মৌলভীবাজার: অতিরিক্ত বৃষ্টি আর প্রকৃতির বৈরিতার মাঝেও এবছর মৌলভীবাজার সদর উপজেলার হাওর আর গ্রামাঞ্চলে আমনের রেকর্ড পরিমাণ উৎপাদন হয়েছে। অন্য বছরের তুলনায় বেড়েছে সোনালী ফসল রোপা-আমন ধানের উৎপাদন।
মৌলভীবাজার সদর উপজেলার খাইঞ্জার হাওর ও বিন্নার হাওরসহ আশপাশের কৃষি জমির হৃৎপিণ্ড হিসেবে পরিচিত কুদালীছড়া খালটি দুইবার খননের ফলেই এবার বাম্পার ফলন হয়েছে বলে মনে করছেন কৃষি সংশ্লিষ্টরা।
এবছরের অগ্রাহয়ণের প্রথম সপ্তাহ পার হতেই মৌলভীবাজারের হাওর আর গ্রামাঞ্চলে শুরু হয়েছে আনন্দে আমন ধান কাটা। ডিজেলের দাম বৃদ্ধি আর সার নিয়ে হতাশ কৃষক মনে নানা শঙ্কা থাকার পরও আমনের ফলন অন্যান্য বছরের চেয়ে ভাল হওয়ায় প্রতিটি পরিবারে বইছে খুশির আমেজ।
মৌলভীবাজার সদর উপজেলার গিয়াসনগর, মোস্তফাপুর ও নাজিরাবাদসহ তিনটি ইউনিয়নের মধ্যদিয়ে কুদালীছড়া খালটি বয়ে চলছে। ১৩ কিলোমিটার দীর্ঘ এই ঐতিহ্যবাহী খালটি এখানকার হাজারও কৃষকের জীবনের সঙ্গে স্বপ্নের মতো মিশে আছে। কিন্তু দীর্ঘদিনের খননের কোনো উদ্যোগ নেওয়া না হলেও বিগত বছর দুয়েক আগে পরপর দুইবার একাধিক অংশ খনন হওয়ায় প্রাণ ফিরে পায় খালটি। যার কারণে কৃষকরাও স্বাচ্ছন্দে তাদের স্বপ্নের ধান চাষাবাদ করতে পেরেছেন।
এবছর হাওরে আমন রোপণের পর অতিরিক্ত সার ব্যবহার করেননি কৃষকরা। তারপরও ফলন হয়েছে অন্য বছরের তুলনায় অনেক বেশি। শুধু এবছরই নয়, বিগত তিন বছর যাবতই হাওরগুলোতে ফলন ভাল হচ্ছে। তবে আমনের বাম্পার ফলন হলেও সেচ সুবিধা না থাকায় বোরো মৌসুমে দেখা দিয়েছিল পানির তীব্র সঙ্কট।
সদর উপজেলার জগন্নাথপুরের খাইঞ্জার হাওর, গোমরা-নিতেশ্বর এলাকার বিন্নার হাওর, আজমেরু, ভুজবল, আনিকেলীবড়, কমলাকলসসহ আশপাশের হাওর আর গ্রাম ঘুরে দেখা যায়, বিস্তীর্ণ হাওরজুড়ে শুধুই ধান আর ধান। কৃষকরাও আনন্দে সারি সারি পাকা ধান কাটছেন। আর যাদের কৃষি জমির পরিমাণ বেশি তাদের অনেকেই ধান কাটছেন আধুনিক কৃষিপ্রযুক্তি ‘কম্বাইন্ড হাভেস্টার’ যন্ত্রের মাধ্যমে। তবে বেশিরভাগ ধান কাটা হচ্ছে সনাতন পদ্ধতিতেই। কৃষকদের আশা, এবছর ফলন ভাল হওয়ায় কিয়ার (বিঘা) প্রতি ১৫ থেকে ১৬ মণ করে পাওয়া যাবে আমন ধান।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, বিন্নার হাওরে এবছর প্রথমবারের মতো রোপা আমন চাষে ধানি গোল্ড, ব্রি-৬ ও হিরা-১০ জাতের হাইব্রিড বিজ রোপন করা হয়েছে অন্তত ২০ হেক্টর জমিতে। উচ্চ ফলনশীল এই হাইব্রিড বিজ রোপনের ফলে প্রতি হেক্টরে বেড়েছে ধানের উৎপাদন। কৃষকের মাঝেও বাড়ছে আগ্রহ। বিন্নার হাওর ও খাইঞ্জার হাওরে মোট কৃষি জমির পরিমাণ ২৪৩ হেক্টর। এর মধ্যে আবাদ হয়েছে ২০০ হেক্টর। প্রতি হেক্টর জমিতে এ বছর সাড়ে ৪ মে.টন ধান পাওয়ার সম্ভানা রয়েছে বলে জানিয়েছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কৃষকরা রোপন করেছেন ব্রি-৭৫, ৮৭, ৫১, ৫২ ও ৪৯ জাতের ধান।
জগন্নাথপুর এলাকার কৃষক লুকমান উদ্দিন বলেন, অন্য বছরের তুলনায় এবার ফলন বেশি হয়েছে। কৃষকরা প্রতি কিয়ারে (বিঘা) ১৫ থেকে ১৬ মণ করে ধান পাচ্ছেন। আগে হাওরে জলাবদ্ধতায় ফলন ভাল হত না। এখন হাওরে জলাবদ্ধতা নেই, ক্ষেত তলিয়ে যাওয়ারও সম্ভাবনা নেই।
সদর উপজেলা উপ-সহকারি কৃষি কর্মকর্তা নিরোজ কান্তি রায় বলেন, কৃষিতে একটা নীরব বিপ্লব হয়েছে। বাংলাদেশ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কৃষি ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে। সেটা সম্ভব হচ্ছে নতুন নতুন প্রযুক্তির কারণে। আগে যে সীমাবদ্ধতা ছিল কৃষকের সঙ্গে যোগাযোগ করা, এখন সরাসরি কৃষকরা পরামর্শ পাচ্ছেন। নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার এগুলো মাঠে বাস্তবায়নের কারণে কৃষকদের অনেক প্রতিবন্ধকতা দূর হয়েছে। একসময় কৃষকরা ফসলের নায্য মূল্য পেতেন না, এখন তারা ভালো দাম পাচ্ছেন। যার কারণে কৃষিতে উৎপাদনও বেড়েছে।
মৌলভীবাজার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক সামছুদ্দিন আহমদ বলেন, জেলার কাউয়াদীঘি হাওরাঞ্চলে সেচের পর ১ হাজার ৩০০ হেক্টর জমিতে আমনের চাষ হয়েছে। ফলনও ভালো হয়েছে। আশা করছি হেক্টর প্রতি পাঁচ থেকে ছয় মেট্রিক টন ধান পাওয়া যাবে। সারা জেলায় এবার লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি আমন ধানের আবাদ হয়েছে।
বাংলাদেশ সময়: ১৭৪৫ ঘণ্টা, ৪ ডিসেম্বর, ২০২২
বিবিবি/এমএমজেড