ঢাকা, শুক্রবার, ৫ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

সময়ের শেকলে পোষ না মানা ফিল্মমেকার ফ্রাঁসোয়া ত্রুফো

মূল গদ্য : হুয়ান কার্লোস গঞ্জালেস এ.<br>অনুবাদ : রুদ্র আরিফ | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩১৪ ঘণ্টা, নভেম্বর ৪, ২০১০
সময়ের শেকলে পোষ না মানা ফিল্মমেকার ফ্রাঁসোয়া ত্রুফো

ত্রুফো নিজেই ছিলেন ফিল্ম একটা
নারীর দরকার ছিলই। বাইসাইকেলে চেপে বাতাসে মিলিয়ে যাওয়া সুন্দরী নারী।

দৃশ্যটি আমরা দেখি। ক্রেডিট লাইন ভাসতে থাকে এ দৃশ্যের উপর। এ হলো ‘দ্য মিসচীফ মেকার্স’ [১৯৫৭]-এর প্রথম ইমেজ। এই নিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো ক্যামেরার পেছনে দাঁড়ালেন এই ফিল্মমেকার। আর ফিল্মি জাদুমন্ত্রে প্রথমবারের মতো বিমোহিত করলেন আমাদের।

এই মেয়েটির উদ্দেশ্যে ভয়েসওভারে ঘোষক বলে তার শৈশবের কথা। স্মরণ করে, ‘বার্নাদঁতে দিয়েছে আমাদের ণিক দেখা স্বপ্ন ও গোপন ফ্যান্টাসিগুলোর ছাপ। আমাদের জাগরণকে করেছে হাজির। আর উস্কে দিয়েছে আমাদের উজ্জ্বল ইন্দ্রিয়সুখকে। ’ এই ফিল্মমেকারের বেলায়ও আমরা একই কথা বলতে পারি। তিনি আবেগী ও সংবেদনশীল, দায়বদ্ধ ও স্বাধীন শিল্পী। তিনি এমনই ফিল্মমেকার, যিনি ফিল্মকে ভালোবাসার চেয়ে বেশি প্রতিনিধিত্বই করে গেছেন। তিনি নিজেই ছিলেন ফিল্ম। তিনি ফ্রাঁসোয়া ত্রুফো।

আমরা ‘সিনেফিলা’য় যাওয়ার আগে, সন্ধির এক না-শোনা ব্যাপার ছিল- ফিল্মের জন্য তৃষ্ণার্ত এই মানুষেরা এক অন্ধকারাচ্ছন্ন সিনেমায় কেবল প্রসন্নতা বাড়াতে পারে। ত্রুফো ছিলেন পাবলিক সেলিব্রেটির পথ, ‘কাহিয়ার দো সিনেমা’ ও ‘আর্টস’ ম্যাগাজিনে ‘বড়দের হাড়জ্বালানো তরুণ’ পরিচয়ের পথ থেকে সরে দাঁড়ানো প্রথম স্ব-শিতি সমালোচক। আন্দ্রে বাজিনের স্নেহে গড়া এক রাস তিনি- যিনি ফিল্ম দেখে, ফিল্মকে ছুঁয়ে ও ফিল্মে দম নিয়ে এর স্রষ্টার সঙ্গে নিজেকে সংক্রামিত করে কড়ায়-গণ্ডায় শিখে নিতেন শিল্প-কৌশল।

এক জীবনের  ক্লোজ-আপ
নাম ফ্রাঁসোয়া রোনাল্ড ত্রুফো। জন্ম ৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৩২, প্যারিসে। মা জ্যানি ডি মনফ্যারান্ড। জন্মদাতার পরিচয় নেই। মা পরে যাকে বিয়ে করেছিলেন, সেই ভদ্রলোক তাকে মেনে নিয়েছিলেন পালকপুত্ররূপে। তার নামই জুড়ে দেওয়া হয়েছে নামের শেষে। কেবল এটুকুই। কুমারী মায়ের লজ্জা ঢাকতে জন্মের পর থেকেই ছেলেটি বড় হচ্ছিলেন কাজের মেয়ের কোলে। অনাত্মীয় এই মানুষের কাছ থেকে তার দায়িত্ব বুঝে নেন মাতৃতুল্য নানী। এরপর নারীর বাড়িতেই বেড়ে উঠেছেন তিনি। কিন্তু নানা ছিলেন ভীষণ কড়া। তার চাপিয়ে দেওয়া কঠিন নিয়ম-কানুনের মধ্যে হাঁসফাঁস করা পিচ্চি ত্রুফোর মনে স্বস্তি এনে দিতো নানীর সাহিত্য ও সঙ্গীতপ্রীতি। নানীই তাকে বইপ্রেমী বানিয়েছিলেন। ফ্রাসোয়াঁর বয়স যখন আট, নানী তখন মারা গেলেন। আর তারপরই প্রথমবারের মতো বাবা-মার সঙ্গী হলেন ত্রুফো।

ফিল্মের সঙ্গে তার সাক্ষাৎ ঘটলো আট বছর বয়সে। ফিল্মের নাম ‘প্যারাডাইস লস্ট’ [১৯৩৯]। ফিল্মমেকার আবেল গ্রেন্স। যখনই একা থাকতেন, তখনই সেটার সুযোগ নিয়ে, স্কুল পালিয়ে, অতি গোপনে ফিল্ম দেখতে যেতেন ত্রুফো। ফলে পর পর বেশ কয়েকটি স্কুল থেকে বহিস্কৃত হলেন। এরপর ঠিক করলেন- প্রাতিষ্ঠানিক পাঠ নেবেন না; হবেন স্বশিতি। বয়স তখন তার চৌদ্দ। স্কুল থেকে তিনি একমাত্র যে জিনিসটা উদ্ধার করতে পেরেছিলেন, সেটা হলো- তার কাসমেট রোবের লাচেনি। পরে তারা বেস্টফ্রেন্ডও হলেন। দিনে তিনটা ফিল্ম দেখার আর সপ্তাহে তিনটা বই পড়ে শেষ করার চেষ্টা করতেন ত্রুফো। অঁরি ল্যাংলুই আবার ‘সিনেমাদিকিউ’ চালু করেছিলেন ১৯৪৪ সালের ডিসেম্বরে। এর ‘ফিল্ম টেকনিসিয়ানস’-এর মিটিংয়ে নিয়মিত ছিলেন ত্রুফো। ১৯৪৮ সালের অক্টোবরে নিজেই একটা ফিল্মক্লাব গড়ে তুললেন। নাম দিলেন, ‘সার্কেল সিনেমা’। মুদির দোকানে কাজ করে যা পেতেন, তা থেকে বাঁচানো টাকাতেই চললো ক্লাব। রবিবারে থিয়েটার ভাড়া নিয়ে ফিল্ম দেখাতেন। প্রথম প্রদর্শনীর খরচ জোগাতে বাবার অফিস থেকে একটা টাইপ রাইটার চুরি করেছিলেন তিনি।

আন্দ্রে বাজিন অথবা বাবার খোঁজ
ফিল্ম সমালোচক আন্দ্রে বাজিন চালাতেন ‘ওয়ার্ক অ্যান্ড কালচার’ নামের একটা ফিল্মকাব। এই ফিল্মক্লাব আর ‘সার্কেল সিনেমা’ নিয়ে-এর ফিল্ম প্রদর্শনীর সময় এক হয়ে যাওয়ায় ত্রুফো ঠিক করলেন, বাজিনের কাছে যাবেন। যদি বুঝিয়ে শুনিয়ে তাদের সিডিউলটা বদলানো যায়! আর তাই ১৯৪৮ সালের ৩০ নভেম্বর ষোল বছরের ত্রুফো মুখোমুখি হলেন ত্রিশ বছর বয়সী বাজিনের- যিনি এরই মধ্যে ‘দ্য প্যারিসিয়ান রিলিজড’ পত্রিকায় সমালোচনা লিখে বিখ্যাত হয়ে গেছেন। কিন্তু এখানে এসে ত্রুফো পেলেন একটা নতুন ফিল্মস্কুল, একটা নতুন বাড়ি, একটা নতুন জায়গার দেখা। দেখা পেলেন অ্যালেন রেসনাই, ক্রিস মার্কার ও আলেকজান্দ্রে আস্ট্রুকের। এর কিছুদিন পর ‘সিনেফিলিক’ দায়বদ্ধতা থেকে ফ্রাঁসোয়া যতো দেনা করেছিলেন- সব শোধ করে দিলেন তার সৎ বাবা। বিনিময়ে জন্মের মতো ফিল্মকাব ত্যাগ করে একটা স্থায়ী চাকরিতে যোগ দেওয়ার লিখিত প্রতিশ্রুতি নিলেন। কিন্তু এরই মধ্যে ‘সার্কেল সিনেমা’ নিয়ে আরো তিনটি প্রদর্শনী কনফার্ম করেছিল, আর ফ্রাঁসোয়া ত্রুফো দৃঢ়তার সঙ্গে তার কাজ চালিয়ে গিয়েছিলেন। এ কারণে কথা না রাখার অভিযোগে রোনাল্ড ত্রুফো তাকে ধরে নিয়ে পুলিশের কাছে দিয়ে আসেন।

পুলিশ স্টেশনের একটা ছোট্ট সেলে ঘুমাতেন কিশোর ত্রুফো। পরে তাকে পুলিশ হেডকোয়ার্টারে নিয়ে যাওয়ার হয়। সেখান থেকে পরবর্তী সময়ে পাঠানো হয় ভিলেজুফের প্যারিসিয়ান কিশোর অপরাধ কেন্দ্রে। সেখানকার মনোবিজ্ঞানী তাকে সাহায্য করার জন্য বেজিনের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। আর বেজিন তাতে সাড়া দিয়ে ত্রুফোকে ‘ওয়ার্ক অ্যান্ড কালচার’-এ চাকরি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। এ সময় ভারসেইলসের একটি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে কাজ করার জন্য শর্ত সাপেক্ষে মুক্তি পান ত্রুফো। ছয় মাস পর সেখান থেকে বহিষ্কার হন তিনি। অভিযোগ- বাজে আচরণের।

এরপর ত্রুফোকে নিজের ব্যক্তিগত সচিব বানান বাজিন। আর আঠার বছর বয়সে এসে বাবা-মার কাছ থেকে আইনীভাবে বন্ধন-মুক্তি লাভ করেন ত্রুফো। অতঃপর পান স্বাধিকারের স্বাদ। বাজিন তাকে নিয়ে যান ‘অবজেকটিভ ৪৯’ ফিল্ম সোসাইটির কাছে। এটা ছিল একটা এলিট গ্রুপ। পরে অবশ্য নয়া-সমালোচনাবাদের ফোরাম হয়ে ওঠে। ওয়েলেস, রসেলিনি ও স্টার্জেসের মতো ফিল্মমেকাররা তাদের কাজ নিয়ে হাজির হতেন এই গ্রুপের কাছে। পরবর্তী সময়ে জাঁ-লুক গদার, সুজানে সিফম্যান ও জাঁ-মারি স্টাব এই গ্রুপে যোগ দেন। কাবের কোনো মিটিংয়ের কোনো সেশনই মিস না করার সিদ্ধান্ত নেন তারা। বৃহস্পতিবারগুলোতে তারা যেতেন ‘সিনে কাব দো কোয়াটিয়ার লাতিন’-এ [ইংরেজিতে সিনেমা কাব ইন দ্য লাতিন কোয়ার্টার]। এটা চলতো এরিক রঁমার তদারকিতে। এই ফিল্মকাবের নিউজলেটারেই ত্রুফো তার সমালোচক জীবনের প্রথম পদপে ফেলেন। সময় তখন ১৯৫০ সালের বসন্তকাল। ‘দ্য রোল্স অব দ্য গেম’ ফিল্মের অরিজিনাল ভার্সনের উপর সাম্প্রতিক আবিষ্কার নিয়ে ছিল তার লেখা প্রথম আর্টিক্যাল। জাঁ রেনোয়ার এই ফিল্মটি মুক্তি পেয়েছিল ১৯৩৯ সালে।

Francois_Truffaut

ফিল্ম সমালোচনাকে তরবারির মতো ব্যবহার
১৯৫০ সালের এপ্রিলে ‘এলে’ ম্যাগাজিনে সাংবাদিকতা শুরু করেন ত্রুফো। একইসঙ্গে ‘সিনে-ডিজেস্ট’, ‘লেটার্স দো মন্ডে’ ও ‘ফ্রান্স-দিমান্চে’তেও কাজ চালিয়ে যান। এরপর এক অভাবনীয় সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি। যোগ দেন আর্মিতে। পরের দুই বছর তিনি বারবার মিলিটারি র‌্যাঙ্ক থেকে পালানোর চেষ্টা করেন। আর এটা করতে গিয়ে ধরা পড়ে কারারুদ্ধ থাকেন। অবশেষে মুক্তি আসে ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারিতে। এক্ষেত্রে বাজিন তাকে আরও একবার ঋণী করলেন। বেশকিছু রাজনীতিবিদের সাহায্য নিয়ে তার মুক্তির ব্যাপারে চাপ দিয়ে আসছিলেন বাজিন। এরপর ব্রাই-সুর-মার্নেতে বাজিন পরিবারের সঙ্গে বসবাস শুরু করেন ত্রুফো। এ সময় ফ্রিল্যান্স কলামিস্ট হিসেবে কিছুটা শান্তভাবে ফিল্ম দেখাদেখি আর আর্টিকেল লেখালেখির চাকরি খুঁজে ব্যর্থ হন।

তিনি যখন মিলিটারি কারাগারে বন্দি ছিলেন, সেই সময় নতুন একটা ফিল্ম জার্নাল আত্মপ্রকাশ করেছিল। নাম, ‘কাহিয়ার দো সিনেমা’। প্রতিষ্ঠাকাল- ১৯৫১-এর এপ্রিল। প্রতিষ্ঠাতা- বাজিন, জ্যাক দনিয়েল-ভালক্রজ ও জোসেফ-মারি লো দুকা। সমালোচনা ছাপার আকাক্সা ছিল তাদের।

ত্রুফো এখানে গদ্য লেখা শুরু করেন। প্রথম লেখার শিরোনাম- ‘অ্যা সারটেইন টেনডেন্সি অব দ্য ফ্রেঞ্চ সিনেমা’। এ লেখায় ‘ট্রাডিশন অব কোয়ালিটি’ টার্মকে প্রশ্নবিদ্ধ করেন তিনি। ‘দ্য ফ্রেঞ্চ ডিসপ্লে’ ফিল্মে জাঁ-পিয়েরে ব্যারোট টার্মটি উদ্ভাবন করেছিলেন। আর এটা সাহিত্যকে ফিল্মে রূপ দেওয়ার এক্ষেত্রেকদি অতঁ-লারা, জাঁ দিলানো ও ইভিস আলেগেঁতের মতো ফিল্মমেকার এবং জাঁ অঁয়েচেঁ ও পিয়েরে বুঁরমতো স্ক্রিপ্টরাইটারকে রেফার করে।

অবশ্য ম্যাগাজিনটিতে প্রকাশিত তার প্রথম লেখা ছিল একটা ফিল্ম রিভিউ। ফিল্মের নাম ‘সাডেন ফিয়ার’। ফিল্মমেকার ডেভিড মিলার। মুক্তি- ১৯৫২। এই লেখার পর ত্রুফোর সাহিত্যিক সৃষ্টি ছিল বেয়াড়া ধরনের। এমনকি মাঝে-মধ্যে তিনি ছদ্মনামেরও আড়াল নিতেন। অবশেষে ‘অ্যা সারটেইন টেনডেন্সি অব দ্য ফ্রেঞ্চ সিনেমা’ প্রকাশিত হয় ১৯৫৪ সালের জানুয়ারিতে। দনিয়েল-ভালক্রজের লেখা একটা সম্পাদকীয় নোটও জুড়ে দেওয়া হয়েছিল তাতে। আর প্রকাশের পরই তর্ক-বিতর্ক তোলপাড় সৃষ্টি করেছিল এটা। মুহূর্তের মধ্যেই মন্তব্যগুলো দুইভাগ হয়ে দুই মেরুতে অবস্থান নিয়েছিল। ফরাসি ফিল্মের এমন অচ্ছুৎ অংশকে আক্রমণ করার সাহস দেখানোয় একই সময়ে একদল এই তরুণের পক্ষ নিলো তো আরেকদল করলো তীব্র সমালোচনা।

এই ম্যাগাজিনে ছয় বছরে ত্রুফোর লেখা ১৭০টা আর্টিক্যাল ছাপা হয়েছিল। এর বেশিরভাগই ছিল ফিল্ম রিভিউ আর ফিল্মমেকারদের সাক্ষাৎকার।

একই বছর সাংস্কৃতিক সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘আর্টস-লেটার্স স্পেকটাকল্স’-এর সম্পাদকেরা ত্রুফোর সঙ্গে যোগাযোগ করেন। এই পত্রিকাটি সে সময়ের ডানপন্থী বুদ্ধিজীবিদের আখড়া হিসেবে পরিচিত ছিল। পরের পাঁচ বছরে ‘আর্টস’-এ ৫২৮টি আর্টিক্যাল লিখেন ত্রুফো। এসব লেখায় ‘ট্রাডিশন অব কোয়ালিটি’ ও বামপন্থী বুদ্ধিজীবিদের প্রতি তার আক্রমণ অব্যাহত রাখেন। তার ছিল মোটাদাগের, বিবাদময় ও নীতিবাদের স্টাইল। তাতে উগ্রতা ও রসিকতা মিশিয়ে দিতেন তিনি। এজন্য উচ্চপ্রশংসা যেমন পেয়েছেন, তেমনি উদারও ছিলেন তিনি- বিশেষ করে তার পছন্দের ফিল্মমেকারদের ব্যাপারে।

এ সময় ‘দ্য এক্সপ্রেস’ ও ‘মডার্ন টাইমস’-এর মতো বামপন্থী প্রকাশনাগুলোর অবিরাম সমালোচনার শিকার হন তিনি। এমনকি ফ্যাসিজমের অভিযোগও আনা হয় তার বিরুদ্ধে। উস্কানি চলতে থাকে : আমেরিকান ফিল্মের উপর আরোপিত সেন্সরশিপ নিয়ে এক নাৎসিকর্মীর লেখা ফিল্ম-গদ্যের প্রশংসা করেন তিনি, এমনকি ফরাসী রাজতন্ত্রের পে শ্রদ্ধাঞ্জলি দেন। একই সময়ে জ্যাক রিভেতির সঙ্গে মিলে প্রিয় ফিল্মমেকারদের সাক্ষাৎকার নেওয়া শুরু করেন ত্রুফো। ফলে রেনোয়া, ম্যাক্স অফুস এবং সবচেয় বড় কথা- রবার্তো রসেলিনির সঙ্গে বন্ধুত্ব হয় তার। পরে রসেলিনির জন্য স্ক্রিপ্ট লিখেছিলেন এবং বিভিন্ন প্রকল্পে তাকে সহযোগিতা করেছিলেন ত্রুফো। পরিণামে এটা অবশ্য কোনো কালি ফেলেনি তার সমালোচক জীবনে। তার লেখকবৃত্তির থিওরিকে বরং সমৃদ্ধ করেছে। ফিল্মমেকারের সুগভীর জ্ঞানকে স্বতন্ত্র করা, বিতর্কের ঊর্ধ্বে থেকে তার স্টাইল ‘প্লেসিং অন স্টেজ’কে প্রকাশ করা এবং ফিল্ম নিয়ে তার চিন্তার জায়গা থেকে নিজের কোনো ফিল্ম প্রত্যাশিত গুণ ধারণ করতে না পারলে সেটার মধ্যে থাকা উদাসিনতা- এইসবকে পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত করার কনসেপ্টে ‘অথর থিওরি’ নামের এই থিওরি জন্ম দিয়েছিলেন ত্রুফো। তার কাছে ‘শ্রেষ্ঠতম’ ফিল্মমেকার ছিলেন আলফ্রেড হিচকক। ফরাসি ফিল্মমেকারদের মধ্যে রোবের ব্রসঁ, জাঁ ককতো, আবেল গ্রেন্স, জাঁ রেনোয়া ও জ্যাক তাতিকে সেরা মনে করতেন।


সমালোচক কখনো ফিল্ম বানাতে পারে?
সময় ১৯৫৫। রোবের লাচেনি হলেন প্রডিউসার ও এসিসটেন্ট। জ্যাক রিবেতি দাঁড়ালেন ক্যামেরার পেছনে। তাদের নিয়ে ত্রুফো বানালেন তার প্রথম শর্টফিল্ম। নির্বাক। সাদাকালো। নাম দিলেন, ‘অ্যা ভিজিট’। এই ফিল্ম নিয়ে তিনি বললেন, ‘কোনোভাবেই কোনো প্লট ছিল না এতে। এটা ছিল অভাবনীয় ও প্রদর্শন-অযোগ্য। ’ হতাশা নিয়ে ফিল্মটা তালাবন্দি করে রাখলেন। এটা কেবল একবারই প্রদর্শিত হয়েছিল। সেটা ১৯৮২ সালে। আর তা ত্রুফোকে বেশ লজ্জায়ই ফেলেছিল।

১৯৫৭ সালে মরিস পঁসের ছোটগল্প অবলম্বনে বানালেন ‘দ্য মিস্চীফ মেকার’। বেশকিছু প্রশংসামূলক রিভিউ ছাপা হলো এর উপর। ব্র“সেলসের ‘মন্ড্রিয়াল ফিল্ম ফেস্টিভাল’-এ ‘বেস্ট ডিরেক্টর’ প্রাইজ জিতে নিলেন ত্রুফো। একমাত্র বিরূপ নোট দিলেন ফিল্মমেকার জাঁ ডিলানো। এই ফিল্মের এক দৃশ্যে বাচ্চারা ডিলানোর ‘লস্ট ডগ্স উইথাউট কর্লাস’ ফিল্মের পোস্টার নষ্ট করে ফেলে। খুব সম্ভবত এই কারণেই এতো ক্ষেপেছিলেন তিনি।

‘দ্য মিস্চীফ মেকার’ ছিল একটা ছোট ইঙ্গিত। তবে তা ট্রাডিশনাল ফরাসি সিনেমার পুরনো স্ট্রাকচার ছিড়ে নতুনধারা বা ‘নিউ ওয়েভ’-এর কথা প্রবলভাবেই প্রকাশ করছিল। ডিলানো যতোই আক্রমণ ফিরিয়ে দিচ্ছিলেন, ত্রুফো ততোটাই মাদালিন মরগেস্তানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠছিলেন। মাদালিন ছিলেন ফিল্ম ডিস্ট্রিবিউশনের খুবই গুরুত্বপূর্ণ কোম্পানি ‘ককিনো’র প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার মেয়ে। এই ঘনিষ্ঠতা তার ফিল্মে অর্থলগ্নি করা এবং তার নিজের প্রোডাকশন কোম্পানি ‘ফিল্মস ফ্রম কোচ’ গড়ে তোলায় বেশ সাহায্য করে। ১৯৫৭ সালের অক্টোবরে ত্রুফো ও মাদালিন বিয়ে করেন।

১৯৫৮ সালে ত্রুফো যখন বার্নাদেতে লাফোঁকে নিয়ে জ্যাক কসিয়ার ‘হট ওয়েদার’ উপন্যাস অবলম্বনে ফিল্ম বানানোর জন্য অপো করছিলেন, তখন দুই দিনের শূটিংয়ে একটা শর্টফিল্ম বানিয়ে ফেলেন। নাম দেন, ‘ওয়াটার হিস্টোরি’। এই ফিল্মে এডিটিং ও সংলাপ পুনর্লেখার কাজ করে দেন জাঁ-লুক গদার। প্যারিসের দক্ষিণাঞ্চলের বন্যার সুযোগ নিয়ে গাড়িতে বসে বেশকিছু ফিল্ম বানিয়েছিলেন ত্রুফো। প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে বন্যার্ত অঞ্চলে ভালোবাসা, জলবায়ু ও সাহিত্যের প্রতিফলন ঘটাতে চেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু বার্নাদেতে মারাত্মক আহত হওয়ায় উপন্যাস থেকে ফিল্ম বানানোর কাজটি দীর্ঘকালের জন্য থমকে দাঁড়ায়। আর এই ফাঁকে নতুন কোনো অ্যাডভেঞ্চারে নিজেকে ব্যস্ত রাখার সিদ্ধান্ত নেন ত্রুফো। এ সময় সমালোচক হিসেবে শেষবারের মতো কান ফিল্ম উৎসবে যোগ দেন এবং সমালোচকের দায়িত্ব অফিসিয়ালি ছেড়ে দিয়ে আসেন। ‘ফোর হান্ড্রেড ব্লৌজ’ তখন তার মাথার ভেতর তোলপাড় করছে।

 

Jules-And-Jim
ফরাসি ফিল্মের বেলাভূমি তছনছ করে দেওয়া এক নতুন ঢেউ
শশুরের টাকায় নতুন প্রজেক্ট শুরু করলেন ত্রুফো। ভিত্তি নিজ শৈশব ও কৈশোর। জন্ম হলো ‘দ্য ফোর হান্ড্রেড ব্লৌজ’-এর। কাস্টিংয়ের জন্য বিজ্ঞাপন ছাপা হলো ‘ফ্রেঞ্চ সঁ’ পত্রিকায়। প্রার্থীদের মাঝ থেকে চৌদ্দ বছরের এক কিশোরকে বেছে নেওয়া হলো। মানসিক ভারসাম্যহীন আর বাজে ছাত্র ছিল সে। নাম জাঁ-পিয়েরে লদ। শূটিং শুরু হলো ১৯৫৮ সালের ১০ নভেম্বর। আর ভাগ্যের কী খেলা- সে রাতেই মারা গেলেন বাজিন। লুকামিয়ায় ভুগছিলেন তিনি। পরের বছরের এপ্রিলে কান উৎসবে দেখানো হলো ফিল্মটি। সেখানে ‘বেস্ট ডিরেক্টর’ প্রাইজ জিতলেন ত্রুফো।

এই সাফল্যের সঙ্গে সঙ্গে একটা নতুন নন্দনতত্ত্ব বৈধতা পেলো। একটা সংস্কার ও সমালোচনামূলক ধারা পাওয়া গেলো। নাম তার ‘নিউ ওয়েভ’। ১৯৫৮ সালে ‘সিনেমা’ পত্রিকার একটি সংখ্যায় পিয়েরে বিলার্ড এই ‘নিউ ওয়েভ’ টার্মটি ব্যবহার করেছিলেন। আগের বছর ‘দ্য এক্সপ্রেস’ পত্রিকায় ছাপা হওয়া ফ্রাঁসোয়া গিয়্যদের লেখা একটি আর্টিক্যাল থেকে এটা পেয়েছিলেন তিনি। ত্রুফোর ‘ফোর হান্ড্রেড ব্লৌজ’ ও কদি শ্যাবলের ‘দ্য কাজিন্স’ [১৯৫৯] প্রিমিয়ারের পর মিডিয়া ব্যাপকভাবে ‘নিউ ওয়েভ’ এক্সপ্রেশনকে ব্যবহার করতে লাগলো। এবং ক্ষণিকের খেয়ালে বড় ধরণের কাজ করে আসা এই বিষয়টিকে বিচ্ছেদের এক ফ্যাশনেবল প্রতীক করে তুললো।

১৯৫০ দশক প্রজন্মের ফিল্মমেকাররা সুলিখিত স্ক্রিপ্টের উপর নির্ভর করে নিজেদের উজার করে দিতেন। কিন্তু একটা ফর্মুলা প্রতি এই আনুগত্য একক স্টাইলিস্টিক স্ট্যান্ডার্ড আর কাহিনীর গঠনপ্রক্রিয়াকে খর্ব করে দিতো। এই ‘সাফল্যের রেসিপি’ ইতিমধ্যেই পরীতি হয়ে গেছে। থিমেটিক ফোকাস সবসময়ই অতীতে জায়গা করে নেয়; ফলে এই ফিল্মমেকারদের পূর্ববর্তী সাহিত্যকর্মের উপর নির্ভর করতে হতো। একই রকম নির্ভর করতে হতো পেশাদার স্ক্রিপ্টরাইটারদের উপর। এই ফিল্মমেকারদের কাছে দর্শকদের জন্য বলা গল্পের প্রাসঙ্গিকতার চেয়ে সিনোগ্রাফির পুনর্নিমাণ এবং পর্যাবৃত্তির খুটিনাটিই বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ফলে ১৯৫০ দশকের মূলধারার ফরাসি ফিল্মে নতুনত্ব ও ঝুঁকির ব্যাপক অনুপস্থিতি ছিল। এমনকি ছোট ও মুক্ত প্রোডাকশনের জায়গাও ছিল না সেখানে।

১৯৫৯ সালের কান উৎসবে ত্রুফোসহ অন্য যেসব প্যারিসিয়ান ফিল্মমেকারের ফিল্ম দেখানো হয়েছে, তাদের সবাই বয়সে ছিলেন অতি তরুণ। এর পরের বছর আরও ৫০জন ফিল্মমেকার তাদের প্রথম ফিল্মের প্রদর্শনী করেছেন। পুনর্শক্তিমান সিনেমাটিক ফর্মে এর সবটাতেই ছিল রিয়েলিজম এবং তাদের দৈনন্দিন জীবনের নান্দনিক নকশা। হ্যান্ড-হেল্ড ক্যামেরা, জাম্প কাট এডিটিং ও সৌখিন অভিনেতাদের ব্যবহার করে স্টুডিও সিস্টেমের বাইরে থেকে কম বাজেটে ফিল্ম বানাতেন তারা। শুরু থেকেই তারা একেবারেই স্বাধীনভাবে তাদের ফিল্মের থিমেটিক বিষয়বস্তু বাছাই করতেন।

ফিল্ম প্রোডাকশনে যারাই সম্পৃক্ত থাকুক না কেন, ফিল্মমেকারই সৃষ্টিশীল বলনে ফিল্মটির ‘কপিরাইট’-এর [d`auteur] কর্তৃত্ব করবেন- ‘নিউ ওয়েভ’-এর স্রষ্টারা এবং তাদের সমসাময়িক অ্যালেই রেনাসঁ, জ্যাক ডেমি, ফিলিপ ডি ব্রোকা, অগনি বার্দা ও জাঁ রোচ এ বিষয়টা বজায় রাখতেন। ‘নিউ ওয়েভ’ কোনো ভাবাদর্শিকভাবে সংগঠিক অগ্রণীদলের প্রতিনিধিত্ব করতো না; বরং একটা ঝাকুনিময় প্রতিক্রিয়া, একটা চরম ও অসহনীয় পরিস্থিতিকে অনেকটা নৈতিকভাবে প্রশমনকারী সাড়া তারা ফেলেছেন। একই কারণে কোয়ালিটি ওঠা-নামায় ভুগেছে তাদের প্রোডাকশন; আর সেখানে সুবিধাবাদীদেরও ঘাটতি ছিল না- যারা ‘নিউ ওয়েভ’-এর পতাকার নিচে নিজ প্রতিভার ঘাটতি ঢেকে ফেলতো।

এ সময় ‘ফোর হান্ড্রেড ব্লৌজ’ বানিয়ে শৈল্পিক ও বাণিজ্যিক- উভয় স্বাদেরই ওম পেলেন ত্রুফো। এটা তাকে অর্থনৈতিক দুশ্চিন্তা ভুলে স্বস্তিকর বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা দিলো। এরপর তিনি ডেভিড গুডিসের ‘ডাউন দেয়ার’ উপন্যাসকে ফিল্মে রূপ দিতে চাইলেন। ‘শ্যূট দ্য পিয়ানো প্লেয়ার’ নামে মুক্তি পেলো এটি। সময় তখন ১৯৬০। এই প্রোডাকশনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো, এতে কাজ করে বেশ কয়েকজন ফিল্মসৈনিক ত্রুফোর টিমে স্থায়ী জায়গা করে নিয়েছিলেন। এরমধ্যে ছিলেন সুজানে, জর্জ ও রাউল। সুজানে সিফম্যান শুরু করেছিলেন কন্টিউনিটি সুপারভাইজার হিসেবে, শেষ পর্যন্ত এসিস্টেন্ট ডিরেক্টর হয়েছিলেন। জর্জ দেলেরু হয়েছিলেন নিয়মিত মিউজিক কম্পোজার। আর রাউল কুতাদের সিনেমাটোগ্রাফিক স্টাইলকে তো ‘নিউ ওয়েভ’-এর ভিজ্যুয়াল নান্দনিকতা হিসেবে নিদর্শন ও নিরূপন করা হয়।

ফিল্মটির প্রিমিয়ার শো হয় প্যারিসে, ১৯৬০ সালের নভেম্বরে। বক্সঅফিসে ছোটোখাটো সাফল্য পায়। একটা ব্যর্থতার দিক থেকে দুর্ভাগ্যজনকভাবে গদারের ‘অ্যা ওম্যান ইজ অ্যা ওম্যান’, শ্যাবলের ‘ওয়াইজ গাইজ্’ ও ডেমির ‘লোলা’র সঙ্গে মিলে যায় এটি। ‘নিউ ওয়েভ’কে ততোদিনে ভালোভাবে গ্রহণ করা হলেও এই ফিল্মমেকারদের কাজগুলোকে আক্রমণ করা হয়। এই ফিল্মগুলো বেশি মাত্রায় বুদ্ধিবৃত্তিক ও বিরক্তিকর- এমনতরো কারণ দেখিয়ে সেই মুহূর্তে অনেক দর্শক ফিল্ম দেখা ছেড়ে দেওয়ার ঘটনায় অনেক সাংবাদিক এই মুভমেন্টকে দোষী করেন। সমালোচকরাও এই মুভমেন্টকে গোল্লায় যাওয়ার অভিশাপ।

পরের ফিল্মে সম্পৃক্ত হওয়ার পর ত্রুফো ভাবেননি ‘নিউ ওয়েভ’ মারা যাচ্ছে। ‘ফ্রান্স-অবজারভার’ পত্রিকায় লেখা আর্টিক্যালের জন্য তার বিরুদ্ধে মানহানি মামলা করে বসেন রজার ভাদিম। সেই আর্টিক্যালে ত্রুফো অভিযোগ করেছিলেন, জাঁ অরেলের ‘প্লিজ, নট নাউ’ [১৯৬১] ফিল্মে ভাদিম অনধিকার চর্চা করেছেন। এই মামলা ‘নিউ ওয়েভ’ মুভমেন্টকে বিভক্ত করে দেয়। ত্রুফো হেরে গিয়েছিলেন। আর সবার মনোবল গিয়েছিল ভেঙে। আর তাতে একটা যুগ ধ্বসে পড়লো। মেরামত-ঊর্ধ্ব স্টাইলিস্টিক ও বাণিজ্যিক প্রতিযোগিতা বড় হয়ে উঠেছিল তখন। ১৯৬৭ সালে হতাশাজন এক ঘোষণা দিলেন ত্রুফো, ‘ইহুদিরা যেভাবে দখলদারী হয়, আজকের দিনে ‘নিউ ওয়েভ’-এর অংশ হতে পারা এবং তার অংশ থেকে যাওয়াও তেমনিভাবে যে কারো জন্য খুব গর্বের বিষয়। ’ এখন পর্যন্ত, এই তিক্ততা অবশ্য তার ফিল্মে ঢুকেনি। তার ফিল্ম কখনই এই মুভমেন্টের স্বতঃসিদ্ধ মূল তত্ত্ব- স্বাধীনতা, স্বাতন্ত্র আর সংবেদনশীলতার আলো হারায়নি।


আন্তনি দানিয়েল, কিংবা উত্তম পুরুষে ফিল্ম
বিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে একটা সিরিজের ইতস্তত ছড়ানো ছিটানো ফিল্মগুলোয় ত্রুফো নিজের পরিবর্তিত অহংবোধের ঢংয়ে একটা চরিত্রকে গড়ে তুলেছেন। ‘ফোর হান্ড্রেড ব্লৌজ’, ‘আন্তনি অ্যান্ড কলেতি’ [১৯৬২], ‘স্টোলেন কিসেস’ [১৯৬৮], ‘বেড অ্যান্ড বোর্ড’ [১৯৭০] ও ‘লাভ অন দ্য রান’ [১৯৭৯] ফিল্মগুলো ছিল আন্তনিও দানিয়েলের রোমান্স নিয়ে বানানো। এই চরিত্রে জীবনের নানা ধাপে অভিনয় করেছেন জাঁ-পিয়েরে লদ। ফিল্মমেকার অবশ্য এটা পরিস্কারভাবেই বলেছেন, ‘বানানো চরিত্র আন্তনিও দানিয়েল আসলে দুইজন বাস্তব মানুষের মিশ্রণ। এর একজন হলেন ফ্রাঁসোয়া ত্রুফো, আরেকজন জাঁ-পিয়েরে লদ’।

স্ক্রিপ্ট চূড়ান্ত করার সময় অহেতুক নজর এড়াতে ও বাবা-মাসহ অন্য বাস্তব চরিত্রগুলোকে খাঁজে ফেলতে টেলিভিশনের স্ক্রিপ্টরাইটার মারসেল মৌসির সহযোগিতা দরকার ছিল। ‘ফোর হান্ড্রেড ব্লৌজ’-এ প্রথম দেখা মেলে আন্তনির। এ ফিল্মে সে ছিল এক পাজি ছাত্র আর বাবা-মার ভুল বোঝার শিকার বালক। ফিল্মমেকারের অভিজ্ঞতার দিক থেকে অনেকগুলো চরিত্র দুর্ভাগ্যের মধ্যে পড়ে : পড়াশোনা ছেড়ে দেওয়ার পর ত্রুফোকে বিলবোর্ড বেচতে হতো। সেই বিলবোর্ডে ছিল শহরের সিনেমা হলগুলোতে চলমান ফিল্মের ‘ক্যাটালগ’। ছিল ফিল্মগুলোর প্রচারণায় ব্যবহৃত ছবিও। ল্যাচানিকে সঙ্গী করে রাতের বেলা এগুলো চুরি করতেন বালক ত্রুফো। ফিল্মে টাইপরাইটার চুরির ঘটনাও দেখানো হয়েছে। আর পরবর্তীকালে তার কয়েদি হওয়ার ঘটনা ফিল্মে আন্তনিকে তরুণ দুষ্কৃতিকারীতে রূপান্তর করেছিল।

কয়েকবছর পর দর্শকরা আন্তনির দেখা পেলো ‘আন্তনি অ্যান্ড কলেতি’ নামের শর্টফিল্মে। ‘লাভ অ্যাট টুয়েন্টি’ নামের একটি যৌথ প্রকল্পের অংশ ছিল এটি। এখানে আন্তনি একটা রেকর্ড কোম্পানির শ্রমিক। কনসার্টে গিয়ে সে প্রেমে পড়ে কলেতি নামের মেয়েটির। কিন্তু মেয়েটি তাকে পাত্তা দেয় না। গ্রীষ্মকালীন এক ক্যাম্পিং গ্রাউন্ডে ত্রুফো তার প্রথম প্রেম লিনিয়ানে রোমানোর দেখা পেয়েছিলেন। প্যারিসে ত্রুফোর খ্যাতি থাকলেও মেয়েটি সম্পর্ক আগাতে চায়নি। প্যারিসবাসী আন্তনি কলেতির বাবা-মার নিজস্ব অ্যাপার্টম্যান্টের মুখোমুখি বিল্ডিংয়ের একটা অ্যাপার্টম্যান্ট ভাড়া নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। ত্রুফোও ঠিক এমনটাই করেছিলেন লিলিয়ান লিটভিঁর প্রেমে পড়ার পর। এই তরুণীর প্রতি আচ্ছন্ন ছিলেন তিনি। লিলিয়ানের সঙ্গে সম্পর্কে ব্যর্থতা ও একাকিত্বে ভোগার কারণেই আর্মিতে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন ত্রুফো। সেখান থেকে পালানোর চেষ্টা করে জেল খেটে, অশেষ অবমাননার শিকার হয়ে মুক্তি পেয়েছেন ১৯৫২ সালে। এই অপমানের বাঁধ তিনি ব্যবহার করেছেন ‘স্টোলেন কিসেস’-এর শুরুতে, যেখানে আর্মি থেকে আন্তনির বহিষ্কার হওয়া দেখানো হয়েছে।

এই বিন্দু থেকেই চরিত্রটি থেকে ত্রুফো আলাদা হয়ে যান, আর চরিত্রটি নিজস্ব জীবন শুরু করে; আন্তনি হয় হোটেলের দারোয়ান, ছদ্মবেশী প্রাইভেট ডিটেক্টিভ, টেলিভিশন মেকানিক; আর শেষমেষ হয় একটা প্রকাশনা সংস্থার প্রুফরিডার। ১৯৬৮ সালের মে দিবসের কারণে ফ্রান্স বেশ ঝাঁকুনি খেয়েছিল। তার কয়েক মাস আগে ত্রুফো এক হিরো সৃষ্টি করেছিলেন, যাকে মনে হয়েছিল সেকেলে, জীবন কিংবা স্থায়ী চাকরি পেতে অম, কিন্তু শেষপর্যন্ত ভালোবাসা পেতে সম এক রোমান্টিক মানুষ। ভায়োলিনবাদক ক্রিস্টিনের ভালোবাসা পেয়েছিল সে। তাকে বিয়েও করেছিল। আলফোনস্ [Alphonse] নামের এক শিশুর জন্মের ভেতর দিয়ে বাবা-মা হিসেবে অভিষেকও হয় তাদের; কিন্তু আন্তনি তখনও তার নিজের ভেতর পিতৃসুলভ ভূমিকা খুঁজে পায় না।

ব্যক্তিগত ও পেশাগত ভিন্নতার বিদ্বেষের দিক বিবেচনা করলে ত্রুফো তখনও চরিত্রটির ভেতর যথেষ্টই বিরাজ করছিলেন। এ কেবল নারীদের প্রতি তার ভালোবাসার কারণে নয়, সরাসরি রেফারেন্সের জন্যও; আন্তনি যেমন একটা উপন্যাস লিখছে, ‘লাভ অ্যান্ড আদার প্রবলেমস’, যেখানে সে তার বাবা-মার সঙ্গে বিশেষ অবস্থায় উপনীত হয়েছে, স্ত্রীর সঙ্গে তার তালাকের বিষয়টিও আছে- যেমনটা আমরা দেখি ‘লাভ অন দ্য রান’-এ। ত্রুফোর স্ত্রী তালাক নিয়েছিলেন ১৯৬৫ সালে। ফলে আন্তনি আর তার স্ত্রীর একই অভিজ্ঞতার স্বাদ পাওয়া বিষয়টা কঠিন কিছু না। এই ফিল্মে আদালতে দেখা হয়ে যাওয়ার পর আন্তনি আর ক্রিস্টিন অনেকগুলো ফ্ল্যাশব্যাকের নেতৃত্ব দেয়। যেখানে কাহিনী ঘুরেফিরে আসে, পূর্ববর্তী সব ফিল্মের নানা অংশ একত্রীভূত হয়, সাবালক প্রতিপুরুষ হিসেবে কলেতির আবির্ভাব ঘটে।

শেষে আমরা দেখি আন্তনি তার প্রেমিকা সাবিনাকে একটা রেকর্ড স্টোরে প্রবল উন্মাদনায় চুমু খাচ্ছে। ‘ফোর হান্ড্রেড ব্লৌজ’ ফিল্মে আন্তনিও পালিয়ে যখন একটা পার্কে ঢুকলো এবং বুলেট গতিতে ঘূর্ণায়মান একটা রাইডে চেপে বসলো, রাইডের পিন যেন তাকে দেয়ালের সঙ্গে সেঁটে দিয়েছে- সেই সুখী মুহূর্ত থেকে তখন উঠে এলো কিছু বিচিত্র ইমেজ। এই একই যন্ত্র এক করে দেয় আবার আড়াল করে, ক্যামেরা ধারণ করে শরীরের অস্পষ্ট ছাপ, আর কে যে কোনটা- দর্শকরা ঠিক তা বুঝে উঠতে পারে না। আমরা যতোই মনোযোগ দেবো, ততোই দেখবো- দেয়ালে একে একে সেঁটে যাচ্ছে তার পরিবর্তিত অহংবোধের তারুণ্য।

 

400_blowsবিকাশ না চাওয়া দিশেহারা বালক ও পুরুষেরা
ত্রুফোকে নিয়ে কলম্বিয়ান ফিল্ম সমালোচক লুইস আলবার্তো আলভারেজ বলতেন, ‘তার সব কাজ ঘিরেই আছে হারানো শৈশবকে খুঁজে ফেরা। ’ আন্তনিওকে যে ঢঙে গড়ে তুলেছেন ত্রুফো, সে দিকে মন দিলেই বিষয়টা বোঝা যায়। তার বদলে যাওয়া অহং এমনকি পূর্ণবয়সে এসেও একটা বালককে মনে করিয়ে দেয়। চরিত্রটি নিয়ে ত্রুফো অনেক ক্যারিকেচার করেছেন, ওকে অবিশ্বস্ত ও সহজে প্রেমে পড়ে যাওয়া মানুষ বানিয়েছেন, এবং নানা চাকরি দিয়ে দেখেছেন- ঠিকমতো কাজ করে কি-না।

আজবভাবে তার পরের দুই ফিল্মের প্রধান চরিত্র দুটিও একই কাজ করেছে। ‘দ্য ম্যান হু লাভ্ড ওমেন’ [১৯৭৭]-এ বার্ট্রান্ড, আর ‘দ্য ওম্যান নেক্সট ডোর’ [১৯৮১]-এ বার্নার্ড। এটা হঠাৎ করে হয়ে যেতে পারে না : ফিল্মমেকার তার চরিত্রগুলোর মধ্যে একটা হারানো শৈশবকে ধীরে ধীরে সঞ্চারিত করেছেন। সাবালকত্ব অবশ্যই হারানো সময়কে পুনরুদ্ধার করবে- এ ছিল তার চিন্তা। এ কারণে চরিত্রগুলো তাদের সঙ্গীকে প্রস্তাব করে- বাচ্চামি, অপক্ক ও অস্থায়ী, ব্যভিচারপ্রবণ ভালোবাসা।

শৈশবের স্থায়ী উপস্থিতি ত্রুফোর ফিল্মের কমন একটা উপাদান। যদিও তার ফিল্মে আমরা বাচ্চাদের দেখা পাই; যেমন- ‘দ্য মিসচিফ মেকার্স’, ‘ফোর হান্ড্রেড ব্লৌজ’, ‘ফারেনহাইট ৪৫১’ কিংবা ‘দ্য গ্রিন রুম’-এ; সম্পূর্ণ ভিন্ন কিন্তু পরিপূরক দিক থেকে এর দুটি ফিল্ম সুনির্দিষ্টভাবে শৈশবকে শ্রদ্ধাঞ্জলি দিয়ে করা। এর একটার উদ্দেশ্য হলো নীতিমূলক, আর আরেকটা তার সমর্থন দিয়ে তৈরি।

মানুষের স্নেহ ও আন্তরিকতা থেকে বঞ্চিত, পরিত্যক্ত শিশু নিয়ে বানানো ‘দ্য ওয়াইল্ড চাইল্ড’ [১৯৭০]-এর থিমটা ভিন্নতর। এই ফিল্ম নিয়ে ত্রুফো বলেছিলেন, ‘দশ বছর পর এই ফিল্মটি ‘ফোর হান্ড্রেড ব্লৌজ’-এর মতো প্রতিক্রিয়া পাবে। আমাদের স্ক্রিনে কেউ একজন অপরিহার্য কিছু ঘাটতি রেখে দিয়েছে- সে কথা আমারা বলেছি আগেই; কিন্তু এই বেলা এসে মানুষেরা ঠিকই সাহায্য করার চেষ্টা করবে। ’ এই ফিল্মে বনে পাওয়া বুনো শিশু ভিক্টরকে আবার মানব সমাজে বাসযোগ্য করে তোলার দায়িত্ব নেওয়া ডাক্তার ইতার্দের চরিত্রে অভিনয় করেছেন ত্রুফো নিজেই। লুসিয়ান ম্যালসনের ‘দ্য ওয়াইল্ড চাইল্ড : মিথ অ্যান্ড রিয়েলিটি’ গ্রন্থ থেকে ফিল্মটির প্লট নেয়া হয়েছে। এই গ্রন্থে পরিত্যক্ত শিশুদের একা বেড়ে ওঠার ৫২টি ঘটনা বিশ্লেষণ করা হয়েছে। শিক্ষা প্রক্রিয়ার আস্থার জায়গা এবং সংস্কৃতিতে আলো ফেলার সম্ভাবনা এখানে ব্যাপকভাবে রয়েছে- যেমনটা ত্রুফোর ক্ষেত্রে তার পরামর্শক বাজিন, আর লদের বেলায় ত্রুফো করেছেন।

এই ফিল্মের স্বাভাবিকতা ‘স্মল চেঞ্জ’ [১৯৭৬] ফিল্মে দেখানো স্কুলের পরিবেশের বৈসাদৃশ বলে মনে হয়। ‘স্মল চেঞ্জ’ বানানো হয়েছিল থিয়ার্স শহরের একদল ছাত্রের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। আর এখানে আন্তনির ভয়ানক শিক্ষকদের দেখানো হয়েছে মানবিক অনুভূতিশীল ও ছাত্রদের প্রতি স্নেহশীল করে। এই ফিল্মে এক গভীর কোমলতা ছড়িয়ে পড়ে। আর তা শিশু থেকে শুরু করে টগবগে কিশোর পর্যন্ত- সববয়সী বালক-বালিকাদের জন্য একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আত্মীয়দের দুর্ব্যবহারের শিকার হয়েছিল তাদের একজন। শিশুদের প্রতি বড়দের দায়িত্ববোধ নিয়ে দেওয়া জনৈক শিকের বক্তব্যের শেষে বিষয়টি জুড়ে দেওয়া হয়। [আপাতদৃষ্টিতে ত্রুফো নিজেই সরাসরি এ বাণী দিয়েছেন বলে মনে হয়। আর এটা এই ফিল্মমেকারের নিজ শৈশবের অভিজ্ঞতা থেকে ছড়িয়েছে এখানে। ] ত্রুফোর শেষ ফিল্মের [‘কন্ফিডেনশিয়ালি ইর্উস, ১৯৮৩] শেষদৃশ্যে গির্জার কোয়াইয়ারে বাচ্চাদের পা দেখানো হয়েছে; পাগুলো একটা ফটোগ্রাফিক ক্যামেরার ল্যান্সের ফিল্টারে সমানে লাথি মারছে। দুষ্টুমি আর গভীর আনন্দ যেন বিরাজ করছে এ খেলায়। আর তা শিশুদের ভেতরকার উচ্ছ্বাসকে ছড়িয়ে দিয়ে অন্যদের মধ্যে তা সঞ্চারিত করছে।


গ্রন্থ ও ফিল্মের প্রতি চিরন্তন ভালোবাসার ঘোষণা
‘ফোর হান্ড্রেড ব্লৌজ’-এ বালজাকের প্রতি শ্রদ্ধা দেখাতে গিয়ে বাবা-মার ঘরে প্রায় আগুন লাগিয়ে দিয়েছিল আন্তনি। এই লেখকের প্রতি তার ভালোবাসা স্কুলের একটি অ্যাসাইনমেন্টে তার স্টাইলকে যথোপযুক্তভাবে প্রকাশ করেছে। শিকরা তাতে সম্মান না দেখালেও তিরস্কার করেছে অনেকবারই। কয়েকবছর পর ‘দ্য সফ্ট স্কিন’-এ [১৯৬৪] পিয়েরে ল্যাচানির দেওয়া মন্ত্রণায় বালজাক ঠিকই বিষয়বস্তু হয়ে উঠেছিলেন। আর এটা ত্রুফোকে তার পরবর্তী ভালোবাসার দিকে নিয়ে গেছে।

উপন্যাসের যেখান থেকে শুরু হয়েছে, গ্রন্থের সেই ভিউ ও টেক্সট দৃশ্যমান হয় ‘টু ইংলিশ গার্লস’-এর [১৯৭১] ক্রেডিটলাইনে। এর হৃদয় থেকে এই ফিল্ম সাহিত্য জীবন, সংবাদপত্র, স্মৃতির ভাণ্ডার, চিঠিপত্রকে নির্দেশ করে- যেখানে একইসঙ্গে শ্বাসরুদ্ধকর ও প্রশমিত অনুভূতি ছড়িয়ে আছে। মনে হয় এর চরিত্রেরা যেন বেঁচে আছে এক ছন্দময় সাহিত্য জীবনে। যেন তারা জেনেছিল তাদের সূচনার কথা, যেন তারা আগেভাগেই বুঝতে পেরেছিল- তাদের জীবন যৌথবদ্ধ হচ্ছে মুদ্রিত শব্দে, আর ফিল্মে গিয়ে তার ঘটছে সমাপ্তি।

আরও একটি ফিল্মে ত্রুফো তার গ্রন্থপ্রীতির সবটাই ইনজেকশনের মতো করে ঢুকিয়ে দিয়েছেন। ‘ফারেনহাইট ৪৫১’ আমাদের ভবিষ্যতের এক সমগ্রতাবাদী সমাজের কথা বলে, গ্রন্থ যেখানে নিষিদ্ধ [আর যদি দেখা মেলে কোনো গ্রন্থের, তবে তা ধ্বংস করে ফেলা হবে], ফিল্মের ক্রেডিট লাইন যেখানে কণ্ঠস্বরে প্রচার করতে হবে- কিছু লেখা যাবে না। কিন্তু আইন অমান্যের সংগঠিত আন্দোলন সেখানে স্বক্রিয় : বিদ্রোহীরা গ্রন্থ সংরক্ষণে অপারগ, নিজেদেরকে তারা রূপান্তরিত করে একের ভেতর। প্রত্যেকে গ্রন্থ মুখস্থ করে আর অন্তহীনভাবে পুনরাবৃত্তি করে। তারা হলো মানুষ-গ্রন্থের সৃষ্টি করা এক নতুন লোককথা, যা তাদের প্রচলিত শাসনব্যবস্থাকে এগিয়ে যেতে এবং গ্রন্থের ভালোবাসার ভেতর বেঁচে থাকতে দেয়। ঠিক যেমনটা ত্রুফো করতেন।

গ্রন্থে যদি এটা সহজবোধ্য হতো, এটা এখন আরও পরিষ্কার যে, ত্রুফোর সবগুলো মুভিই সিনেমার কথা বলে। চরিত্রেরা সিনেমা দেখে, সিনেমা পড়ে, সিনেমা নিয়ে আলাপ করে। আর সেটাও সিনেমা হয়ে ওঠে। এই সিনেমাটিক জগতে একটা সড়ক আছে। সেই সড়কের নাম জাঁ ভিগো। এই চাঁদোয়া নির্দেশ করেন জন ফোর্ডের কথা- যে অগ্নিমানবের স্বপ্ন মিলে যায় ‘ভার্টিগো’র প্রধান চরিত্রের সঙ্গে, ভবিষ্যৎবাদী সাহিত্য-চিতায় পোড়া ‘কাহিয়ার’-এর একটা কপির সঙ্গে, এমনকি খুব সম্ভব ‘বেড অ্যান্ড বোর্ড’-এ মঁসিয়ের হুলো হিসেবে আবির্ভূত হওয়া জ্যাক তাতির সঙ্গে। যে শিল্পের রূপান্তর ঘটেছে তার জীবনে, ত্রুফো সেটাকেই তার সব আউটপুটে চরম ধ্যানে হাজির করেছেন। এই সব প্যাশনকে এক ফিল্মে সংক্ষিপ্তরুপে ধারণ করে আছে ‘ডে ফর নাইট’ [১৯৭৩]। এখানে আমরা একজন মানুষের মনোরম জীবনযাত্রা দেখি, দেখি কোনো শিল্পের উপর আস্থার অকৃত্রিম প্রজ্ঞাপন। এই ফিল্মে ফিল্মমেকার [ত্রুফো অভিনীত] চরিত্রটি ঠিক ফিল্মমেকিং করছেন না, তার নিজ অস্তিত্বের দিনলিপি লিখে রাখছেন। ‘ইনট্রোডিউসিং পামেলা’ নামের কল্পিত ফিল্ম প্রজেক্ট এবং উপযুক্ত ফিল্ম হলো প্রত্যেকটা শটের অন্তরালে আসলে স্মৃতিকাতর চাহনি এক- যেমন করে ফিল্মমেকিংয়ে কেটে যায় একেকটা দিন। এটাকে একটা ‘অথর’ ফিল্ম ধরা যায় না; বরং সাহিত্যসংস্কৃতিতে অনুৎসাহী বাণিজ্যিক ফিল্ম একটা। ত্রুফোর উদ্দেশ্য ছিল মূলত বাস্তবিক কোনো মজার কাহিনী দেখানোর; টেকনিক্যাল নয়। ফলে দাঁড়ালো সিনেমার ভালোবাসার একটা গল্প। আর এটা ‘সেরা বিদেশী ফিল্ম’ ক্যাটাগরিতে অস্কার জিতে নিলো।


ফ্রেঞ্চ ফিল্ম নয়ার
১৯৪৬ সালে জার্মান দখলদারিত্ব থেকে মুক্তি ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে ফ্রান্সে আবার আমেরিকান ফিল্ম ফিরে এলো। এই দলে হিচককের কিছু থ্রিলার বেশ ভূমিকা রাখলো। ত্রুফো মুহূর্তেই এই স্টাইলের গুণমুগ্ধ ভক্ত হয়ে গেলেন। এর প্রধান কারিগরের সঙ্গে দেখা করতে লস অ্যাঞ্জেলসে গেলেন ১৯৬২ সালে। ছয়দিন ধরে যে সাক্ষাৎকার নিলেন তিনি, চার বছর পর সেটি বই আকারে ছাপা হলো; নাম- ‘দ্য সিনেমা অ্যাকোরডিং টু হিচকক’। এতে মহান ইংলিশ ফিল্মমেকার হিচককের প্রতি ত্রুফোর আনুগত্য ও শ্রদ্ধা স্পষ্টতমভাবে পরিলতি হলো।

এই প্রভাব থেকে ছয়টি মুভি সম্মানিত হয়েছে : ‘দ্য ব্রাইড ওর্য় ব্ল্যাক’ [১৯৬৭], ‘মিসিসিপি মারমেইড’ [১৯৬৯], ‘সাচ অ্যা গর্জিয়াস কিড লাইক মি’ [১৯৭২] আর ‘কনফিডেনশিয়ালি ইর্উস’ [১৯৮৩]। এর মধ্যে শেষেরটা ছিল একাধারে তার সেরা থ্রিলার, একটা খাঁটি ফরাসি ‘ফিল্ম নয়ার’, উদ্দেশ্যে সুন্দর ও ফলাফলে বিষম। ফিল্মটির প্রতি পদে ত্রুফো নিজেকে অতিমাত্রায় সিরিয়াসলি না নেওয়ার, নিজেকে ও ফিল্মের এই শাখাকে নিয়ে মজা করার এবং হিচককের প্রতি সম্মান জানানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। উজ্জ্বল নারীদের মতো এক পুরুষ এর প্রধান চরিত্র- যে মৃত; পেছনে বিঁধে আছে ছুরি; যেটি অপরাধী দলের প্রতি ‘সন্দেহের ছায়া’ ফেলে যায়নি- যেমনটা দেখেছি ‘রেআর উইন্ডো’তে [১৯৫৪], দোষী মানুষটি নড়তে অম, বেইসমেন্টে আটকে গেছে, চাইছে এক নারীর সাহায্য।

ত্রুফোর থ্রিলারগুলোর সমস্যা হলো, এর প্রধান চরিত্রেরা অতি মাত্রায় সংবেদনশীল, ক্রিমিনাল এন্টারপ্রাইজে সফল হওয়ার  ক্ষেত্রে অনেক বেশি ঋদ্ধ। ইউরোপিয়ান বিষাদের একটা নমুনা তার ‘ফিল্ম নয়ার’গুলোতে রঞ্জিত হয়ে আছে। ঘিরে থাকা চরিত্রগুলোর বেশিরভাগ স্বাভাবিকভাবেই নারী : লিনা [মারি দুবু অভিনীত], জুলি কোলার [জেন মরিও অভিনীত] , জুলি রাসেল [ক্যাথেরিন দিনিবি অভিনীত], ক্যামেলি ব্লিস [বার্নদাতে লাফোঁ অভিনীত] আর বারবারা [ফ্যানি আঁদাত অভিনীত]। এই নারীরা চরম শক্তিশালী চরিত্র একেকটা; এমনকি অবস্থানভেদে ভয়ঙ্করও। তবে তারা পৃথিবী দেখা ও বোঝার ক্ষেত্রে তাদের নিজস্ব চিন্তা অনুসারে আচরণ করে। সে যাই হোক, তাদের স্রষ্টা খুব ভালোবাসতেন তাদের জন্য যন্ত্রণা রচনা করতে কিংবা তাদেরকে দিয়ে যন্ত্রণা ছড়াতে। ত্রুফো কেবল তাদের ভালোবেসে যাওয়ার কথাই ভাবতেন।

 

Antoine_and_Colette
প্যাশন, লাভ অ্যান্ড আদার প্রব্লেমস
‘লাভ অন দ্য রান’-এ স্মৃতিকাতর আন্তনি তার মাকে মনে করে : ‘তিনি আমাকে শিখিয়েছিলেন, ভালোবাসাই একমাত্র কাজের জিনিস। ’ ত্রুফো মনে হয় মাতৃতুল্য চিত্রকল্পকে সঙ্গতিপূর্ণ করতে চেয়েছিলেন, তবে তখনো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণভাবে প্যাশনকে কবুল করেছেন- আর এটাই খাওয়াতো তাকে, আর এটাই তার ফিল্মকে সাজিয়ে দিতো। তার যৌবনের পতিতাদের থেকে শুরু করে নাগালের মধ্যে থাকা মোহনীয় ফিল্মস্টাররা পর্যন্ত- নারীপ্রেমের প্রতি তার আকৃষ্টতার কোনো সীমানা ছিল না। ‘সাচ অ্যা গর্জিয়াস কিড লাইক মি’তে অর্থার [চার্লস ডিনার] আর ‘ডে ফর নাইট’-এ আলফোসঁ [লদ অভিনীত] এই ভঙ্গিটা বজায় রাখে; এবং ‘শ্যূট দ্য পিয়ানো প্লেয়ার’-এর প্লাইনে [সার্জে দেব্রি অভিনীত] চরিত্রটির কণ্ঠে আসলে ত্রুফোরই কণ্ঠস্বরের প্রতিফলন ঘটে : ‘নারী হলো খাঁটি, কোমল, নাজুক। নারী হলো অবাক করা জিনিস, নারী হলো সর্বপ্রধান। আমার কাছে নারী সবসময়ই সর্বোচ্চতম। ’ ত্রুফো তার প্রায় সব অভিনেত্রীর প্রেমেই উন্মাদের মতো পড়েছিলেন। তাদের প্রতি তার দিক থেকে এটা ছিল এক আচ্ছন্নতা- সেখানে বৈবাহিক অবস্থান কিংবা কমিটমেন্টের কোনো জায়গা ছিল না। তিনি ছিলেন সত্যিকারের সেই পুরুষ, যিনি ‘সব’ নারীকে ভালোবাসতেন, আর মোহনীয় মতায় অনিন্দ্যসুন্দর নারী প্রতিকৃতি ফুটিয়ে তুলতেন তার ফিল্মে; আর আমাদের দেখাতেন আবেগপ্রবণ ভালোবাসার জটিল বর্ণচ্ছটা।

অঁরি-পিয়েরে রোচের উপন্যাস অবলম্বনে ১৯৬২ সালে বানিয়েছিলেন ‘জুলস অ্যান্ড জিম’। বানানোর কয়েক বছর আগেই পড়েছিলেন উপন্যাসটি। সুতাহীন সংযুক্তি আর ভবিষ্যৎবাণীর ঊর্ধ্বে থাকা নারীর প্রতি ত্রুফোর বিমুগ্ধতার একটা আদর্শ ফিল্ম হিসেবে এই ফিল্মটি হাজির হয় আমাদের সামনে। ক্যাথেরিনের [জেন মরিও অভিনীত] প্রাণশক্তি দুই বন্ধুকে এমন ঘূর্ণিবায়ুতে টেনে নিয়ে যায়- যেখানে মৃত্যুই কেবল পারে তাদের স্থির করতে। আরেকটা ত্রিভুজ প্রেম প্রকাশিত হয়েছে ‘টু ইংলিশ গার্ল’-এ। এখানে অবশ্য দুই নারী। এটিও বানানো হয়েছে রোচের উপন্যাস থেকে। এই ফিল্মে মনোনিবেশের কেন্দ্রে হলো একটা পুরুষ, নাম তার কদি [লদ অভিনীত]- ব্রিটিশ দুই বোনকে উত্তেজিত করে সে। একজনের নাম এ্যানি, আরেকজনের মুরিয়েল। মানুষের পূর্ণবিকাশের নানা পর্যায়ে একটা রোমান্টিক সম্পর্ক কীভাবে টিকে থাকে- এই ফিল্মে ফিল্মমেকার আমাদের সেটাই দেখাতে চেয়েছেন। ফলে শুরুতেই আমরা কদি ও মুরিয়েলের মধ্যে কৈশোরের নিষ্কাম প্রেম দেখি, পরে যৌবনে কদি ও এ্যানির মধ্যে পাই দৈহিক প্রেমের দেখা। হঠাৎ হওয়া এই সঙ্গীদের স্বল্পণের প্রকৃতির যে দুটি চরম চিত্র ত্রুফো তার ফিল্মে এঁকেছেন, তা যেমন দেয় ব্যভিচারের পাঠ, তেমনি দেয় আত্মসুখেরও। স্পর্শকাতর এই দ্বন্দ্ব নিয়ে নিশ্চয়ই মৃত্যুও খেলা করবে।

মস্তিস্কবিকৃতির সঙ্গে তার আবেগপ্রবণ প্রেম, আমাদের মমত্বের কোনো বস্তু নিয়ে স্পষ্ট চিন্তা করতে অম- এভাবে চিহ্নিত করা যায় ত্রুফোকে। আর সবচেয়ে আজগুবি ব্যাপার হলো, তিনি তার প্যাশনকে এতোটাই অতিরিক্ত মাত্রায় দেখান যে, সেটাকে ভোগ করতে হয় শাস্তি। সাধারণত এই শাস্তির ফল হলো- মৃত্যু। এমনকি ‘দ্য মিসচীফ মেকার’-এও আমরা এমনটা দেখি। বিয়ের  ক্ষেত্রে তার ধারণা একদমই স্বচ্ছ নয়; সাধারণত একঘেয়েমির বিরক্তির সঙ্গে একে দলবদ্ধ করে দেয়। আর এটা বিবাহবহির্ভূত যৌনসম্পর্কের রোমাঞ্চকে ন্যায্যতা দেয়। বৈবাহিকজীবনের একঘেয়েমিতা আছে ‘ফোর হান্ড্রেড ব্লৌজ’-এ, আছে ‘শ্যূট দ্য পিয়ানিস্ট’-এ, আছে ‘দ্য সফ্ট স্কিন’-এ, আছে ‘দ্য ওম্যান নেক্সট ডোর’-এ। বিধান হিসেবে বিয়ে দুঃখ বয়ে আনে ‘দ্য ব্রাইড ওঅর ব্ল্যাক’-এ, আর মর্যাদাহানী ও প্রবঞ্চনা করে ‘মিসিসিপি মারমেইড’-এ।

তার আবেগপ্রবণ গল্পগুলোর মধ্যে ‘দ্য সফ্ট স্কিন’ সবচেয়ে বেশি শারীরিক; শরীর-কামনার সবচেয়ে বেশি পুলকিত ফিল্মগুলোর একটা। আর এতে অবশ্যই নারীরা নিষিদ্ধ। মেয়েটির নাম নিকোল [ফ্রাঁসোয়া ডলারেস অভিনীত]। বিমানবালা। তার সৌন্দর্যে দিশেহারা হয়ে বয়স্ক ও বিবাহিত লেখক পিয়েরে ল্যাচানি [জাঁ দিসালি অভিনীত] তাকে সঙ্গমে প্রলুব্ধ করে। একটা বোর্ডিং হাউজে তাদের গোপন অভিসারটি ত্রুফোর ফিল্মের সবচেয়ে চরম সেনসুয়াল মুহূর্তের সৃষ্টি করে; আর থরোথরো আবেগে মনে করিয়ে দেয় লুই মালের ‘দ্য লাভার্স’ [১৯৫৮] ফিল্মটির কথা। ত্রুফোর গল্পে সাধারণত শিশুসুলভ বৈশিষ্ট্যের পুরুষের বিপরীতে বলিষ্ঠ ও স্থূল নারীর দেখা মেলে। ‘দ্য সফ্ট স্কিন’-এ পিয়েরের স্ত্রী ফ্রাঙ্কাও তেমনি। ফিল্মের শেষে সে বিচার নিবেদন করে এবং স্বামীর ব্যভিচারের শাস্তি দেয়।

তবে কেউ যদি ‘ক্রেজি লাভ’ নিয়ে চরম গবেষণা করে, তাহলে দু’টি নিশ্চিন্ত ফিল্মের দেখা পাবে। একটা হলো ‘দ্য স্টোরি অব আদেলে এইচ.’, আরেকটা  ‘দ্য ওম্যান নেক্সট ডোর’। প্রথমটা ভিক্টর হোগোর কন্যা আদেলেকে নিয়ে। ১৮৬৩ সালে আর্মি অফিসার আলবার্তের প্রতি আচ্ছন্ন হয়ে হ্যালিফ্যাক্সে পালিয়ে গিয়েছিল সে। এই পাগলামিতে ডুবে সে একটা কল্পিত জগত আবিষ্কার করেছিল- যেখানে প্রতিটা সময়ে বিশাল মিথ্যের ভেতর বসবাস সম্ভব। আদেলের চরিত্র নির্মাণের বেলায় ত্রুফো সাংঘাতিক যত্ন  নিয়েছেন। ফলে তার কিছু কিছু সংলাপে আমরা আসলে ত্রুফোর কণ্ঠই যেন শুনতে পাই। ধরা যাক এই লাইনটার কথাই- ‘আমাকে জন্ম দিয়েছিলেন এক অজ্ঞাত পিতা’। এই চরিত্রের আত্মজৈবনিক গঠন আমরা চিনতে পারি। কেননা, ত্রুফোর সব ফিল্মের মতো সেও ভালোবাসার স্পর্ধা দেখাতে গিয়ে নিয়তির যন্ত্রণায় ভোগে। ‘দ্য ওম্যান নেক্সট ডোর’-এ দুই সাবেক সঙ্গী বার্নার্ড [জেরার্ড ডিপার্ডিও অভিনীত] আর ম্যাথিদে [ত্রুফোর দ্বিতীয় স্ত্রী ফ্যানি আদাতঁ অভিনীত] যখন ভাগ্যের জোরে পুনর্মিলিত হয়, তখন একই ঘটনা ঘটে বলে মনে হয়। উত্তেজিত করতে ও আশাহীন আগুনে ঝাঁপ দিয়ে পুড়ে মরতে তাদের মধ্যে ফিরে আসে অনুরাগ।

তাদের পরস্পরকে দেখার এই বিশৃঙ্খল প্রয়োজনীয়তা, কোনো কিছু পক্ষে না থাকলেও আলাদা থাকার অপারগতা এবং নিজেদের দোষী জানা- এইসব করুণ খুব।


এবং মৃত্যু যখন দাঁড়ালো এসে...
‘দ্য স্টোরি অব আদেলে এইচ.’-এর সাউন্ডট্র্যাক রচয়িতা মরিস জোবের ফিল্মটির প্রিমিয়ারে আসেননি। না, আগেকার কোনো কমিটমেন্টের জন্য নয়; জোবেরের না আসার কারণ হলো- ৩৫ বছর আগেই মরে গেছেন তিনি। যুদ্ধক্ষেত্রে যখন লড়ছিলেন ফ্রান্স রক্ষায়- দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ তখন তাকে নিয়ে গেছে মৃত্যুর দেশে। ছোট্ট জীবনে তিনি জাঁ ভিগোর ‘লা আটলান্টে’ [১৯৩৪] ফিল্মের মতো বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ ফিল্মে মিউজিক লিখে গেছেন। তার মিউজিক্যাল উত্তরাধিকারকে ভুলে যেতে দিতে নারাজ ছিলেন ত্রুফো। আর তাই ‘স্মল চেঞ্জ’, ‘দ্য ম্যান হু লাভ্ড ওমেন’ এবং অবশ্যই ‘দ্য গ্রিন রুম’-এ ব্যবহার করেছেন জবের কম্পোজিশন। পরবর্তীকালে, মরিস জোবেরের যে ছবিটা ছিল, সেই ছবিতে পুরো ঘর, মোমবাতি ও স্মৃতি ভরে ফেলেছিলেন। নিজেকে কেবল ‘জীবনের দর্শক এক’ ঘোষণা করা জুলিয়েন সংবাদপত্রে শোকবার্তা লিখতে গিয়ে যে কথা লিখেছিলেন, সেই ‘মৃত জানে বেঁচে থাকতে’ বাক্যটিও জুড়ে থাকলো ত্রুফোর চারপাশের জগতে।

এই ফিল্মে জুলিয়েন চরিত্রে অভিনয় করলেন ত্রুফো। প্রেমাচ্ছন্নতার প্রতি তার সুনির্দিষ্ট ও বিকশিত শ্রদ্ধা তো ছিলই, তবে এই বেলা মৃত্যুর দিকে নির্দেশিত হলেন। এটা তাকে ন্যায়পরায়ণতা বিধান করতে, সব কিছুকে যথার্থ স্থানে ছেড়ে দিতে সাহায্য করলো। ১৯৮৩ সালের আগস্টের একদিন। ত্রুফো অনুভব করলেন, ‘একটা পটকাবাজি যেন বিস্ফোরিত হলো আমার মাথার ভেতর’। আসলে মারাত্মক ব্রেন-টিউমারে ভুগছিলেন তিনি। তেজ ও অতি মানসিক জোরের সময়ের ভেতর দিয়ে, হতাশা ও যন্ত্রণার মিশ্র মুহূর্তের ভেতর দিয়ে ত্রুফো তার জীবনের শেষ মাসগুলো পরিবার ও বন্ধু-বেষ্টিত হয়ে কাটিয়েছেন। ১৯৮৪ সালের ২১ অক্টোবর তার পার্থিব জীবন চিরতরে শেষ হয়ে যায়। ফ্রাঁসোয়া ত্রুফো যখন মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন, তখন তার বয়স ৫২ বছর।

কিন্তু ত্রুফোর মতো শিল্পী টিকে থাকবেন সেই সব স্মৃতিতে- যেখানে ভালোবাসা আছে, যেখানে জানা-অজানার ঊর্ধ্বে রয়েছে বিস্ময়বিমুগ্ধতা। ফলে, একটা ফিল্ম যখন আমাদের আত্মা ছুঁয়ে যায়, যখন ফিসফাস করে কথা বলে আমাদের হৃদয়ের সঙ্গে, এবং আমাদের সকল জানতে চাওয়াকে উপলব্ধি করিয়ে দেয়; তখন খুব আনন্দের সঙ্গে এই কথাটা মনে করার সুযোগ মেলে যে- একদা একজন মানুষ জীবিত ছিলেন, ফ্রান্স দেশে, ফিল্ম দিয়ে তিনি একটা জগত সৃষ্টি করে গেছেন, আর তিনি জানতেন কীভাবে সেটা সাজানা লাগে, আর পুরো আত্মার বেলায় এখানেই যতো গোপনীয়তা।

তথ্যব্যাংক
ফ্রাঁসোয়া ত্রুফো। জন্ম : ৬ ফেব্রুয়ারি, ১৯৩২, প্যারিস, ফ্রান্স। মৃত্যু : ২১ অক্টোবর ১৯৮৪, নিওলি-সার-সিয়েনে, ফ্রান্স। নির্মিত ফিল্ম : অ্যা ভিজিট [১৯৫৫], দ্য মিস্চীফ মেকার্স [১৯৫৭], দ্য ফোর হান্ড্রেড ব্লৌজ [১৯৫৯], শ্যূট দ্য পিয়ানো প্লেয়ার [১৯৬০], অ্যা স্টোরি অব ওয়াটার [জাঁ-লুক গদারের সঙ্গে যৌথ নির্দেশনা; ১৯৬১], জুলস অ্যান্ড জিম [১৯৬২], আন্তনি অ্যান্ড কলেতে [১৯৬২], দ্য সফ্ট স্কিন [১৯৬৪], ফারেনহাইট ৪৫১ [১৯৬৬], দ্য ব্রাইড ওয়্যর ব্ল্যাক [১৯৬৮], স্টোলেন কিসেস [১৯৬৮], মিসিসিপি মারমেইড [১৯৬৯], দ্য ওয়াইল্ড চাইল্ড [১৯৭০], বেড অ্যান্ড বোর্ড [১৯৭০], টু ইংলিশ গার্লস [১৯৭১], সাচ অ্যা গর্জিয়াস কিড লাইক মি [১৯৭২], ডে ফর নাইট [১৯৭৩], দ্য স্টোরি অব আদেলে এইচ. [১৯৭৫], স্মল চেঞ্জ [১৯৭৬], দ্য মেন হু লাভ্ড ওমেন [১৯৭৭], দ্য গ্রিন রুম [১৯৭৮], লাভ অন দ্য রান [১৯৭৯], দ্য লাস্ট মেট্রো [১৯৮০], দ্য ওম্যান নেক্সট ডো [১৯৮১], কনফিডেনশালি ইর্উস [১৯৮৩]। অন্য ফিল্মমেকারদের জন্য লেখা স্ক্রিপ্ট : ব্রেথলেস [ফিল্মমেকার : জাঁ-লুক গদার; ১৯৬০], দ্য লিটল থিফ [ফিল্মমেকার : কদি মিলার; ১৯৮৮], বেলে ইপোকিউ [ফিল্মমেকার : গ্যাভিন মিলার; ১৯৯৫]। অভিনয়: দ্য ফোর হান্ড্রেড ব্লৌজ, দ্য ওয়াইল্ড চাইল্ড, বেড অ্যাণ্ড বোর্ড, ডে ফর নাইট, দ্য স্টোরি অব আদেলে এইচ., স্মল চেঞ্জ, কোজ এনকাউর্ন্টাস অব দ্য থার্ড কাইন্ড [ফিল্মমেকার : স্টিভেন স্পিলবার্গ, ১৯৭৭], দ্য গ্রিন রুম, দ্য ওম্যান নেক্সট ডোর। অন্য ফিল্মমেকারের জন্য প্রযোজনা : গুড আনা [ফিল্মমেকার হেরি কোমেল, ১৯৫৮], টেস্টামেন্ট অব অর্ফিয়ুস [ফিল্মমেকার : জাঁ ককতো, ১৯৬০], দ্য গোল্ড বাগ [ফিল্মমেকার : রোবের লাচেনি, ১৯৬১], নেকেড চাইল্ডহুড [ফিল্মমেকার : মরিস পিয়ালাত, ১৯৬৮]। গ্রন্থ : ফোর হান্ড্রেড ব্লৌজ [১৯৬০], হিচকক অ্যান্ড হিচকক [১৯৬৭], অ্যাডভেঞ্চার্স অব আন্তদিনিয়েল [১৯৭০], স্মল চেঞ্জ : অ্যা ফিল্ম নভেল [১৯৭৬], ফিল্মস ইন মাই লাইফ [১৯৮১] ইত্যাদি।


[লেখক পরিচিতি : হুয়ান কার্লোস। কলম্বিয়ান ডাক্তার। ক্লিনিক্যাল মাইক্রোবায়োলজি ও এপিডেমিয়োলজি বিশেষজ্ঞ। ফিল্ম সমালোচকও। লিখেন ম্যাগাজিন ও পত্রিকায়]

বাংলাদেশ স্থানীয় সময় : ১২১৫, নভেম্বর ৪, ২০১০

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।