রাশিয়ার লিমিটেড লায়াবিলিটি কোম্পানিতে কর্মী নিয়োগের বাচাই পরীক্ষার অনুমতি নেয় প্রতিষ্ঠানটি। ওই সময় ৩০০ দক্ষ ও ১০০ অদক্ষ নির্মাণ শ্রমিক নিয়োগের পরীক্ষা নেওয়ার অনুমোদন নেয় জান্নাত ওভারসিজ। ১১ থেকে ১৩ ফেব্রুয়ারি তিন দিনব্যাপী এই বাছাই পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ডেলিগেটর না আসায় শেষ পর্যন্ত পরীক্ষাটি অনুষ্ঠিত হয়নি।
এ প্রসঙ্গে বিএমইটির প্রশিক্ষণ পরিচালনা পরিচালক প্রকৌশলী মো. সালাহ উদ্দিন বলেন, বিএমইটিতে প্রশিক্ষিতদের চাকরির সুযোগ দিতে আমরা বিভিন্ন সময় রিক্রুটিং এজেন্সিকে জব ফেয়ার বা চাকরি মেলা করার সুযোগ দিই। এরই ধারাবাহিকতায় জান্নাত ওভারসিজকেও জব ফেয়ার করার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ডেলিগেটর না আসায় শেষ পর্যন্ত বাছাই পরীক্ষাটি হয়নি।
অনুসন্ধানে জানা যায়, আল সৌরভ ওভারসিজও একই প্রক্রিয়ায় রাশিয়ায় মানবপাচারের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে। গত ৬ থেকে ৮ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর ভাটারার সোলমাইদে রহমান টেকনিক্যাল ট্রেনিং সেন্টারের বাছাই পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। পরবর্তী সময়ে নিকুঞ্জের মারজান টেকনিক্যাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে ৬ ফেব্রুয়ারির বাছাই পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। এ সময় চার শতাধিক বিদেশ গমনেচ্ছু ব্যক্তি বাছাই পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন।
খবর পেয়ে সরেজমিনে মারজান টেকনিক্যাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে কথা হয় বিদেশ গমনেচ্ছু মোহাম্মদ মিরাজের সঙ্গে। তিনি বলেন, রাশিয়া যেতে বেশি টাকা লাগবে না। কিন্তু ৮০০ থেকে ৯০০ ডলার বেতন দেবে। খাওয়া ও থাকা ফ্রি, তাই পরীক্ষা দিয়েছি।
এ সময় অন্তত ১২ জনের সঙ্গে কথা হয়। নিয়োগপ্রত্যাশীদের বেশির ভাগই স্বল্পশিক্ষিত এবং কেউ কেউ বর্তমানে দিনমজুর। উচ্চ বেতন হওয়ায় প্রত্যেকেই রাশিয়া যেতে আগ্রহ দেখাচ্ছেন।
এদিকে ৬ ফেব্রুয়ারি বাছাই পরীক্ষার পরীক্ষাস্থলে প্রতিবেদক উপস্থিত হওয়ায় পরবর্তী বাছাই পরীক্ষা স্থগিত করে আল-সৌরভ ওভারসিজ।
অনুসন্ধানে জানা যায়, মূলত রাশিয়ায় অস্তিত্বহীন কোম্পানিতে শ্রমিক নিয়োগের প্রক্রিয়া চালিয়েছে জান্নাত ওভারসিজ ও আল-সৌরভ ওভারসিজ। এমনকি কর্মী নিয়োগের আগে রাশিয়ার বাংলাদেশ দূতাবাস, প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় থেকেও অনুমোদন নেয়নি প্রতিষ্ঠানগুলো।
বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও অভিবাসী আইন ২০১৭-এর ৬ ধারায় জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) দায়িত্ব ও কার্যাবলি সম্পর্কে বলা হয়েছে, অভিবাসীর সংখ্যা অনধিক ২৫ জন হলে সংশ্লিষ্ট বাংলাদেশ মিশনের সত্যায়িত চাহিদাপত্র পরীক্ষা ও প্রক্রিয়াকরণ, অভিবাসীর সংখ্যা ২৫ জনের বেশি হলে অথবা চাহিদাপত্র মিশন বা দূতাবাসের সত্যায়িত না হলে সরকার অনুমোদিত চাহিদাপত্র প্রক্রিয়াকরণ ও বহির্গমনে ছাড়পত্র প্রদান করা।
কোম্পানির ডিমান্ড লেটার এজেন্সি দূতাবাস থেকে সত্যায়ন করবে, চুক্তি অনুযায়ী কর্মীদের সুবিধা দিতে পারবে কি না। সত্যায়ন নিয়ে কোম্পানি প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ে আবেদন করবে। কিন্তু রাশিয়ায় কর্মী নিয়োগের কথা বলে ৪০০ জনের এই বিশাল কর্মযজ্ঞ সম্পন্ন করেছে সংশ্লিষ্ট কোনো সংস্থার অনুমোদন ছাড়াই।
রাশিয়ায় কর্মী পাঠাতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের তথ্য স্বীকার করেন জান্নাত ওভারসিজের স্বত্বাধিকারী লিমা বেগম। বিদেশে কর্মী পাঠাতে বিএমইটির অনুমোদন আছে কি না জানতে চাইলে তিনি প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে বলেন, আমরা তো কর্মীদের পরীক্ষা বাতিল করে দিয়েছি। মূলত কর্মীদের একটি প্রাথমিক তালিকা করে রাখতে আগাম পরীক্ষার আয়োজন করেছিলাম। রাশিয়া থেকে সব ধরনের নথিপত্র না আসায় পরীক্ষার তারিখ পেছানো হয়েছে।
বিএমইটির তালিকাভুক্ত এই রিক্রুটিং এজেন্সি এখন পর্যন্ত রাশিয়ায় কোনো কর্মী পাঠায়নি বলে দাবি করেন লিমা বেগম। কথা বলার এক পর্যায়ে তিনি আবার বলেন, রাশিয়া থেকে ভিসা ইস্যু হওয়ার পর তারা কর্মী পাঠান।
অন্যদিকে আল-সৌরভ ওভারসিজের বিরুদ্ধে মানবপাচারের অভিযোগ প্রসঙ্গে কথা বলতে প্রতিষ্ঠানটির মালিবাগ রেলগেটসংলগ্ন কার্যালয়ে প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী জামাল উদ্দিনের সাক্ষাৎ চাইলে তিনি নেই বলে জানান অফিস সহকারী। পরে ব্যবস্থাপনা পরিচালক আতিকুল ইসলাম সোহেলকে মোবাইলে কল দিলে তিনি কোনো বক্তব্য দিতে রাজি হননি।
সূত্র: কালের কণ্ঠ
বাংলাদেশ সময়: ১১০৮ ঘণ্টা, মার্চ ৩, ২০২৫
জেএইচ