ঢাকা, শুক্রবার, ৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

কৃষি

গাছে গাছে লিচুর সোনালি মুকুল

টিপু সুলতান, উপজেলা করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০৪৭ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ৮, ২০২১
গাছে গাছে লিচুর সোনালি মুকুল গাছে গাছে লিচুর সোনালি মুকুল। ছবি: বাংলানিউজ

পাবনা (ঈশ্বরদী): গাছে গাছে কচি পাতার মুখে থোকায় থোকায় আসতে শুরু করেছে লিচুর সোনালি মুকুল। ফাল্গুন মাস আসতে কয়েকদিন বাকি।

মাঘের শেষে সোনারঙা নাক ফুলের মতো মুকুলগুলো সুবাতাস ছড়িয়ে দিচ্ছে বাতাসে।  

লিচু উৎপাদনের গ্রামগুলোর মধ্যে উত্তর-দক্ষিণাঞ্চলের প্রবেশদ্বার পাবনার ঈশ্বরদীর উপজেলার অর্ধশতাধিক গ্রামের নাম মানুষের কাছে এখন বেশ সমাদার পেয়েছে। ‘লিচুতে সেরা ঈশ্বরদী’ যথেষ্ট পরিচিতি লাভ করেই ক্রমান্বয়ে যেন লিচু বাগানের পরিধি বাড়ছেই।  

মাঘ মাসের শেষে গাছে মুকুল আসতে শুরু করেছে। ফাল্গুনের শেষে বাগানগুলোতে লিচুর মুকুল থেকে কুঁড়ি আসা শুরু হবে। আর চৈত্রের শুরুতে কুঁড়ি থেকে ফুটবে গুটি লিচু। সবুজ গুটি থেকে থোকা থোকা বৈশাখের শেষে টকটকে লাল রঙে রাঙাবে গ্রাম। লিচুর রাজ্যে পরিণত হবে পাবনার ঈশ্বরদীর অর্ধশত গ্রাম।

ঈশ্বরদী উপজেলার মাটির গুণাগুণ উর্বর হওয়ায় কারণে এই অঞ্চলের লিচুর আটি ছোট হয় মাংস বেশি আর রসালো হয় ঈশ্বরদীর লিচু। ঈশ্বরদীতে ৩ হাজার ৩১৫ হেক্টর জমিতে ভিত্তিতে লিচু চাষ হচ্ছে।

সরেজমিনে পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলার বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে দেখা গেছে, গাছে গাছে মুকুল আসতে শুরু হয়েছে। আর বাগান পরিচর্চায় ব্যস্ত সময় পার করছেন লিচু চাষিরা। লিচু বাগানে পাখিদের আনা-গোনা, নয়নাভিরাম দৃশ্যে মুগ্ধ এই অঞ্চলের পথচারী ও এলাকাবাসী।

লিচু চাষিরা বাংলানিউজকে জানান, চলতি মৌসুমে অধিকাংশ গাছেই মুকুল আসবে। যদি আবহাওয়া অনুকূলে থাকে, তাহলে এবার লিচুর বাম্পার ফলন হবে। আর আগামী কয়েক দিনের মধ্যে ফুলে ফুলে ছড়িয়ে পড়বে বিভিন্ন এলাকা। মুকুল এসে যেন ঝরে না পড়ে, তাই জন্য এখন থেকেই বাগানের দিকে নজর রাখছেন বাগান চাষিরা।  

ঈশ্বরদী উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, ঈশ্বরদী পৌরসভা ও সাতটি ইউনিয়নর  বিভিন্ন গ্রামে ৩ হাজার ১৫০ হেক্টর জমিতে লিচু গাছ রয়েছে ২ লাখ ৮৩ হাজার ৫০০টি। বিঘা প্রতি ২০টি থেকে ১৫টি গাছ অর্থাৎ ১ একর জমিতে ৪২টি, ১ হেক্টর জমিতে ৯০টি গাছ হয়।  

লিচু আবাদী কৃষকের সংখ্যা ৯ হাজার ৬২০ বাণিজ্যিক আকারে বাগান ২ হাজার ৬০০ হেক্টর জমিতে। বিচ্ছিন্নভাবে বসতবাড়িতে আবাদ রয়েছে ৫৫০ হেক্টর। ফলন্ত আবাদি জমির পরিমাণ ২ হাজার ৮৩৫ হেক্টর জমি। লিচু উৎপাদন জমির পরিমাণ ২ হাজার ৮৩৫ হেক্টর। অফলন গাছ রয়েছে ৫৫ হাজার ৫৫০টি। ঈশ্বরদীতে সাধারণত দুই প্রজাতির লিচুর ফলন বেশি হয়। মোজাফ্ফর বা দেশি এবং বোম্বাই লিচু। বিভিন্ন বাগানে চায়না-৩, কদমী, বেদানা লিচুর চাষও হচ্ছে। দেশি বা মোজাফ্ফর লিচু পরিপক্ক হয়ে সবার আগে বাজারে আসে। তবে ব্যবসায়ীরা বোম্বাই ও চায়না-৩ লিচু বেশি দামে বাজারে বিক্রি করে থাকেন। আবার বোম্বাই লিচু আকারে বেশ বড় হয়ে থাকে এবং খেতে বেশ সুমিষ্ট। আর চায়না লিচু আকারে দেশি লিচুর মত হলেও খেতে খুবই সুস্বাদু হয় এবং আঁটি ছোট হয় বলে দেশ-বিদেশে বেশ সুনাম রয়েছে।

উপজেলার সলিমপুর ইউনিয়নের নওদাপাড়া গ্রামের তরুণ কৃষক ইয়ারুল হক খোকন বাংলানিউজকে বলেন, আমার ৩০ বিঘা জমিতে লিচু গাছের পরিচর্যা করা হচ্ছে। যদি আবহাওয়া অনুকূলে থাকে আর প্রাকৃতিক কোনো দুর্যোগ না হয়, তবে ১৫ লাখ লিচু উৎপাদন হবে বলে আশা করছি।  

সলিমপুর ইউনিয়ের চরমিরকামারী গ্রামের তরুণ কৃষক মুনসুর মালিথা বাংলানিউজকে বলেন, বাগান কয়েক ধাপে বিক্রি হয়। গাছে মুকুল আসার আগেই এবং লিচু গুটি হওয়ার পরে বাগান বিক্রি হয়। লিচু পাকার আগেই বেশ কয়েকবার পরিবর্তন হয় বাগানের মালিকানা। তবে অনেক বাগান মালিকরা লাভের আশায় নিজেই শ্রম দেন। অনেক সময় খরার কারণে লিচুর আকার ছোট হয়ে যায়। আবার অনেক সময় বৈশাখী কালবৈশাখী ঝড়ে সব লণ্ডভণ্ড হয় লিচু বাগান। তখন ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হয় লিচু চাষি ও ব্যবসায়ীরা।  

মুনসুর আরও বলেন, গাছে মুকুল আসা শুরু হয়েছে। বাগানে কীটপতঙ্গ, মাকড়সা দূর করার জন্য বালাইনাশক স্প্রে করা হয়েছে।

ঈশ্বরদীর পাকশী ইউনিয়নের রূপপুর গ্রামের লিচু চাষি পলাশ আহম্মেদ বাংলানিউজকে বলেন, প্রায় ১০ বিঘা জমিতে আমার লিচু বাগান রয়েছে। অনাবৃষ্টি আর খরার কারণে মুকুল এসে ঝরে পড়ে। আবার ধূলিঝড় আর বৃষ্টির কারণে কিছু মুকুল ঝরে যায়। এবার ঠিক সময়ে লিচুর মুকুল এসেছে। মুকুল আসার পর পরই বেশ বৃষ্টি হওয়াতে কুঁড়ি সতেজ হয়েছে। গাছে ভিটামিনও কম স্প্রে করতে হচ্ছে।

সৌখিন লিচু চাষি শরিফুল আলম দিপু মণ্ডল বাংলানিউজকে বলেন, ২০ বছর আগে থেকে  এই এলাকায় বাণিজ্যিক ভিত্তিতে লিচু চাষ শুরু হয়। প্রথম দিকে মিশ্র বাগান হিসাবে অর্থাৎ কলা বাগানে, হলুদ ক্ষেতে লিচু চাষ হয়। লিচু বড় হয়ে গেলে অন্য সব গাছ কেটে ফেলা হয়। লিচু বাগান শুরুর দিকে গাছ ছোট থাকা অবস্থায় কয়েক বছর সাথী ফসলের চাষ করা যায়। এখন অনেকেই শুধু লিচুর চাষ করে লাভবান  হচ্ছে। তাই শখ করে কয়েক বন্ধু মিলে লিচুর বাগান করেছি।  
 
লিচু চাষিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চলতি মৌসুমে গাছে গাছে আসতে শুরু হয়েছে মুকুল। মাঘ মাসের শেষে বৃষ্টি হলে গাছের কুঁড়ি এবং পাতা আরও সতেজ হয়। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে লিচুর বাম্পার ফলন হয়। আগামী কয়েক দিনের মধ্যে লিচু গাছে ফুলে ফুলে ছেয়ে যাবে। তাই গুটি যেন ঝরে না যায়, সেদিকে নজর রাখছেন বাগান চাষিরা। গুটি ঝরা রোধকল্পে অনেকে বাগানে সেচ দিচ্ছেন।  
 
ঈশ্বরদী উপজেলার কৃষি কর্মকর্তা আব্দুল লতিফ বাংলানিউজকে বলেন, চলতি বছরে ঈশ্বরদীতে ২৩ হাজার ৩৪২ বিঘা জমিতে অর্থাৎ ৭ হাজার ৭৮০ একর জমির ৩ হাজার ১৫০ হেক্টর জমিতে লিচু চাষ করা হয়েছে। যা গত বছরের চেয়ে প্রায় ১৫০ হেক্টর বেশি। প্রতি বছর এই এলাকায় লিচু চাষ বাড়ছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ না ঘটলে লক্ষমাত্রার চেয়ে বেশি উৎপাদন হবে বলে মনে করছি।  

বাংলাদেশ সময়: ১০৪৬ ঘণ্টা, ফেব্রয়ারি ০৮, ২০২১
এসআরএস/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।