সিন্ধুলিপি, পৃথিবীর ইতিহাসপ্রেমী মানুষের কাছে একটি সমাধান না হওয়া ধাঁধা। যুগের পর যুগ ধরে সিন্ধু সভ্যতার লিপির পাঠোদ্ধারের চেষ্টা চলছে বিশ্বজুড়ে।
এই প্রবন্ধে যুক্তিসহকারে তুলে ধরা হয়েছে, সিন্ধুসভ্যতার সিলমোহরগুলি আসলে ছিল কর বা খাজনা আদায়ের জন্য ব্যবহৃত সিলমোহর, আর সিন্ধুলিপি উৎকীর্ণ করা ক্ষুদ্রায়তন ট্যাবলেটগুলি ছিল খাজনা আদায়ের এবং কিছু বিশেষ পণ্য সংক্রান্ত কারিগরিশিল্প ও বাণিজ্য করার লাইসেন্স বা ছাড়পত্র। ১৯২০-এর দশকে সিন্ধুসভ্যতার বিভিন্ন ঘাঁটি এবং নগরী আবিষ্কার শুরু হওয়ার পর থেকেই মূলত ছোট ছোট পাথরের সিলমোহর এবং ট্যাবলেটে উৎকীর্ণ সিন্ধুলিপির নিদর্শনগুলি পৃথিবীজুড়ে ঐতিহাসিক, ভাষাবিদ, ও লিপিবিদদের ভাবিয়ে তোলে।
সিন্ধুলিপি এখনো পাঠোদ্ধৃত নয়। তবু ব্যঙ্গার্থে একে অনেকে “সর্বোধিক পাঠোদ্ধৃত লিপি” বলে থাকেন। কারণ একশোরও বেশি পাঠোদ্ধারের দাবি করা হয়েছে সিন্ধুলিপি আবিষ্কারের পরবর্তী একশো বছর ধরে। এই পাঠোদ্ধার প্রচেষ্টার বেশিরভাগই সিন্ধুলিপিকে বানান করে পড়ার চেষ্টা করে থাকে এবং লিপিগুলিতে নানান প্রাচীন সনাতন ধর্মের দেবদেবীর নাম, ধর্মীয় বার্তা, অথবা বিভিন্ন বণিকের ও জায়গার নাম লেখা আছে বলে দাবি করে থাকে। এ ধরনের বেশিরভাগ পাঠোদ্ধারের প্রচেষ্টাতেই বিশেষ কোনো প্রমাণ ছাড়াই কোনো একটি প্রাচীন ভাষা, যেমন বৈদিক সংস্কৃত, প্রাচীন তামিল, এমনকি মেসোপটেমিয়ার সুমেরিয়ান ভাষাকেও সিন্ধুলিপির ভাষা হিসেবে ধরে নিয়ে সেই ভাষার নানান মনগড়া শব্দ বানান করে পড়ে ফেলার চেষ্টা করা হয়।
কিন্তু আমি মনে করি, কোনো পাঠোদ্ধার না হওয়া প্রাচীনলিপি পড়ার চেষ্টার প্রথম দুটি ধাপ হলো দুটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের উত্তর খোঁজা। প্রশ্ন-১) লিপিটি কী উপায়ে লেখা হত? যেহেতু প্রাচীন লিপিসমূহ সবসময়ে বর্ণচিহ্ন দিয়ে (alphabetically) বা অক্ষরচিহ্ন (syllabically) সহকারে লেখা হতো না, অনেক ক্ষেত্রেই শব্দচিহ্ন (logograms), অর্থচিহ্ন (sematograms), চিত্রচিহ্ন (pictograms), বা এদের মিশেল সহকারে (যেমন logo-syllabic writing) লেখা হতো, প্রাচীন লিপিদের প্রকৃতি নির্ধারণ তাদের পাঠোদ্ধারের জন্য খুবই জরুরি একটি ধাপ। প্রশ্ন-২) লিপিটি কী ধরনের অর্থ বোঝাতে ব্যবহৃত হতো? যদি কোনো লিপি আলফাবেটিক্যালি বা সিলেবিক্যালি না লেখা হয়, যদি তার মধ্যে বিভিন্ন সাংকেতিক চিহ্ন বা সিম্বলের ব্যবহার থেকে থাকে, তবে সেই লিপির পাঠোদ্ধারের জন্য, তার সিম্বলিজম কী ধরনের বিষয় সংক্রান্ত মানে বোঝাচ্ছে তা বোঝা খুবই প্রয়োজন।
২০১৯ সালে ন্যাচার ডটকমেই প্রকাশিত (doi:10.1057/s41599-019-0274-1, https://www.nature.com/articles/s41599-019-0274-1) আমার আরেকটি প্রবন্ধ এরই মধ্যে এক নম্বর প্রশ্নটির উত্তর দিতে পেরেছে। সিন্ধুলিপি নিদর্শনগুলির (লিপি নিদর্শন বলতে কোনো একটি সিলমোহর, ট্যাবলেট, বা মৃৎপাত্রে পাওয়া ইন্সক্রিপশন বোঝায়, যা কোনো একটি সম্পূর্ণ বার্তা বহন করতে ব্যবহৃত হয়েছিল) কাঠামো এবং লিপি নিদর্শনের ভেতরে লিপিচিহ্নগুলি সাজানোর প্যাটার্নসমূহ বিশ্লেষণ করা এই প্রবন্ধ এরই মধ্যে প্রমাণ করেছে যে সিন্ধুলিপির চিহ্নগুলি আসলে এক একটি শব্দ বা অর্থ বোঝায়, কোনো বর্ণ বা অক্ষর বোঝায় না। এই দাবি অবশ্য অনেক নামী পণ্ডিতের পাঠোদ্ধারের দাবিকে বেশ সমস্যায় ফেলে দেয়।
যেসব পণ্ডিত সিন্ধুলিপিকে কিছুটা বানান করে, আর কিছুটা শব্দচিহ্ন দিয়ে লেখা লোগো-সিলেবিক লিপি বলে মনে করেন, তারা সাধারণতঃ এক একটি লিপি-নিদর্শনের পাশাপাশি বসানো বিভিন্ন চিহ্নগুলিতে আলাদা আলাদা ধ্বনি আরোপিত করে তাদের দিয়ে এক একটা বানান করা শব্দ পড়ার চেষ্টা করেন। যেমন, সিন্ধুসভ্যতার উল্লেখযোগ্য বন্দর-নগরী লোথালের উৎখননের জন্য বিখ্যাত প্রত্নতত্ত্ববিদ এস আর রাও তার ১৯৭৯ সালে প্রকাশিত খনন-রিপোর্টে সিন্ধুলিপিতে প্রাচীন বৈদিক সংস্কৃত ভাষায় লেখা নানান শব্দ পাওয়া গেছে দাবি করেন। তার পাঠোদ্ধারের উপায়টি ছিল বেশ অদ্ভুত এবং অবৈজ্ঞানিক। সিন্ধুলিপির কিছু চিহ্নের সঙ্গে সেমিটিক লিপিদের চিহ্নের মিল আছে এমন দাবি করে রাও কিছু কিছু লিপিচিহ্নে কিছু সেমিটিক বর্ণমালার ধ্বনিকে সরাসরি আরোপিত করেন। তার পর সিন্ধুলিপির বাকি চিত্ররূপ চিহ্নগুলিকে নিজের ইচ্ছেমতন অর্থ আরোপ করে, সেই অর্থসংক্রান্ত কিছু বিশেষ সংস্কৃত শব্দের প্রথমাক্ষরগুলিকে তিনি বেমালুম সেই সব সিন্ধুলিপিচিহ্নের ধ্বনিরূপ হিসেবে নির্ধারিত করেন। যেমন, কিছু পাখির মত দেখতে সিন্ধুলিপিচিহ্নকে দেখে এস আর রাও স্বপ্নাদিষ্টভাবে ঠিক করেন যে সেগুলি শকুন পাখি এবং সংস্কৃত ভাষায় সেই পাখির প্রচলিত নামটির অর্থাৎ শকুন্ত শব্দটির প্রথম কিছু অক্ষর বা ধ্বনিকে, যেমন “শক”, তিনি ওই লিপিচিহ্নগুলির ধ্বনি হিসেবে বেছে নেন। তেমনই অশ্বত্থ পাতার মতো দেখতে একটি সিন্ধুলিপিচিহ্ন সম্পর্কে তিনি সরাসরি দাবি করেন যে, অশ্বত্থ শব্দটির প্রথম কিছু অক্ষর, যেমন ‘অশ’ বা ‘অশ্ব’ ধ্বনিটি ওই লিপিচিহ্নের মাধ্যমে বোঝানো হয়েছে। এস আর রাও-এর এই পাঠপদ্ধতি যে কত স্তরে ভুল তা বলার নয়। এস আর রাও এমন অদ্ভুত পদ্ধতিতে বানান করে করে অসংখ্য সিন্ধুলিপি নিদর্শন পড়ে ফেলার দাবি করেছিলেন। যেমন সিন্ধুলিপি চিহ্ন ,, এবং কে তিনি যথাক্রমে “শ”, “পক” এবং “আ” ধ্বনির চিহ্ন হিসেবে নির্ধারিত করে একটি সিলমোহরের চিহ্নাবলি কে বেমালুম পড়ে ফেললেন সংস্কৃত বাক্যাংশ “শ-পকা” বা “শা-পাক”, এবং তার সংস্কৃত মানে ধার্য করলেন “শক্তিশালী অভিভাবকের থেকে” বা “ভীষণ সৎ ব্যক্তির থেকে”। দুর্ভাগ্যক্রমে এস আর রাওয়ের মতো মহাপণ্ডিত প্রত্নতত্ত্ববিদ, যার ভারতীয় উপমহাদেশের প্রত্নতত্ত্বে অপরিসীম অবদান, তিনিও এমন সব মনগড়া অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে করা পাঠোদ্ধারের দাবি লিখে গিয়েছেন।
ঠিক তেমনই, যারা দ্রাবিড়ীয় ভাষার পণ্ডিত, তারাও অনেকে নানান অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে সিন্ধুলিপির নিদর্শনগুলিতে বানান করে করে প্রাচীন দ্রাবিড় ভাষাগোষ্ঠীর বিভিন্ন ভাষায় লেখা, যেমন প্রাচীন তামিলে লেখা নানান শব্দের খোঁজ করেছেন। মজার কথা এই যে, সিন্ধুলিপি যে বানান করে লেখাই নয়, আমার প্রথম প্রবন্ধের এই প্রমাণিত সত্যটি সেসব স্বপ্নাদিষ্ট বানান করে করে পড়া পাঠোদ্ধারের ভিত সমূলে নাড়িয়ে দেয়। যাতে প্রমাণ হয় যে, সিন্ধুলিপির বিভিন্ন চিহ্নগুলি বেশিরভাগই অর্থ-চিহ্ন বা sematogram। বিভিন্ন প্রাচীন প্রোটো-রাইটিং সিস্টেমে এই জাতীয় চিহ্নের বহুল ব্যবহার দেখা যায়। কোনো একটি বস্তুর মতো দেখতে চিহ্ন সেই বস্তুটিকেই সরাসরি বোঝাতে পারে। যেমন একটি ক্রাউন বা মুকুটের মতো চিহ্ন দিয়ে আমরা সরাসরি মুকুট বস্তুটিকেই বোঝাতে পারি। আবার অনেক ক্ষেত্রে প্রাচীন লিপিসমূহ মিটোনিমি (metonymy) পদ্ধতিতে বিভিন্ন অর্থকে এনকোড করে। মিটোনিমিকে সহজ উদাহরণের মাধ্যমে বোঝাতে হলে, আমরা অনেক সময়ে একটি বিশেষ সিম্বলের সঙ্গে এক ধরনের অর্থকে সংযুক্ত করি। যেমন মুকুটের চিহ্ন এঁকে আমরা অনেক ক্ষেত্রে শাসক বা রাজাকে বোঝাই। এভাবে কোনো বিষয়কে বোঝাতে সেই বিষয়ের সঙ্গে সম্পর্কিত কোনো বস্তুর চিহ্ন প্রয়োগ করার নাম metonym. এই জাতীয় চিহ্নগুলি অনেক সময়েই কোনো বিশেষ ভাষার সঙ্গে যুক্ত নয়। তবে মিটোনিমির এরূপ ব্যবহার অনেক সময়েই বিশেষ বিশেষ সংস্কৃতি ও স্থান-কাল-পাত্রের ওপর নির্ভরশীল। যেমন ‘হোয়াইট হাউস’ বলতে আজকের আধুনিক পৃথিবীতে সাধারণতঃ আমেরিকার সরকারকে বোঝায়। কিন্তু স্থান-কাল-পাত্র অনুযায়ী অন্য কোনো সময়কালে, পৃথিবীর অন্য কোনো অংশে ‘হোয়াইট হাউস’ শব্দবন্ধটি এবং তার সংশ্লিষ্ট কোনো চিহ্ন অন্য কোনো অর্থ বয়ে নিয়ে আসতে পারে। আবার অনেকক্ষেত্রে কোনো একটি ভাষায় ব্যবহৃত সমধ্বনির ভিন্নার্থক দুটি শব্দকে ব্যবহার করে প্রাচীন লিপিসমূহে কোনো একটি মানেকে বোঝানো হতো। যেমন নদীর তীর আর বাণ ধরনের অস্ত্র তীর সমধ্বনির দুটি ভিন্নার্থক শব্দ। এবার নদীর তীর বোঝাতে যদি আমরা কোনো চিত্রচিহ্নকে ব্যবহার করতে চাই, তবে সেই চিত্রচিহ্ন বেশ জটিল হয়ে উঠতে পারে। তাই তার জায়গায় একটি বিশেষ ধরনের তীর বা বাণের ছবিকে যদি ব্যবহার করা হয়, তবে সেই শব্দচিহ্নের মাধ্যমে নদীর তীরও বোঝানো যেতে পারে। এই ধরনের homonym-র প্রয়োগ যদি কোনো লিপিচিহ্নে করা হয়, তবে সেই লিপিচিহ্নগুলি একটি বিশেষ ভাষার সঙ্গে সম্পর্কিত লোগোগ্রাম বা শব্দচিহ্ন হয়ে ওঠে, ভাষা নির্বিশেষে ব্যবহৃত অর্থচিহ্ন থাকে না। আমি মনে করি, সিন্ধুলিপি এই রকম মিটোনিমি সংক্রান্ত অর্থচিহ্ন এবং হোমোনিমি সংক্রান্ত কিছু শব্দচিহ্নের মাধ্যমে লেখা ছিল।
এখন যেহেতু সিন্ধুলিপি বানান করে লেখা নয়, সেহেতু এটি বিভিন্ন বণিক বা শাসকের নাম বা বিভিন্ন জায়গার নাম খোদাই করতেও অপারগ। সিন্ধুলিপিতে কিছু বস্তুর নাম বা বিষয়ের নাম সংক্রান্ত সাধারণ বিশেষ্য বা common noun লেখা থাকতো, proper nouns লেখা থাকতো না। এখন কোন সিন্ধুলিপিচিহ্ন কোন অর্থ বোঝাতে ব্যবহৃত হত তা বোঝার উপায় কী? আমি মনে করি, সিন্ধুলিপির পাঠোদ্ধারের একটি মূল উপায় হল সিন্ধুলিপিতে কী ধরনের অর্থ বোঝানো হতো তা নির্ধারণ করা, এবং প্রাচীন সভ্যতাসমূহে, বিশেষ করে প্রাচীন ভারতীয় উপমহাদেশে, এইসব অর্থ বোঝাতে কী ধরনের সিম্বলিজম ব্যবহৃত হতো তা খুঁজে সেই ভিত্তিতে লিপিচিহ্নগুলির চিত্ররূপগুলি ও লিপিনিদর্শনে ব্যবহৃত চিহ্নদের পারস্পরিক প্যাটার্নগুলি বিশ্লেষণ করা। বিভিন্ন লিপি নিদর্শনের আর্কিওলজিক্যাল কনটেক্সট, অর্থাৎ কী ধরনের অঞ্চলে লিপিনিদর্শনটি পাওয়া গেছে এবং সেই সব অঞ্চলে কী ধরনের কাজকর্ম করা হতো, এসব প্রমাণ খতিয়ে দেখে আমার প্রকাশিত প্রবন্ধটি প্রমাণ করেছে যে সিন্ধুলিপিতে মূলতঃ খাজনা আদায় এবং বাণিজ্যিক পারমিট বা ছাড়পত্র সংক্রান্ত নানান তথ্য এবং নিয়ম শব্দচিহ্ন ও অর্থচিহ্নের মাধ্যমে লিখে রাখা হতো। সৈন্ধব সিলমোহরগুলি ছিল প্রাচীন ট্যাক্স স্ট্যাম্প। তাই নগরদ্বারে, এবং নানান কারিগরি শিল্পের অঞ্চলে আর প্রাচীন অফিসবাড়িগুলিতে খাজনা আদায়ে ব্যবহৃত সিন্ধুসভ্যতার বাটখারাদের সঙ্গে প্রায়ই এই সিলমোহরগুলি পাওয়া যেত। কোনো পণ্যবাহী পাত্রকে ভালো করে পরীক্ষা করে, তার মধ্যে কোনো পণ্য আছে, তার জন্য কোন রেটে খাজনা ধার্য করা আছে, আর কত খাজনা দিতে হবে তা হিসেব করে সেই পণ্যের ওপর খাজনা আদায় করে, পণ্যবাহী পাত্র বা merchandise package এর গায়ে নরম মাটির ট্যাগ আটকে সেই ট্যাগের ওপর বিশেষ পণ্যসমূহের খাজনা সংক্রান্ত সিলমোহরের ছাপ দেওয়া হতো। এইবার সেই ছাপে লেখা অর্থচিহ্নগুলি খাজনার নাম, পণ্যের ধরন, খাজনার রেট ইত্যাদি উল্লেখ করতো বলে অন্যান্য চেকপোস্টে, বা নিয়ন্ত্রিত বাজার এলাকায় নিযুক্ত প্রাচীন অফিসারেরা সহজেই দেখে নিতে পারতেন পণ্যবাহী পাত্রটি যথাযথ খাজনা দিয়েছে কি না, অর্থাৎ বার্লি বা গমের জন্য ধার্য রেটে খাজনা দিয়ে ভেতরে লুকিয়ে সোনাদানা পাচার করে দিচ্ছে কি না। মজার কথা এই যে, অনেক হাজার বছর বাদে লেখা কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রেও এমন বাণিজ্যিক সিলমোহরের ব্যবহারের উল্লেখ আছে। সিলমোহর নির্ভর অ্যাডমিনিস্ট্রেশন বেশ কয়েকশো বছর ধরে চালানোর পরে সিন্ধুসভ্যতার অতি বুদ্ধিমান মানুষেরা পাথরের বা পাথর গুঁড়ো করে তৈরি পেস্ট দিয়ে বানানো ছোট ছোট ট্যাবলেটের প্রচল করেন, যাদের সামনের পিঠে সিলমোহরের মত লিপিনিদর্শনই উৎকীর্ণ করা হতো। এইসব ট্যাবলেট ছিল খাজনা আদায় এবং নানান বাণিজ্যিক কাজকর্মের ছাড়পত্র। মজার কথা এই যে ছাড়পত্রগুলির পেছন দিকে অনেক সময় কিছু বিশেষ হিসেবনিকেশের লিপিনিদর্শন লেখা থাকতো ( , , , ) যেখানে অধিকাংশ ক্ষেত্রে দুই, তিন, চারটি দাঁড়ি সহকারে কিছু সংখ্যা এবং আয়তনজনিত মাপজোক বা ভলিউমেট্রিক ইউনিট সংক্রান্ত কিছু পাত্রের মত চিহ্ন লেখা থাকতো। আমার প্রবন্ধে যুক্তিসহকারে তুলে ধরা হয়েছে যে, যেহেতু ট্যাবলেটের সামনের দিকের একই পণ্যসংক্রান্ত এবং বাণিজ্যসংক্রান্ত লিপিনিদর্শন (যেমন ) একাধিক পেছনদিকের মাপজোক সংক্রান্ত লিপিনিদর্শনের সঙ্গে একই সিন্ধুনগরীতে একই সময়কালে ব্যবহৃত হতো, এগুলি খুব সম্ভব কিছু নির্দিষ্ট লাইসেন্স-স্ল্যাব এবং তৎসংক্রান্ত লাইসেন্স-ফি কে বোঝাতো। যেমন আধুনিক বাংলাদেশে ট্রেড লাইসেন্স পেতে গেলে লাইসেন্সের মেয়াদ এবং লাইসেন্সপ্রাপ্ত সংস্থার বার্ষিক আয় অনুসারে একই বাণিজ্য লাইসেন্সের জন্য একাধিক স্ল্যাব নির্ধারিত থাকে খানিকটা সেরকম ব্যাপার আর কী।
এই ধরনের নতুন সব দাবি কীভাবে চিত্রিত করেছি, তা জানতে হলে দীর্ঘ অথচ ছিপছিপে প্রায় আঠারো হাজার শব্দের প্রবন্ধটি পড়ে দেখতে হবে, যার সঙ্গে একটি প্রায় সাত হাজার শব্দের সাপ্লিমেন্টারি ফাইলও রাখা হয়েছে। প্রবন্ধটি যেহেতু পাশের লিংকে https://www.nature.com/articles/s41599-023-02320-7 ক্লিক করে বিনা পয়সায় পড়ে ফেলা যায়, আর দেরি করেন কেন?
আমি মনে করি, সিন্ধুলিপির আংশিক পাঠোদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে এবং সেই সংক্রান্ত একাধিক গবেষণাপত্র ২০২৪ সালেই নানান আন্তর্জাতিক সেমিনারের প্রোসিডিংসের পুস্তকের অংশ হিসেবে বা প্রবন্ধাকারে ছাপা হবে। এ প্রবন্ধটি গবেষকদের ভবিষ্যৎ পাঠোদ্ধার সংক্রান্ত কাজকর্মের ভিত্তিপ্রস্তর হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ একটি ভূমিকা পালন করবে বলে আশা রাখি।
লেখক: ভারতীয় বাঙালি প্রযুক্তিবিদ ও ইতিহাস গবেষক
বাংলাদেশ সময়: ১৩৫২ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০৯, ২০২৪
এইচএ/