নাটোর: দীর্ঘস্থায়ী বন্যা ও পুকুর ভেসে যাওয়ার কারণে চলনবিল ও হালতিবিল অধ্যুষিত নাটোর জেলায় এবার লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে দ্বিগুণ মাছ উৎপাদন হয়েছে বলে দাবি করেছে মৎস্যবিভাগ। দেশীয় প্রজাতির বিভিন্ন মাছের সঙ্গে সঙ্গে রুই, কাতলা, সিলভার কার্পসহ অন্যান্য মাছের উৎপাদনও অনেকাংশে বেড়েছে।
সংশ্লিষ্টদের মতে লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে এবার অন্তত ১ লাখ ২০ হাজার মেট্রিক টন মাছ বেশি উৎপাদন হয়েছে। যার গড় মূল্য প্রায় ২০০ কোটি টাকার ওপরে। আর চলনবিল ও হালতিবিলে উৎপাদিত এসব দেশি মাছ স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে রাজধানী ঢাকা, রাজশাহী, বগুড়াসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় সরবরাহ করা হচ্ছে। এতে আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছেন অন্তত হাজার খানেক মৎস্যজীবীসহ মৎস্য কাজে জড়িতরা। নাটোর জেলা মৎস্য অফিস সূত্রে জানা যায়, চলতি মৌসুমে জেলায় পুকুর ও প্রাকৃতিকভাবে ৬৪ হাজার মেট্রিক টন মাছ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। সেখানে এ পর্যন্ত মোট উৎপাদন হয়েছে ৬২ হাজার ১৭০ মেট্রিক টন। এর মধ্যে পুকুরে উৎপাদন হয়েছে ৩৭ হাজার ৪৪২ মেট্রিক টন। খাল-বিল, বিভিন্ন জলাশয়ে এখনো বিপুল পরিমাণ মাছ মজুদ রয়েছে, যা এখনো সম্পূর্ণভাবে উত্তোলন হয়নি। ফলে এবার গতবারের তুলনায় দুইগুণ বেশি মাছ উৎপাদনের সম্ভাবনা রয়েছে।
ধারণা করা হচ্ছে, এবার মাছের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে ১ লাখ মেট্রিক টন থেকে ১ লাখ ২০ হাজার মেট্রিক উৎপাদন হবে। যা দেশীয় অর্থনীতিতে সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হবে।
সূত্র জানায়, গত মৌসুমে মাছ উৎপাদন হয়েছিল ৬৩ হাজার মেট্রিক টন। আর জেলায় মোট মাছের খাদ্য চাহিদা ৪২ হাজার ৩৭৬ মেট্রিক টন। সেখানে লক্ষ্যমাত্রা বিবেচনায় উদ্বৃত্ত মাছ উৎপাদন হচ্ছে ১৯ হাজার ৭৯৬ মেট্রিক টন। তবে এবার অনেকগুণ মাছ উদ্বৃত্ত থাকবে বলে আশা করা হচ্ছে।
মৎস্য বিভাগ জানিয়েছে, গত ১০ বছরে কাকিলা, কাজলী, রানী মাছ, নান্দিনা, ভেদা, গুতুম, বৈরানীসহ অন্তত ৬৪ প্রজাতির মাছ সংকটাপন্ন ছিল। ইতোমধ্যে উত্তোলন হয়েছে ৩০/৩২ প্রজাতির মাছ। এবার মাছ উৎপাদন বাড়াতে উন্মুক্ত জলাশয়ে রুই, কাতলা, মৃগেল জাতীয় প্রায় ২ হাজার ৫০০ কেজি পোনা অবমুক্ত করা হয়। বাগাতিপাড়া উপজেলা ছাড়া ৬টি উপজেলায় বিল নার্সারি কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। জেলার সিংড়া, গুরুদাসপুর ও নলডাঙ্গা উপজেলা মিলে অন্তত ১৮টি অভয়াশ্রম রয়েছে। যেখান থেকে দেশীয় মাছের বংশ বিস্তার হচ্ছে এবং মাছের উৎপাদন বৃদ্ধিতে সহায়তা হচ্ছে।
নলডাঙ্গা উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা সঞ্জয় কুমার সরকার বাংলানিউজকে জানান, এবার তিন দফার বন্যার কারণে অধিকাংশ পুকুরের মাছ ভেসে গেছে। ফলে চাষের মাছ উৎপাদন কম হওয়ায় প্রকৃতিগত মাছের উৎপাদন অনেক বেড়েছে। আর পুকুর মালিকরা ক্ষতি পুষিয়ে নিতে চাষকৃত মাছের ভাল দাম পাওয়ার আশায় এ সময়ে কেউ মাছ উত্তোলন করছেন না। তাছাড়া বর্তমান বাজারে দেশীয় মাছের আমদানি বেশি এবং চাহিদা বেশি থাকার কারণে পুকুরের মাছের দাম তুলনামূলক একটু কম। তাই মৎস্য চাষিরা পুকুর থেকে মাছ উত্তোলন বন্ধ রখেছেন। আবার অনেকে ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে মাছ উত্তোলন করে বিক্রিও করে দিয়েছেন। কারণ ডিসেম্বরের শেষ দিকে খাল, বিল, নদী, ডোবা থেকে দেশীয় মাছ উত্তোলন হবে এবং আমদানি বাড়বে।
তিনি বলেন, সরকারি হিসাব অনুযায়ী তার উপজেলার খাল, বিল, নদী-নালায় এ পর্যন্ত প্রায় ১৩০ মেট্রিক টন মাছ উৎপাদন হয়েছে। উৎপাদনের পরিমাণ আরো বাড়বে বলে আশা প্রকাশ করছেন তিনি।
সিংড়া উপজেলার সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা ওয়ালী উল্লাহ একই কথা ব্যক্ত করে বাংলানিউজকে জানান, এবার দেশীয় প্রজাতির মাছের উৎপাদন বেড়েছে। বিভিন্ন হাট-বাজার কিংবা আড়তগুলোতে লক্ষ্য করলেই দেখা যাবে বিলুপ্ত প্রায় অনেক মাছের এখন দেখা মিলছে। এসব মাছের দাম বেশি এবং চাহিদাও অনেক। বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পর খাল, ডোবা, বিলের ভেতর ছোট ছোট পুকুর কিংবা জলাশয় শুকিয়ে এসব মাছ ধরছেন মৎসজীবী ও পুকুর মালিকরা। মাছের ভাল দাম পাওয়ায় আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছেন তারা।
তিনি বলেন, চলনবিলের আনাচে কানাচে ছোট বড় প্রায় শতাধিত স্থানে মাছের আড়ৎ গড়ে উঠেছে। এসব আড়ৎ থেকে প্রতিদিন শতশত টন মাছ দেশের বিভিন্ন স্থানে যাচ্ছে।
নাটোর জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. জাহাঙ্গীর আলম বাংলানিউজকে জানান, এবারের তিন দফার বন্যার কারণে ৩ হাজার ৩১১ জন মালিকের ৪ হাজার ২৮৩টি পুকুর ভেসে গেছে। এতে প্রায় ২ হাজার ৮০০ মেট্রিক টন রুই, কাতলা, সিং, মাগুর, পাঙ্গাস, গুলশা ও তেলাপিয়া জাতীয় মাছ বন্যার পানিতে ভেসে গেছে। যার আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৩২ কোটি টাকা। তিনি বলেন, বন্যার কারণে পুকুরে মাছের উৎপাদন কমে গেছে। তবে প্রকৃতিগতভাবে খাল-বিলে মাছের উৎপাদন দেড়গুণ বেড়েছে। করোনার সময়ে মানুষের ক্রয় ক্ষমতা কমে গিয়েছিল। এজন্য মাছের দাম ছিল নিম্নমুখী।
এদিকে বর্তমানে বাজারগুলোতে দেশি প্রজাতির বিপুল পরিমাণ মাছের আমদানি হলেও দাম একটু বেশি। তবে পুকুরে উৎপাদিত মাছের আমদানি অনেকাংশে কমে গেছে। বন্যার পানি নেমে যাওয়ায় চলনবিল ও হালতিবিলে মাঝে বিভিন্ন জলাশয়, খালের পানি সেচে মাছ ধরে আড়ত কিংবা বাজারে নিয়ে আসছেন ফড়িয়া মাছ ব্যবসায়ীরা।
সরেজমিনে সপ্তাহ ধরে নলডাঙ্গা, সিংড়া ও গুরুদাসপুর এলাকার বিভিন্ন বাজার ও আড়তগুলো ঘুরে দেখা যায়, স্থান ভেদে বোয়াল মাছ বড় ৬০০-৭০০ টাকা কেজি এবং ছোট থেকে মাঝারি সাইজ ৪০০ থেকে ৪৫০ টাকা কেজি, কৈ মাছ ২৫০ টাকা থেক শুরু করে সর্বোচ্চ ৪০০ টাকা থেকে ৫০০ টাকা, শোল ২৩০ থেকে শুরু করে ৩০০ টাকা কেজি, টেংরা ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা কেজি দর, সিং ২৮০ টাকা থেকে ৩৫০ টাকা, গোচি ৫০০ টাকা থেকে ৭০০ টাকা কেজি, দেশি পাবদা ৪০০ টাকা থেকে ৪৫০ টাকা, আইড় মাছ বড় সাইজ ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা এবং ছোট সাইজ ৩৫০ টাকা থেকে ৪০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে পাইকারি বাজারে।
এছাড়া বাইম মাছ বড়গুলো ৮০০ টাকা থেকে ৯০০ টাকা এবং ছোট সাইজ ৬০০ টাকা থেকে ৬৫০ টাকা, টাকি মাছ ১০০ টাকা থেকে ১৫০ টাকা, চিংড়ি ১৫০ টাকা থেকে ২০০ টাকা, দেশি মাগুর ৩২০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৫০০ টাকা, চেলার মাছ ২৫০ টাকা থেকে ৩০০ টাকা, কালবাউস ১৮০ থেকে ২০০ টাকা, সরপুঁটি ১০০ থেকে ১২০ টাকা, পুঁটি ১২০ টাকা, রুই ১৫০ থেকে ১৬০ টাকা, কাতলা ১৫০ থেকে ১৯০ টাকা, চান্দা ১০০ টাকা থেকে ১৫০ টাকা, সিলভার কার্প বড় ১৫০ টাকা, ছোটগুলো ১০০ টাকা থেকে ১১০ টাকা দরে পাইকারি বিক্রি হচ্ছে। তবে স্থান ও সময় ভেদে মাছের বাজার কিছুটা হেরফের হয়ে থাকে। আর খচুরা বাজারে এসব মাছ প্রতি কেজিতে ৪০ টাকা থেকে ৫০ টাকা বেশি দরে বিক্রি হচ্ছে।
নলডাঙ্গা বাজারের মাছের আড়তদার মুক্তার হোসেন ও আকতার হোসেন বাংলানিউজকে জানান, মাছের আমদানি ও ক্রেতাদের আগমনের ওপর ভিত্তি করে মাছের বাজার ওঠানামা করে। প্রতিদিন তাদের আড়ত থেকে অন্তত দুইশ মণ করে মাছ বিক্রি হয়। একই কথা জানালেন হালতিবিল সংলগ্ন মাধনগর, ত্রিমোহনী, চলনবিলের সিংড়া ও গুরুদাসপুরের চাঁচকৈর বাজারে গড়ে ওঠা মাছের আড়তদার ও ব্যবসায়ীরা।
সিংড়ার মাছের আড়তদার আব্দুস সালাম জানান, এসব আড়ত থেকে প্রতিদিন শতশত মণ দেশি মাছ বেশির ভাগ ঢাকা, বগুড়া, রাজশাহী, নাটোর শহরসহ বিভিন্ন স্থানে নিয়ে যান মাছ ব্যবসায়ীরা। অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার মাছের উৎপাদনও অনেক বেশি হয়েছে। এজন্য চলনবিল ও হালতিবিলের চারিধারে গড়ে ওঠা আড়তগুলোতে এখন চলছে বিশাল মৎস্য কর্মযজ্ঞ।
বাংলাদেশ সময়: ০৯১৭ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩০, ২০২০
আরএ