ঢাকা, শুক্রবার, ১২ পৌষ ১৪৩১, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

লাও ৎসু-র তাও তে চিং

সরকার আমিন | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২২৫৩ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৮, ২০১০
লাও ৎসু-র তাও তে চিং

সম্ভবত খিস্টপূর্ব ষষ্ঠ থেকে পঞ্চম শতাব্দীর কোনও এক সময় দার্শনিক লাও ৎসু জন্মগ্রহণ করেন চীন দেশে। তাঁর নামের মানে ‘বৃদ্ধ-তরুণ’।

লাও-এর একটি মাত্র বইয়ের সন্ধান পাওয়া গেছে। নাম ‘তাও তে চিং’। এতে পাঁচ হাজার চীনা অক্ষর আর একাশিটি অনুচ্ছেদ আছে।

২.
বার্মিংহাম প্রবাসী আমার কবিবন্ধু দেলোয়ার হোসেন মনজু ইংল্যান্ড থেকে প্রকাশিত স্টিফেন মিশেল কৃত TAO TE CHING গ্রন্থটি আমাকে উপহার দেন। চমৎকার কাগজে অপূর্ব অলংকরণে সমৃদ্ধ বইটি বহু দিন আমার মন ও মগজকে একরকম দখল করে রাখে। কবিতাগুলো অনুবাদ করে মনকে খানিকটা মুক্ত করার চেষ্টা করেছি মাত্র।
৩.
তাও এক রহস্যপূর্ণ মতবাদ। একটি আশ্চর্য ধূম্রগন্ধময় জীবনবোধ। ‘উত্তর আধুনিকতা’ বিষয়ক অনেক চিন্তার সাথে তাও এর চিন্তার দুর্দান্ত-রকম মিল আছে। বিশ্ব-প্রতিবিশ্ব, প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য, সত্য-মিথ্যা, সত্তা-অসত্তার সংঘর্ষ দেখতে পাওয়া যায় তাও ভাবনায়। তাও এমন একটি প্রণোদনা যার কোনও বিশেষ ফর্ম নেই, রীতি নেই। একে চিন্তায় নয়, কল্পস্রোতে বা অনুভবে পাওয়া যায়। এ যেন আমাদের লোকজ দর্শনগোত্রের বস্তু, এক মন্থর মারেফাত।

তাও কি ধর্মীয় মতবাদ? হতে পারে আবার নাও পারে । এ মতবাদের উদগাতা বলেছেন ‘তাও ঈশ্বরের চেয়েও প্রবীণ’। যারা ঈশ্বরের চেয়েও পুরাতন সত্য জানতে চান তারা তাও দর্শনে ডুবে যেতে পারেন অনায়াসে।  
উল্লেখ্য, অনূদিত পুরো বইটি বাংলা  একাডেমী থেকে প্রকাশিত হয়েছে। এখানে কিছু নিদর্শন সংকলিত হলো।



তাও কি?

তাও হচ্ছে তা    যাকে শব্দে বাঁধা  যায় না
কখনো হতে পারে নামকরণ
তাতে আসল তাও ধরা পড়ে না

শব্দের মাঝে পাওয়া যায় সীমিতকে
অসীম নামে ধরা দেয় না

যদিবা মুক্ত হও বাসনা থেকে
               তবে রহস্যকে পাবে
যদি পড়ে থাকো বাসনাকে নিয়ে
            কেবলই পাবে প্রকাশ্যকে

রহস্য আর প্রকাশ্য    উৎস তো এক
এই উৎসের নাম অন্ধকার

অন্ধকারের ভেতর অন্ধকার
মূলমন্ত্র   সবকিছুকে বোঝার।



 যখন  শেষ হয় কাজ
 গুরু তা ভুলে যান

লোকেরা যখন কোনও কিছুতে সৌন্দর্য দেখে
অন্যকিছুকে মনে হয় তার দারুণ কুৎসিত
লোকে যখন কোনও কিছুকে ভালো বলে

অন্যকিছুকে তাদের মন্দ মনে হয়

থাকা আর না থাকা একে অন্যকে সৃষ্টি করে
জটিলতা আর সহজতা এক অপরকে সমর্থন করে
হ্রস্ব আর দীর্ঘ তো  একে অপরকে চিহ্নিত করে  
উঁচু এবং নিচু একে অপরকে নির্ভর করে
পূর্ব এবং পর একে অপরকে অনুসরণ করে

গুরু তার কাজ করে যান    কোনও কিছু না করেই
দীক্ষা দেন  তিনি  বাক্য খরচ না করে
যখন কিছু জাগে  তিনি  জাগতে দেন
যখন কিছু অবলুপ্ত হয়   বিলুপ্ত হতে দেন
যা আছে তাকে ত্যাগ করতে তাঁর কোনও দ্বিধা নেই
তিনি প্রত্যাশা ছাড়াই  কাজ করে যান
যখন শেষ হয় তাঁর কাজ       তিনি তা ভুলে যান
এ কারণে বেঁচে থাকে চিরকাল   তাঁর অবদান।




কোন কিছু না করে অনুশীলন করো

যদি মহাপুরুষকে অতিরিক্ত বড় করো
সাধারণ-মানুষ  হয়ে পড়ে অসহায় রকম ছোট
যখন সম্পদের অতিমূল্য প্রচার করো
লোকে তখন তা চুরি করতে প্রলুব্ধ হয়।

দীক্ষা দেন গুরু মানুষকে
মন থেকে মুছে দিয়ে মোহ
অপসারণ করে দিয়ে বাসনা।
শিক্ষা দেন মানুষকে গুরু
কেমন করে সহসা
   সবকিছু থেকে থাকা যায় মুক্ত।

মানুষ তখন দ্বিধাগ্রস্ত হয়  সে বিষয়ে
যে বিষয়ে সে  অতি বেশি নিশ্চিত।

কিছু না, অনুশীলন করো
সবকিছু পাবে।



তাও ঈশ্বরের চেয়েও প্রবীণ

তাও যেন এক ঝরনা।
সতত দানশীল, কখনো ফুরায় না।
তাও যেন অনন্ত শূন্যতা
ভরে আছে  অসীম সম্ভাবনায়।

অদৃশ্য তাও   সদা জাগ্রত
জানিনা কে এর জন্মদাতা

তাও ঈশ্বরের চেয়েও প্রবীণ।


থেমে যাও কেন্দ্রবিন্দুতে

তাও জন্ম দেয় ভালো আর মন্দ
সে কোনও পক্ষ নেয় না ।
গুরুরও কোনও  পক্ষ নেই
তিনি সন্ত এবং পাপীকে একসাথে স্বাগত জানান।

তাও যেন  উপত্যকা
এক বিরল শূন্যতা
যত বেশি  গ্রহণ করবে, বেড়ে যাবে ততই
বাচাল হবে যতটা বেশি
তত বেশি কম পাবে তাকে।

অতএব, কেন্দ্রে এসে মৃদুবাক হয়ে যাও তুমি।


তাও আছে হৃদয়ে তোমার

তাও এক মহান মা।
শূন্যতাময় সুষমা
জন্ম দেয় অনন্ত পৃথিবী।

তাও আছে নিশ্চয়, সবসময়, হৃদয়ে তোমার
গ্রহণ করো একে যখন যেমন যতটা প্রয়োজন।


তাও সবকিছু থেকে মুক্ত

তাও অসীম অনন্ত।
কেন?
কারণ সে  গ্রহণ করেনি জন্ম
সুতরাং মৃত্যু নেই তার।
কেন সে অসীম?
তার নেই কোনও নিজস্ব বাসনা।
সে সবার মাঝে করে বসবাস।

গুরু আছেন তাই তো আছে তাও
তাও মুক্ত সবকিছু থেকে
সে থাকে সবকিছুর মাঝে
আর লুকাতে পারে নিজেই নিজের ভেতর।

তাও  এক অনন্য পূর্ণতা।


ভালো হচ্ছে জলের মতো

সার্বভৌম ভালো  যেন জল
জলের মতো সে কাজে লাগে সকলের
মানুষ ঘৃণা করে নিচুভূমির জল
তাও যেন ভূমিনিম্ন জল।

বাস করো স্থলের নিকটে
চিন্তা করো সারল্যের সাথে
সংঘাতে থাকো যতোটা সম্ভব সৎ
শাসন করো  নিয়ন্ত্রণ ছাড়াই
যে কাজে পাও আনন্দ তা করো সংকোচবিহীন
পরিবারজীবনে সবসময় উপস্থিত থাকো

যখন থাকবে যথেষ্ট সরল
ভুলেও করবে না তুলনা
কখনো হবে না কারো প্রতিদ্বন্দ্বী

দেখবে সবাই তোমাকে ভালোবাসে সবচে বেশি।



যদি পাত্র ভরে যায় বেশি

যদি পাত্র ভরে যায় বেশি
              চুঁইয়ে পড়বে
যদি বড় বেশি ধার দিতে থাকো ছুরি
 দেখা যাবে হয়ে গেছে ভোঁতা।

অর্থ আর নিরাপত্তার জন্য যদি বেশি বেশি পাগল হও
দেখবে তোমার হৃদয়টিকে খুঁজেও পাওয়া যাচ্ছে না।
যদি গ্রাস করে জনরুচি
হয়ে যাবে তুমি জনতার ক্রীতদাস।

কাজ করো আর ফিরে আসো
এটাই তো পথ সবকিছুকে পাবার।


১০
বড় গুণ

তুমি কি রাখতে পারো মনকে সদা রঞ্জিত
সর্বদাই একনিষ্ঠ সদা স্থির?
সদ্যোজাত শিশুর মতো ধারণ করতে পারো দেহ
পরিচ্ছন্ন রাখতে পারো কি মনোদৃষ্টি
না দেখে কিছুই আলোকিত থেকে?
বাসতে কি পারো ভালো মানুষকে
তোমার ইচ্ছার বোঝা চাপিয়ে না দিয়ে?
জটিলতাকে কি পূর্ণ হবার দিতে পারো সুযোগ?

প্রত্যাশাবিহীন কাজ
নিয়ন্ত্রণবিহীন নেতৃত্ব
অধিকারবিহীন অর্জন
এসবই তো সবচে বড় গুণ।

১১
শূন্যতার ফলাফল

চাকার মাঝে গ্রথিত থাকে স্পোক
বৃত্তের মাঝে শূন্যতা
ফলাফল গতি

মাটির দলা দিয়েই তৈরি হয় পাত্র
এ তৈরি করে শূন্যতা
যা আমাদের প্রয়োজন মেটায়।

ঘর বানাবার জন্যই মসৃণ করা হয় কাঠ
ভেতরে থাকে শূন্যতা
যার ফলাফল গৃহবাস

আমরা সত্তার সঙ্গে লিপ্ত থাকি
যা নেই তাকেই করি ব্যবহার ।

১২
তাঁর হৃদয় যেন খোলা মাঠ

রঙ অন্ধ করে দেয় চোখ
শব্দ নষ্ট করে দেয় কান
গন্ধ শেষ করে দেয় স্বাদ
চিন্তা ক্ষত করে দেয় মন
বাসনা ভ্রষ্ট করে হৃদয়

গুরু পৃথিবীকে সহজ করে দেখেন
সবকিছুকে তিনি স্বীকার করে নেন

তাঁর মহান হৃদয় যেন এক খোলা মাঠ।


১৩
ভারসাম্য

সাফল্য ব্যর্থতার মতোই ভয়াবহ
আশাও ভয়ের মতো।

কী তবে এর মানে ‘সফলতা ব্যর্থতার মতোই ভয়াবহ’?
যতক্ষণ না উন্নতি ততক্ষণ নয় অবনতি।
যখন কেউ দাঁড়ায়  ভর দিয়ে পায়ে
বুঝতে পারে সে ভারসাম্য।

‘আশা ভয়ের মতো’-- কথার কি তবে মানে?
আশা আর ভয় একে অপরের ভূত
যার উৎপত্তি চেতনতা থেকে।
যখন নিজেকে দেখি না
তখন কি  ভয়ডর থাকে?

পৃথিবীকে দেখো  সত্তার ভেতর
ভালোবাসো যা আছে যেমন
ভালোবাসো পৃথিবীকে নিজস্ব রীতিতে

তাহলে বন্ধু হবে সব কিছুর।


১৪
প্রজ্ঞার মর্মশাঁস

তাকাও    দেখা যাবে না
শুনো      কিছুই যাবে না শোনা
পৌঁছাও    কখনো গন্তব্য পাবে না

ওপরে যা      তা নয় উজ্জ্বল
নিচে  যা  সে নয় গাঢ়
এ ফিরে আসে শূন্যতার জগত থেকে
এ অখ-, যার নাম নেই
এ আকারবিহীন আকার
এ ছবিবিহীন ছবি
এ হচ্ছে এক নিবিড় সত্তা, ধারণারও অতীত।

অনুসরণ করো একে, যার কোনও শুরু নেই, সমাপ্তি  নেই

তুমি  হয়তো পারবে না জানতে
      তবে একে পেতে পারো সহজ জীবনে

শুধু বুঝতে চেষ্টা করো কোথা থেকে এসেছো তুমি
এটাই তো  জগত-প্রজ্ঞার মর্মশাঁস।

১৫
যেন পার হচ্ছেন পরিখা  

প্রাচীন গুরুর দিব্যদৃষ্টি ছিলো       ছিলো গভীর ধ্যান
জানতেন তিনি  প্রজ্ঞার সীমা
আমরা তো জানি কেবল তাদের জীবনের
                                   পোশাকি মহিমা।

তারা ছিলেন সতর্ক
যেন পার হচ্ছেন পরিখা  ভাবতেন আছেন শত্রুর এলাকায়
তাঁরা জানতেন সৌজন্যের রীতি
ছিলেন বরফের মতোন রূপান্তরশীল
জানেন বিচ্ছিন্ন হতে   যেন কাঠের টুকরো    
উপত্যকার মতো সম্প্রসারণশীল
      ছিলেন তাঁরা জলের মতো স্বচ্ছ।

তুমি কতোটা ধৈর্য ধরতে জানো
পারবে  কাদামাটিকে শক্ত হবার  দরকারি সময়টুকু দিতে?

তাঁর মনে পূর্ণতার জন্য হাহাকার নেই
গুরু  হাজির সর্বকাজে সবসময়।


১৬
তোমার হৃদয়কেই মনে হবে তাও

শূন্য করে দাও মন
সরিয়ে রাখো বিচিন্তা
হৃদয় তবে খুঁজে পাবে প্রশান্তি।

অশান্তিকে গলা টিপে মেরে ফেলো না
এরও আছে পূর্ণতা পাবার অধিকার।

জগতের বিচ্ছিন্ন সত্তা ফিরে আসে উৎসে
এই ফিরে আসাটাই খাঁটি
এই সত্যটাকে যদি বোঝ তবে কেটে যাবে দ্বিধা

যতই সহজ হবে তুমি     ফিরে পাবে ধৈর্য
যতই নির্মোহ হবে        ফিরে পাবে উপকারী মন
          রাজর্ষী মহার্ঘে দীপ্ত হবে হৃদয় তোমার
 হৃদয়কেই তখন মনে হবে তাও।

জীবন যেভাবে আসে
                         গ্রহণ করো একে সহজ আনন্দে
মৃত্যু যেভাবে  আসুক
                         গ্রহণ করো একে সহজিয়া ছন্দে।
 

 ১৭
 লোকে বলে

গুরুর শাসনে    মানুষ হয় শাসিত
                              নিজের অজান্তে।

  সেই নেতা ভালো    যিনি ভালোবাসা পান
  সেই নেতা মন্দ নয়   লোকে যারে ভয় পায়
  তবে সেই নেতাই খারাপ লোকে যারে ঘৃণা করে।

যদি বিশ্বাস করতে না পারো
দেখবে মানুষ হচ্ছে বিশ্বাসঘাতক।

কথা নয় গুরুজী ভালোবাসেন কাজ।
সফল সমাপ্ত হলে কাজ
লোকে বাহবা কুড়ায় আর বলে
 বাহ এই  কাজ কিন্তু আমরাই করেছি।

১৮
নৈরাজ্য থেকে জন্ম নেয় দেশপ্রেম

বিলুপ্ত হলে বুদ্ধি জন্ম নেয় চালাকি
                    পিছু হটে জ্ঞান
বিনম্র হলে তাও-এ
জন্ম নেয় মহত্ত্ব আর সৌন্দর্য।

সংসারে না থাকলে শান্তি অধঃপাতে যায় সন্তান
তবে দেশ ডুবে গেলে নৈরাজ্যে জন্মায় দেশপ্রেম।

বাংলাদেশ স্থানীয় সময় ২২৩৫, অক্টোবর ২৮, ২০১০

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।