যশোর: স্নাতক পাস করে ২৮৮ টাকা বেতনে স্কুল শিক্ষকতা শুরু করেন খুলনার ডুমুরিয়া গ্রামের নান্নু মিয়া। সংসার চালাতে হিমসিম খেতে হয় বলে শিক্ষকতা ছেড়ে মাছচাষে ভাগ্য বদলের স্বপ্ন দেখেন তিনি।
স্বল্প পুঁজির স্বপ্নের ডানায় ভর করে মাছের রেণু উৎপাদনে রেকর্ড গড়েছেন তিনি। কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন। মাত্র চার হাজার টাকা নিয়ে যাত্রা শুরু করা নান্নু এখন প্রতিবছর প্রায় চার কোটি কার্পজাতীয় মাছের পোনা উৎপাদন করেন। যার বাজারমূল্য প্রায় তিন কোটি টাকা। পেয়েছেন জেলার দুই বারের শ্রেষ্ঠ মৎস্য চাষির পুরস্কারও। তার দেখানো স্বপ্নের পথে হেটে এলাকার অনেক বেকার যুবক স্বাবলম্বী হয়েছেন।
পরিশ্রম, অদম্য ইচ্ছা আর দৃঢ় মনোবলকে পুঁজি করে এখন তিনি গড়েছেন ‘নান্নু আদর্শ মৎস্য হ্যাচারি’। শুধু কী নান্নুই? সাদা মাছের রুপালী বিপ্লবের দিনবদলের এমন উদাহরণ কমনয় যশোর শহরতলীয় চাঁচড়া হ্যাচারি পল্লীতে। নান্নুর মতো এমন শতাধিক হ্যাচারি মালিকের রয়েছে রুপালি দিনবদলের গল্প। যা যশোরে মাছের পোনা উৎপাদন ও চাষে অপার সম্ভাবনা জাগিয়েছেন হ্যাচারি মালিক ও ছোট-বড় মাছ চাষিরা।
আশির দশকে শুরু হলেও ২০১০ সালের পর থেকে চাঁচড়া এ মৎস্য হ্যাচারিতে দেশি ও বিদেশি জাতের মাছের পোনা উৎপাদন ও মাছ চাষে বিপ্লব ঘটে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সবচেয়ে বড় চারা মাছের রাজধানীখ্যাত চাঁচড়া হ্যাচারি পল্লীতে। এ রুপালী বিপ্লবে তারা বেকারত্ব ঘুচানোর পাশাপাশি অবদান রাখছে জাতীয় অর্থনীতিতেও।
জেলা হ্যাচারি মালিক সমিতি সূত্রে মতে, আশির দশকে যশোরে মাছের রেণু উৎপাদনের বিস্তার ঘটে। যশোর জেলায় ১৩ হাজার ৬২৬ হেক্টর জলায়তন বিশিষ্ট পুকুর ও ১৩ হাজার ৯৩১ হেক্টর বাঁওড় রয়েছে।
হ্যাচারিগুলোতে উৎপাদিত রেণু পোনা এসব জলাশায়ে চাষ করে জীবিকা নির্বাহ করে প্রায় ৩২ লাখ মানুষ। বিশেষ করে যশোর শহরের চাঁচড়াসহ আশপাশের এলাকায় গড়ে ওঠে ৮৭টি হ্যাচারি। রুই, কাতলা, থাই পাঙাশ, শিং, কই, মাগুর, সিলভার কার্প, কালবাউশ, মিরর কার্প, মৃগেলসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছের সাত থেকে আট হাজার কেজি রেণু পোনা উৎপাদন করা হয়। মাসে মোট উৎপাদন হয় ২৮ থেকে ৩২ হাজার কেজি রেণু পোনা। প্রতি কেজি রেণু গড়ে দুই হাজার টাকা দরে বিক্রি হয়। সেই হিসাবে মাসে এখানে পাঁচ কোটি ৬০ লাখ থেকে ছয় কোটি ৪০ হাজার টাকার রেণু পোনা বিক্রি হয়। এছাড়া দেশের একটি বৃহত্তর অংশের মাছ চাষিদেরও জীবিকা নির্বাহ হয় এ উৎপাদিত রেণু পোনা থেকে। এসব হ্যাচারি উৎপাদিত রেণু পোনা দেশের মোট চাহিদার ৮০ শতাংশ পূরণ করছে বলে দাবি জেলা হ্যাচারি মালিক সমিতির।
স্থানীয় চাহিদা মিটিয়েও স্বল্প পরিসরে এলসির মাধ্যমে বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়েও ভারতে রপ্তানি হচ্ছে যশোরের এ রেণু পোনা। কিন্তু বর্তমানে হ্যাচারি মালিকরা চরম প্রতিকূলতার সম্মুখীনের মধ্যে দিনপার করছেন। ব্রুড স্বল্পতা, পুকুর লিজ, মাছের খাবার, বিদ্যুৎসহ সংশিষ্ট সব কিছুর দাম বাড়ায় ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এতে করে স্বাদুপানির মাছ উৎপাদনে পড়েছে বিরূপ প্রভাব। সেই সঙ্গে করোনার প্রভাবে বিপর্যয়ের মুখে রেণু পোনা উৎপাদন। এ অবস্থায় মৎস্য বিভাগের উৎসাহে লোকসানের ঝুঁকি নিয়ে উৎপাদন করছে হ্যাচারিগুলো। তবে এমন অবস্থায় মৎস্য বিভাগের কর্মকর্তারা চাষীদের সমস্যা সমাধানে সব ধরনের চেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন বলে জানিয়েছে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, চাঁচড়া মোড়ে প্রায় মুজিব সড়ক ও যশোর বাসটার্মিনাল সড়কের দুধারে স্থানীয় ও দূর-দূরান্তের ক্রেতাদের সমাগমে প্রতিদিনই প্রাণচঞ্চল হয়ে ওঠে জায়গাটি। ভোর হতে না-হতেই চাঁচড়া চেকপোস্ট মোড় থেকে বিশাল এলাকাজুড়ে সড়কের দুই ধারে প্রচুর সংখ্যক ট্রাক, পিকআপ, ইঞ্জিনচালিত নছিমন, আলমসাধু প্রভৃতি গাড়ি এসে মাছ বোঝাইয়ের অপেক্ষায় থাকে। এসব গাড়িতে করেই কাছে-দূরের গন্তব্যে রেণু পোনা নিয়ে যান ব্যাপারীরা। এ বাজার বসে প্রতিদিন ভোর থেকে। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পোনা বিক্রির হাটও শেষ হয়ে যায়। প্রতিদিন এ বাজারে লাখ লাখ টাকার মাছের পোনা বেচাকেনা হয়।
বাপ্পী রেণু পোনা স্বত্বাধিকারী বাপ্পী ইসলাম বলেন, বাংলাদেশের মধ্যে রেণু পোনার জন্য যশোর বিখ্যাত। দেশের চাহিদার সব ধরনের মাছের প্রায় ৮০ শতাংশ মাছের পোনা এ জায়গা থেকে সরবাহর করা হয়। আবার দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে রেণু অর্ডার দিলে পরিবহনের মাধ্যমে আমরা পৌঁছে দিই। এ জনপ্রিয় ও মানের দিক দিয়েও যশোরের মাছের পোনার সুনাম রয়েছে।
নিজামউদ্দিন নামে এক হ্যাচারি মালিক বলেন, বর্তমানে মাছের রেণু পোনা উৎপাদন কমে গেছে। রেণুর বাজারে ধস নেমে যাওয়ায় চাষিরা হতাশগ্রস্ত হচ্ছে। বর্তমানে পুকুরে যে পরিমাণ অর্থ লগ্নি করছি সেটি উঠছে না।
দেশ হ্যাচারির স্বত্বাধিকারী আতিকুর ইসলাম বলেন, আমার হ্যাচারির তিন বছর ধরে পোনা উৎপাদন কিছুটা কমে গেছে। পোনা উৎপাদনের প্রতিটি জিনিসের দাম বেড়েছে। এখন আমরা পোনা উৎপাদন করতে যা খরচ করি তার অর্ধকে টাকার বিক্রি করতে পারি না। সরকার যদি হ্যাচারি মালিকদের বাঁচাতে চায়, তাহলে আমাদের ঋণ দিতে হবে।
যশোর জেলা হ্যাচারি মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক জাহিদুর রহমান গোলদার বাংলানিউজকে বলেন, যশোরে কার্প জাতীয় মাছ চাষ হচ্ছে বাণিজ্যিকভাবে। স্বাদু পানির মাছের মধ্যে শিং, কৈ ও মাগুরও ব্যাপকভাবে উৎপাদিত হচ্ছে। দেশি কৈয়ের পাশাপাশি চাষ হচ্ছে থাই ও ভিয়েতনামের কৈ। যশোরের রেণু মাছের গুণগত মান ভালো হওয়ায় দেশব্যাপী সুনাম রয়েছে। এসব পোনা বরিশাল, ভোলা, পটুয়াখালী, বরগুনা, পিরোজপুর, কুষ্টিয়া, পাবনা, চুয়াডাঙ্গা, সাতক্ষীরা, নড়াইল, শরীয়তপুর, মাদারীপুরসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পাঠানো হয়। যশোরে মাছের রেণু পোনা উৎপাদনে খরচ বেশি না হলেও বাজারজাতকরণ নিয়ে নানা দুচিন্তায় মধ্যে পড়তে হয়। পরিবহন ও অক্সিজেনের দাম বেশি হওয়ায় এটার মূল কারণ। মাছ চাষে ভূমি উন্নয়ন কর উঠিয়ে বিদ্যুৎ বিলে ভর্তুকির ব্যবস্থা করতে হবে। সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোকে সহজশর্তে বেকার যুবকদের ঋণ দিতে হবে। এতে মৎস্য খাতের অভূতপূর্ব উন্নতির পাশাপাশি কর্মসংস্থানেরও সুযোগ সৃষ্টি হবে, আমিষের ঘাটতিও পূরণ হবে।
যশোরে প্রতিদিন ২ থেকে ৩ কোটি থাকার মাছ বিক্রি করতে পারলেও বতর্মানে এখন ২০ থেকে ২৫ লাখ টাকার মধ্যে নেমে এসেছে। এ বেচাকেনা কম হওয়ায় সব চাষিরা বিপাকে পড়েছেন। এসব মৎস্য হ্যাচারি রক্ষার্থে চাষিদের প্রণোদনা দেওয়ার জন্য সরকারের দৃষ্টি কামনা করেন তিনি।
যশোর জেলা মৎস্য কর্মকর্তা আনিচুর রহমান বলেন, যশোরের হ্যাচারি পল্লীখ্যাত চাঁচড়ায় সাদা রঙের সব ধরনের মাছের রেণু চাষ করে। ভালোমানের জন্য যশোরের পোনার খ্যাতি ছড়িয়েছে দেশব্যাপী। চলতি বছরে ৬ দশমিক ৮২ মেট্রিক টন রেণু পোনা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। উন্নতজাতের ও আধুনিক পদ্ধতিতে মাছের পোনা উৎপাদেনর লক্ষ্যে জেলা ও সদর উপজেলা মৎস্য বিভাগ সব ধরনের সহযোগিতা করে যাচ্ছে। এরই মধ্যে চাঁচড়ায় সরকারি ব্যবস্থাপনায় নির্মাণ করা হয়েছে মাছের পোনা বিক্রির আধুনিক বিক্রয় কেন্দ্র। এটি চালু হলে আর্থিকভাবে লাভবান হবে এ অঞ্চলের মৎস্য ব্যবসায়ীরা। চলতি বছরের মার্চ এপ্রিল থেকে এখানে মাছের রেণু-পোনা বিক্রয় করতে পারবেন এ হ্যাচারি পল্লীর চাষিরা।
বাংলাদেশ সময়: ০৮০০ ঘণ্টা, এপ্রিল ১০, ২০২১
ইউজি/ওএইচ/