রাতের আঁধার ঘনিয়ে আসতেই অর্পিতা দুশ্চিন্তায় পড়ল, বুক ফেটে কান্না আসতে লাগল। রাত যাপনের ব্যবস্থা করতে না পারলে ঘোর বিপদে পড়বে।
সমুদ্রের কিনার থেকে কিছুটা দূরে বসে বালি খুঁড়তে লাগল অর্পিতা। কাছাকাছি থাকলে জোয়ারে ডুবিয়ে দেবে বালিঘর; তাই আগে থেকেই সাবধান হচ্ছে। সৈকত আর বনের মাঝামাঝি জয়গায় রাত কাটানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে। বালি খোঁড়া তেমন কোনো কঠিন কাজ নয়। মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যেই নিজের দেহের সমপরিমাণের একটা গর্ত খুঁড়ে ফেলল অর্পিতা। তারপর প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেওয়ার মতো অন্যান্য কাজকর্ম সেরে গর্তে শুয়ে বালি টেনে দিল নিজের শরীরের ওপর। শুধু মুখ-মাথা বাইরে রেখে সম্পূর্ণ শরীর বালি দিয়ে ঢেকে ফেলল। আর মুখ-মাথায় লাইফ জ্যাকেটটা ভালোভাবে মুড়ে দিল, যাতে কুয়াশায় ভিজে না যায়।
ধীরে ধীরে আঁধার ঘনীভূত হচ্ছে। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সাগরের তর্জন গর্জনও বাড়ছে। মূলত নির্জতার কারণেই রাতের আওয়াজ ভয়ংকর শোনাচ্ছে। জলের ছলাৎ ছলাৎ আওয়াজে প্রকম্পিত হচ্ছে সৈকত। অথচ এই উত্তাল সাগরেই ভেসে রাত কাটিয়েছে অর্পিতা। এখন তো সাগরের জলে পায়ের পাতা চুবাতেও সাহস পাচ্ছে না। দুর্যোগের ঘটনাটা মনে হতেই অর্পিতা শিউরে উঠল। মনে পড়ল পরিবার-পরিজন আর তিয়াসের কথা। তারা কেউ বেঁচে আছে কি না তাও নিশ্চিত নয় সে। আপনজনদের কথা মনে হতেই অর্পিতা হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল। ওর বাঁচতে ইচ্ছে করছে না আর। সমুদ্রের রোষানলে পড়ে এত কঠিন শাস্তি ভোগ করতে হবে জানলে ভুলেও ছেঁড়া দ্বীপে পা রাখত না। তিয়াস সেদিন দ্বীপে আসতে চায়নি। অর্পিতার পিড়াপিড়িতেই বেচারি রাজি হয়েছিল দ্বীপে আসতে। আবার সাগরের জল শুকিয়ে যাচ্ছে দেখেও তলদেশে নামতে রাজি হয়নি তিয়াস। অর্পিতা টিপ্পনি কাটতেই নিচের দিকে নামতে পা বাড়িয়েছিল সে। বিচার বিবেচনায় যতটা উপলব্ধি করেতে পেরেছে তাতে নিজকেই দোষী মনে হচ্ছে অর্পিতার। তিয়াস নির্দোষী, তাই শাস্তিটা অর্পিতার প্রাপ্য হিসেবেই ধরে নিচ্ছে।
এদিকে আঁধার ঘনীভূত হতেই বন থেকে ভেসে আসতে লাগল হিংস্র জীব জানোয়ারের হাঁকডাক। ভয়ে কাঁপছে অর্পিতা। জানোয়ারগুলো সৈকতে চলে এলেই বিপদে পড়বে এটা নিশ্চিত। বালিঘর থেকে টেনে বের করে আনা ওদের পক্ষে অসম্ভব কিছুই নয়। ওরা গন্ধ শুঁকে শুঁকে শিকারের অবস্থান নির্ণয় করতে পারে। অর্পিতার তা ভালো করেই জানা আছে। সেই ধরনের কিছু হলে নিশ্চিত ঘুমন্ত সমাধি ঘটবে। কারণ ওর বালিঘর শক্ত মজবুত কোনো আশ্রয়স্থল নয়। এই ঘরে আশ্রয় নিয়ে ঠাণ্ডা থেকে সামান্য রক্ষা পেলেও জীবজন্তুর কবল থেকে রক্ষা পাওয়া মুশকিল। তারপরেও টিকে থাকতে জোর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সে।
বালিঘরের ভেতর তেমন ঠাণ্ডা নেই। বাইরের তুলনায় কিছুটা কম ঠাণ্ডা; বরং খানিকটা উষ্ণ। সূর্যের উত্তাপে বালি উত্তপ্ত হওয়ায় কিছুটা আরামবোধ করছে। রাত বাড়তে বাড়তে হয়তো ঠাণ্ডাটাও বেড়ে যাবে। বালিগুলো মাটির মতো স্যাঁতসেঁতে নয়। সৈকতের বালিকণা কাঁকর মিশ্রিত হওয়ায় বেশ ঝুরঝুরে থাকে, সহজে ঠাণ্ডাও হয় না।
অর্পিতার খুব ঘুম পাচ্ছে। চোখ বুজে আসছে ঘুমে। সমস্ত দিন কেটেছে অনাহারে, টেনশনে; খুব ক্লান্ত হয়ে পড়েছে এখন। যদিও ডাব খাওয়ায় পিপাসা মিটেছে, পেটও ভরেছে খানিকটা; তবে দুর্বলতা কাটেনি তেমন একটা। পুষ্টিকর খাবার খেতে পারলে হয়তো শরীরটা চাঙ্গা হতো; অবশ্য সেটা দ্বীপে আটকে থাকা পর্যন্ত সম্ভব নয়। যেখানে বেঁচে থাকাটাই চ্যালেঞ্জের, সেখানে খাবারের চিন্তা করাও অবান্তর। এখন ভালোয় ভালোয় ভোরে ঘুম থেকে জেগে উঠতে পারলেই হয়। দেরিতে ঘুম ভাঙলে বিপদে পড়ে যাবে। নরখাদকদের দল সকালে এদিকে এলেই দেখে ফেলবে, কাজেই সতর্ক থাকতে হবে, ঘুম থেকেও জাগতে হবে খুব ভোরে।
নানান বিষয়ে ভাবতে ভাবতে অর্পিতা কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছে তা আর টের পায়নি। গভীর রাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেছে ঠাণ্ডার চোটে। মুখ-মাথা ভিজে গেছে। ঠাণ্ডায় মাথা শির শির করছে, ভারী ভারী লাগছে। অর্পিতা ভাবছে, মাথার চুল তো ভেজার কথা নয়! মাথায় লাইফ জ্যাকেট মুড়িয়ে ঘুমিয়েছে, নিশ্চয়ই ওটা মাথার ওপর থেকে সরে গেছে।
মাথা ভিজে যাওয়ায় অর্পিতা যেমনি হতবাক হলো, তেমনি খুশি হলো আকাশে চাঁদের উপস্থিতি দেখে। বালিঘরে প্রবেশের আগেও সৈকতজুড়ে ছিল ঘুটঘুটে আঁধার। এখন সমস্ত দ্বীপজুড়ে জ্যোৎস্নার মাখামাখি। সৈকত অনেকটাই ফকফকা। তার মানে সে ঘুমিয়ে যাওয়ার পর আকাশে চাঁদ উঠেছে। চারপাশ জ্যোৎস্নায় প্লাবিত হতেই অর্পিতার মনে খানিকটা সাহস এলো। আশপাশে জীবজন্তু বা শত্রুরা চলাফেরা করলে নজরে পড়বে এখন। সমস্যা হচ্ছে, শত্রুদের প্রতিহত করার মতো তেমন কোনো অস্ত্রশস্ত্র সঙ্গে নেই। আছে শুধু ধারালো একটা পাথরখণ্ড। হিংস্র প্রাণীরা কাছাকাছি এলে মাথায় আঘাত করতে পারবে। অথবা নরখাদকদের দুই-একজন কাছে এলেও আত্মরক্ষা করতে পারবে পাথরখণ্ড ছুড়ে। এই পাথরটাই এখন একমাত্র হাতিয়ার।
মাথার কাছে জ্যাকেট না পেয়ে বালির ভেতর থেকে বাম হাতটা বের করে হাতড়ে হাতড়ে খুঁজতে লাগল অর্পিতা। খোঁজাখুঁজি করেও হাতের নাগালের মধ্যে পায়নি ওটা। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল মাথার আশপাশেও নেই। জ্যাকেট ছাড়া ঘুমানো যাবে না। দ্বীপে ঠাণ্ডা কম হলেও প্রচুর কুয়াশা ঝরছে। উপায়ান্তর না দেখে শরীরের কিছু অংশ বালির ভেতর থেকে বের করে ফেলল। তারপর জ্যাকেট খোঁজার চেষ্টা করতে লাগল। কিন্তু চারদিকে প্রখর দৃষ্টিতে তাকিয়েও জ্যাকেটের সন্ধান পায়নি। অর্পিতা চিন্তিত হলো, জ্যাকেট গেল কোথায়? মাথার সঙ্গেই তো পেঁচিয়ে রেখেছে। জোরে বাতাস বইলেও ওটা সরে যাওয়ার কথা নয়। ঘাবড়ে গেল অর্পিতা। বালি সরিয়ে উঠে বসল এবার। আশপাশে কাউকে দেখা যাচ্ছে না। স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল বনের দিকে। যত ভয় এখন বন-জঙ্গল ঘিরেই। চোখের সঙ্গে জ্যোৎস্নার আলোর সমন্বয় ঘটতেই অর্পিতার নজরে পড়লো একটা আলোর প্রতিবিম্ব। বুঝতে পেরেছে সে প্রতিবিম্বটা জ্যাকেটের উপর থেকেই আসছে। বিস্মিত হলো অর্পিতা। ওটা ওখানে গেল কীভাবে! ওটা তো আর নিজে নিজে গড়িয়ে যায়নি, নিশ্চয় ওখানে কেউ নিয়ে গেছে। তাহলে কি কেউ ওকে অনুসরণ করছে? নরখাদকদের তো অনুসরণ করার কথা নয়; অত জ্ঞান বুদ্ধি ওদের নেই। ওরা দেখলে সরাসরি এসে ধরে নিয়ে যাবে, জ্যাকেট কুড়িয়ে নেওয়ার কথা নয়। আবার অশরীরী অথবা জীবজন্তুরাও কাপড়—চোপড় টেনে নেবে না। ঘুমন্ত অবস্থায় দেখলে ওকে মেরে ফেলবে, এটাই তো স্বাভাবিক। কোনো যুক্তি দিয়েই বিষয়টার সমাধান করতে পারেনি। ভয়ে কাঁপছে থরথর করে। কী আছে কপালে কে জানে? অর্পিতা বালিঘর থেকে বের হলো। জ্যাকেটটা কুড়িয়ে আনতে হবে। কিন্তু ওখানে যাওয়ার সাহস পাচ্ছে না। অথচ ওটা খুব বেশি দূরেও নয়, বালিঘর থেকে মাত্র কয়েক গজ দূরে; বনের ওই দিকটায় পড়ে আছে। এখন ওখানে যেতেও পারছে না, ভয়ে হাত-পা কাঁপছে অর্পিতার। বাকি রাত কাটাতে হলে জ্যাকেটের প্রয়োজনও আছে। মাথায় না পেঁচালে চুল ভিজে যাবে; ঘুমাতে পারবে না।
সাত-পাঁচ ভেবে মনে সাহস নিয়ে এক পা দুই পা করে সামনে এগোচ্ছে অর্পিতা। মনে হচ্ছে বন-বাদাড় থেকে ভূতপ্রেত এসে ঘাড় মটকে দেওয়ার চেষ্টা করছে। অথচ খোলা প্রান্তরেই এতক্ষণ ঘুমিয়েছে, এতটা ভয় পায়নি তখন। এখন যেন দুনিয়ার সমস্ত ভয় চেপে ধরেছে। পা চলছে না আর। বুঝতে পেরেছে বাকি রাত কাটানো কঠিনই হবে। সব কিছুর পরেও চিন্তাভাবনা করে দেখল জ্যাকেটটা ওর খুব প্রয়োজন। তাই ভয়-ডর কাটিয়ে একদৌড়ে জ্যাকেটটা হাতে নিয়ে বালিঘরের কাছে এলো। তারপর অর্পিতা আগের মতোই গর্তে শুয়ে শরীরের ওপর বালি টেনে দিল। দু’হাত বাইরে রেখেছে, মাথায় জ্যাকেট পেঁচাতে হবে। কাজটা করতে গিয়েই অর্পিতা আরেকবার ধাক্কা খেলো জ্যাকেটের কাপড় কাটা—ছেঁড়া দেখে। ভাবছে এমন তো হওয়ার কথা নয়! ঘাবড়ে গেল অর্পিতা। বিষয়টা কি হতে পারে বুঝে উঠতে পারছে না সে। চেষ্টা করেও রহস্যের কূলকিনারা করতে না পেরে কাটা—ছেঁড়া জ্যাকেটটাই মাথায় প্যাচিয়ে শুয়ে রইল।
এই ঘটনার পর থেকে আর কিছুতেই ঘুমাতে পারছে না অর্পিতা। ভয় হচ্ছে, শত্রু কোন ফাঁকে এসে আক্রমণ করে বসে। এখন কয়টা বাজে তাও জানতে পারছে না। রাত বাড়ছে, না কি ভোর হচ্ছে, সেটাও উপলব্ধি করতে পারছে না। বালিঘরের ভেতরে শুয়েই থরথর করে কাঁপছে। ভোরের প্রতীক্ষায় প্রহর গুনছে। আকাশ ফর্সা হলে বালিঘর থেকে বেরিয়ে পড়বে; আশ্রয় নেবে বনে। দিনের বেলায় বনের ভেতরেই কাটাতে হবে। ওখানে পালিয়ে থাকা যতটা সহজ, সৈকতে পালিয়ে থাকা ততটা সহজ নয়।
অর্পিতা বুঝতে পেরেছে, দ্বীপে উদ্ধারকারী কেউ আসবে না। কারণ এখনো কেউ জানতে পারেনি দুর্যোগের তাণ্ডবে এই দ্বীপে মানুষজন আটকে পড়েছে। তাছাড়া সভ্য সমাজের লোকজনের যাতায়াতও নেই দ্বীপে। নিশ্চয়ই নরখাদকদের সম্পর্কে কমবেশি ধারণা আছে আশপাশের দ্বীপবাসীর। সেই ভয়েই হয়তোবা কেউ দ্বীপে দুযোর্গের পরেও খোঁজ খবর নিতে আসেনি। অর্পিতা ধরে নিচ্ছে বেঁচে থাকা পর্যন্ত ওকে এই দ্বীপেই কাটাতে হবে। নরখাদকেরা না থাকলে হিংস্র পশুদের চোখ ফাঁকি দিয়ে বেঁচে থাকতে পারতো। খাদ্যের সমস্যাও হতো না, এটা সেটা খেয়ে দিনাতিপাত করতে পারতো। কিন্তু সেটা সম্ভব হচ্ছে না, যেকোন সময় ওদের হাতে ধরা পড়ার সম্ভাবনা আছে। বুঝতে পেরেছে দ্বীপে বেঁচে থাকতে হলে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে। তার ওপর জ্যাকেটের বিষয় নিয়েও শঙ্কিত হয়ে পড়েছে। জ্যাকেটটা নিশ্চয় গড়িয়ে যায়নি ওখানে। কিছু একটা ঘটছে অর্পিতাকে ঘিরে, তা সে টেরও পাচ্ছে। মনে সন্দেহ ঢুকেছে অশরীরীদের কবলে পড়েছে হয়তোবা। অশরীরা মানুষজনকে মেরে ফেলার আগে এভাবেই ভয় দেখিয়ে থাকে, তারপর ঘাড় মটকে দেয়। বিভিন্ন গাল—গল্পে এই ধরনের অনেক ঘটনা পড়েছেও সে। গল্পের কাহিনীগুলো তো আর এমনি এমনি লেখা হয়নি। কিছু না কিছু তো ভিত্তি আছেই। অর্পিতা নিশ্চিত ওকে অশীরীরা নজরবন্দি করে রেখেছে, যেকোন সময় আক্রমণ করবে। বিষয়টা ভাবতেই ভয়ে ওর হাত-পা অবশ হয়ে এলো। চোখের ঘুমও উধাও হয়ে গেল।
আসলে কাজটা যে নারকেল কাঁকড়ার তা অর্পিতার জানা নেই। জানা থাকলে এই হিংস্র প্রাণীদের কবল থেকে রক্ষা পেতে সতর্ক হতো। খোলা প্রান্তরে ঘুমিয়ে রাত কাটানোর সাহস হতো না। অর্পিতার ভাগ্য ভালো কাঁকড়াটা খাবার মনে করেই শুধু জ্যাকেটটা নিয়েই পালিয়েছে। আসলে এই কাঁকড়ারা যেকোন ধরনের রঙিন কাপড় দেখলেই আকৃষ্ট হয়। খাবার মনে করে তা ছিনিয়ে নিয়ে কুটিকুটি করে রাখে। সেরকম মনে করেই অর্পিতার জ্যাকেটটা নিয়ে পালিয়েছে নারকেল কাঁকড়াটা।
এই জ্যাকেট অর্পিতার কাছে মহামূল্যবান একটা সম্পদ। ওকে বাঁচার স্বপ্ন দেখিয়ে দ্বীপ পর্যন্ত নিয়ে এসেছে। আবার কুয়াশা থেকেও এখন সুরক্ষা দিচ্ছে। অর্পিতা সারাদিন জ্যাকেটটা গায়ে জড়িয়ে রেখেছে, কোথাও খুলে রাখেনি হারিয়ে যাওয়ার ভয়ে।
সৈকতে রাতে অসংখ্য নারকেল কাঁকড়া বিচরণ করে। বিশেষ করে নারকেল গাছের নিচে বা আশপাশে বেশি দেখা যায়। অর্পিতার বালিঘর নারকেলতলা থেকে সামান্য দূরে হলেও সে ভীষণ ঝুঁকিতে আছে। এদিকে নারকেল কাঁকড়াদের আনাগোনা অনেক বেশি। রাতে সমস্ত এলাকায় আতিপাতি করে খাবার খুঁজে বেড়ায় অসংখ্য কাঁকড়া।
গভীর রাত। ভয়ে কাঁপছে অর্পিতা। ঘুমানোর চেষ্টা করেও চোখের পাতা জড়ো করতে পারছে না আর। তার ওপর সাগরের বুক থেকে ভেসে আসছে ফোঁস ফোঁস আওয়াজ। বনের গাছ-গাছালির সঙ্গে সংঘর্ষ লেগে সেই আওয়াজের প্রতিধ্বনি সৈকতময় ঘুরছে। যেন এক রহস্যময় আওয়াজ দ্বীপে ভেসে বেড়াচ্ছে। ঠিক তেমনি মুহূর্তে বনের ভেতর থেকে ভয়ানক এক চিৎকার কানে ভেসে এলো। চিৎকারটা কোন জীবজন্তুর নয়; মানুষের গলার আওয়াজ। স্পষ্ট শুনতে পেয়েছে অর্পিতা। আওয়াজটা শুনে বিস্মিত হয়ে গেল সে। শব্দটা ভিনদেশি কোনো ভাষার নয়, বাংলায় উচ্চারিত পুরুষ মানুষের গলার আওয়াজ। এই আওয়াজটা নরখাদকদেরও নয়। ওরা কথা বলতে জানে না। ওদের ঘোৎ ঘোৎ আওয়াজ আর হাসিছাড়া কিছুই শুনেনি অর্পিতা। তবে কি দ্বীপে আরও বাঙালির যাতায়াত আছে? সকালের দেখা আহত লোকটাকে তো ওরা হত্যা করে চিবিয়ে খেয়েছে, তাহলে এই আওয়াজটাই বা কার! ভৌতিক কোনো ব্যাপার-স্যাপার নয় তো! অশরীরীরা দূর থেকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে বিভিন্নভাবে ডেকে বনপ্রান্তরে নেওয়ার চেষ্টা করছে কি না কে জানে। আবার এমনও তো হতে পারে, কোনো মানুষজন বিপদে পড়েছে, সাহায্য চাচ্ছে চিৎকার দিয়ে। যদি তাই হয়ে থাকে, তাহলে লোকটাকে সাহায্য করা উচিত। কিন্তু কীভাবে এই রাত দুপুরে সাহায্য করবে, সেটাও ভাবনার বিষয়। তাছাড়া আওয়াজটা অনেক দূর থেকে ভেসে এসেছে। কারণ বনের ভেতরে চিৎকার দিলে গাছ-গাছালির ফাঁকফোকর দিয়ে আওয়াজ বেরিয়ে আসে। অনেকটা মাইকের আওয়াজের মতো প্রতিধ্বনিত হয়ে কানে ভেসে আসে। সেই আওয়াজ দূর থেকে ভেসে এলেও উৎসস্থল কাছাকাছি মনে হচ্ছে। ব্যাপারটা মরীচিকার মতো। তবে দিনে হলে আওয়াজের উৎসস্থল সন্ধানের চেষ্টা করত অর্পিতা। এতরাতে সন্ধানের বিষয়টা কল্পনাও করা যায় না।
বনের দ্বারপ্রান্তে না গিয়ে অর্পিতা নিজেই চিৎকার দিয়ে জানাতে চায় ওর অবস্থান সম্পর্কে। কিন্তু এতে যদি আবার সমস্যায় পড়ে যায়। শত্রুরা যদি জেনে যায় ওর বালিঘরের সন্ধান, তাহলে তো নিজের জীবন নিয়েই টানাটানি। কাজেই ঝুঁকি নেওয়া ঠিক হবে না। সবকিছু ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিয়েছে আকাশ ফর্সা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিপদগ্রস্ত লোকটাকে খুঁজতে বনে ঢুকবে। তাই ভোরের আলো ফোটার অপেক্ষায় পূব আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল অর্পিতা। চলবে...
মানুষখেকোর দ্বীপ। পর্ব-২
মানুষখেকোর দ্বীপ। পর্ব-৩
মানুষখেকোর দ্বীপ। পর্ব-৪
মানুষখেকোর দ্বীপ। পর্ব-৫
মানুষখেকোর দ্বীপ | পর্ব-৬
মানুষখেকোর দ্বীপ | পর্ব-৭
মানুষখেকোর দ্বীপ | পর্ব-৮
মানুষখেকোর দ্বীপ | পর্ব-৯
মানুষখেকোর দ্বীপ | পর্ব-১০
মানুষখেকোর দ্বীপ | পর্ব-১১
মানুষখেকোর দ্বীপ | পর্ব-১২
মানুষখেকোর দ্বীপ | পর্ব-১৩
মানুষখেকোর দ্বীপ | পর্ব-১৪
মানুষখেকোর দ্বীপ | পর্ব-১৫
আলম শাইন: কথাসাহিত্যিক, পরিবেশ ও জলবায়ুবিষয়ক কলামিস্ট
বাংলাদেশ সময়: ০৯৪৮ ঘণ্টা, মার্চ ১, ২০২৪
এমজেএফ