নুর মোহাম্মদ একটু সামনের দিকে ঝুকে হাঁটছেন। একহাতে স্কুল ছাত্রের মতো বুকে ধরে আছেন দুটি বই।
তিনি বারান্দায় উঠতেই অফিস পিয়ন মনিরুল সামনে দাঁড়িয়ে বলল, স্যার, আপনারে হেড স্যার দেখা করতে কইছেন।
নুর মোহাম্মদ থমকে দাঁড়িয়ে পড়লেন। তিনি বুঝতে পারছেন না কমন রুমে যাবেন, না হেডমাস্টার স্যারের সঙ্গে আগে দেখা করে আসবেন।
বিশেষ ভাবতে হলো না। মনিরুল আবার বলল, স্যার বলছেন, আপনে আসলেই যেন তার রুমে যান।
নুর মোহাম্মদ সোজা হেডমাস্টার স্যারের রুমের দিকে পা বাড়ালেন।
স্কুলের প্রধান শিক্ষকদের মর্যাদার চিহ্ন হলো তাঁদের চেয়ারের সঙ্গে একটি তোয়ালে ঝোলানো থাকে। নুর মোহাম্মদ মাথাটা সারস পাখির মতো সামনে এনে ভালো করে তাকিয়ে দেখলেন চেয়ারটা খালি। হলুদ রঙের তোয়ালে ঝুলছে। পরক্ষণেই রুমের ডানদিকে চোখের কোণে কিছু নড়ে উঠতেই বুঝতে পারলেন প্রধান শিক্ষক মো. আব্দুস সালাম আনসারী নামাজ শেষ করে উঠলেন। এই সকাল সাড়ে এগারোটায় আনসারী স্যার কোন ওয়াক্তের নামাজ পড়লেন তা বোঝা গেল না। হেডমাস্টার সাহেব মাথার টুপি ভাঁজ করে পকেটে রাখতে রাখতে খ্যাসখ্যাসে গলায় বললেন, নুর মোহাম্মদ, বসেন।
নুর মোহাম্মদ সুবোধ বালকের মতো বসলেন।
প্রধান শিক্ষক আনসারী রেগে আছেন। অন্য কোনো কথায় না গিয়ে সরাসরি বললেন, বলেন তো, আপনার সমস্যাটা কী?
নুর মোহাম্মদ দুদিকে মাথা নেড়ে বললেন,আমার কোনো সমস্যা নেই।
হেডমাস্টার এবার উচ্চকন্ঠে বললেন, আপনার সমস্যা নেই, কিন্তু আপনাকে নিয়ে আমাদের সমস্যা আছে। আপনি নাহারের সঙ্গে কী করেছেন? ছিঃ ছিঃ। আপনার নাম হলো নুর মোহাম্মদ। নুর মানে জগতের আলো, আর আপনে জগৎটারেই অন্ধকার করে দিচ্ছেন।
স্যার, নুর মানে আলো, জগতের আলো নয়। নুরজাহান মানে জগতের আলো।
জ্ঞান দেবেন না। আপনার জ্ঞান দেয়া মানায় না। যা জিজ্ঞাসা করি তার জবাব দেন। আপনি নাহারের সঙ্গে কী আচরণ করেছেন?
নুর মোহাম্মদ একটু টান হয়ে বসে পুরু কাচের ভেতর দিয়ে হেডস্যারের দিকে তাকিয়ে বললেন, কোন নাহার?
নাহারকে চেনেন না? দশম শ্রেণীর সাবিকুন নাহার।
কী করেছি?
যা করেছেন বলতেও তো আমার লজ্জা লাগে!
নুর মোহাম্মদ বোকার মত বললেন, কীসের লজ্জা?
কীসের লজ্জা বোঝেন না! গতকাল আপনি নাহারের অতি কাছে দাঁড়িয়ে নিচু হয়ে যুবতী মেয়েটার বুকের দিকে তাকিয়েছেন না?
জি।
তাকিয়েছেন!
জি।
এটা বলতে আপনার একটু লজ্জা করছে না?
লজ্জা করবে কেন?
বাপরে বাপ! আপনে কী জিনিস? দেখুন নুর মোহাম্মদ সাহেব, আপনি ছেলেমেয়েদের ভালো পড়ান। আপনি ভালো জানেন-শোনেন। আপনার প্রতি সে কারণে আমার একটা ভিন্ন দৃষ্টি ছিল। কিন্তু আপনার লজ্জার থলি যে এমন খালি তা জানতাম না।
আমার প্রচুর লজ্জা স্যার। আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন।
সেটা যাক, আপনি কয়েক দিন আগে স্কুল কমিটিসহ বিভিন্ন জায়গায় আবেদন করেছেন, এই স্কুলের নাম পাল্টে নারায়ণ ঘোষ উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় রাখার জন্য?
জি।
আপনি কি জানেন যে স্কুল কমিটির সভাপতির বাবার নামে এই স্কুল? তিনি আপনাকে নারায়ণ ঘোষ নয়, নারায়ণ দেবতার নামও ভুলিয়ে দেবেন।
জি।
তারপরও কেন করলেন?
নুর মোহাম্মদ মুখের খোঁচা খোঁচা দাড়ি চুলকে বলেন, এই স্কুলটা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন নারায়ণ ঘোষ নামের ওই মহামানুষ।
মহাপুরুষ?
জি, আমার দৃষ্টিতে মহাপুরুষ।
আপনার কাজ স্কুলের ছেলেমেয়েদের ইংরেজি শেখানো, মহাপুরুষ খুঁজে বের করা না।
জি স্যার।
নারায়ণ ঘোষকে আমিও চিনতাম। বাজারে একটা মিষ্টির দোকান ছিল। কৃপণ মানুষ ছিল। মহা হলো কী করে?
সামান্য মিষ্টির দোকান করে তিলে তিলে টাকা জমিয়েছিলেন। সেই অর্থ দিয়ে তিনি এই স্কুলের জায়গা কিনেছিলেন, দুটি স্কুলঘর তুলেছিলেন। এমন কৃপণ হওয়া খুবই কঠিন কাজ। তিনি ধূমপান করা ছেড়ে দিয়েছিলেন এই স্কুলের জন্য টাকা জমাতে গিয়ে।
আপনি দেখি ইতিহাস জেনে ফেলেছেন!
জি স্যার, যে জাতি ইতিহাস ভুলে যায় সে জাতি সভ্য হয় না।
থাক, আপনি সভ্য হন! আমাদের আর সভ্য বানানো লাগবে না। আপনাকে বোধহয় স্কুল কমিটি আর রাখতে চাচ্ছে না। কাল একটি মিটিং কল করা হয়েছে।
নুর মোহাম্মদ নির্লিপ্তভাবে উত্তর দিলেন, জি আচ্ছা। তারপর উঠে দাঁড়ালেন।
হেড মাস্টার আনসারী বললেন, কোথায় যাচ্ছেন?
ক্লাসে।
শুনুন, আপনার আজ ক্লাস নেবার দরকার নেই। কাল সিদ্ধান্তটা হোক, তারপর ভাগ্য ভালো থাকলে ক্লাস নেবেন।
জি আচ্ছা।
নুর মোহাম্মদ আর লাইব্রেরিতে গেলেন না। বারান্দা দিয়ে আবার নেমে এলেন। স্কুলের ফাঁকা বিশাল মাঠের ভেতর দিয়ে হাঁটতে শুরু করলেন। তিনি মাঠের এক কোণে বহু পুরাতন আমগাছটির দিকে একবার তাকালেন। চশমার ভেতর দিয়ে গাছটিকে ঝাপসা কালো দেখা গেল। তিনি জানেন, ১৯৭১ সালে এই গাছটি এতটা হৃষ্টপুষ্ট ছিল না। একহারা গড়নের ছিল। এই গাছের সঙ্গে নারায়ণ ঘোষকে বাঁধা হয়েছিল। নুর মোহাম্মদ বয়স্ক লোকদের মুখে শুনেছেন লোকটি নাকি একটুও ছুটাছুটি করতে চেষ্টা করেননি। শুধু ঘাড় কাত করে কয়েকবার আকাশের দিকে তাকিয়েছিলেন। রাজাকার আর বিহারিরা যেভাবে বাঁধতে চেয়েছে, তিনি সেভাবে বাঁধতে দিয়েছেন। ফুটবলে পেনাল্টি কিক নেয়ার মতো করে একটু দূরে সার বেঁধে দাঁড়িয়েছে তিন-চারজন। মমিনউদ্দিন তাদের নেতা। মমিনউদ্দিন সোজাসুজি দাঁড়িয়ে থ্রি নট থ্রি রাইফেল দিয়ে পেটের ওপর একটি গুলি করেছিল। সঙ্গে সঙ্গে পা দুটো ভাঁজ হয়ে গিয়েছিল। মাথাটা নিচের দিকে ঝুলে পড়েছিল।
দুটি ছেলে ছিল নারায়ণ ঘোষের। তারা পালিয়ে ভারত চলে গিয়েছিল। আর ফিরে আসেনি। আসবে কী, এই স্কুলটা করা ছাড়া তিনি সন্তানদের জন্য কোনো কিছু করে যাননি। স্বাধীনতা যুদ্ধের পর স্কুলটির নাম দেয়া হয়েছিল শহীদ নারায়ণ ঘোষ উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়। ১৯৭৬ সালে পাল্টে দেয়া হয়। মানুষটির নাম এখন আর কোথাও লিপিবদ্ধ নেই। আর হয়তো বছর দশেকের মধ্যে যারা তাঁকে দেখেছেন তারাও এ পৃথিবী থেকে চলে যাবেন।
নুর মোহাম্মদ মাঠ থেকে রাস্তায় উঠলেন। কিছুদূর গিয়ে মমিনপুর বাজার ডান পাশে রেখে বা পাঁশের রাস্তা ধরলেন। সামনে মমিনউদ্দিনের ছেলে এখলাসের হলুদ পাকা বাড়ি। মমিনউদ্দিন বেঁচে থাকতেই এ বাড়ি পাকা হয়েছিল। এখন আরো দুটি ঘর বেড়েছে। নুর মোহাম্মদ বুঝতে পারছেন না তিনি এদিকে কেন এলেন। মনের অজান্তেই কি এখলাসউদ্দিনের সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন? তিনি কি মনে মনে ভেবেছেন যে দেখা হলে সব কথা এখলাস সাহেব জানতে চাইতে পারেন। তিনি বুঝিয়ে বললে এবারের মত চাকরিটা বেঁচে যাবে? পরক্ষণেই মনে হলো, না তিনি মোটেই সেজন্য আসেননি। কেন যেন হাঁটতে ইচ্ছা করছে। বাড়িতে যেতে ইচ্ছা করছে না। নুর মোহাম্মদের সিগারেট খেতে ইচ্ছা করল। বাড়িটার সামনে দিয়ে খানিক এগোলেই ছোট একটি দোকান। রমেশ শীলের। হিন্দুরা কেন যেন বংশের পেশা হারিয়ে ফেলছে। রমেশ শীল দোকান করে খায়, নুর মোহাম্মদের প্রতিবেশী নিখিল কর্মকার এখন বাজারে মাছ বিক্রি করে।
দোকানের সামনে বাঁশ দিয়ে বানানো বেঞ্চে বসলেন নুর মোহাম্মদ। জোরে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে হাঁটার ক্লান্তি দূর করে বললেন, ও রমেশদা, কেমন আছো।
রমেশ শীলের মুখের দাঁত বোধকরি একটিও নেই। জিহ্বা আর মাড়ির ঠোকাঠুকি করে জড়ানো শব্দে বললেন, ভগবান রাখছে তোমাগো দোয়ায়।
একটা সিগারেট দাও। তোমার শরীর কেমন?
শরীরের কথা আর বোইল না। মাজার ব্যথাটা বাড়ছে। শরীরটাও ছাইড়া দিছে। পাইলসের সমস্যাটা খুব জ্বালাইতেছে। রাতে ঘুম হয় না।
তাহলে আর ভগবান ভালো রাখল কই?
বাঁইচা তো আছি রে ভাই। চোখের সামনে কতজন চইলা গেল, আমি তো কেমনে যেন রইয়া গেলাম।
হাতে রমেশ শীলের বাড়িয়ে দেয়া সিগারেটটা নিতে নিতে নুর মোহাম্মদ বললেন, এখলাস সাহেবরাও তো রয়ে গেলেন।
রমেশ শীল সঙ্গে সঙ্গে যেন সতর্ক হয়ে উঠলেন। চুপসে গেলেন। বললেন, হে, তারা বড় মানুষ। তারা তো থাকবেই।
রমেশদা, একটা বিষয় কিন্তু আমার জানা নাই। এই বাড়িটা এখলাস সাহেবদের হলো কী করে?
কথাটা বলেই বাঁ দিকে মানুষের শব্দ পেয়ে নুর মোহাম্মদ চশমার ভেতর দিয়ে তাকালেন। ঝাপসা চোখে জব্বার বাউলের লম্বা চুলগুলো দেখলেন। শীর্ণ শরীরের এই মানুষটি কথা বলে বেশ উঁচু গলায়। কিন্তু বাউলসুলভ বিনয়ের কোনো অভাব নেই। বাউলদের বিষয়টা যে কী নুর মোহাম্মদ ঠিক বুঝে উঠতে পারেন না। জব্বার নমস্কার জানানোর ভঙ্গিতে দু হাত তুলল। তারপর সামনের বেঞ্চে বসতে বসতে বলল, মাফ করবেন মাস্টার সাহেব। কথার ভেতর প্রবেশ করা ঠিক না, পাপের কাজ। কিন্তু গুরু লালন বইলা দিছেন, সত্য বল, সুপথে চল। তাই সত্য বলার খায়েশ ছাড়তে পারি না। ওই বাড়িটা আছিল নারায়ণ ঘোষের। তারে মাইরা ফেলানোর পর তো পরিবার পালাইল। কিন্তু ওইখানে থাইকা গেছিল তাঁর বোন দীপিকা। আমার বয়স তখন ১৫-১৬ বছর। ঘুইরা বেড়াই। নারায়ণ ঘোষরে মারার কয়েকদিন পরের কথা। আমি ওই জায়গাটা বইসা বিড়ি টানতেছি আমাগো হারেসরে সাথে নিয়া। হঠাৎ দেখলাম নিরবে তিন-চারজন লোক নারায়ণ ঘোষের বাড়ি ঢোকে। হাতের বিড়ির আগুন মুঠের মইধ্যে লুকাইয়া ভালো কইরা তাকায় দেখি সামনের মানুষটা মমিনউদ্দিন। তারা বাড়ির ভেতর ঢুকার পর দীপিকা পিসি দুই-তিনটা চিৎকার দিল। তার সাথে সাথে টিনের ঘরের ভেতর বিকট জোরে একটা গুলির আওয়াজ হইল। দীপিকা পিসির জামাই একটা চিৎকার দিল মাত্র। আমি একটু আগায় গেলাম। শুনি ঘরের মধ্যে ধ্বস্তাধস্তির শব্দ। আর দীপিকা পিসি গোঙ্গায়! ভয়ে আমার হাত-পা শুকায় গেল। আমি কী করব বুঝি না। হারেসরে সাথে নিয়া একটু দূরে গিয়া অপেক্ষা করতে থাকলাম। বেশ কিছুক্ষণ পর দেখি তারা বাইর হইয়া যায়। খুব ভয়ে ভয়ে জানালা দিয়া উঁকি দিলাম। দেখি পিসা মশাইর লাশ পইড়া আছে। একটু দূরে দীপিকা পিসি একেবারে ন্যাংটা পইড়া আছেন। তার পেটের ওপর বেনেট দিয়া কুমরার মতো ফাইড়া দিছে। আহা! এরপর যে কী দিয়া কী হইল...বাড়িটা হইয়া গেল মমিনউদ্দিনের! এখনো তো তার পোলা এখলাসের কথায় বাঘে মইষে একসাথে পানি খায়...
নুর মোহাম্মদ সিগারেটের ফিল্টারটা হাত থেকে ফেলে উঠে দাঁড়ালো। বাড়ি যাওয়া দরকার। জব্বার বাউল পিঠের সঙ্গে রাখা দোতারা সামনে এনে কায়দা করে ধরল। যেন এক মুক্তিযোদ্ধা রাইফেল ধরেছে। নুর মোহাম্মদ পেছন থেকে বাড়ির পথ ধরে শুনতে পেলেন জব্বার বাউল গান ধরেছে :
ওরে রাক্ষুসে মশা তুই করলি বড় দুর্দশা
জীব জানোয়ার সব খাইলি, আর খেতে কি তোর আশা...
নুর মোহাম্মদ পাটখড়ির বেড়া পার হয়ে নিজ বাড়ির উঠোনে ঢুকতেই বজ্রের মত ঠা ঠা শব্দ তুলে স্ত্রী রেহানা ছুটে এল। তার হাতে ছিল একটি আধপোড়া খড়ি। ছুটে আসতে আসতে হাতের খড়িটি ছুড়ে মারল নুর মোহাম্মদের দিকে। চিৎকার করে বলল, অসভ্য লোক কোথাকার! লম্পট!
নুর মোহাম্মদ হতভম্ব হয়ে হাসি হাসি মুখ করলেন। রুদ্রমূর্তি নিয়ে প্রায় কাছে চলে আসা স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললেন, কী হইছে, কী ব্যাপার?
ব্যাপার কিছু জানেন না! কিছু জানেন না!
কী জানব?
স্ত্রী রেহানা হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, স্কুলের মেয়ের সঙ্গে কী করছেন! আন্ধা কোথাকার! নিজের বউরে ভাত-কাপড় দিতে পারেন না এত বদমায়েশি আসে কথা থিকা?
তখনো নুর মোহাম্মদের কিছু মনে আসছে না। তিনি বললেন, কীসের বদমায়েশি?
বোঝেন না কীসের বদমায়েশি? আমি আব্বারে খবর দিছি। আব্বা আসতেছে। এখনই চইলা যাব!
নুর মোহাম্মদ ঠায় দাঁড়িয়ে রইলেন। তার স্ত্রী একটু সময় নিয়ে তারপর যেন নিজে নিজেই কথা বলছে এমন ভাবে বলল, কত বড় বেলজ্জা লোক! ক্লাস টেনের মেয়ের বুকে হাত দেয়!
নুর মোহাম্মদ কিছু বলার আগেই তাঁর শ্বশুর রব্বানী সাহেব বাড়ির ভেতর উঠোনে ঢুকলেন। লম্বা, একহারা মানুষ। পরনে সাদা পাঞ্জাবি। মুখে সুন্দর করে ছাঁটা দাড়ি। তিনি ছোট করে কাশ দিলেন।
নুর মোহাম্মদ দু পা সামনে এগিয়ে গেলেন। রেহানা তাঁর আগে লাফ দিয়ে চলে এলেন। বললেন, এই খবরদার! আমার আব্বার সঙ্গে কোনো কথা না!
রব্বানী সাহেব হাত উঁচু করে মেয়েকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, নুরু, তুমি আমার সঙ্গে আসো।
নুর মোহাম্মদ তাঁর পেছনে পেছনে উঠোনের পাঠখড়ির বেড়া পার হয়ে বাইরে গেলেন। রব্বানী সাহেব কোনো ভূমিকা না রেখেই বললেন, কথাটি আমার কানেও আসছে। ঘটনা কী?
কোন ঘটনা?
রব্বানী সাহেব বিরক্ত হয়ে বললেন, কী মুশকিল! এই যে তোমার স্কুলে একটি মেয়ে নিয়ে কেলেঙ্কারির ঘটনা।
নুর মোহাম্মদ মোটা কাঁচের ভেতর দিয়ে একবার খোলা আকাশের দিকে দেখতে চেষ্টা করলেন। তারপর ধীরে ধীরে বললেন, কাল দুপুরে হঠাৎ আমার চোখের কোণে কিছু একটা রোদের আলোতে ঝিলিক দিয়ে উঠল। তাকিয়ে দেখি, কয়েক হাত দূরে দাঁড়ানো একটি মেয়ের গলার লকেট। মনে হলো লকেটটিতে সোয়াস্তিকা চিহ্ন। কাছে গিয়ে ভালো করে লকেটটি দেখলাম। তারপর থেকেই...
লকেটে কি স্বোয়াস্তিকা চিহ্ন ছিল?
না, স্বোয়াস্তিকার মতো দেখা গেলেও সেটি স্বোয়াস্তিকা না। দেখে আমি আশ্বস্ত হয়েছিলাম।
স্বোয়াস্তিকা হলে তোমার অসুবিধা কী?
স্বোয়াস্তিকা নাৎসি দলের প্রতীক। ক্লাস টেনের একটি ফুটফুটে মেয়ে, তাও আবার আমারই ছাত্রী, স্বোয়াস্তিকা গলায় নিয়ে ঘুরবে, তা হয় না।
রব্বানী সাহেব বিরক্ত হয়ে উচ্চস্বরে বললেন, তুমি এত বেশি বোঝো কেন! স্বোয়াস্তিকা হলেই বা তোমার কী!
নুর মোহাম্মদ নার্ভাস হয়ে বললেন, জি আব্বা, তাতে আমার কী?
রাতে নুর মোহাম্মদের স্ত্রী রেহানার চোখে মুখে অনুতাপ। দুপুরে কান্নাকাটির কারণে এখনো তার চোখ মুখ ফুলে আছে। রেহানা বলল, আপনি দেইখেন, কোনো সমস্যা হবে না। আমাদের সঙ্গে আল্লাহ আছে। তাছাড়া এতদিন ধরে আপনি চাকরি করতেছেন। কমিটির লোকজন কিছু না শুনেই কি আপনার চাকরি খেয়ে ফেলবে? আপনি তো আর খারাপ চোখে মেয়েটার দিকে তাকান নাই।
নুর মোহাম্মদ কোনো মন্তব্য করলেন না।
রেহানা আবার বলল, তারপরও আমার হাত-পা কাঁপতেছে। আপনার চাকরি গেলে আমরা খাব কী? যাব কোথায়?
রাতভর নুর মোহাম্মদ বিছানায় ছটফট করলেন। শেষ রাতের দিকে তন্দ্রা এল। তিনি স্বপ্ন দেখলেন। মমিনপুর উচ্চবিদ্যালয় দোতলা হয়েছে। স্কুলের সামনে শিক্ষকদের দু-তিনটি সাদা প্রাইভেট কার দাঁড়ানো। ক্লাসের ভেতর প্রত্যেকটি মেয়ে একটি করে ডেস্কে বসে আছে। তাদের সবার সামনে একটি করে ল্যাপটপ। একজন শিক্ষক তাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। তার হাতে একটি ছোট ডিভাইস। তিনি সেটিতে চাপ দিলেই ব্ল্যাকবোর্ডের ছবি পাল্টে যাচ্ছে। শিক্ষকটি উঁচু গলায় বলছেন, তোমরা সবাই আঞ্চলিক ইতিহাসের কিছু নোট নিয়ে নাও। মহান শিক্ষানুরাগী মমিনউদ্দিন জন্মগ্রহণ করেছিলেন ১৯৪১ সালে। দারিদ্রের ভেতর বেড়ে উঠলেও তিনি ছিলেন সমাজের প্রতি নিবেদিত প্রাণ। ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীনের পূর্বেই তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, পাকিস্তানিদের হাত থেকে মুক্তির একমাত্র উপায় শিক্ষাবিস্তার। বিশেষ করে নারী শিক্ষার প্রতি প্রয়োজনীয়তা তিনি মর্মে উপলব্ধি করেছিলেন। তাই তিনি তাঁর সর্বস্ব দিয়ে গ্রামে উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন....
ব্ল্যাকবোর্ডের মতো পর্দাটিতে তখন ফুটে উঠেছে মমিনউদ্দিনের ছবি। ষাটোর্ধ্ব মমিনউদ্দিনের মুখভর্তি দাড়ি। নোট নেয়ার ফাঁকে ফাঁকে ক্লাস টেনের মেয়েগুলো পরম শ্রদ্ধায় অতীতের মহান মানুষটির ছবির দিকে তাকাচ্ছে!
বাংলাদেশ সময় ২১৪০, ডিসেম্বর ২০, ২০১০