ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

ধারাবাহিক উপন্যাস

মানুষখেকোর দ্বীপ | পর্ব-১৪

আলম শাইন | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১৩০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৬, ২০২৪
মানুষখেকোর দ্বীপ | পর্ব-১৪

উদয় ঘোষাল ভয়ে ঠক ঠক করে কাঁপছে। এই বুঝি ধরা পড়ে যাচ্ছে।

দুর্বল শরীর নিয়ে দৌড়ে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। হাঁপরের মতো বুক ওঠানামা করছে। দম ফুরিয়ে আসছে; শ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে। সব কষ্ট হজম করেও উদয় চুপচাপ ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে রইল। ওর দৃষ্টি এখন বনের বাইরে। সামনে নরখাদকের দল দাঁড়িয়ে আছে। বন থেকে বড়জোর ২০-২৫ গজ দূরে। জঙ্গলের ফাঁকফোকর দিয়ে সবকিছু স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। ওরা বনে প্রবেশ না করে সীমানার কাছাকাছি কেন দাঁড়িয়ে আছে, তা এখনো বুঝতে পারছে না উদয়। অথচ ওরা সামনে এগোলোই সে ধরা পড়ে যাবে। কোন দুরভিসন্ধি আছে, কে জানে? নরখাদকেরা দৌড়ে এসে প্রথমে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল। তারপর কেউ একজন ইশারা করতেই ঝোপ—জঙ্গল লক্ষ্য করে কয়েকটা তীর ছুড়ল। শিকারের সাড়াশব্দ না পেয়ে ওরা ধরে নিয়েছে শিকার বনের গহীনে চলে গেছে। তার ওপর আঁধার ঘনিয়ে আসছে, বনে ঢুকলেই বিপদে পড়বে। তাই ওরা সিদ্ধান্ত নিয়েছে ডেরায় ফিরে যাওয়ার। যা করার সকালে এসে করবে। নরখাদকের দল জানে শিকার পালিয়ে যেতে পারবে না দ্বীপ ছেড়ে। আবার জঙ্গলেও বেঁচে থাকতে পারবে না। বেঁচে থাকতে হলে শিকারকে বন থেকে বেরিয়ে আসতেই হবে। মূলত এই ধারণা নিয়েই ওরা ডেরায় ফিরে যাচ্ছে। ওদের বনভীতি সম্পর্কে উদয় ঘোষালের কিছুই জানা নেই। তাই সে বুঝতে পারেনি ফিরে যাওয়ার আসল রহস্যটা।

নরখাদকেরা বনসীমা পেরিয়ে ওদের ডেরা-কুটিরের দিকে রওনা করেছে। এখন কী করবে সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না উদয়। এদিকে ক্রমশ আঁধার ঘনিয়ে আসছে বনে। কয়েক মিনিটের মধ্যেই কিছু একটা করতে না পারলে নিঃসন্দেহে হিংস্র জীবজন্তুর পেটে চলে যাবে। এমতাবস্থায় উদয়ের ইচ্ছে গাছে চড়ার। সেটা সম্ভব নয় গাছ—গাছালির বিশাল পরিধির কারণে। এই বনের গাছগুলো বেশ মোটাসোটা, উঁচু উঁচু। গাছগুলোর পরিধি এতটাই প্রশস্ত যে, দু’জন মানুষের হাত একত্রিত করেও বেড় পাওয়া যাবে না। তাছাড়া সরু গাছ-গাছালি খুব একটা নেইও বনে। এর প্রধান কারণ হচ্ছে, একেকটা গাছের বয়স শত বছরের ঊর্ধ্বে। তাই গাছগুলো অনেক মোটাসোটা হয়েছে পর্যাপ্ত আয়ুষ্কাল পেয়ে। আরেকটা বিষয় হচ্ছে, আজ পর্যন্ত কেউ বনের গাছপালা কেটে নেয়নি। দ্বীপবাসী শুধু ডিঙ্গি বানানোর প্রয়োজনে দুই—চারটা গাছ কেটেছে হয়তোবা। ফলে অনুকূল পরিবেশের কারণে গাছগুলো বর্ধিত হওয়ার যথেষ্ট সুযোগ পেয়েছে। আঁধার ঘনিয়ে না এলে উদয় দুই—একটা সরু গাছ খুঁজে বের করতে পারত ঠিকই। এখন সেই সুযোগ থেকেও বঞ্চিত হয়েছে। হিংস্র প্রাণীদের আক্রমণ ঠেকানোর আর কোনো উপায়ও নেই এই মুহূর্তে।

নিরুপায় হয়ে উদয় ঘোষাল সিদ্ধান্ত নিয়েছে ঝোপের ভেতরে বসেই রাত কাটাবে। এতে যা হওয়ার তাই-ই হবে। এ নিয়ে দুশ্চিন্তা করবে না। তবে বনের আরও গহীনে প্রবেশ করতে পারলে ভালো হতো। কাছাকাছি থাকলে কখন কী ঘটে বলা মুশকিল। উদয়ের ভয় হচ্ছে, যদি নরখাদকের দল আলোজাতীয় কিছু নিয়ে বনে প্রবেশ করে তাহলে নিশ্চিত ধরা পড়ে যাবে। তাই নিরাপদ থাকতে বনের আরও গহীনে যাওয়ার চেষ্টা করছে। এদিকে আঁধার আরও ঘনীভূত হয়ে আসছে। দৃষ্টি শক্তিও হ্রাস পাচ্ছে। ফলে চেষ্টা করেও বেশি দূর হেঁটে যেতে পারেনি উদয় ঘোষাল।

উদয় আশপাশে তাকিয়ে দেখছে সামনে আরও ঘন ঝোপ-জঙ্গলের বিস্তৃতি রয়েছে কি না। ঘন জঙ্গল থাকলে রাত কাটাতে সুবিধা হবে। বিষয়টা মাথায় নিয়ে দ্রুত চারপাশে চোখ বুলাতে লাগল। খুঁজতে খুঁজতে কয়েক গজ দূরে আরেকটা ঝোপের সন্ধান পেলো। এই ঝোপটা ওর কাছে খানিকটা নিরাপদ মনে হলো। তাই দেরি না করে ঝোপের ভেতরে প্রবেশ করল উদয়। বনের গাছ-গাছালির নিচে বসে থাকার চেয়ে ঝোপের ভেতরে বসে থাকলে কিছুটা নিরাপদ থাকবে। হুট করে হিংস্র জানোয়ারের নজরেও পড়বে না। এই চেষ্টায় বেঁচে যেতে পারলে তো ভালোই, না হলে আর করারও কিছু নেই। আজ রাতটা নিরাপদে কাটাতে পারলে সকালে নতুন কৌশলে বাঁচার চেষ্টা করবে।

এই ঝোপটা তত ঘন নয়। তথাপিও সাপখোপের ভয় আছে। আবছা আঁধারে চোখ বুলিয়ে নিশ্চিত হলো কয়েক গজের মধ্যেই সাপখোপ নেই। যতটা পেরেছে হাতড়ে হাতড়ে জায়গাটা সামান্য পরিষ্কার করে নিলো। সুবিধা হচ্ছে, সমস্ত দ্বীপে কাঁকর-বালি মিশ্রিত মাটি। থিক থিকে কর্দমাক্ত মাটি বনে নেই। বনের মাটি কাঁকর-বালি মিশ্রিত হওয়ায় নিচ থেকে তেমন ঠাণ্ডা উঠছে না। বালি মাটিতে বসে থাকায় জামাকাপড়ও ভিজছে না। আরেকটা বিষয় হচ্ছে, হাঁড় কাঁপানো ঠাণ্ডা নেই বনে। জঙ্গলের ভেতরে বসে থাকায় শীতের প্রকোপ থেকে কিছুটা রক্ষাও পাচ্ছে। গায়ের সামান্য ভারী জামাকাপড় দিয়েই মোটামুটি শীত ঠেকাতে পারছে। রাত বাড়লে শীত বাড়ার সম্ভাবনাও আছে। তবে আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে শীতের প্রকোপ বরাবরই কম। ফলে উদয়ের জন্য অনেকটা সুবিধা হচ্ছে।

ঝোপের ভেতর হাত-পা গুটিয়ে বসে আছে উদয় ঘোষাল। আশপাশে জীবজন্তুর আনাগোনা টের পেয়ে ভয়ে শরীরের রোম দাঁড়িয়ে গেছে ওর। প্রাণীগুলো সহজেই মানুষের গায়ের গন্ধ ওদের নাকের সেন্সরে নিতে পারছে না। বোঝা যাচ্ছে ওরা মানুষের গায়ের গন্ধের সঙ্গে পূর্বপরিচিত নয়। পরিচিত হলে কাছাকাছি চলে আসতো এতক্ষণে। অবশ্য বাঘ-হায়েনা-চিতা হলে ঠিকই খুঁজে বের করতে পারত। ভালো কথা হচ্ছে, এই বনে ওই ধরনের হিংস্র প্রাণীর বিচরণ নেই। আছে শূকর, শেয়াল এসব। তবে শেয়ালের পালও হিংস্র। মুখোমুখি হলে বিপদ এড়ানো কঠিন। কামড়ে ক্ষত-বিক্ষত করে দেয়। এতসব উদয়ের জানা নেই; যেমন জানা নেই দ্বীপবাসীদের আগুনভীতি ও বনভীতি সম্পর্কে।

নিজকে রক্ষা করার মতো কোনো হাতিয়ার উদয়ের সঙ্গে নেই। বাঁশের লাঠিটাও হাতে নেই। দৌড়াতে গিয়ে লাঠিটা কোন ফাঁকে হাত ফসকে পড়েছে তাও মনে নেই। বাঁচতে হলে দৌড়াতে হবে সামনে, এটাই শুধু তখন মাথায় ছিল উদয়ের। তাতে অবশ্য সে সফলও হয়েছে, পালিয়ে আসতে পেরেছিল ঠিকঠাক মতো। এমতাবস্থায় লাঠিটা থাকলে খুব কাজে দিতো। অন্তত শেয়াল-টেয়াল কাছে এলে তাড়াতে সুবিধা হতো। বনের মাটিতে লাঠি আকৃতির কোনো ডালপালাও নেই, থাকলে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা যেত।

ঝোপের ভেতর কয়েক মিনিট বসতেই মশার উপদ্রব শুরু হলো। চোখের পলকেই ঝাঁকে ঝাঁকে মশা গায়ে বসে রক্ত খেতে লাগল। বন থেকে বেরিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু বেরিয়ে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি নেইও। চারপাশে ঘুটঘুটে আঁধার, পা ফেলাও মুশকিল। ইচ্ছে করলেও এখন বের হওয়ার পথ খুঁজে পাবে না। ভয়ানক এক পরিস্থিতির মুখোমুখি হলো উদয় ঘোষাল।

নিজের প্রতি এখন আর দরদ নেই উদয়ের। বনে রাত কাটানোর ঝুঁকি জানলে সে দৌড়ে পালাতো না। নরখাদকেরা তীর ছুড়ে মেরে ফেললেও ভালো হতো। নিজ থেকেই ধরা দিতে ইচ্ছে করছে এখন। নরখাদকের দল যদি ওকে খুঁজতে আসে, তাহলে জঙ্গল থেকে বেরিয়ে ওদের সামনে দাঁড়াবে। যা ইচ্ছে তাই-ই করুক ওরা।

মশার আক্রমণে দিশেহারা উদয়। পাগল পাগল লাগছে। কী করার আছে, বুঝতে পারছে না। কিছুক্ষণ ভেবেচিন্তে গায়ের মোটা শার্ট খুলে ভেতরের টি-শার্টটা বের করে মুখ মাথায় পেঁচিয়ে জামাটা আবার পরে ফেলল। তারপর পায়ের পাতার উপর কাঁকর-বালি টেনে দিল। কিছু কাজে দিয়েছে বুদ্ধিটা। মশা গুনগুন করলেও আগের মতো কামড়াতে পারছে না। কিছুটা স্বস্তি মিলছে এবার।

এদিকে ক্ষুধা-তৃষ্ণায় কাহিল হয়ে পড়েছে উদয়। শরীর ভীষণ দুর্বল। ক্লান্তিতে চোখ বুজে আসছে। এরই মধ্যে ধীরে ধীরে বনপ্রান্তর ফর্সা হতে লাগল। গাছ-গাছালির ফাঁকফোকর গলে জ্যোৎস্নার আলোকরশ্মি ক্ষীর রসের মতো চুঁইয়ে পড়ল বনপ্রান্তরে। সেই ক্ষীণ আলোকরশ্মি বনের আঁধার কাটাতে পারেনি, ঘন ঝোপ-জঙ্গলের বিস্তৃতির কারণে। তবে আগের চেয়ে খানিকটা ফর্সা চারপাশ। এখন নিজের হাত-পা আবছা আবছা দেখছে। আশপাশ ঘেঁষে জীবজন্তুরা হাঁটাচলা করলে কিছুটা হলেও নজরে পড়বে। মনে খানিকটা সাহস এসেছে। সিদ্ধান্ত নিয়েছে রাতটা জেগে কাটাবে, ঘুমাবে না। সিদ্ধান্ত মোতাবেক কিছুক্ষণ চেষ্টাও করেছে বসে থাকতে। পারেনি চোখ ভেঙে ঘুম আসায়। ঝুমতে ঝুমতে একসময় বনের বালিতেই শুয়ে পড়ল উদয়। তারপর কখন যে, গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ল তা আর টের পায়নি।

মধ্য রাত। কুয়াশায় ঢাকা বনপ্রান্তর। ঝোপের উপর টুপটাপ শিশির ফোটা পড়ছে। মাথার উপর ঘন ঝোপের বিস্তৃতির কারণে উদয়ের শরীরে খুব বেশি শিশির পড়েনি। তবে যতটাই পড়েছে তাতেই জামাকাপড় ভিজে শরীর হিম হয়ে গেছে। এই পরিস্থিতিতে করার কিছু নেইও অবশ্য। তাই সে কুণ্ডলি পাকিয়ে জুবুথুবু হয়ে ঝোপের ভেতর পড়ে রইল।

গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন উদয় ঘোষাল। পায়ের পাতার উপরের বালিকণা সব সরে গেছে। ঠাণ্ডা বেড়ে যাওয়ায় মশার উপদ্রবও কিছুটা কমেছে। নিস্তব্ধতার সুযোগে পা টিপে টিপে উদয়ের দিকে এগিয়ে এলো একটা বিশাল সাইজের নারকেল কাঁকড়া। কোনো ধরনের বাধা না পেয়ে কাঁকড়াটা ওর কাছে চলে এলো কিছুক্ষণের মধ্যেই। ফুট খানেক দূরত্ব বজায় রেখে কাঁকড়াটা থমকে দাঁড়াল।

দ্বীপের অমেরুদণ্ডী প্রাণীদের মধ্যে নারকেল কাঁকড়া সবচেয়ে বেশি ভয়ংকর প্রাণী। ওরা স্বভাবে খুবই লাজুক। দিনের চেয়ে রাতের আঁধারেই বেশি চলাফেরা করে। জীবজন্তুরা যখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন থাকে, ঠিক তখনি ওরা শিকারে বের হয়। ওদের প্রধান শিকার ডাব-নারকেল, শূকর, শেয়াল ইত্যাদি। গাছে উঠে নিজেরাই ডাব-নারকেল পাড়ে। সাঁড়াশি দিয়ে আস্ত নারকেল ফাটিয়ে খায়। এমনকি চুপি চুপি গিয়ে ঘুমন্ত জীবজন্তুর পা কেটে টেনে নিয়ে পালিয়ে যায়। তাতে বিন্দুমাত্রও টের পায় না জীবজন্তুরা। এতটাই সতর্ক হয়ে কাজটা করে নারকেল কাঁকড়ারা। ওদের সাঁড়াশি এতটাই শক্ত মজবুত আর ধারালো যে, নিমেষেই পশুর হাড়গোড় কেটে দুই টুকরো করে ফেলতে পারে।

নারকেল কাঁকড়াটা উদয় ঘোষালের কাছে এসে দাঁড়ালো। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই বুঝতে পেরেছে শিকার নিরাপদ। ওর নাকের সেন্সরে তা ধরাও পড়েছে। ঘ্রাণ শুঁকে নিশ্চিত হয়েছে অপারেশনে নামার সুযোগ এখুনি। ভেবেচিন্তে কাঁকড়াটা নিশ্চিত হলো অপারেশন কোথায় কোন জায়গায় চালানো যায়। মিটিমিটি দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখল পায়ের পাতা ছাড়া শিকারের আর কিছু নজরে পড়ছে না। পায়ের পাতার উপর আগে বালিকণা থাকলেও এখন সব সরে গেছে। পায়ের উপরে মশা ছাড়া আর তেমন কোনো প্রতিবন্ধক নেই। এই সুযোগেই কাঁকড়াটা প্রস্তুতি নিয়ে ফেলল। পায়ের পাতার সামনের দিকে আঙুল বরাবর নিচ দিয়ে সাঁড়াশিটা ঢুকিয়ে দিলো আস্তে করে। পজিশন ঠিকঠাক মতো নেওয়া হয়েছে। এবার সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করে চাপ দিলো সাঁড়াশির দুই প্রান্তর একত্রিত করে। অমনি কটাস করে পায়ের বৃদ্ধা আঙুলসহ মোট তিনটি আঙুল কেটে সাঁড়াশির ফাঁকে আটকে রইল। তা নিয়েই দৌড়ে পালাল নারকেল কাঁকড়াটা। আর অন্য দুটি আঙুল আলগা হয়ে ঝুলে রইল পায়ের পাতার সঙ্গে।

ভীষণ যন্ত্রণায় উদয় ঘোষাল জোরে জোরে চিৎকার দিতে লাগল। মুহূর্তেই ভুলে গেছে সে পালিয়ে আছে। চিৎকারের চোটে বনপ্রান্তরে সেই আওয়াজ ধ্বনি প্রতিধ্বনিত হতে লাগল। চোখে ঘুম লেগে থাকায় উদয় ঘোষাল এখনো বুঝতে পারছে না ওর ডান পায়ের পাতার অগ্রভাগে কী হয়েছে? ব্যথার কারণও নিশ্চিত করতে পারছে না। আবছা আলোতে বেশি কিছু দেখাও যাচ্ছে না যে, নিশ্চিত হবে। শুধু হাতটা পায়ে ঠেকালো ব্যথার জায়গাটা চিহ্নিত করতে। পায়ে হাত রেখেই উদয় ঘোষাল আরও জোরে জোরে চিৎকার দিতে লাগল। এ কি পায়ের আঙুল দুটি আলগা হয়ে ঝুলছে কেন? অন্য তিন আঙুলই বা কোথায়! হাত ভিজে যাচ্ছে! তার মানে পা থেকে রক্ত ঝরছে! কীভাবে কী হলো কিছুই বুঝতে পারছে না উদয় ঘোষাল। আশেপাশে কোনো জীবজন্তুর ছায়াও দেখা যাচ্ছে না। কীভাবে পায়ের আঙুল কাটা পড়ল বুঝতে পারছে না! ভেবেচিন্তে নিশ্চিত হলো হিংস্র প্রাণীর আক্রমণের শিকার হয়েছে সে। জোরে জোরে চিৎকার দেওয়ায় প্রাণীটা শুধু পায়ের আঙুল কামড়ে পালিয়েছে। বুঝতে পেরেছে বড় ধরনের হিংস্র প্রাণী নয়; শেয়াল—টেয়ালের কাজ এটা।

রক্ত ঝরছে প্রচুর। হাত দিয়ে চেপে ধরেও রক্তপাত বন্ধ করতে পারছে না। তার ওপর স্পষ্ট কিছু দেখতে পাচ্ছে না। সকাল না হলে ভালোভাবে দেখার সম্ভাবনাও নেই। তবে অনুমান করছে প্রচণ্ডবেগে রক্ত ঝরছে।

রক্ত থামছে না। থামানোর মতো কোনো ব্যবস্থাও নিতে পারছে না। এই মুহূর্তে দরকার ডাক্তারের শরণাপন্ন হওয়া, না হলে যেকোন সময় বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। অবস্থা বেগতিক দেখে ভয়ে থরথর করে কাঁপতে লাগল উদয়। এই বুঝি সব শেষ হয়ে যাচ্ছে। মহাদুর্যোগ থেকে বেঁচে গেলো, মরতে মরতে বেঁচে ফিরে এলো নরখাদকদের কবল থেকে। শেষমেষ প্রাণ হারাতে হচ্ছে বুঝি জীবজন্তুর কবলে পড়ে। তবে কি বিধাতা তার জীবন চক্রটা এভাবেই নির্ধারণ করে রেখেছেন!

বিপদ থেকে উদ্ধার পেতে উদয় ঘোষালের কিছু করার নেইও এখন। পায়ের সামনের অংশ ঠেঁসে ধরে বসে আছে সে। কিছুসময় অতিবাহিত হতেই কাটা জায়গা থেকে উদয়ের হাতটা সরে গেছে। ধীরে ধীরে শরীর নিস্তেজ হয়ে আসছে। আর ঠিক থাকতে পারেনি, বসা থেকে কাত হয়ে পড়েছে। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের ফলে বোধশক্তিও হারিয়ে ফেলেছে। এদিকে ধীরে ধীরে ভোর হয়ে আসছে। বনভূমি কিছুটা ফর্সা এখন। সেই সুবাদে কাটা আঙুলগুলো দেখার চেষ্টা করল উদয় ঘোষাল। চেষ্টা করেও স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে না কিছুই, সব যেন ঝাপসা দেখছে এখন। চলবে...

মানুষখেকোর দ্বীপ। পর্ব-২
মানুষখেকোর দ্বীপ। পর্ব-৩
মানুষখেকোর দ্বীপ। পর্ব-৪
মানুষখেকোর দ্বীপ। পর্ব-৫
মানুষখেকোর দ্বীপ | পর্ব-৬
মানুষখেকোর দ্বীপ | পর্ব-৭
মানুষখেকোর দ্বীপ | পর্ব-৮
মানুষখেকোর দ্বীপ | পর্ব-৯
মানুষখেকোর দ্বীপ | পর্ব-১০
মানুষখেকোর দ্বীপ | পর্ব-১১

মানুষখেকোর দ্বীপ | পর্ব-১২
মানুষখেকোর দ্বীপ | পর্ব-১৩

আলম শাইন: কথাসাহিত্যিক, পরিবেশ ও জলবায়ুবিষয়ক কলামিস্ট

বাংলাদেশ সময়: ০৭২৯ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৬, ২০২৪
এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।