সমুদ্রের রূপ একেক সময় একেক রকম। মুহূর্তে শান্ত; মুহূর্তেই উত্তাল।
বিপদের মুখোমুখি হয়ে মোবাশ্বের আলী থর থর করে কেঁপেছেন কয়েকবার। চালকের ওপর ভীষণ চটেছেন তিনি। চালকের অসর্তকতার জন্য তিনি কড়া হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। মোবাশ্বের আলী বলেছেন, ‘ঝুঁকি নিয়ে বোট চালানোর কোনো দরকার নেই। সমস্যা হলে যেকোন ফিশিং বোটের সঙ্গে নোঙর করে রাখবে। ’ সাগরে মাছ ধরার অজস্র বোট আছে, কোনো একটার সঙ্গে বেঁধে রাখলে কেউ আপত্তিও করবে না। চালক কথা শোনেনি, প্রতিকূলতার মধ্যেও বোটের গতি কমানোর চেষ্টা করেনি। ফলে বারবার বিপদে পড়তে হচ্ছিল। এভাবে কয়েকবার বিপদের মুখোমুখিও হয়েছে বোট। লাইফ বোট না হয়ে সাধারণ কোনো বোট হলে নির্ঘাৎ সাগরে ডুবে যেত। আশার কথা হচ্ছে, এই বোট সাধারণ অন্যসব বোটের মতো নয়। মূলত এগুলো হচ্ছে বড় বড় জাহাজের ‘লাইফ বোট’। বাইরের দেশের পরিত্যক্ত জাহাজ থেকে কেনা। বাংলাদেশের ডক ইয়ার্ডে জাহাজ কাটতে আনলে, কতৃর্পক্ষ ভালো মানের লাইফ বোটগুলো কমদামে বিক্রি করে দেয়। তখন স্থানীয়রা সেগুলো কিনে পর্যটন অথবা সমুদ্রে মাছ ধরার কাজে ব্যবহার করে। যা কক্সবাজার, সেন্টমার্টিন, মহেশখালী, সুন্দরবন ও কুয়াকাটা এলাকায় ব্যাপক নজরে পড়ে। বোটগুলো দেখতে রাবার ড্যামের মতো গোলাকার, টেকসইও। তাতে সাগরের প্রতিকূল পরিস্থিতিতে বেশ কাজে দেয়। বোটগুলো সাধারণত দৈর্ঘ্যে ১০-৩০ ফুট পর্যন্ত লম্বা হয়। সুবিধা হচ্ছে, এই বোটের ইঞ্জিন বিকল হলে বা প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়লেও তেমন সমস্যা হয় না, ভেসে থাকতে পারে। ডুবে যাওয়ারও সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। খাদ্যসংকট না থাকলে মোটামুটি নিরাপদে উদ্ধার কাজ চালানো যায় লাইফ বোটে চড়ে। আকারে গোলাকার বিধায় এই বোটের ওপরে বসে থাকার তেমন সুযোগ নেই। ছোট পরিসরের ছাদ থাকলেও তাতে বসা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। সমুদ্রের উত্তাল ঢেউ বোটে আছড়ে পড়লে বসে থাকা কঠিন। তাই সাধারণত কেউ এখানে বসেও না। অথচ এমন একটা ঝুঁকিপূর্ণ জায়গায় মোবাশ্বের আলী আর তিয়াস বসে আছে। চোখে বাইনোকুলার লাগিয়ে সাগর পর্যবেক্ষণ করতে হলে ছাদে বসার বিকল্প নেই। বোটের ভেতরে বসে থাকলে চারপাশে ভালোভাবে তাকানো যায় না। তাই ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও ঠাণ্ডার মধ্যে দু’জন বোটের ছাদে বসে অর্পিতাকে খুঁজছে। উদ্ধারকর্মী তাদের বারবার সতর্ক করেছেন, লাইফ জ্যাকেট ছাড়া যেন কেউ ছাদে না ওঠে। জ্যাকেট ছাড়া ছাদে উঠলে বিপদ অনিবার্য। উত্তাল ঢেউয়ের ধাক্কা সামলানো কঠিন হবে।
উত্তাল ঢেউয়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বোট সাঁ সাঁ গতিতে এগিয়ে চলছে। নির্দিষ্ট গন্তব্য নেই; দূর দক্ষিণে গন্তব্য। যে দিকে অর্পিতা ভেসে গেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে, ঠিক সেই দিকেই ছুটে চলছে বোট। এটা অবশ্য তিয়াসের অনুমান যে, অর্পিতা দক্ষিণে ভেসে গেছে। তবে অনুমানের কারণটা একেবারেই অযৌক্তিক নয়। কারণ সুনামি পরবর্তী স্রোত দক্ষিণে প্রবাহিত হয়েছিল, তিয়াসের সেটা মনেও আছে। তাই তিয়াস ধরে নিয়েছে অর্পিতা দক্ষিণেই ভেসে গেছে। সে নিজেও স্রোতের টানে সেদিকে ভেসে গিয়েছিল। সেই অনুমানের ওপর ভিত্তি করেই বোট সোজা দক্ষিণে নিয়ে যেতে চালককে নির্দেশ দিল তিয়াস। মোবাশ্বের আলী এ ব্যাপারে দ্বিমত করেননি। তিয়াস তাকে বুঝিয়েছে, বিশাল সমুদ্রের চারদিকে একসঙ্গে অর্পিতাকে খোঁজার সুযোগ নেই। স্রোতের টান সুনামি পরবর্তীতে যেদিকে প্রবাহিত হয়েছে সেদিকেই খুঁজতে হবে আগে। তিয়াসের যুক্তির ওপর নির্ভর করে বোট দুই দিন ধরে সাগরের দক্ষিণে অগ্রসর হচ্ছে। দুঃখের বিষয় হলো, রাত-দিন মিলিয়ে ৪৮ ঘণ্টার বেশি সময় ধরে বোট সামনে অগ্রসর হলেও কোনো ভূখণ্ড নজরে পড়েনি। নজরে পড়েনি সাগরের বুকে ভাসমান কোনো দুর্ভাগা জনমানবও। বিপদগ্রস্ত কাউকে দেখলে তাদের উদ্ধার করে হলেও কিছুটা স্বস্তি পেত মোবাশ্বের আলীর টিম। দুই দিনে সেই ধরনের বিপদগ্রস্ত কাউকে দেখা যায়নি; জলযান ছাড়া।
সমুদ্রে চষে বেড়ানো গেলেও বাংলাদেশের জলসীমা পেরুনোর অনুমতি নেই তাদের। তাই দেশের গণ্ডির মধ্যেই চষে বেড়াতে হচ্ছে মোবাশ্বের আলীর টিমকে। বোট একবার বাংলাদেশের জলসীমা অতিক্রম করে ফেলেছিল প্রায়। ভিনদেশি কোস্ট গার্ডের আপত্তির কারণে বোট জলসীমা অতিক্রম করার সুযোগ পায়নি। তিয়াস তাদের সব ঘটনা খুলে বললেও আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের দায় নিতে কেউ রাজি হয়নি। ফলে নিজ দেশের গণ্ডির মধ্যেই অর্পিতাকে খুঁজতে লাগল।
বাংলাদেশের জলসীমার বিস্তৃতিও কম নয়; বিশাল। ছোট্ট একটা বোট নিয়ে সমুদ্রে ঘুরে বেড়ানো যায় সত্যি, তবে সন্ধান করা বলতে যায় বোঝায় সেটা সম্ভব নয়। বিষয়টা এক ধরনের খেয়ালিপনা ছাড়া অন্য কিছু নয়। যা মোবাশ্বের আলীও বুঝতে পারেননি। তখন আবেগে গা ভাসিয়েছেন। আবেগের স্রোতের বেড়াজাল থেকে এখন বেরিয়েও আসতে পারছেন না আর।
মোবাশ্বের আলী চোখে বাইনোকুলার লাগিয়ে সাগরে তাকিয়ে আছেন। যতদূর দৃষ্টি যায়, ততটাই পর্যবেক্ষণ করছেন তিনি। ইতোমধ্যে সবাই বুঝতে পেরেছে অর্পিতাকে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। তারপরেও মোবাশ্বের আলী পাগলের মতো মেয়েকে খুঁজে বেড়াচ্ছেন। অর্পিতা ছাড়া তার আর কোনো সন্তানাদিও নেই। ফলে তার কাছে সমস্ত দুনিয়া এখন অন্ধকারময়। মনে হচ্ছে বেঁচে থাকাটাই অনর্থক। অর্পিতাকে ফিরে পাবে, সেই বিশ্বাসটাও ধীরে ধীরে হারিয়ে ফেলেছেন তিনি। বিশাল আয়তনের জলরাশি, এখানে কোনো মানুষজন খুঁজে বেড়ানো বোকামির সামিল। অনেকটা জলে হারিয়ে যাওয়া আলপিন খুঁজে বেড়ানোর মতো। বিষয়টা বুঝতে পেরেছেন মোবাশ্বের আলীও। এমতাবস্থায় কী করবেন, সেটাই ভাবছেন তিনি। মোবাশ্বের আলী নিশ্চিত অর্পিতা আর বেঁচে নেই। দুই দিন অতিবাহিত হওয়ার পরেও সাগরের বুকে এখন পর্যন্ত কোনো ভূখণ্ড নজরে পড়েনি, তাহলে অর্পিতার দ্বীপে আশ্রয়ের বিষয়টা অলিক কল্পনা ছাড়া আর কিছুই নয়। বিষয়টা নিয়ে যোগবিয়োগ দিয়েছেন মোবাশ্বের আলী। যোগফল মিলাতে না পেরে সেন্টমার্টিন ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তিনি। তিয়াসকেও কথাটা জানিয়েছেন মোবাশ্বের আলী।
তিয়াসও নিশ্চিত হয়েছে অর্পিতাকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। অর্পিতা কোথায় আছে, বেঁচে আছে কি না, সেই বিষয়ে কিছু না জেনেই অনুমানের ওপর খোঁজাখুঁজি করছে। তিয়াসের পরামর্শটা যে সঠিক নয়, সে নিজেও বুঝতে পেরেছে। এখন ফিরে যাওয়ার বিষয়টাও মোবাশ্বের আলীকে জানাতে পারছে না। কারণ তিয়াসের পরামর্শে ইতোমধ্যে তিনি প্রচুর অর্থকড়ি খরচ করে ফেলেছেন। ভুল স্বীকার করে সেন্টমার্টিন ফিরে যেতে বললে তিনি রেগে যেতে পারেন। তাই সিদ্ধান্তটা মোবাশ্বের আলীর কাছ থেকেই আশা করছে তিয়াস।
চোখে বাইনোকুলার ঠেঁসে ধরে দ্বীপ-টিপ কিছু খোঁজার চেষ্টা করছে তিয়াস। এক পলকের জন্যেও বাইনোকুলার থেকে চোখ সরায়নি। আশার প্রদীপ প্রজ্জ্বলনের অপেক্ষায় দূর সমুদ্রে তাকিয়ে আছে।
দুইদিন অতিবাহিত হতেই মোবাশ্বের আলীও বুঝতে পেরেছে বিষয়টা খেয়ালিপনা ছাড়া আর কিছুই নয়। তিয়াসের অপরিপক্ক বুদ্ধি তার মতো একজন বয়স্ক মানুষের বিবেচনায় নেওয়া ঠিক হয়নি। কাজটা একেবারেই ছেলেমানুষি কাজ। তখন আবেগের টানে এসেছে ঠিকই, এখন নির্বুদ্ধিতার কাজ মনে হচ্ছে। ব্যাপারটা বুঝতে পেরে মোবাশ্বের আলী বোট চালকের কাছে জানতে চাইলেন, ‘বর্তমানে বোট সেন্টমার্টিন থেকে কতদূর আছে বলতে পারবে?’
চালক বলল, ‘সেন্টমার্টিন থ্যাইকা আড়াইশো নটিক্যাল মাইলের মইধ্যে আছি আমরা। ’
‘সেন্টমার্টিন ফিরে যেতে কয়দিন সময় লাগবে আমাদের?’
‘দুইদিন লাগনের কথা। ইঞ্জিন জোরে চালু দিলে আরেট্টু কম সময় লাগবো। আসার সময় বোট ধীরে ধীরে চালইছি। জোরে চালাইলে তো কিছু দেখতেন না। আবার উপরে ঠাণ্ডায় বইতে পারতেন না। হের জইন্য ধীরে ধীরে চালাইছি। ’
মোবাশ্বের আলী বললেন, ‘আমরা আর সামনে অগ্রসর হচ্ছি না। বোট পেছনে ঘুরাও। এখনই সেন্টমার্টিনের উদ্দেশে রওনা করবো। ’
আচমকা মোবাশ্বের আলীর কথা শুনে চালক ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল। কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না চালক। কথা নেই বার্তা নেই হঠাৎ এই সিদ্ধান্ত কেন নিলেন মোবাশ্বের আলী সেটা মাথায় ধরছে না চালকের। তার নিজের ভুলের কারণে মোবাশ্বের আলী রেগে গেছেন কি না সেটাও চালক মনে মনে ভাবছে। সাগরে আরও দুই-একদিন থাকার পক্ষে যুক্তি দিতে চাইল চালক। কিন্তু মোবাশ্বের আলীর মুখের দিকে তাকিয়ে চালক সংযত হয়ে গেল। মোবাশ্বের আলী রেগে আছেন তাও চালক বুঝতে পেরেছে। তারপরেও সাহস নিয়ে বলল, ‘আমাদের সঙ্গে তো সাত দিনের চুক্তি হইছে। দুই-তিন দিনের যাত্রা জানলে তো সাগরে বোট নামাইতাম না। ’
‘এমন পরিস্থিতিতে কি কোন মানুষজনের সন্ধান করা সম্ভব, তুমি বলো?’
‘সেই চিন্তা আগেই করতেন। বোটের মালিক আমার কাছ থ্যাইকা সাত দিনের ভাড়াই আদায় করবো। মালিক এখানকার স্থানীয়, আমি বাইরের জেলা থ্যাইকা আইছি, তাগোর লগে তো জোর-জবরদস্তিতে পারমু না। ’
‘তুমি ভাড়া নিয়ে ভেবো না। এতগুলো টাকা যখন খরচ করেছি, তোমার বাকি ভাড়াও পরিশোধ করতে পারবো। এখন জলদি সেন্টমার্টিন নিয়ে চলো। ’
চালক আস্বস্ত হলো। তাই আর কোনো কথা না বাড়িয়ে সেন্টমার্টিন ফেরার প্রস্তুতি নিলো।
বোট সেন্টমার্টিনগামী। পেছনে ফিরতেই তিয়াসের মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। আর বিন্দুমাত্র আশা নেই প্রিয়জনকে খুঁজে পাওয়ার। চিরদিনের জন্যই অর্পিতাকে সাগরে রেখে চলে যাচ্ছে। খুব কষ্ট পাচ্ছে সে। যে কষ্টের কথা কাউকে তিয়াস বোঝাতেও পারছে না।
মোবাশ্বের আলীর মনও ভালো নেই। তার দুই চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে। কিন্তু করার কিছু নেই, চলে যেতে হবে। অর্পিতাকে খুঁজে পাওয়ার সামান্য সম্ভাবনা থাকলেও তিনি উদ্ধার কাজ চালিয়ে যেতেন। মোবাশ্বের আলী চোখ মুছতে মুছতে তিয়াসের কাঁধে হাত রেখে বললেন, ‘আমার আর করার কিছু নেই, শেষ চেষ্টাও করেছি। মেয়েকে ফিরে পেতে টাকা-পয়সা নিয়েও কৃপণতা করিনি। সবই আমার ভাগ্য। ’
তিয়াস বলল, ‘আঙ্কেল, আপনার জন্য খুব কষ্ট হচ্ছে। মনে হচ্ছে আমি আপনাকে ভুল পরামর্শ দিয়ে উদ্ধার কাজে এনেছি। ক্ষমা করবেন। ’
‘তুমি ক্ষমা চাচ্ছ কেন! আমার মেয়েকে খুঁজে পেতেই তো এতসব আয়োজনের পরামর্শ দিয়েছো। এটা তোমার অপরাধ নয় তিয়াস। যতদিন বেঁচে থাকবো, ততদিন সান্ত্বনা পাবো যে, মেয়েকে আমি সাগরে খুঁজেছি। তুমিও এতদিন আমার সঙ্গে ছিলে, একজন দুঃখী মানুষকে সঙ্গ দিয়েছো। বিষয়টা আমার জন্য কম পাওনা নয়। এতদিন পর উপলব্ধি করেছি মেয়ে উপযুক্ত একটা ছেলেকেই পছন্দ করেছে। এই নিয়ে নিজকে অপরাধী ভেবো না তিয়াস। ’
বোট সেন্টমার্টিনের উদ্দেশে ছুটে চলছে। তিয়াস বোটের ছোট্ট ছাদে বসে বাইনোকুলার চোখে লাগিয়ে সাগরপানে তাকিয়ে আছে। সাগর ছেড়ে চলে যেতে মন চাচ্ছে না ওর। বসে আছে তো আছেই। এদিকে মাঝে মধ্যে উঁচু উঁচু ঢেউ এসে বোটে ধাক্কা মারছে। সেদিকে ওর খেয়ালও নেই। কিন্তু মোবাশ্বের আলী বিষয়টা খেয়াল করেছেন। বুঝতে পেরেছেন বোটের ছাদে বসে থাকা আর নিরাপদ নয়। তাই তিনি গহর আলীকে ছাদে পাঠালেন তিয়াসকে ডেকে আনতে।
গহর আলী ছাদে উঠে তিয়াসকে নিচে নামার তাগিদ দিলো। তিয়াস নিচে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। গহর আলী তার পাশেই দাঁড়ানো। ঠিক তখুনি মাঝারি ধরনের একটা ঢেউ বোটের গায়ে আছড়ে পড়ল। ঝোরে ঝাঁকুনি খেলো বোট। সঙ্গে সঙ্গে গহর আলী পা পিছলে সাগরে ছিটকে পড়ল। হতভম্ভ হয়ে তিয়াস গহর আলীর দিকে তাকিয়ে রইল। কী থেকে কী ঘটে গেলো কিছুই বুঝতে পারছে না সে। গহর আলী চিৎকার দিয়ে হাত-পা ছুঁড়তেই তিয়াসের হুঁশ হলো। দেরি না করে সে দ্রুত নিচে নেমে চালককে ঘটনাটা জানালো। চালক বোটের গতি কমিয়ে দিলো। ততক্ষণে গহর আলী অনেকদূর চলে গেছে। ঢেউয়ের তালে তালে ওঠানামা করছে, আর হাত-পা ছুঁড়ছে। ভাগ্যিস গহর আলীর গায়ে লাইফ জ্যাকেট পরা ছিল। তার ওপরে সে ভালো সাঁতারও জানে। আবার সাগরও তত উত্তাল নয়। তাই ঠাণ্ডা মাথায় পরিস্থিতি মোকাবিলার চেষ্টা করছে। কারণ সে জানে বোট ঘুরে আসবে তাকে উদ্ধার করতে। তাই মনোবল হারায়নি গহর আলী।
বোট ঘুরিয়ে গহর আলীর কাছে নেওয়ার চেষ্টা করছে চালক। প্রতিকূল ঢেউয়ের আঘাতে সামান্য বাধাপ্রাপ্ত হলেও বোট তার কাছে পৌঁছতে বেশি সময় লাগেনি। উদ্ধারকর্মী প্রস্তুত। রিং আকৃতির লাইফ বয়া ছুড়ে দিলো তার দিকে। তারপর উদ্ধারকর্মী সাগরে নেমে গহর আলীকে বোটে তুলে আনলো।
দুর্ঘটনার পর মোবাশ্বের আলী তিয়াসকে ডেকে বলল, ‘তুমি আর উপরে যেও না। আমি চাই না আর কোনো মায়ের বুক খালি হোক, কথাটা মনে রেখো বাবা। ’
তিয়াস আর ছাদে ওঠেনি। বোটের ভেতরে বসেই খাঁচার পাখির মতো চটপট করতে লাগল। বোটের ফাঁকফোকর দিয়ে অর্পিতাকে খোঁজার চেষ্টা করছে সে। মোবাশ্বের আলীও বসে নেই। চালকের পাশে বসে সাগরের দিকে তাকিয়ে রইলেন। এভাবে দু’জন চটপট করতে করতে ফিরতি পথের দুই দিনও পার করলেন।
কষ্টে বুক ফেটে যাচ্ছে তিয়াসের। সময় যত পেরুচ্ছে, ততই ভেঙে পড়ছে সে। হিসেব মোতাবেক আর কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তারা সেন্টমার্টিন পৌঁছে যাবে। সে ভালো করেই জানে কিছুক্ষণের মধ্যেই অর্পিতার সঙ্গে জলে ভাসার সম্পর্কটাও বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। আজীবনের জন্যই সম্পর্ক ছিন্ন হবে। আর চেষ্টা করেও সাগরে ভেসে অর্পিতার খোঁজ নিতে পারবে না। বড় কষ্ট নিয়ে প্রতিটা সেকেন্ড পার করছে তিয়াস।
ইতোমধ্যে বোট ছেঁড়াদ্বীপ অতিক্রম করে ফেলেছে। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই সেন্টমার্টিন জেটি ঘাটে পৌঁছে যাবে সবাই। এদিকে মোবাশ্বের আলী সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, কোনমতে রাতটা সেন্টমার্টিন কাটিয়ে আগামীকাল টেকনাফের উদ্দেশে রওনা করবেন। তারপর রাতের মধ্যেই ঢাকার গাড়ি ধরবেন। তিনি তার সিদ্ধান্তের কথা তিয়াসকে জানালেনও। সব শুনে তিয়াস বলল, ‘আঙ্কেল, আপনারা ঢাকায় ফিরে যান, আমি আর কয়েকটা দিন সেন্টমার্টিন থাকবো। অর্পিতাকে সাগরে ফেলে রেখে গেলে ও আমাকে ক্ষমা করবে না। আমি ওর জন্য অপেক্ষা করবো। ’
মোবাশ্বের আলী বললেন, ‘মেয়েকে ফেলে রেখে আমারও যেতে মন চাইছে না। জানো তো এখন আর করার কিছু নেই। তবে একটা কাজ করবো, বোট থেকে নেমে কোস্ট গার্ডের সঙ্গে দেখা করবো আগে। বিস্তারিত জানিয়ে তাদের অনুরোধ করবো, সম্ভব হলে তারাও যেন অর্পিতার খোঁজ খবর রাখে। বিশেষ করে ভিনদেশি কোস্ট গার্ড যদি কখনো উদ্ধার করে, তাহলে ওকে যেন বাংলাদেশ কোস্ট গার্ডের জিম্মায় নিয়ে আসার চেষ্টা করে। ’
মোবাশ্বের আলীর মুখের ওপর কথা বলার সাহস হয়নি তিয়াসের। তাই সে চুপচাপ বসে দূর সমুদ্রে তাকিয়ে রইল। ততক্ষণে বোট সেন্টমার্টিন জেটি ঘাটে চলে এলো। মোবাশ্বের আলী তিয়াসের মাথায় হাত বুলিয়ে ওকে বুঝিয়ে শুনিয়ে হোটেলে নিয়ে এলেন। চলবে...
মানুষখেকোর দ্বীপ। পর্ব-২
মানুষখেকোর দ্বীপ। পর্ব-৩
মানুষখেকোর দ্বীপ। পর্ব-৪
মানুষখেকোর দ্বীপ। পর্ব-৫
মানুষখেকোর দ্বীপ | পর্ব-৬
মানুষখেকোর দ্বীপ | পর্ব-৭
মানুষখেকোর দ্বীপ | পর্ব-৮
মানুষখেকোর দ্বীপ | পর্ব-৯
মানুষখেকোর দ্বীপ | পর্ব-১০
মানুষখেকোর দ্বীপ | পর্ব-১১
মানুষখেকোর দ্বীপ | পর্ব-১২
মানুষখেকোর দ্বীপ | পর্ব-১৩
আলম শাইন: কথাসাহিত্যিক, পরিবেশ ও জলবায়ুবিষয়ক কলামিস্ট
বাংলাদেশ সময়: ১১০০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৩, ২০২৪
এমজেএফ