ফেনী: তখন ভরদুপুর, প্রখর রোদ হওয়ায় ফেনীর সোনাগাজী মুহুরী প্রজেক্ট এলাকায় রেগুলেটরের উপরে কোনো মানুষ নেই। রেগুলেটরের উপরের চিত্র একদম ফাঁকা, নিচের চিত্র পুরোটাই ভিন্ন।
ফেনী নদীতে তখন শত শত মানুষ নিষিদ্ধ মশারি ও ঠেলা জাল দিয়ে চিংড়ির রেনু আহরণ করছে এবং এ রেনুর জন্য ধ্বংস করছে অন্য হাজারো মৎস্য ও জলজ প্রজাতি।
কাজটি অবৈধ হলেও প্রকাশ্যেই চলছে। যারা চিংড়ির রেনু ধরছে অবৈধ কাজ হিসেবে তাদের মধ্যে কোনো ধরনের ভীতি নেই। তাদের বক্তব্য সবাইতো ম্যানেজড, ধরবে কে? টাকার ভাগতো সবাই পায় ব্যবস্থা নেবে কে?
একই চিত্র দেখা গেছে জেলেপাড়া থেকে নৌকায় এক কিলোমিটার যাওয়ার পর চর খোন্দকার এলাকায়ও।
সেখানেও চলছে এ অবৈধ যজ্ঞ। এ যেন নদীকে মাছহীন করার উৎসব!সোনাগাজীতে সমুদ্র উপকূলীয় ফেনী নদীর বিভিন্ন স্থানে ও সাগরের মোহনায় নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে অবৈধভাবে অবাধে চলছে গলদা-বাগদা চিংড়ির রেনু আহরণ। এ রেনু আহরণ করতে গিয়ে প্রতিনিয়তই ধ্বংস হচ্ছে হাজারো প্রজাতির মৎস্য ও জলজ প্রাণির পোনা।
নদীর বিভিন্ন স্থানে গিয়ে দেখা যায়, নিষিদ্ধ মশারি ও ঠেলা জাল দিয়ে জেলেরা লাখ লাখ চিংড়ির রেনু আহরণ করে বিক্রি করছেন স্থানীয় ব্যাপারিদের কাছে। তারা সেগুলো দ্বিগুণ দামে বিক্রি করছেন খুলনা, বাগেরহাট ও যশোরসহ দেশের বিভিন্ন চিংড়ি ঘের মালিকদের কাছে।
ফেনী নদীর মুহুরী রেগুলেটরের দুই পাশে, চর খোন্দকার, সোনাগাজী সদর ইউনিয়নের জেলেপাড়া, সুজাপুর, থাক খোয়াজ লামছি, ছোট স্লুইচ গেট, ভাঙ্গাবেড়ী, চর খোয়াজের লামছিসহ বেশ কিছু স্থানে গিয়ে চিংড়ির আহরণ এবং মৎস্য প্রজাতির এ ধ্বংস লীলা দেখা যায় প্রতি বছর এপ্রিল থেকে জুলাই মাস পর্যন্ত।
অথচ প্রজনন মৌসুম থাকায় এ সময়টাতে নদীতে মাছ ধরার প্রতি রয়েছে সরকারি নিষেধাজ্ঞা।
ফেনী নদীর মুহুরী সেচ প্রকল্প এলাকা থেকে শুরু করে চট্টগ্রামের মীরসরাইয়ের ইছাখালী, বানচন্দ খাল পর্যন্ত এবং ছোট ফেনী নদীর কাজীর হাট স্লুইচ গেট থেকে দক্ষিণে সন্দ্বীপ চ্যানেল পর্যন্ত বিশাল উপকূলীয় এলাকায় প্রতিদিনই লাখ লাখ চিংড়ি পোনা আহরণ করা হচ্ছে। এতে খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট এবং সোনাগাজী উপকূলীয় অঞ্চলের কয়েক হাজার মানুষ শুধু নদীতে চিংড়ি পোনা আহরণ করেই তাদের জীবিকা নির্বাহও করছে।
এসব স্থান ঘুরে দেখা যায়, জেলে, শিশু ও বৃদ্ধ সবাই মশারি ও ঠেলা জাল নিয়ে চিংড়ির রেনু আহরণ করছে। জেলেরা শুধু বাগদা-গলদা চিংড়ির রেনু সংগ্রহ করে অন্যান্য মাছের রেনু ও জলজ প্রাণী ফেলে দিচ্ছে।
পোনা আহরণের জন্য এসব জেলেরা প্রভাবশালী মহলের ছত্রছায়ায় গড়ে তুলেছে অবৈধভাবে অসংখ্য টিনের ঘর। ফেনী থেকে ঢাকা, খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা জেলার চিংড়ি ঘেরগুলোতে পোনা পাঠানো হয়। শুধু সোনাগাজী এলাকা থেকেই দৈনিক লক্ষাধিক চিংড়ি পোনা বৃহত্তর ঢাকা ও খুলনা অঞ্চলে সরবরাহ করা হয়। ফেনী মুহুরী রেগুলেটর এলাকায় গিয়ে দেখা এমন কয়েকজন মৎস্যজীবীর সঙ্গে। তাদেরই একজন অভিজিৎ মণ্ডল, তিনি এসেছেন খুলনা থেকে।
তিনি জানান, চিংড়ির রেনু পোনা আহরণ করার জন্য তিনি দুই মাসের জন্য এ এলাকায় এসেছেন। স্থানীয় মহাজনের মাধ্যমে তিনি নদী থেকে এ পোনা আহরণ করে প্রতি পিস এক টাকা ধরে বিক্রি করেন।
শাখাওয়াত হোসেন নামের খুলনা থেকে আসা আরেকজন জানান, তিনি প্রতি বছরই এপ্রিল-জুন তিন মাসের জন্য এলাকায় চিংড়ির রেনু পোনা আহরণের জন্য আসেন। স্থানীয় কালু মিয়া মহাজনের মাধ্যমে তিনি পোনাগুলো বিক্রি করেন।
একই এলাকা থেকে আসা আরেক জেলে জানান, তারা নদী থেকে মশারির জাল দিয়ে অন্য পোনাসহ চিংড়ির পোনাগুলো আহরণ করেন। পরে চিংড়িটা রেখে অন্যগুলো ফেলে দেন।
মানু মিয়া নামে স্থানীয় সোনাপুর এলাকার আরেকজন জানান, চিংড়ির রেনু সংগ্রহ করার সময় কোরাল, কাঁকড়া, বাইলা, মলা-ঢেলা, টেংরা, পোয়া, লইট্টা, ভেটকিসহ অনেক প্রজাতির পোনা আসে। তারা শুধু চিংড়ির রেনু আহরণ করেন বাকিগুলো ফেলে দেন।
তিনি জানান, তারা চিংড়ি ভালো দামে বিক্রি করতে পারেন। অন্য মাছের পোনা নষ্ট হলে তাতে তাদের কোন সমস্যা নেই।
ওই অঞ্চলের মৎস্যজীবীরা বলছেন, আমরাও বুঝি আমরা অনেক মাছের জাত ধ্বংস করছি। কিন্তু কী করবো? এই সময় কোনো কাজ না থাকায় জীবনের তাগিদে বাধ্য হয়ে এই রেনু আহরণ করছি।
তারা জানান, খুলনা, বাগেরহাট, যশোর এলাকার ঘের মালিকরা স্থানীয় সোনাগাজী ও মীরসরাই এলাকার আড়তদারদের মাধ্যমে চিংড়ির রেনু সংগ্রহ করেন। আড়তদাররা হকারের মাধ্যমে জেলেদের কাছ থেকে রেনু সংগ্রহ করেন। সবাই নির্দিষ্ট হারে কমিশন পায়। প্রাথমিক পর্যায়ে প্রতিটি পোনা এক টাকায় বিক্রি করলেও খুলনা পর্যন্ত যেতে তার দাম পড়ে তিন টাকার মত।
সবতো ম্যানেজড, ব্যবস্থা নেবে কে?
মুহুরী রেগুলেটর এলাকায় চিংড়ির রেণু আহরণকারী মানু মিয়া নামের একজন ছবি তুলতে দেখে মন্তব্য করছিলেন- ‘সবতো ম্যানেজ, ছবি-টবি তুলে কোনো কাম হবে না’।
আরো কয়েকজন মৎস্যজীবীর সঙ্গে কথা বলেও একই ধরনের বক্তব্য পাওয়া যায়। তাদের দাবি, এ প্রক্রিয়ায় স্থানীয় চেয়ারম্যান, মেম্বার থেকে শুরু করে প্রশাসন এবং কী মৎস্য অফিসও জড়িত। এখানকার আহরণ করা চিংড়ির টাকা সবার পকেটেই যায়।
সোনাগাজী পৌর এলাকার বাসিন্দা আজগর হোসেন জানান, সোনাগাজী থানার সামনে দিয়েই ড্রামে ড্রামে চিংড়ির এসব রেনু যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন এলাকায়। প্রশাসনের নাকের ডগা দিয়েই চলছে এই অবৈধ কারবার।
অভিযান লোক দেখানো, বলছেন স্থানীয়রা:
স্থানীয়রা বলছেন, নিজাম জমিদার, মফিজ জমিদার (ক্যারপেডি), ওবায়দুল হকসহ অন্যরা প্রকাশ্যে ছোট ছোট ঘর করে খুলনা, বাগেরহাট, যশোর থেকে লোক এনে এ ব্যবসা পরিচালনা করছে। সবার সামনেই ড্রামে করে নিয়ে যাচ্ছে এসব পোনা, নেওয়া হয় না কোনো ধরনের ব্যবস্থা।
কবির আহম্মদ নামের সোনাগাজীর সাহাপুর এলাকার এক বাসিন্দা বলেন, এ অবৈধ কাজের ফলে নদী মাছশূন্য হয়ে যাচ্ছে। রাজনৈতিক আশ্রয়ে সিন্ডিকেটটি ফেনী নদীর মাছ ধ্বংস করে দিচ্ছে। তিনি বলেন, এ অবৈধ কাজের জন্য বড় ধরনের কোনো সাজা ও জরিমানার নজির নেই। যা হয় তা লোক দেখানো। অভিযানে আসার আগে মৎস্য অফিসের লোকজনই অবৈধ কারবারিদের ফোন করে দেন। অভিযানে এলে আর নদীতে কাউকে পাওয়া যায় না।
স্থানীয়রা জানান, এক সময় এ অঞ্চলে অনেক মাছ পাওয়া যেতো। এভাবে চিংড়ির রেনু আহরণ করতে গিয়ে মাছের অনেক প্রজাতি ধ্বংস হচ্ছে, এর ফলে নদীতে আর আগের মতো মাছ পাওয়া যায় না। এলাকার সাধারণ মানুষ বলছেন, প্রাকৃতিক উৎস হতে বেপরোয়াভাবে এই রেনু ধরা বন্ধ করার দরকার।
অনেকে অভিযোগ করেন, এক শ্রেণির লোভী ব্যবসায়ী স্থানীয় প্রশাসনকে ‘ম্যানেজ’ করেই অবাধে চলাচ্ছে এ রেনু সংগ্রহ।
একটি চিংড়ির রেনুর জন্য ধ্বংস হয় ১ হাজার ৭শ ৬৩ প্রজাতি:
এ বিষয়ে কথা হয় ফেনী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, বিশিষ্ট মৎস্যবিজ্ঞানী ও শিক্ষাবিদ প্রফেসর ড. মো. সাইফুদ্দিন শাহর সঙ্গে।
তিনি বলেন, বিগত কয়েক বছর ধরে চিংড়ির রেনু পোনা ধরা সরকারিভাবে নিষিদ্ধ রয়েছে। তারপরও সাগর মোহনা অঞ্চলের গরিব মৎস্যজীবীদের ঠেকানো যাচ্ছে না। তারা অবৈধভাবেই নদী ও খাল থেকে গলদা ও বাগদার রেনু পোনা আহরণ করছেন। এ প্রবণতা আরও বেড়ে গেছে বিগত কয়েক বছরে হ্যাচারিগুলোতে কৃত্রিমভাবে পোনা উৎপাদন প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর থেকে। এখন ঘের মালিকরা সবাই গলদা চিংড়ির জন্য প্রাকৃতিক মৎস্য সম্পদের ওপরই পুরোপুরি নির্ভলশীল হয়ে আছে। এর ফলে বাংলাদেশের প্রাকৃতিক মৎস্য সম্পদ দিন দিন মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে।
এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, একটি গলদা বা বাগদা চিংড়ির রেনু পোনা আহরণ করতে গিয়ে অন্য ৪শ ৬৩ প্রজাতির মাছের রেনু পোনা ধ্বংস হয়। আর সঙ্গে নদীর পানিতে বাস করা ক্ষুদ্র জীবকণা ধরা হয় তাহলে তার সংখ্যা দাঁড়ায় ১ হাজার ৭শ ৬৩টি। এটা সার্বিকভাবে বাংলাদেশের মৎস্য সম্পদের জন্য বিশাল ক্ষতির কারণ। এটা কঠিনভাবে নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে বাংলাদেশের নদীগুলো ধীরে ধীরে মাছশূন্য হয়ে যাবে। আর নিয়ন্ত্রণ করা গেলে বাংলাদেশের মৎস্য সম্পদ বাড়বে দিনকে দিন। মৎস্য কর্মকর্তার ভাষ্য:
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে সোনাগাজী উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা তূর্য সাহা বলেন, ‘আমরা প্রতিবছর অভিযান পরিচালনা করি। এবছরও অভিযান হবে। সব সময় না পারলেও মৌসুমে মাঝেমধ্যেই আমরা অভিযান পরিচালনা করি। অভিযানে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট থাকলে জেল-জরিমানা করা হয়। এছাড়াও অবৈধভাবে চিংড়ির রেনু ধরার কাজে ব্যবহারিত জাল ধ্বংস করে দেওয়া হয়। এবং চিংড়ির পোনাগুলো নদীতে ফেলে দেওয়া হয়।
উপজেলা প্রশাসন থেকে সহায়তা নিয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান চালানো হবে এবছরও এবং মৎস্য সংরক্ষণ আইনের আওতায় শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে।
তিনি আরও জানান, এই রেনু আহরণে বেশি ক্ষতি হচ্ছে ইলিশের। এতে হাজারো জলজ প্রাণি ধ্বংস হচ্ছে। এ থেকে উত্তরণের জন্য দরকার ব্যাপক গণসচেতনতা ও জেলেদের বিকল্প কর্মসংস্থান।
বাংলাদেশ সময়: ২১৫৫ ঘণ্টা, মে ২১, ২০২২/আপডেট: ১৪৩১ ঘণ্টা,
এসএইচডি/এএটি