ঢাকা: কলকাতার চিৎপুরে ‘ঘড়িওয়ালা বাড়ি’ নামে বিখ্যাত ছিল মধুসূদন সান্যালের বাড়ি। সেই বাড়ির আঙিনায় মাসিক ৪০ টাকা ভাড়া নিয়ে শুরু হয় ‘ন্যাশনাল থিয়েটার।
কলকাতার নির্দেশক বিভাস চক্রবর্তী তার একটি প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘সেখানে মঞ্চ নির্মিত হয়েছিল। নির্মাণে প্রধান শিল্পী ধর্মদাস সুর, সহায়তায় ক্ষেত্রমোহন গঙ্গোপাধ্যায়, ব্যবস্থাদির দায়িত্বে নগেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। দর্শক আসনের তিনটি শ্রেণি- দুই টাকা, এক টাকা, আট আনা। প্রথম শ্রেণির জন্য ভাড়া করা চেয়ার, দ্বিতীয় শ্রেণির জন্য বাঁশের কাঠামোর ওপর পাটাতন বসিয়ে বেঞ্চ, তৃতীয় শ্রেণির জন্য দালানের সিঁড়ি ও রোয়াক। প্রথম রজনী ছিল ‘হাউসফুল’, টিকিট বিক্রি বাবদ আয় মোট দুইশ' টাকা। ’
সেই থেকে শুরু হলো দর্শনীর বিনিময়ে নাটক দেখতে বাঙালির প্রচেষ্টা। তারপর তো এক লম্বা সময়। বছর পাঁচেক আগেও ঢাকার শিল্পকলা একাডেমি ও মহিলা সমিতির টিকিট ঘরের সামনে দর্শকের ভিড়ভাট্টা ছিল চোখে পড়ার মতো। তবে করোনার পর থেকে টিকিট ঘরের সামনে ভিড় কমতে থাকে। কিন্তু টিকিট ঘরের সামনে ভিড় কমলেও দর্শক সারিতে দর্শকের কিন্তু কমতি নেই।
দেশে মোবাইল ব্যাংকিং চালু হওয়ার পর ২০১৮ সাল থেকে ফোনে ফোনে দুয়েকটি নাটকের টিকিট বিক্রির খবর মিলতে থাকে। আর করোনার পর ঘরে বসে মোবাইল ব্যাংকিংয়েই টিকিট কেনার দিকে ঝুঁকে পড়েন মঞ্চনাটকের দর্শকরা। এখন অবশ্য এ প্রথা বেশ জনপ্রিয়ও হয়ে উঠেছে।
গত ১২ জুন ‘কাউন্টারে কোনো টিকিট রাখতে পারছি না। আমরা আন্তরিকভাবে দুঃখিত। ’ বলে ফেসবুক পেজে ঘোষণা দেয় নাট্যদল তাড়ুয়া। দলের আদম সুরত নাটকের সেই দিনের প্রদর্শনীর সব টিকিট মোবাইল ব্যাংকিংয়ে মাধ্যমে বিক্রি হয়ে গিয়েছিল তাদের। আলী যাকের নতুনের উৎসবে ২৫ জানুয়ারি মঞ্চে আসার পর এ পর্যন্ত নাটকটির আটটি প্রদর্শনী হয়েছে।
নাটকের নির্দেশক বাকার বকুল জানান, এর মধ্যে অন্তত দুটি প্রদর্শনীর টিকিট কাউন্টারে দিতেই পারেননি তারা। বাকি ছয়টি প্রদর্শনীর ৯০ শতাংশের বেশি টিকিট মোবাইল ব্যাংকিংয়ে মাধ্যমে বিক্রি করেছেন। এছাড়া ১০ শতাংশের কম টিকিট কাউন্টারে মিলেছে।
‘আদম সুরত’ ছাড়া শিল্পকলা একাডেমি ও মহিলা সমিতিতে ওই একই মাসে মঞ্চস্থ হয়েছে স্পর্ধার ‘আমি বীরাঙ্গনা বলছি’, হৃৎমঞ্চের ‘রিমান্ড’, বাতিঘরের ‘ভগবান পালিয়ে গেছে’, থিয়েটারওয়ালা রেপার্টরির ‘নাজুক মানুষের সংলাপ’ ইত্যাদি; মে মাসে এসেছে থিয়েটারের নতুন নাটক ‘লাভ লেটারস’। এছাড়া হৃৎমঞ্চের প্রযোজনায় আসাদুজ্জামান নূরের ‘রিমান্ড’ নাটকের টিকিটেরও হয় একই অবস্থা।
১৫ জুন থেকে টানা ১৫ দিনে শিল্পকলা একাডেমির স্টুডিও থিয়েটার হলে ‘আমি বীরাঙ্গনা বলছি’র ২১টি প্রদর্শনী হয়েছে। ২১টি প্রদর্শনীর মধ্যে অন্তত ১১টি প্রদর্শনীর শতভাগ টিকিটই মোবাইল ব্যাংকিংয়ে মাধ্যমে বিক্রি হয়েছে। ফলে সেসব দিনে টিকিট ঘর কার্যত বন্ধই ছিল বলে জানিয়েছে স্পর্ধা: ইনডিপেনডেন্ট থিয়েটার কালেকটিভ।
দর্শক কীভাবে মোবাইল ব্যাংকিংয়ে মাধ্যমে টিকিট কাটেন, তার খানিকটা ধারণা দিলেন স্পর্ধার কর্মী সুস্মিতা খান।
তিনি বলেন, সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেওয়া নির্দিষ্ট নম্বরে যোগাযোগ করে নিজের নাম ও টিকিটের ক্যাটাগরি লিখে পাঠান দর্শক। সেই ক্যাটাগরির টিকিট সহজলভ্য হলে দর্শককে জানানো হয়। এরপর মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে টিকিটের মূল্য পরিশোধ করলে টিকিটটি ‘বুক’ করা হয়; প্রদর্শনীর আগে স্পর্ধার কর্মীদের কাছ থেকে টিকিট সংগ্রহ করেন দর্শক।
আর এভাবে টিকিট কাটার পর দর্শকরা জানান, পরিবার নিয়ে ঢাকার যানজট ঠেলে শিল্পকলায় এসে টিকিট না পেলে সব পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। আর মোবাইল ব্যাংকিংয়ে মাধ্যমে টিকিট কাটলে সময়ও বাঁচে, নিশ্চিতও থাকা যায়।
দর্শকের পাশাপাশি নাট্যদলও টিকিট ঘরে টিকিট বিক্রির ঝামেলা থেকে এখন অনেকটাই মুক্ত।
থিয়েটারের প্রতিষ্ঠাতা রামেন্দু মজুমদার জানান, ‘লাভ লেটারস’ নাটকের ৯০ শতাংশের বেশি টিকিট মোবাইল ব্যাংকিংয়ে মাধ্যমে বিক্রি করেছে থিয়েটার। তার ভাষ্য, প্রযুক্তির মাধ্যমে অগ্রিম টিকিট বিক্রি করে নাট্যদলগুলো আগেভাগেই অর্থ পাচ্ছে, আবার কতজন দর্শক আসবেন, সেটাও আগেভাগেই জানতে পারছেন। ’
মোবাইলে টিকিট কাটার চল আসার আগেও টুকটাক অগ্রিম টিকিট বিক্রি হতো, ঢাকার বেইলি রোডের বিভিন্ন দোকানে বিক্রির জন্য টিকিট রাখা থাকতো, তবে বেচাবিক্রি ছিল সীমিত। দিন শেষে দর্শক প্রদর্শনীর আগেই কাউন্টার থেকে টিকিট কিনতেন বলে জানান রামেন্দু মজুমদার।
ঢাকার মঞ্চে ১৯৭৩ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি বাদল সরকার রচিত নাটক ‘বাকি ইতিহাস’- এর প্রদর্শনীতে প্রথমবারের মতো টিকিট বিক্রি করে নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়। এর পর থেকে নিয়মিতভাবে টিকিট কেটে মঞ্চে নাটক উপভোগ করছেন দর্শক। দেশের মঞ্চনাটক মূলত ঢাকাকেন্দ্রিক। ঢাকার বাইরে চট্টগ্রাম ও সিলেটেও মাঝেমধ্যে নাটকের প্রদর্শনীর খবর মেলে।
বাংলাদেশ সময়: ২২৫৪ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৪, ২০২৩
এইচএমএস/আরআইএস