বরেণ্য চিত্রশিল্পী এস এম সুলতানের ১৬তম মৃত্যুবার্ষিকী ১০ অক্টোবর। ১৯৯৪ সালের এ দিনে তিনি যশোর সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন।
সমালোচকদের মতে, বাঙালি জাতিসত্তার গভীরতম অন্তরভূমিতে যে অমিত শক্তি সুুপ্ত ছিল হাজার বছর ধরে, তারই নান্দনিক-শৈল্পিক প্রকাশ ঘটেছে সুলতানের চিত্রকলায়। তাই দেখা যায় সুলতানের কৃষক হাড়জিরজিরে-পর্যুদস্ত নয়, বরং পেশিবহুল, সাহসে বলীয়ান ও সংগ্রামী।
১৯২৪ সালের ১০ আগস্ট তৎকালীন মহকুমা শহর নড়াইলের চিত্রা নদীর পাশে মাছিমদিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন শিল্পী এস এম সুলতান। বাবা মোঃ মেছের আলী, মা মাজু বিবি। বাবা-মা আদর করে নাম রেখেছিলেন লাল মিয়া।
লাল মিয়ার শিাজীবন শুরু হয় ১৯২৮ সালে রুপগঞ্জ আশ্রম স্কুলে ভর্তির মাধ্যমে। ১৯৩৩ সালে নড়াইল ভিক্টোরিয়া কলেজিয়েট স্কুলে পঞ্চম শ্রেণীতে পড়াকালে স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যয়ের পুত্র শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় স্কুল পরিদর্শনে আসেন। এ সময় লাল মিয়া তার একটি সুন্দর ছবি আঁকলে তৎকালীন জমিদার ধীরেন্দ্রনাথ রায়সহ সবাই মুগ্ধ হন। শুরু হয় শিল্পী লাল মিয়ার রঙতুলি হাতে নতুন জীবন। শিল্পী হওয়ার বাসনায় লাল মিয়া পাড়ি জমান কলকাতায়। কলকাতার কাশিপুরে নড়াইলের জমিদারদের বাড়িতে থেকে জমিদারপুত্র অরুণ রায়ের সহযোগিতায় কোলকাতার আর্ট কলেজে ভর্তি পরীায় অবতীর্ণ হন। পরীায় প্রথম স্থান লাভ করলেও প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি না থাকায় ভর্তির সুযোগ থেকে বঞ্চিত হন। পরে বিখ্যাত শিল্পসমালোচক শাহেদ সোহরাওয়ার্দীর হস্তেেপ ভর্তি হওয়ার সুযোগ পান তিনি। সোহরাওয়ার্দী সাহেব তার অমায়িক আচরণে মুগ্ধ হয়ে লাল মিয়াকে তার বাসায় থাকার সুযোগ করে দেন। এ সময় শাহেদ সোহরাওয়ার্দীর মা তার নাম রাখেন শেখ মোহাম্মদ সুলতান, যা পরে এস এম সুলতান নামে পরিচিতি লাভ করে।
১৯৪৩ সালে সুলতান খাকসার আন্দোলন নামে একটি সেবামূলক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন। শিাজীবন অসমাপ্ত রেখেই ১৯৪৪ সালে তিনি ভারত ভ্রমণে বেরিয়ে পড়েন। কাশ্মীরের পাহাড়ে কিছুদিন একদল আদিবাসীর সঙ্গে বসবাস করেন। ১৯৪৬ সালে কাশ্মীর থেকে চলে যান সিমলায়, সেখানে তার প্রথম চিত্রপ্রদর্শনী হয়। এই প্রদর্শনীই তার শিল্পী জীবনের প্রথম স্বীকৃতি। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের লাহোরে ও পরে করাচিতে অবস্থান করেন। এ সময় নাগী, চুগতাই, শাকে আলী, শেখ আহম্মেদসহ অনেক প-িত ব্যক্তির সঙ্গে তার পরিচয় ঘটে। সেখান ইউরোপ ও আমেরিকা সফরে বেরিয়ে পড়েন। এরপর ১৯৫৩ সালে দেশে ফিরে আসেন। কিছুদিন ঢাকা আর্ট কলেজের ছাত্রাবাসে অবস্থান করে ফিরে আসেন মাতৃভূমি নড়াইলে। ১৯৫৫ সালে নড়াইলের কালিয়া উপজেলার চাচুড়িÑপুরুলিয়ায় নন্দনকানন স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৫৬ সালে পল্লীকবি জসীমউদদীনের সাথে কয়েক দিন অবস্থান করেন। শিল্পী ১৯৫৮ থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত যশোরের নীলগঞ্জ শশ্মানে মাঝে মাঝে ধ্যান করতেন। ১৯৬০ সালে যশোরের চাঁচড়ার জমিদার বাড়িতে কিছু কাল অবস্থান করেন।
১৯৬৫ সালে সবার অগোচরে আবার তিনি পশ্চিম পাকিস্তানে চলে যান। দু বছর পর ১৯৬৭ সালে নড়াইলের অদূরে এক গ্রামে তাকে খুঁজে পাওয়া যায়। যশোরের তৎকালীন জেলা প্রশাসক এনাম আহম্মেদ চৌধুরী তাকে যশোর নিয়ে আসেন। ১৯৬৮ সালে যশোর-খুলনা কাবে তার একক চিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করেন। জেলা প্রশাসক এনাম আহম্মেদ চৌধুরীর উদ্যোগেই ১৯৬৯ সালের ১০ জুলাই সুলতানের মাছিমদিয়ার বাড়িতে ‘দি ইনস্টিটিউট অব ফাইন আর্টস’ উদ্বোধন করা হয়। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় শিল্পী জেলার বিভিন্ন গ্রামে ঘুরে ঘুরে যুদ্ধের ছবি আঁকেন।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর শিল্পী নিজ শহরে ঘুরে বেড়িয়েছেন এক স্থান থেকে অন্য স্থানে। ১৯৭৬ সালে ঢাকায় শিল্পকলা একাডেমিতে তার একক চিত্রপ্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। মূলত এই প্রদর্শনীর মাধ্যমেই এ দেশের সুশীল সমাজ তাকে নতুনভাবে আবিষ্কার করে।
চিত্রশিল্পী এস এম সুলতান তার ৭০ বছরের বোহেমিয়ান জীবনে তুলির আঁচড়ে মাটির গন্ধমাখা আর ঘামে ভেজা মেহনতি মানুষের সাথে নিজেকে একাকার করে সৃষ্টি করেছেন ‘পাটকাটা’, ‘ধানকাটা’, ‘ধান ঝাড়া’, ‘চর দখল’, ‘মৎস্য শিকার’, ‘গ্রামের দুপুর’, ‘নদী পারাপার’, ‘ধান মাড়াই’, ‘জমিকর্ষণে যাত্রা’, ‘মাছ ধরা’, ‘নদীর ঘাটে’, ‘ধান ভানা’, ‘গুন টানা’, ‘ফসল কাটার ণে’ , ‘শরতের গ্রামীণ জীবন’সহ অনেক বিখ্যাত ছবি।
১৯৫০ সালে ইউরোপ সফরের সময় যৌথ প্রদর্শনীতে তার ছবি সমকালীন বিশ্ববিখ্যাত চিত্রশিল্পী পাবলো পিকাসো, ডুফি, সালভেদর দালি, পল কি, কনেট, মাতিসের ছবির সঙ্গে প্রদর্শিত হয়। সুলতানই একমাত্র এশিয়ান শিল্পী যার ছবি এসব শিল্পীদের ছবির সঙ্গে একত্রে প্রদর্শিত হয়েছে। কালোত্তীর্ণ এই শিল্পী ১৯৮২ সালে একুশে পদক, ১৯৮৪ সালে বাংলাদেশ সরকারের রেসিডেন্স আটিস্ট হিসেবে স্বীকৃতি, ১৯৮৬ সালে চারুশিল্পী সংসদ সম্মাননা এবং ১৯৯৩ সালে স্বাধীনতা পদক লাভ করেন।
এস এম সুলতানের আজীবনের লালিত স্বপ্ন ছিল শিশুদের নিয়ে। নিজের সঞ্চিত অর্থে শহরের মাছিমদিয়া এলাকায় চিত্রা নদীর পাড়ে নিজ বাড়িতে শিশুস্বর্গ নির্মাণ কাজে হাত দেন। নির্মাণ করেন ভাসমান শিশুস্বর্গ নামের একটি নৌকা। শিল্পীর ইচ্ছা ছিল এই নৌকায় করে কোমলমতি শিশুদের সঙ্গে নিয়ে প্রকৃতি দেখবেন। শিশুরা প্রকৃতির সঙ্গে পরিচিত হবেন। প্রকৃতির ছবি আঁকবেন। কিন্তু তার সেই সাধ পূর্ণ হওয়ার আগেই ১৯৯৪ সালের ১০ অক্টোবর মহাপ্রয়াণ ঘটে এই বরেণ্য শিল্পীর।
বাংলাদেশ স্থানীয় সময় ২৩২০, অক্টোবর ০৯, ২০১০