ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

কৃষি

সাত ধরনের আঙুর চাষ করে তাক লাগিয়ে দিলেন নাটোরের আমজাদ

মো. মামুনুর রশীদ, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১২৫ ঘণ্টা, নভেম্বর ২০, ২০২৪
সাত ধরনের আঙুর চাষ করে তাক লাগিয়ে দিলেন নাটোরের আমজাদ

নাটোর: সাদা রংয়ের পলিনেট হাউসের ভেতর মাচায় ঝুলে আছে থোকা থোকা মিষ্টি আঙুর। আর সবুজ পাতার মাঝে উঁকি দিচ্ছে কোথাও লাল, আবার কোথাও হলুদ-সবুজ রঙের মিশ্রণের আঙুর।

খেতে কোনোটা মিষ্টি আবার কোনোটা হালকা টক-মিষ্টি। এসব আঙুর দেখতে যেমন সুন্দর, খেতেও বেশ মজার।  

আর আঙুরের এ বাগান দেখলে যে কারোরই মনে হবে এটা বুঝি বিদেশের কোনো বাগান। আগে মানুষের ধারণা ছিল, আঙুর একটি বিদেশি ফল, এ দেশে চাষ করলে হয় টক। কিন্তু সেই ধারণা পাল্টে দিয়ে মিষ্টি আঙুর চাষ করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন নাটোরের বাগরোম গ্রামের তরুণ কৃষি উদ্যোক্তা আমজাদ হোসেন।

শহরতলির কান্দিভিটা এলাকায় দেড় বিঘা জমিতে বাণিজ্যিকভাবে রাশিয়ান বাইকুনুরসহ সাতটি জাতের আঙুর চাষ করে সফল হয়েছেন তিনি। তার বাগানে গেলেই দেখা মিলবে মাচায় ঝুলে আছে থোকা থোকা টসটসে আঙুর। প্রতিদিন দেখতে অনেকেই তার বাগান দেখতে আসেন, অনেকে আসেন কিনতে।

আমজাদ হোসেন দখিয়ে দিয়েছেন, মনোবল, উদ্যোগ ও প্রচেষ্টা থাকলে দেশের মাটিতে বিদেশি ফল চাষ করে স্থানীয় চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি আর্থিকভাবে লাভ করা সম্ভব। পাশাপাশি বিদেশ থেকে আমদানি নির্ভরতা কমিয়ে দেশেই আঙুর উৎপাদন করে বিদেশে রপ্তানি করার অপার সম্ভাবনা রয়েছে।  

কৃষি বিভাগ বলছেন, বাংলাদেশের আবহাওয়া উপযোগী ও উন্নতমানের এ জাতের আঙুর চাষে কোনো কীটনাশক ও রাসায়নিক সারের প্রয়োজন হয় না। কেবলমাত্র গোবর বা জৈব সার ও মাকড় মারার জন্য ভারমিটেক ব্যবহার করেই এ ফল চাষ করা যায়। তাই ফসলে জৈব-বালাইনাশক ব্যবহারের জন্য কৃষি উদ্যোক্তাদের আগ্রহ সৃষ্টি করানো হচ্ছে। পাশাপাশি বাণিজ্যিকভাবে আঙুর চাষে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে।  

কৃষি উদ্যোক্তা মো. আমজাদ হোসেন বাংলানিউজকে জানান, গেল দুই বছর আগে ইউটিউব দেখে রাশিয়া, ইউক্রেন, ইতালি ও অস্ট্রেলিয়া থেকে ৩৫ জাতের আঙুরের চারা সংগ্রহ করে পরীক্ষামূলকভাবে চাষ শুরু করেন তিনি। প্রথম বছরেই আঙুর চাষে সফলতা পেয়েছেন। তবে এর মধ্যে বাছাই করে সাতটি জাতের আঙুরের ফলন ভালো এবং স্বাদে মিষ্টি পেয়েছেন। এর মধ্যে রাশিয়ান বাইকুনুর জাতটি সবচেয়ে ভালো এবং ভালো ফলন হয়েছে। এ জাতটি  দেশের আবহাওয়া ও চাষের পরিবেশ উপযোগী বলে তিনি দাবি করেন।  

তিনি বলেন, প্রথমে প্রায় ৫০ শতাংশ নিজস্ব জমি ও লিজ নেওয়া ২৫ শতাংশ মিলিয়ে মোট ৭৫ শতাংশ জমিতে ৩৫ জাতের আঙুর চাষ করি। এরমধ্যে গবেষণা করে রাশিয়ান বাইকুনুর জাতসহ সাতটি জাতের আঙুরের ভালো ফলন ও ভালো স্বাদ হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত হই। এরপর পরীক্ষিত জাতগুলো দিয়ে ২৫ শতাংশ জমিতে পলিনেট হাউজের মাধ্যমে একটি মাতৃবাগান তৈরি করেছি। এ বাগানে মোট ১২০টি চারা রোপণ করা হয়েছে। চারা রোপনের তিন মাস পর ফল এসেছে।  

প্রায় ছয় মাস পর তিনি ফল বিক্রি শুরু করেছেন। তার মতে, রোপণ থেকে গাছের বয়স এক বছর হলে পরিপূর্ণভাবে আঙুর ফল বাজারজাত করা সম্ভব। এর মধ্যে তার এ আঙুর বাগানের প্রতিটি গাছে অফ-সিজনে আট থেকে ১০ কেজি করে ফল পাওয়া যাচ্ছে। সে হিসাবে ১২০টি গাছে অন্তত গড়ে এক হাজার ২০০ কেজি বা ৩০ মণ ফল পাওয়া যাবে। বাজার মূল্য গড়ে ৩০০ টাকা কেজি দরে হিসাব করলে যার আর্থিক মূল্য দাঁড়ায় তিন লাখ ৬০ হাজার টাকা।  

এছাড়া তার উৎপাদিত অনেক আঙুর বাজারে বিক্রি করেছেন এবং চাহিদা রয়েছে বেশ। কারণ খেতেও বেশ মিষ্টি।  

তিনি বলেন, সাধারণত মার্চ-এপ্রিল মাস আঙুর চাষের জন্য উপযুক্ত সময়। ওই সময়ে বাণিজ্যিকভাবে বেশি আঙুর বিক্রি করা হয়। আর এখন অফ-সিজন হলেও বর্তমানে পাইকারি ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা কেজি ধরে বাজারে আঙুর বিক্রি করছেন। বাজারে চাহিদা থাকায় আর পেছনে ফিরে তাকাতে হচ্ছে না।  

তার মতে, আঙুরের এ জাত নাটোরের মাটিতে চাষযোগ্য এবং বাণিজ্যিকভাবে চাষ করা সম্ভব।

তিনি বলেন, পলিনেট হাউসে ২৫ শতাংশ জমিতে আঙুর চাষ করতে গিয়ে গাছের চারা, মাচা, পরিচর্যাসহ সব মিলিয়ে খরচ পড়েছে এক লাখ ২০ হাজার টাকা। আঙুর বাগানে যে পরিমাণ ফল এসেছে এবং বর্তমান যা বাজার মূল্য, তাতে আনুমানিক তিন থেকে চার লাখ টাকায় বিক্রি করা সম্ভব। আর পলিনেট হাউস তৈরি করতে প্রায় ৩০ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। তবে এ অর্থ কৃষি বিভাগের মাধ্যমে সরকারিভাবে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।  

এছাড়া খোলা জায়গায় আরও ৭৫ শতাংশ জমিতে আঙুর চাষ করেছেন তিনি। আবার তাপ নিয়ন্ত্রণ করা যায় পলিনেট হাউজে। চাষ প্রক্রিয়ায় গোবর সার ও মাকড় মারার জন্য ভারমিটেক ব্যবহার করেছি। আর পলিনেট হাউসে আঙুর চাষ করায় রোগবালাই অনেক কম। গাছে পোকার কোনো আক্রমণ হয়নি। কীটনাশক ব্যবহারের কোনো প্রয়োজন নেই। এজন্য এ ফলটি নিরাপদও বটে।  

আমজাদ হোসেন বলেন, লেখাপড়ায় বেশি দূর এগোতে পারিনি। তাই নিজ এলাকার একটি বাজারে ইলেকট্রনিক্স পণ্যের ব্যবসার পাশাপাশি কৃষি কাজও করি। এরই মধ্যে ইউটিউব দেখে আঙুর চাষ সম্পর্কে ধারণা নিই। এরপর ইউটিউব দেখে চাষ প্রক্রিয়া, জাত উদ্ভাবন, চারা সংগ্রহ শুরু করি। এরপর শখের বসে নিজ জমিতে পরীক্ষামূলকভাবে আঙুর চাষ করে সফল হয়েছি।  

আঙুরের পাশাপাশি তিনি চারা করেও বাজারজাত করছেন। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে কৃষি উদ্যোক্তারা এসে তার কাছ থেকে চারা নিয়ে যাচ্ছেন। এতে ব্যাপক সাড়া পড়েছে। তার আঙুর বাগান দেখতে স্থানীয়সহ বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মানুষ এসে ভিড় করছেন। বিভিন্ন ইউটিউব চ্যানেল থেকেও লোকজন আসছেন তার বাগানে। বাগানে আগত লোকজনকে তিনি বিনামূল্যে তার উৎপাদিত আঙুর খাইয়ে দেন।  

তিনি বলেন, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে বাংলাদেশের মাটিতেই বিদেশি এ ফল বাণিজ্যিকভাবে চাষ করা সম্ভব হবে। তা সম্ভব হলে বিদেশ থেকে আঙুর আর আমদানি করতে হবে না। বরং দেশের চাহিদা মিটিয়ে অন্য দেশে রপ্তানি করা যাবে। এছাড়া খুবই খুশির সংবাদ, আঙুর এখন ১২ মাস পাওয়া যাবে। রাশিয়ান এ জাতগুলো ১২ মাস ফল দিচ্ছে। সিজনে প্রচুর ফল থাকে। বছরের অন্য সময় তুলনামূলক কম ফল ধরেছে। তবে তা সন্তোষজনক। গুণগত মান ঠিক আছে।  

সারা দেশে আঙুর চাষ পদ্ধতি ও জাত সর্ম্পকে ধারণা ছড়িয়ে দিতে কাজ করছেন তিনি।

এদিকে আমজাদের আঙুর বাগান দেখতে আসা দর্শনার্থীরা ফলের স্বাদ উপভোগ করে অভিভুত হচ্ছেন এবং অনেকেই চাষের উদ্বুদ্ধ হচ্ছেন। বগুড়া থেকে আসা আবু রায়হান জানান, আমজাদ হোসেনের আঙুর বাগানে থোকা থোকা ফল দেখে অবাক হয়েছেন তিনি। কেননা বাজার থেকে কেনা আঙুর আর এখানকার আঙুরের স্বাদ প্রায় একই। তাই আঙুর বাগান করার ইচ্ছে আছে তার। এখান থেকে চারা সংগ্রহ করে নিজেই একটি আঙুর বাগান করবেন।  

একই আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন কুড়িগ্রামের শফিকুল ইসলাম ও রাজশাহীর তানোর এলাকার মফিজুলসহ আরও অনেকে।  

কৃষি সংশ্লিষ্টা বলছেন, এটি বাণিজ্যিকভাবে সারা দেশে চাষ করা হলে স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রপ্তানি করা সম্ভব। সঠিক পৃষ্ঠপোষকতা পেলে বিদেশ থেকে আমদানি নির্ভরতা কমবে, দেশের অর্থনীতি শক্তিশালী হবে।  

নাটোর সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা নিলিমা জাহান বাংলানিউজকে বলেন, নাটোরে অনেক বিদেশি জাতের ফল বাণিজ্যিকভাবে চাষ হচ্ছে। আঙুর চাষের চেষ্টা অনেকেই করেছেন, কিন্তু সফল হননি। তবে আমজাদ হোসেনের বাগানে সঠিক জাত নিরূপণ হওয়ায় এবার আঙুরের ফলন ভালো হচ্ছে এবং খেতেও বেশ মিষ্টি।  

আঙুর চাষ আগামীতে সম্ভবনাময় ফসল হবে বলে মনে করছেন এ কৃষি কর্মকর্তা।

নাটোর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের পরিচালক কৃষিবিদ আব্দুল ওয়াদুদ বাংলানিউজকে জানান, পলিনেট হাউসের মধ্যে চাষ হওয়ায় পোকামাকড়ের আক্রমণ কম হয়। ফলে এ পদ্ধতিতে আঙুর চাষে আগ্রহী হচ্ছেন অনেকে। কৃষি বিভাগ থেকে সার ও বালাইনাশক দেওয়ার পাশাপাশি আঙুর চাষ সম্পর্কে ধারণা দিতে প্রয়োজনে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হবে। বাণিজ্যিকভাবে আঙুর চাষের সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। নাটোরের একজন কৃষি উদ্যোক্তা পরীক্ষামূলকভাবে রাশিয়ান জাতের চাষ করে সফল হয়েছেন। সারা দেশে এ ফল চাষ ছড়িয়ে দিতে কৃষি বিভাগ কাজ করবে।

বাংলাদেশ সময়: ১১১২ ঘণ্টা, নভেম্বর ২০, ২০২৪
এসআই


 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।