প্রকৃতির অমোঘ নিয়মেই বিদায় নিলেন এদেশের প্রবাদ-প্রতীম সঙ্গীতসাধক ও সংগ্রামী সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব কলিম শরাফী। ২ অক্টোবর তার মহাপ্রয়াণ বিহ্বল করেছে জাতিকে।
ফিরোজা বেগম
ওঁর চলে যাওয়াতে খুবই কষ্ট পেয়েছি। আমরা সমকালীন ছিলাম। সেই ১৯৫০-এর দশকে কলিম শরাফীকে আমি প্রথম ঢাকায় দেখি। এক সঙ্গে অনেক অনুষ্ঠানে গান গেয়েছি। আমি তখন ওঁর সঙ্গে রবীন্দ্র-সঙ্গীতও গেয়েছি। আমাকে ভীষণ সম্মান করতেন। আমাকে শহরের একজন ব্যস্ত শিল্পী হিসেবে জানতেন।
খুব বড়, খুব উদার মনের মানুষ ছিলেন তিনি। ...আমার বহু পুরোনো সুহৃদদের একজন ছিলেন তিনি। ... দেখা হলে খুব মজা করতাম। ...
গণসঙ্গীত নিয়ে আলোচনা করতাম। তার গানের গলা ছিল চমৎকার। তবে খুব কম গাইতেন। এসব নিয়েও আমরা মজা করতাম। আমরা সঙ্গীতে সহযাত্রী ছিলাম
আমি চাইবো তাঁর সঙ্গীতভবনের মাধ্যমে তার স্মৃতি চিরস্মরণীয় করে রাখা হোক। আর সঙ্গীতচর্”া অব্যাহত রাখুক।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
অসাধারণ শিল্পী ছিলেন কলিম শরাফী। তার কণ্ঠ ছিল বিশিষ্ট। আর সেটাই তার একমাত্র পরিচয় নয়। তিনি সকল প্রগতিশীল গণ-আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনি হিন্দু ছিলেন না মুসলমান ছিলেন সে প্রশ্ন কখনোই ওঠেনি। অথচ দেশ-ভাগের কারণে তাকে তার জন্মভূমি ছেড়ে চট্টগ্রামে আসতে হলো। এখানে এসেও তিনি গণতান্ত্রিক সাংকৃতিক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হলেন। এবং জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি এসবের সঙ্গে যুক্ত থেকেছেন।
ভারত-ভাগের পর তিনি এদেশে নতুন মধ্যবিত্ত সমাজে রবীন্দ্র-সঙ্গীতকে পরিচিত করে তুলেছেন। বস্তুত, তিনি এদেশের মানুষের ভিতর রবীন্দ্র-সঙ্গীত শোনার রুচি তৈরি করেছিলেন। এদেশে তখন প্রধানত লোকগান ও নজরুল গীতিই শোনা হতো। তিনি অনেক ছাত্র তৈরি করেছিলেন যে কারণে আজ এদেশে রবীন্দ্র-সঙ্গীতের এত প্রসার ঘটেছে।
আনিসুজ্জামান
কলিম শরাফী শুধু একজন মহৎ সঙ্গীতশিল্পীই ছিলেন না, তিনি একই সঙ্গে নিষ্ঠাবান সমাজকর্মী ছিলেন। ১৯৪০-এর দশকে ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলন করে স্বল্পকালের জন্যে তিনি কারারুদ্ধ হন। পরে কমিউনিস্ট পার্টির রাজনীতির প্রতি আকৃষ্ট হন। ভারতীয় গণ-মানুষের সঙ্গে তিনি কাজ করেছেন। দেবব্রত বিশ্বাস, সূচিত্রা মিত্র, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, শম্ভু মিত্র প্রমূখ দেশবরেণ্য শিল্পীর সঙ্গে তিনি গণসঙ্গীত গেয়েছেন এবং রবীন্দ্রসঙ্গীতের সাধনা করেছেন।
তাঁর বামপন্থী মনোভাবের জন্য পাকিস্তান আমলে তাঁকে অনেক বাঁধা-বিঘেœর মুখোমুখি হতে হয়েছে। একসময় তাকে বেতারে গান গাইতে দেওয়া হয়নি। তবে তিনি নিজের বিশ্বাসের প্রতি অবিচল ছিলেন। রবীন্দ্রসঙ্গীতের চর্চা যথাসাধ্য ছড়িয়ে দিয়েছেন দেশে। এবং বাঙালী সংস্কৃতির চর্চা ও বিকাশে অকান্তভাবে কাজ করে গেছেন।
তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের শ্রেষ্ঠ উপায় সঙ্গীতের একনিষ্ঠ চর্চা করা, বাঙালী সংস্কৃতিকে সমুন্নত রাখার চেষ্টা করা।
করুণাময় গোস্বামী
কলিম ভাইয়ের চলে যাওয়ার সংবাদ শুনে আমি ভীষণ ব্যথিত হয়েছি। তার ছিল অসাধারণ কণ্ঠ। তিনি ছিলেন রবীন্দ্র-সঙ্গীতের একজন বিশিষ্ট শিল্পী। তিনি তার যাদুকরী কণ্ঠস্বর দিয়ে শ্রোতাদের ভীষণভাবে মুগ্ধ করতেন।
কলিম ভাই তার চমৎকার গায়কী দিয়ে অত্যন্ত আশ্চর্যজনকভাবে রবীন্দ্রনাথের গানের ধ্যান-মগ্নতার দিকটি শ্রোতাদের ভিতরে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন।
মুর্তজা বশীর
কলিম শরাফী বা কলিম ভাইকে চিনতাম ঢাকায় সেই ১৯৫০-এর দশক থেকে। তার আগে কলকাতায় কলিম ভাইয়ের গণসঙ্গীতের সঙ্গে জড়িত থাকার বিষয়টি জানতাম। তবে রবীন্দ্রসঙ্গীতে তার দরদ-ভরা কণ্ঠ আমাকে অত্যন্ত অভিভূত করেছিল। তার আবেগ-ভরা গলা আমাকে মোহিত করেছিল।
আজ তো অনেক কিছুই মনে পড়ছে। তিনি আমাকে তার আত্মীয় বলে জানতেন। যখনই দেখা হতো তার অতিচেনা মৃদু হাসিটি দিয়ে আমাকে বরণ করতেন। হঠাৎ করেই আজ কথা বলতে গিয়ে ‘সূর্যস্নান’ ছবিতে কলিম ভাইয়ের প্লে-ব্যাক গানটির কথা খুব মনে পড়ছে। ছবিতে গানটিতে ঠোঁট মিলিয়েছিলেন আনোয়ার হোসেন। অত্যন্ত হৃদয়গ্রাহী ছিল গানটি।
তার তিরোধান আমাকে অত্যন্ত ব্যথিত করেছে। তিনি ছিলেন একজন অকৃত্রিম মানুষ। তবে কোনো জনবিরোধী কাজ হলে তিনি কঠোর হয়ে উঠতেন।
রামেন্দু মজুমদার
কলিম শরাফী আমাদের সকল সামাজিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলনে নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালন করেছিলেন। আমরা একজন আইকনকে হারালাম। তিনি কর্মজীবনে তার আদর্শের জন্যে কোনো কিছুর কাছেই নতি স্বীকার করেননি। একটি অসাম্প্রদায়িক সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার জন্যে তিনি নিরলস পরিশ্রম করে গেছেন।
সেই ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে, পাকিস্তান আমল এমনকি এদেশে যখনই জন-স্বার্থ বিরোধী কাজ হয়েছে তখনই তিনি প্রতিবাদী হয়ে ওঠেছিলেন। রবীন্দ্র-সঙ্গীতের প্রচার ও প্রসারের জন্যে তিনি যে কাজ করে গেছেন তা অতুলনীয়। তিনি দুই-বাংলাতেই সমান জনপ্রিয়।
এই মহান মানুষটির আদর্শকে যদি আমরা নিজেদের ভিতর ধারণ করতে পারি তাহলেই তার প্রতি প্রকৃত শ্রদ্ধা জানানো হবে।
নাসিরউদ্দিন ইউসুফ
কলিম শরাফী এই উপমহাদেশে একজন পুরোধা সঙ্গীতগুরু। সঙ্গীতকে তিনি নিছক বিনোদন-মাধ্যম হিসেবে চর্চা করেননি, তিনি একে আত্ম-উপলব্ধি, আত্ম-উন্নয়ন ও মানবকল্যাণের জন্য ব্যবহার করেছেন।
আজ থেকে প্রায় সাত দশক আগেই তিনি একটি অসাম্প্রদায়িক সমাজের জন্য নিজেকে নিযুক্ত করেছিলেন। তিনি কাজ করেছিলেন মানুষের মুক্তির জন্য। আর এই সূত্রেই তিনি, বিশেষ করে আকৃষ্ট হয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথের গানে। রবীন্দ্র-সাহিত্য সকল মানুষের মিলনের কথা বলেছে। তাই কলিম শরাফী এর অনুগামী হয়েছিলেন।
তিনি গানের মধ্য দিয়ে দেশের সামাজিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলনগুলোতে নিজেকে যুক্ত করেছিলেন অনমনীয় মনভাব নিয়ে। তাই তিনি কখনোই কোনো স্বার্থের সঙ্গে আপস করেননি। তিনি একজন অনুকরণীয় ব্যক্তি। তার আদর্শ মেনে চলতে পারলে আমরা নিজেদের শুদ্ধ করতে পারবো।
আমাদের উচিত তার সঙ্গীতভবনের মধ্য দিয়ে তার আদর্শকে জাগরুক রাখা, একে আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। একটি প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করে আমরা তাকে আমাদের তরুণ প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে পারি।
রিজওয়ানা চৌধুরী বন্যা
অনেক প্রতিকূলতার ভিতর দিয়ে কলিম শরাফী তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে রবীন্দ্রসঙ্গীতকে জনপ্রিয় করে তুলেছিলেন। এটাকেই আমি এদেশের শিল্প-সংস্কৃতিতে তার সবচেয়ে বড় অবদান বলে মনে করি। এজন্যে তাকে অনেক কিছু ত্যাগ করতে হয়েছিল। তবে তিনি কখনোই কারো কাছে নত হননি। সবসময়ই তিনি তার আর্দশকে সমুন্নত করে রেখেছিলেন।
আমরা তার ওপর একটি স্মারকগ্রন্থ চাই। যেখানে আমরা কলিম শরাফীর অবদান বিভিন্ন লেখকের মাধ্যমে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে জানতে পারবো। এছাড়া, তার গাওয়া গানগুলোকে আরো ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দেওয়া দরকার। আগ্রহী শ্রোতাগণ যেন তার গান শুনতে পান সে ব্যবস্থা করা দরকার।
মহিউজ্জামান চৌধুরী
মূলতঃ কলিম শরাফীকে হারিয়ে জাতি একটা অধ্যায় হারিয়েছে। জাতি তার সুকণ্ঠ থেকে বঞ্চিত হলো। তিনি অসম্ভব প্রতিভাবান ও প্রখর ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন মানুষ ছিলেন। তার জীবনের প্রথমভাগ কেটেছিল অবিভক্ত ভারতে। তখন থেকেই তিনি এই অঞ্চলের সামাজিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলনে যুক্ত হয়ে দেশসেবায় নিয়োজিত হয়ে এদেশের উন্নয়নে অবদান রেখে গেছেন।
পরবর্তী সময়ে পাকিস্তান আমলে এবং স্বাধীন বাংলাদেশে বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে তিনি এদেশের সামাজিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলনকে বেগবান করেছিলেন।
তিনি রবীন্দ্র-সঙ্গীতকে এতো ভালোবাসতেন যে, এদেশে রবীন্দ্র-সঙ্গীতকে জনপ্রিয় করে তোলার জন্য তিনি জীবনের অধিকাংশ সময় ব্যয় করেছিলেন। তিনি সঙ্গীতভবন প্রতিষ্ঠা করে শিল্পীদের গায়কীর উন্নয়নে নিরলস পরিশ্রম করেছিলেন।
তিনি দেবব্রত বিশ্বাসের গান খুব পছন্দ করতেন। আমার গায়কী ঢং নিয়ে অনেক পরামর্শ দিতেন। আজ আমি এক বিশাল শূন্যতা অনুভব করছি।
এই সময়ে আমাদের উচিত কলিম শরাফীর নামে একটি ‘স্মৃতি পরিষদ’ গঠন করা এবং সেই পরিষদের মাধ্যমে তার কাজগুলোকে সংরক্ষণ করা।
বাংলাদেশ স্থানীয় সময় : ১৮২০, নভেম্বর ৪, ২০১০