ঢাকা, শুক্রবার, ১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৫ নভেম্বর ২০২৪, ১৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

নীরবেই পার হচ্ছে ‘মেঘনাদবধ কাব্য’র সার্ধশতবর্ষ

রক্তিম দাশ, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭০৩ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৯, ২০১০
নীরবেই পার হচ্ছে ‘মেঘনাদবধ কাব্য’র সার্ধশতবর্ষ

কলকাতা: বাংলাসাহিত্যে অমিত্রাক্ষর ছন্দ বা ‘ফ্রি ভার্স’র প্রবর্তক মাইকেল মধুসূদন দত্তের(১৮২৪-৭৩) ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ রচনার সার্ধশতবর্ষ পার হতে চললেও দুই বাংলার সাহিত্য-সংস্কৃতি অঙ্গনে তেমন কোনও আলোড়ন বা আনুষ্ঠানিকতা নজরে পড়ছে না।

১৮৬১ সালের ৪ জানুয়ারি বাংলা তথা ভারতীয় কোনও ভাষায় রচিত প্রথম মহাকাব্য মেঘনাদ বধ প্রকাশিত হয়।


 
বিশ্বের একটি প্রধান জাতিগোষ্ঠী ও ভাষার প্রথম মহাকাব্য তার প্রকাশের দেড় শত বছরের মাইল ফলক স্পর্শ করেছে, অথচ সেই জাতির তা নিয়ে কোনও আগ্রহ বা উৎসাহ নেই--বিষয়টি একই সঙ্গে হতাশার এবং ব্যর্থতারও। বিশ্বজুড়ে সাহিত্যামোদী তথা সাধারণ শিতি বাঙালিদের জন্য এ ঘটনা অবশ্যই অস্বস্তিকর বলা যায়।    

মেঘনাদবধ রচনার আগে এক আলোচনা অনুষ্ঠানে মধুসূধন প্রচলিত পয়ার ছন্দের পরিবর্তে অমিত্রাক্ষর ছন্দে বাংলা কাব্য রচনার ইচ্ছা প্রকাশ করলে অনুষ্ঠানে উপস্থিত যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর কিছুটা উপহাসের ঢঙে প্রশ্ন তোলেন, ‘পয়ার বাদ দিয়ে অমিত্রাক্ষর ছন্দ! বাংলায় কি তা সম্ভব?’

কিন্তু বাংলায় অমিত্রার প্রচলনের সাফল্য নিয়ে যতীন্দ্রমোহনের সন্দেহকে অমূলক প্রমাণ করে দিয়ে মধুসূদন দু’বছরের মধ্যে অমিত্রাক্ষর ছন্দে লিখে ফেললেন পরপর চারটি অসাধারণ কাব্য- ‘তিলোত্তমাসম্ভব’(১৮৬০), ‘মেঘনাদবধ কাব্য’(১৮৬১), ‘ব্রজাঙ্গনা কাব্য’(১৮৬২) ও ‘বীরাঙ্গনা কাব্য’(১৮৬২)।

‘মেঘনাদবধ কাব্য’-কে বাংলা সাহিত্যে মহাকাব্য বলা হয় এবং একই সঙ্গে বাংলায় আধুনিক মহাকাব্য রচনার পথিকৎ রূপে মাইকেল মদুসূদন দত্তকে ধরা হয়।

তবে মাইকেল নিজে মেঘনাদবধ কাব্যকে মহাকাব্য বলতে চাননি। তিনি বলেছেন, ‘এটি ছোটমাপের মহাকাব্য। ’ কিন্তু আধুনিক সাহিত্য সমলোচকরা একবাক্যে স্বীকার করেছেন, মাইকেল শুধু বাংলায়ই না, কোনও ভারতীয় ভাষায় আধুনিক মহাকাব্যের জনক।

জানা যায়, মধুসূদনের লেখা ইংরেজি নাটক ‘রিজিয়া’ পড়ার পর  রাজনারায়ণ বসু তাকে অনুরোধ করেছিলেন বাঙালির ছেলে বিজয় সিংহের ‘সিংহল বিজয়’ নিয়ে একটি মহাকাব্য লিখতে। তবে বিজয় সিংহ নিয়ে মহাকাব্য না লিখলেও মধুসূদন মহাকাব্য ঠিকই লিখেন। আর তা হলো মেঘনাদবধ কাব্য।

গ্রীক রীতিতে হিন্দু পূরাণের (রামায়ন) কাহিনী অবলম্বনে রচিত মেঘনাদবধ কাব্যের প্রথম সংস্করণ দু’টি খণ্ডে প্রকাশিত হয়। প্রথম খণ্ড ছিল পঞ্চম সর্গ পর্যন্ত যার পৃষ্ঠা সংখ্যা ১৩১টি, প্রকাশিত হয়েছিল ৪ জানুয়ারি ১৮৬১ সালে। দ্বিতীয় খণ্ডে ছিল শেষ চার সর্গ যার পৃষ্ঠা সংখ্যা ১০৪টি।

রাজা তিম্বর মিত্র মেঘনাদবধ কাব্যের প্রথম সংস্করণের ব্যয়ভার বহন করেছিলেন। কাব্যটি তার নামেই উৎসর্গ করেছিলেন মধুসূধন।

মেঘনাদবধ কাব্যের সাফল্য অনেক। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রথম জীবনে এই কাব্যের নেতিবাচক সমালোচনা করেছিলেন। আক্রমণাত্মক ওই সমালোচনার শেষে তিনি লিখেছিলেন, ‘আমি মেঘনাদবধ কাব্যের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ লইয়া সমালোচনা করিলাম না। আমি তাহার মূল্য লইয়া, প্রাণের আধার লইয়া সমালোচনা করিলাম, দেখিলাম তাহার প্রাণ নাই। দেখিলাম তাহা মহাকাব্যই নয়। ’

তবে পরিণত বয়সে কবিগুরু মাইকেল মধুসূদনকে এই মেঘনাদবধ কাব্যের জন্যই সাধুবাদ জানিয়ে লিখেছিলেন, ‘কবি পয়ারের বেড়া ভাঙিয়াছেন। ’ রবীন্দ্রনাথ আরও লিখেছেন, ‘যে শক্তি অতি সাবধানে সমস্তই মানিয়া চলে, তাহাকে যে মনে মনে অবজ্ঞা করিয়া, যে শক্তি স্পর্ধাভরে কিছুই মানিতে চায় না, বিদায়কালে কাব্যলক্ষী নিজের মালাখানি তাঁহারই গলায় পরাইয়া দিল। ’

মেঘনাদ বধ কাব্য সম্পর্কে ড. অসিতকুমার বন্দোপাধ্যায় বলেছেন, ‘এ কাব্যে মহাকাব্যের যে সুর বেজেছে, বাঙালির পয়ারে অভ্যস্ত কানে তা উৎকট, অদ্ভূত ও অস্বাভাবিক মনে হয়েছিল। এর মধ্যে রাম-রাবণের চরিত্র যেভাবে উপস্থাপিত করা হয়েছে, তার জন্য বাঙালির পুরানো সংস্কার বিদ্রোহী হয়েছিল। এর বাচনভঙ্গি, ছন্দ-অলঙ্কার প্রভৃতিও পাঁচালীর ভক্ত বাঙালিকে বিমূঢ় করে ফেলেছিল। পরে ক্রমে ক্রমে মধুসূধনের মেঘনাদবধ কাব্যের অনুপম মহিমা সকলে বুঝিতে পারল, কবি শিক্ষিত সমাজের কাছে মহাকবি রূপে ছাড়পত্র পেলেন। ’

এই কাব্যে অষ্টম সর্গে রামচন্দ্রের প্রেতপুরিতে যাওয়ার দৃশ্যের সঙ্গে কবি ভার্জিনের ‘ইনিড’ এবং দান্তের ‘দিভিনা কোম্মেদিয়ার’ মিল পাওয়া যায়। এক্ষেত্রে সমালোচকদের কারও কারও মন্তব্য এ রকম---কবি পাশ্চাত্য শিক্ষার দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু এটা মনে রাখতে হবে তিনি আর একটি রামায়ন লেখেননি। রামায়নের অংশ বিশেষকে কেন্দ্রে রেখে নির্মাণ করেছেন একটি মহাকাব্য।

নাট্যমঞ্চে মেঘনাদবধ কাব্য একাধিক বার অভিনীত হয়েছে। বাংলা নাট্যমঞ্চের প্রবাদপুরুষ গিরিশ ঘোষ এর নাট্যরূপ দিয়েছেন। হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর উদ্যোগে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্চে এটি অভিনীত হয়েছে। আজও এই মহাকাব্যটি দুই বাংলার নাট্যদলগুলির প্রচেষ্ঠায় নতুন আঙ্গিকে ফিরে ফিরে আসে মঞ্চে।

তাই বোধহয় এই মহাকাব্যটি রচনার সার্ধশতবর্ষপরও বাঙালির মনকে ছুঁয়ে যায় বার বার এর অমোঘ আর্কষণ।

বাংলাদেশ সময়: ১৩৪৭ ঘন্টা, ১৯ নভেম্বর, ২০১০

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।