চাঁপাইনবাবগঞ্জ: কানসাটের আমচাষি মজিবুর রহমান বেসরকারি চাকরি করেন। সেই সামান্য আয় আর আম বাগানের আয় দিয়েই চলে সংসার।
তবে এবার তীব্র গরমে তার বাগানের ৭৫ ভাগ আমের গুটিই নষ্ট হয়েছে গেছে। এখন ২৫ ভাগ আম টিকলেও তীব্র খরায় তা টিকবে কি না, সেই চিন্তায় তিনি।
তিন-চারদিন আগে সাড়ে ছয় হাজার টাকা খরচ করে কীটনাশক স্প্রে করেছেন ১ বিঘা জমির অবশিষ্ট ২৫ ভাগ আমের জন্য। এ নিয়ে মুকুল আসার পর থেকে তার খরচ প্রায় ২০ হাজার টাকা। তার ১ বিঘার এ বাগানে ৮০ ভাগ মুকুল এলেও বৃষ্টি ও ভোরের ঠান্ডা আবহাওয়ায় সব শেষ। এখন চলছে প্রচণ্ড খরা। আমের গুটি টেকাতে দিতে হবে সেচ। তাতে বাড়বে খরচ। কিন্তু টাকা কোথায়। বাগানের এ ২৫ ভাগ আমই এখন তার গলার কাঁটা।
এনিয়ে আক্ষেপ করছেন মজিবুর। শুধু মজিবুর একা নন। এ অবস্থা পুরো চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার আমচাষিদের।
আমের রাজধানী চাঁপাইনবাবগঞ্জে এ বছর গাছে মুকুল এসেছিল প্রায় ৬০ ভাগ। সেই অল্প মুকুল নিয়েও চাষিদের মনে জ্বলছিল আশার আলো। কিন্তু সম্প্রতি চৈত্রের বৃষ্টিতে ঝরে গেছে এসব আমের মুকুল। ফলে পর্যাপ্ত গুটি আসেনি গাছে। তবে মুকুলের পরিবর্তে এসেছে গাছে গাছে কচিপাতা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত বছরের তুলনায় এবার অর্ধেকে নামতে পারে এ জেলার আম উৎপাদন। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে জেলার অর্থনীতি। ক্ষীণ হবে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের হিসাব।
চলতি বছর জেলায় মোট ৪ লাখ ৫০ হাজার মেট্রিক টন আম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে কৃষি বিভাগ। যা গত বছরের তুলনায় ২৫ হাজার মেট্রিক টন বেশি।
তবে মাঠ পর্যায়ের চিত্র একেবারে ভিন্ন। চাষিরা বলছেন, গত বছরের তুলনায় এবার অর্ধেকে নেমে আসবে আম উৎপাদন। কারণ এবার ৬০-৬৫ শতাংশ গাছেই আমের গুটি নেই।
শিবগঞ্জের শাহবাজপুর এলাকার ইসরাইল হোসেন বলেন, আমরা পারিবারিকভাবেই আম ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। আমার দাদা-বাবা সবাই আম ব্যবসা করেছেন। এরই ধারাবাহিকতায় আমিও এ কাজ করে যাচ্ছি ১৫ বছর ধরে। কিন্তু গত ৪-৫ বছর ধরে লোকসান গুণতে গুণতে পুঁজি প্রায় শেষ। গত বছর প্রচুর মুকুল আসায় আমও হয়েছিল ভালো। কিন্তু তেমন দাম পাইনি। আর এবার গাছে মুকুল অনেক কম। তারপরও কয়েকদিন আগে প্রচুর বৃষ্টি হয়েছে। আমের সব মুকুল ও গুটি পচে গেছে।
শিবগঞ্জের ইসরাইল মোড়ের বাসিন্দা আব্দুল বাতেন বলেন, আমার এ বছর প্রায় ২ বিঘা জমিতে বিভিন্ন জাতের আম বাগান রয়েছে। ৮০ ভাগ গাছে মুকুল এসেছিল। ফলন সে অনুপাতে হলে এবং আমের দাম মোটামুটি থাকলে প্রায় ৩ লাখ টাকা লাভ হতো। কিন্তু এখন বাগানে ৩০ ভাগ আম আছে। বাকি সব মুকুল ঝরে গেছে এবং কচিপাতা বের হয়েছে ৪০ ভাগ গাছে। ফলে পরিচর্যা খরচ তোলাই দায়। তার ওপর চলছে তীব্র তাপপ্রবাহ।
সদর উপজেলার আমচাষি ইসারুল ইসলাম বলেন, আমার সংসার চলে আমের টাকায়। কিন্তু এবার আমার গাছে আম নেই। বৃষ্টিতে সব নষ্ট হয়ে গেছে। ঈদের পর হাসিমুখে থাকতে চেয়েছিলাম। বাগান দেখতে এসে মনটা খারাপ হয়ে গেল। তাপপ্রবাহে বাগানে কীভাবে সেচ দেব আর বালাইনাশকের টাকা কোথায় পাব, সেই চিন্তায় আছি।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ ম্যাংগো ফাউন্ডেশনের সদস্য সচিব আহসান হাবিব বলেন, জেলায় সব চেয়ে বেশি আম উৎপাদন হয় শিবগঞ্জে। কিন্তু এবার শিবগঞ্জে আমের অবস্থা খুবই খারাপ। আমাদের চাষিদের আম বিক্রি করে কীটনাশক খরচ উঠবে কিনা, তা নিয়ে সন্দেহ আছে।
তিনি আরও বলেন, এবার আম বাগানে রোগ-বালাইও বেশি। এ রোগ-বালাইয়ের কারণে আমের গুটি ঝরে যাচ্ছে।
শিবগঞ্জ ম্যাংগো প্রোডিউসার কো-অপারেটিভ সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক ইসমাইল হোসেন শামীম খান বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে এ বছর শীতের প্রকোপ অনেক বেশি ছিল। মূলত এ কারণেই বাগানে মুকুল কম। আর বৃষ্টিতে আমের মুকুলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এজন্য আমাদের উপজেলায় প্রায় গাছেই আম নেই। আশা করছি, জেলায় ৪০ শতাংশ গাছে আম থাকবে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক পলাশ সরকার বলেন, যেহেতু গত বছর আম গাছে প্রচুর মুকুল ছিল, তাই এ বছরকে অফ সিজন বলা যায়। তবে শীতের প্রকোপে, কয়েকদিন আগে ঘন কুয়াশা এবং অসময়ের অতিরিক্ত বৃষ্টির কারণে ফলন বিপর্যয় কিছু হবে। বিশেষ করে বড় গাছে আমের ফলন একেবারেই কমে যাবে।
তিনি আরও বলেন, আবার এখন যে খরা চলছে, তাতে এখনই গাছের গোড়ায় সেচের মাধ্যমে পানি সরবরাহ বাড়াতে হবে। সামনে আরও প্রাকৃতিক দুর্যোগ আছে। যেমন কালবৈশাখী ঝড়, শিলাবৃষ্টি। এমনটা হলে আমের উৎপাদন আরও কমে যাবে। সব মিলিয়ে বলা যায়, আমরা যে আম উৎপাদনের আশা করেছিলাম, তা এবার নাও হতে পারে।
বাংলাদেশ সময়: ১৪১১ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৩, ২০২৪
এসআই