আর অর্থকরি এই ফসলের সম্মানে সোম ও শুক্রবার বসে পানের বিশেষ হাট। পুরো হাট জুড়েই থাকে শুধু পান আর পান।
সকাল ১০টার দিকে যখন বাজারে ঢুকছিলাম চক্ষুস্থির হয়ে আসছিলো, চারদিক থেকে পিঁপড়ার সারির মতো পান নিয়ে বাজারে প্রবেশ করছে চাষিরা। যেনো সেনাবাহিনীর কমান্ডো অপরেশন চলছে। কোন দিকে তাকাবার জো নেই, শুধুই সামনে চলতে হবে। প্রত্যেকের মাথায় বিশেষ কায়দায় গোছানো পানের পোয়া, দেখতে অনেকটাই টুকরির মতো, উপর নিচে কলাপাতা দেওয়া, বাইরে থেকে শুধু পানের বোটা দৃশ্যমান। পুরোটাই শিল্পীর কারুকার্যের মতো নান্দনিক।
১৯৯৫ সালে শুরু হয় পানের হাট। ছোট্ট পরিসরে শুরু হলেও মাত্র কয়েক বছরের মাথায় জমে ওঠে মচমইলের পান বাজার। এই হাট শুরু হওয়ার পুর্বে এই এলাকার সবচেয়ে বড় পানের হাট ছিল তাহেরপুর। কিন্তু সেখানে ইজারদারদের স্বেচ্ছাচারিতার কারণে মানুষ মুখ ফিরিয়ে নেয়। আর জমজমাট হতে থাকে মচমইল।
মচমইলকে রাজশাহী তথা বাংলাদেশের বৃহত্তম পানের হাট বলে দাবি করেছে স্থানীয়রা। অবশ্য ব্যবসায়ীরাও এর সঙ্গে একমত। নওগাঁ থেকে পান কিনতে আসা সাইফুল ইসলাম বলেন, এ অঞ্চলে নাটোরসহ আরো কয়েকটি পানের হাট রয়েছে। তবে মচমইল সবচেয়ে বড় বলতে হবে। এখানে যে পরিমাণ আমদানি হয় অন্য কোথাও এতো পানের আমদানি হয় না। সকাল থেকে শুরু হয়ে বিকেল নাগাদ বন্ধ হয়ে যায় বেচাকেনা।
প্রত্যেক হাটে বিশ থেকে তিরিশ ট্রাক পানের আমদানি হয়। এর সঙ্গে পিকআপ, অটো, সিএনজি চালিত অটো রিকশা তো থাকেই। পান নির্ভর এই হাটের চলতি মৌসুমে ইজারা উঠেছে ১ কোটি ১০ লাখ টাকায়। এতেও কিছুটা অনুমাণ করা যায় হাটের বিশালত্ব, দাবি করেন বিক্রেতা দবির উদ্দিন।
যোগানে যেমন সর্বোচ্চ, তেমনি ক্রেতা সমাগমেও এ হাটকে সেরার তালিকায় রাখেন ক্রেতা- বিক্রেতারা। তাদের দাবি, একমাত্র এই হাটেই সারাদেশের ক্রেতার দেখা মিলবে। আর অন্য কোথাও এমন সংমিশ্রন পাওয়া দুষ্কর। হাটটির ভেতরে গেলে দেখা হয় দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা পান ব্যবসায়ীদের সঙ্গে।
তারা কেউ ঢাকা থেকে, কেউ চট্টগ্রাম, নওগাঁ ও গাইবান্ধাসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে ট্রাক নিয়ে এসেছেন পান কেনার জন্য। একেকটি দলে মহাজনের ম্যানেজারের সঙ্গে বেশ কয়েকজন করে লোক। তারা এসে বাজার ঘুরে কিনছেন, আর ম্যানেজার শুধু কাগজে লিখে টাকা পরিশোধ করছেন। শুধু ম্যানেজার নন, ছোট মালিকরাও কয়েকজন মিলে ট্রাক ভাড়া করে হাজির হয়েছেন পান কেনার জন্য।
শুক্রবার (১১ আগস্ট) পানির দরে বিক্রি হতে দেখা গেছে পান। এই হাটে পানের হিসাব হচ্ছে ৬৪ পানে এক বিড়া। আর ৩২ বিড়া’য় এক পোয়া। এক পোয়া পান সর্বনিম্ন ৫০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ১২’শ টাকা দরে বেচাকেনা হতে দেখা গেলো। যাকে স্থানীয়রা পানির দাম বলে আক্ষেপ করলেন।
বাগমারার মনিপুর গ্রামের বাসিন্দা আনিস মিয়ার সঙ্গে দেখা হয় পান হাটে। তিনিও পান বিক্রি করতে এসেছেন। এবার পনেরো কাঠা জমিতে পান চাষ করেছেন। তিনি জানান, মাত্র ৬৫ টাকা পোয়া দরে পান বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছেন। অথচ পান চাষের খরচ তোলা দূরের কথা, কামলা দিয়ে তুলে নেওয়ার খরচই উঠছে না।
কেউ যদি কামলা দিয়ে ছোট পান তোলেন তাকে বাড়ি থেকে টাকা এনে কামলার মজুরি পরিশোধ করতে হবে। তিনি বলেন, একজন কামলা (ভোর ৫টা থেকে সকাল ১১টা) ৬ ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ৮০ বিড়া পান তুলে গুছিয়ে দিতে পারে। আজকের বাজারে যার দাম দেড়’শ’ টাকা। আর কামলার মজুরি হচ্ছে দু’শ’ টাকা। তাকে দিয়ে যদি বাজারে পাঠাতে হয় তাহলে আরো দিতে হয় ১’শ’ টাকা। যে কারণে অনেকেই পান তোলাই বন্ধ করে দিয়েছে।
যাদের পানের লতা উপরে উঠে যাচ্ছে তারা পানসহ মাটিতে পুঁতে ফেলছে। পানের গাছ শিমের গাছের মতো লতানো। নিচের বড় পোক্ত পাতাগুলো তুলে নেওয়া হয়। আর গাছ বড় হতে থাকে। তবে সেডের বাইরে যেতে দেওয়া হয় না। যে কারণে লতার মাথা যখন সেড ছুঁই ছুঁই করে তখন নিচের দিকে থেকে মাটিতে পুঁতে দিতে হয়। এভাবেই সারা বছর ধরে চলে পান সংগ্রহ।
হাটটির সামান্য একটি অংশে ছোট ছোট সেড। আর পুরোটা জুড়ে ফাঁকা মাঠ, সেই মাঠে ইটের শুড়কি ফেলানো। সকাল থেকেই হচ্ছিল বৃষ্টি, ক্রেতাদের পদভারে কাদা জমে যায় অনেক জায়গায়। এর মধ্যেই চলে হরদম বিকিকিনি। কারোরই যেনো দম ফেলবার ফুসরত নেই।
সোম ও শুক্রবার পানের হাট ছাড়াও রোববার গরুর হাট আর বুধবার ধান-চালের হাট বসে মচমইলে। জমে ওঠে বিশাল বাণিজ্য।
বাংলাদেশ সময়: ১১১৫ ঘণ্টা, আগস্ট ১২, ২০১৭
এসআই/জেডএম