নাটোর: নাটোরের হালতিবিলের বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠ। চারিদিকে বাতাসে দোল খাচ্ছে সোনা রাঙ্গা বোরো ধান।
মৌসুমের শুরুতে আগাম রোপণ করা জমির পাকা ধান কাটতে শুরু করেছেন অনেক কৃষক। পুরোদমে ধান কাটা-মাড়াই কার্যক্রম শুরু হতে সময় লাগবে আরও সপ্তাহ খানেক।
কিন্তু তাতে বসে নেই কৃষকরা। এরই মধ্যে তারা ধান কাটাতে শ্রমিকের সন্ধান করছেন। সেই সঙ্গে তারা ধান কাটা-মাড়াই মেশিন সংগ্রহ, ধান রাখার গোলা ও চাতাল (ধান রাখা হয়) প্রস্তুতসহ নানা কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন। শঙ্কায়ও রয়েছেন আবহাওয়া নিয়ে।
কারণ দেশের হাওরাঞ্চলে হঠাৎ বন্যায় বোরো ধান ডুবে কৃষকরা বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। সেই দিক বিবেচনা করে হালতিবিলের কৃষকরা আছেন দুঃশ্চিন্তায়। ভালোয় ভালোয় ফসল ঘরে তুলতে পারলেই স্বস্তি। তা না হলে হাওরাঞ্চলের কৃষকদের মত পরিণতির ভয় পাচ্ছেন তারা। এজন্য যত দ্রুত সম্ভব ফসল ঘরে তোলা যায়, তা নিয়ে কৃষকের যত ব্যস্ততা।
কৃষি সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কৃষকরা যাতে সময় মত এবং সুবিধাজনকভাবে বোরো ধান ঘরে তুলতে পারেন, সেজন্য জেলা প্রশাসন ও কৃষি বিভাগও বেশ তৎপর। তারা কৃষকদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ করছেন, পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণসহ ফসলের মাঠও পরিদর্শন করছেন।
কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা যায়, বুধবার (২০ এপ্রিল) সকালে জেলার হালতিবিলে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উদ্যোগে আনুষ্ঠানিকভাবে বোরো ধান কাটা ও মাড়াই কার্যক্রমের সূচনা হবে।
এদিকে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, চলতি বোরো মৌসুমে জেলার সাতটি উপজেলায় ৫৮ হাজার ২০০ হেক্টর জমিতে বোরো ধান চাষাবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। এর মধ্যে হাইব্রিড জাত চার হাজার হেক্টর, স্থানীয় জাত ১০ হেক্টর ও উফসী জাত ৫৪ হাজার ১৯০ হেক্টর জমিতে চাষ করা হয়। তবে লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে বোরোর চাষাবাদ হয়েছে এবার।
প্রতি হেক্টরে গড় ফলন চার দশমিক ৬৪ মেট্রিক টন হিসাবে মোট উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে দুই লাখ ৭৫ হাজার ১৫৮ মেট্রিক টন। এর মধ্যে হাইব্রিড ২১ হাজার ৫২০ মেট্রিক টন, উফসী জাত দুই লাথ ৫৩ হাজার ৬০৯ মেট্রিক টন ও স্থানীয় জাতের ধান ২৯ মেট্রিক টন।
গত বোরো মৌসুমে জেলায় ৫৭ হাজার ৮৬০ হেক্টর জমিতে বোরো ধান চাষাবাদেও লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। সেখানে চাষ হয়েছিল ৫৯ হাজার ৩৩০ হেক্টর জমিতে। অর্থাৎ লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে এক হাজার ৪৭০ হেক্টর বেশি জমিতে বোরোর আবাদ হয়েছিল। আর প্রতি হেক্টরে চার দশমিক ৭২ মেট্রিক টন হিসাবে মোট ধান উৎপাদন হয়েছিল দুই লাখ ৭৯ হাজার ৭৭৪ মেট্রিক টন। এ জেলায় চলনবিল অধ্যুষিত সিংড়া উপজেলা ও গুরুদাপুর উপজেলা এবং হালতিবিল অধ্যুষিত নলডাঙ্গা উপজেলায় সবচেয়ে বেশি বোরো ধান চাষ হয়।
কৃষি বিভাগের দাবি, চলতি মৌসুমে প্রণোদনার আওতায় কৃষকরা বিনামূল্যে সার ও বীজ পাওয়ায় এবং আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় বোরোর আবাদ ভালো হয়েছে। ধান কেটে ঘরে তোলা পর্যন্ত আবহাওয়া ভালো থাকলে এবারও বোরো ধানের বাম্পার ফলন হবে। এরই মধ্যে আগাম রোপণকৃত বোরো ধান টাকার পর সন্তোষজনক ফলন পাওয়া গেছে। এছাড়া মানভেদে প্রতিমণ বোরো ধান ১১০০ টাকা থেকে ১২০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
তবে স্থানীয় কৃষকরা বলছেন, বোরোর বীজ রোপণ থেকে এখনও পর্যন্ত আবহাওয়া ভালো থাকায় এবং প্রয়োজন মত সার ও পানি সেচ দেওয়ায় ফসল ভালোই ছিল। কিন্তু গত সপ্তাহ খানেকের মধ্যে বোরো ধানে মাজরা পোকার আক্রমণ দেখা যাচ্ছে। যা ধানের শীষ কেটে দিচ্ছে। এতে ধানের শীষে চিটা দেখা দিচ্ছে। ফলে ধানের ফলন নিয়ে চিন্তায় আছেন অনেকে।
খোলাবাড়িয়া গ্রামের কৃষক আব্দুল গফুর জানান, এ বছর তিনি আড়াই বিঘা জমিতে বোরোর আবাদ করেছেন। ফসলও বেশ ভালো হয়েছে। তবে মাজরা পোকার আক্রমণে কিছুটা ক্ষতির শঙ্কায় আছেন। এরই মধ্যে বোরো ধান প্রায় পেকে গেছে। সপ্তাহ খানেকের মধ্যে কাটা-মাড়াই সম্পন্ন হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
হালতি গ্রামের কৃষক আফজাল হোসেন জানান, ফসলের অবস্থা এখনও পর্যন্ত ভালো আছে। শেষ পর্যন্ত ভালো থাকলে এবং সঠিক সময়ে কাটা-মাড়াই সম্পন্ন করতে পারলে বাম্পার ফলন হবে। তবে মাঝখানে একদিনের ঝড়ে হালতিবিলের অনেক ক্ষেতের কাঁচা-পাকা ধান মাটিতে নুয়ে পড়েছে। এতে ফলন নিয়ে কিছুটা শঙ্কা কাজ করছে। পুরো হালতিবিলের ধান কাটতে স্থান ভেদে অন্তত এক মাস সময় লাগবে।
একই কথা জানালেন দিঘীড়পাড়, কোচঁকুড়ি, খাজুরা, একডালা, পাটুল গ্রামের কৃষকরা।
নলডাঙ্গা উপজেলা কৃষি অফিসার ফৌজিয়া ফেরদৌস বাংলানিউজকে জানান, হালতিবিলসহ তার উপজেলায় এ বছর আট হাজার ৭২০ হেক্টর জমিতে বোরোর আবাদ হয়েছে। ফসলের অবস্থা বেশ ভালো রয়েছে। দুই-এক জায়গায় পোকার আক্রমণ ও ঝড়ের প্রভাবে ধান মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে। তবে এ কারণে সার্বিক উৎপাদনে কোনো প্রভাব পড়বে না। আশা করা হচ্ছে, বিগত বছরের মতো এবারও বোরো ধানের বাম্পার ফলন হবে।
নাটোর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মাহমুদুল ফারুক বাংলানিউজকে জানান, খাদ্যশস্যে উদ্বৃত্ত এ জেলায় চলতি মৌসুমে বোরোর আশানুরূপ আবাদ হয়েছে। কৃষকরা সময়মত সার, বীজসহ অন্যান্য উপকরণ সঠিকভাবে পাওয়ায় বোরো ধান চাষে কৃষকদের কোনো প্রতিবন্ধকতা ছিল না।
এছাড়া সরকারের দেওয়া প্রণোদনার বীজ ও সার পেয়ে কৃষকরা উপকৃত হয়েছেন। ফসলের বর্তমান পরিস্থিতি অনুযায়ী আশা করা হচ্ছে, এবারও ফলন ভালো হবে। কৃষকরা যদি সঠিকভাবে তাদের ফসল ঘরে তুলতে পারেন এবং ফসলের ন্যায্য মূল্য পান, তাহলে অর্থনৈতিকভাবে বেশ লাভবান হবেন। এছাড়া জেলার উৎপাদিত ধান স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে বাইরের জেলায় সরবরাহ বা বিক্রি করা সম্ভব হবে, যোগ করেন তিনি।
বাংলাদেষ সময়: ১৭১৪ ঘণ্টা, এপ্রিল ২১, ২০২২
এসআই