কিন্তু এসব সিনথেটিক অ্যান্টিবায়োটিক প্রাণিদেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা মারাত্মকভাবে হ্রাস করে। পশুখাদ্যে “প্লানটেইন ঘাস” ব্যবহার করে অ্যান্টিবায়োটিকের এই ক্ষতিকর প্রভাবের হাত থেকে গবাদি পশুকে রক্ষা ও মাংস উৎপাদন বৃদ্ধিতে সফলতা পেয়েছেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) পশুপুষ্টি বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আল-মামুন।
পশুখাদ্যে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের কারণে উৎপাদিত পশুপণ্য অর্থাৎ ডিম, দুধ ও মাংসের মধ্যেও তা ছড়িয়ে পড়ে। আর এসব খাবার গ্রহণের ফলে মানুষের শরীরেও ব্যবহার পরবর্তী (রেসিডিউয়াল) ক্ষতিকারক প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। এতে মানবদেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস, হৃদরোগ জনিত সমস্যা, ডায়াবেটিস, অটিজমসহ বিভিন্ন ভয়াবহ রোগ দেখা দেয়।
গ্রোথ প্রোমোটার ব্যবহারের ক্ষতিকর দিক অনুধাবন করে ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ উন্নত বিশ্বে ২০০৬ সালের ১ জানুয়ারি থেকে পশুখাদ্যে অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার বন্ধ করে দেয়া হয়। এরপর থেকেই বিজ্ঞানীরা গ্রোথ প্রোমোটারের বিকল্প পশুখাদ্য খুঁজতে থাকেন।
গবেষণায় দেখা যায়, ঔষধি উদ্ভিদ অ্যান্টিবায়োটিকের বিকল্প পশুখাদ্য হতে পারে। এরকমই একটি বহুবর্ষজীবী ঘাস জাতীয় ঔষধি উদ্ভিদ হলো প্লানটেইন (Plantago lnceolata L.)। যা কোনো ধরনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ছাড়াই পশুর শরীরে অ্যান্টিবায়োটিক গ্রোথ প্রোমোটার কিংবা তার চেয়ে বেশি হারে বর্ধিত করবে।
পশুখাদ্যে ঘাসটির ব্যবহারের উপকারিতা সম্পর্কে ড. মোহাম্মদ আল-মামুন বলেন, রোমন্থক প্রাণী যেমন গরু, ভেড়া ইত্যাদিকে স্বাভাবিক খাবারের সঙ্গে খুব সামান্য পরিমাণে (পোল্ট্রিতে ১%, ভেড়ায় ৪%, গরুতে ৫-১০%) প্লানটেইন ঘাস ও এর পাউডার মিশিয়ে খাওয়ালে প্রাণীর উচ্চ তাপমাত্রার পীড়ন (হিট স্ট্রেস) কমিয়ে প্রোটিন সংশ্লেষণ বাড়িয়ে দেয়। উচ্চ এন্টিঅক্সিডেন্ট ক্ষমতা সম্পন্ন হওয়ায় মাংসের উৎপাদন, স্বাদ ও রং বৃদ্ধি পায় এবং পচনরোধ করে। এটি হরমোনের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে দুগ্ধবতী ও গর্ভবতী প্রাণীর দুধের উৎপাদন ক্ষমতা বাড়ায় এবং সুস্থ-সবল বাচ্চা জন্ম দেয়। একইসঙ্গে ফ্যাটি এসিডের (ওমেগা-৬ এবং ওমেগা-৩) অনুপাত কমাতে সহায়তা করে। এতে মানুষের হার্ট ভালো থাকে। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ও আয়ুষ্কাল বাড়ায়। রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা কমায়। ক্যান্সার ও অটিজম প্রতিরোধ করে।
প্লানটেইন শীতপ্রধান অঞ্চলের ঘাস। কীভাবে ঘাসটি বাংলাদেশে উৎপাদন করে দেশের প্রাণীজ মাংসের উৎপাদন বৃদ্ধি করা যায় তা নিয়ে ভাবতে থাকেন ড. মোহাম্মদ আল-মামুন।
২০১১ সালে জাপান থেকে পিএইচডি ও পোস্টডক শেষে বাংলাদেশে ফিরে উদ্ভিদটি নিয়ে দেশীয় আবহাওয়ায় জন্মানোর চেষ্টা করে তিনি সফলতা পান। শীতপ্রধান অঞ্চলের উদ্ভিদ হওয়ায় তিনি শীতকালকে বেছে নেন তার গবেষণার উপযুক্ত সময় হিসেবে। এটি ৬০-২৪০ সেলসিয়াস তাপমাত্রা পর্যন্ত সহ্য করতে পারে। তবে ২০০ সেলসিয়াস তাপমাত্রায় সবচেয়ে বেশি ঔষধি গুণাগুণ থাকে। উৎপাদন ব্যয় কম হওয়ায় দেশের কৃষকরা এটি ব্যবহার করলে খুব কম খরচেই অধিক লাভবান হবেন বলে জানান তিনি।
দেশীয় আবহাওয়ায় ঘাসটির চাষাবাদ সম্পর্কে ড. আল-মামুন বলেন, নভেম্বরের শুরুতে বীজ ছিটিয়ে দিতে হবে। কোনো ধরনের বিশেষ যত্ন ছাড়াই এটি যে কোনো ধরনের মাটিতে জন্মাতে পারে। বীজ বপনের ৪৫-৫৫ দিন পর প্রথমবার কেটে নেয়া যায় এ ঘাস। এর পর প্রতি এক মাস পর পর কেটে নেয়া যাবে।
তার এ গবেষণাটি অ্যানিমাল জার্নালসহ বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। মেধাবী ও সুস্থ জাতির জন্য পশুখাদ্যে ঔষধি উদ্ভিদ ব্যবহার অত্যন্ত জরুরি। তাই প্রাণীর মোটাতাজাকরণ ও মাংস উৎপাদনের জন্য “অ্যানিমাল অ্যাক্ট” এর যথাযথ প্রয়োগ সুনিশ্চিত করার দাবি জানান তিনি।
এছাড়াও গ্রোথ প্রোমোটারের বিকল্প আবিষ্কার ও ব্যবহারে সরকার যেনো গবেষকদের সার্বিকভাবে সহযোগিতা করেন সে বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করেন তিনি।
বাংলাদেশ সময়: ১৫৪৭ ঘণ্টা, ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৭
আরএ