ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১১ পৌষ ১৪৩১, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

ফিদেল কাস্ত্রোর আত্মজীবনী : ‘কৌশলগত বিজয়’

আহমেদ জুয়েল | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮৪৬ ঘণ্টা, জুন ৬, ২০১০

‘একদিকে সাধারণ অস্ত্র নিয়ে ৩০০ গেরিলা, অন্যদিকে আধুনিক অস্ত্রসজ্জিত ১০ হাজার সেনা। সেই লড়াইটা ছিল অসম।

আমার বিপ্লবী গেরিলারা ওদের প্রতিরা ব্যবস্থা ভেঙে ফেলে। তারপর ওরা সিয়েরা মাস্ত্রা পর্বতমালা থেকে প্রাণপণ লড়াই করে স্বৈরশাসক বাতিস্তার সেনাদের পরাজিত করে। বাতিস্তার সেনারা ট্যাংক, মর্টার আর মেশিনগান ফেলে প্রাণ বাঁচাতে ছুটে পালাতে থাকে। ’

 সম্প্রতি প্রকাশিত আত্মজীবনী গ্রন্থে এভাবেই তিনি বর্ণনা করেছেন বিপ্লবের দিনগুলোর কথা। স্বৈরাচার সরকারকে উৎখাত করে ক্ষমতা দখলের কথা আর কিউবার মানুষের সুখের দিন ফিরিয়ে আনার কথা। এছাড়া তিনি বর্ণনা করেছেন তার শৈশব, কৈশোর আর বিপ্লবী হয়ে ওঠার গল্প। ক্যারিবিয়ান সাগরের দ্বীপরাষ্ট্র কিউবার এই বিপ্লবী নেতার নাম ফিদেল কাস্ত্রো।

জীবনের শেষ প্রান্তে এসে ফিদেল বলতে চেয়েছেন তার অনেক না-বলা কথা, অনেক অজানা ইতিহাস। তিনি লিখেছেন, ‘আমার শৈশব, কৈশোর, যৌবন আর জীবনের কোন পর্বটি আমাকে বিপ্লবী বানাল, সশস্ত্র যোদ্ধা বনতে ভূমিকা রাখল, তা আমি জানাতে চাই। ’

কেউ যখন মানব থেকে মহামানব কিংবা নায়ক থেকে মহানায়ক হয়ে ওঠেন, তখন তার জীবন সম্পর্কে মানুষ জানতে চায়। ঘুরে বেড়াতে চায় তার জীবনের নানা ঘটনার অলিগলি, অনুভব করতে চায় সেই মহাজীবনের মুহূর্ত আর এগিয়ে যাওয়ার গল্পগুলো। কাস্ত্রো এমনই এক মহানায়ক। আর তাই শুধু তার দেশের নয়, পৃথিবীর সব দেশের মানুষই তার ঘটনাবহুল জীবনের গল্প শুনতে আগ্রহী। মানুষের সেই সেই আগ্রহ মেটাতে তাই তিনি লিখে ফেললেন আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘লা এস্ত্রেতেজিকা ভিক্তোরিয়া’ (ইংরেজিতে ‘দ্য স্ট্র্যাটেজিক ভিক্টোরি’, বাংলায় ‘কৌশলগত বিজয়’)।

২৫টি অধ্যায়ে বিভক্ত ৮৯৬ পৃষ্ঠার স্প্যানিশ ভাষায় লেখা বইটির বেশির ভাগ অংশ জুড়েই তিনি ১৯৫৯ সালে বাতিস্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধজয়ের কাহিনী বর্ণনা করেছেন।

২ আগস্ট সোমবার হাভানা ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন সেন্টারে কিউবার এ রহস্যময় গেরিলা নেতা বইটির মোড়ক উন্মোচন করেন। বইটি নিয়ে এরই মধ্যে পৃথিবীময় হইচই শুরু হয়ে গেছে। প্রাথমিকভাবে সাড়ে ৩ হাজার বই ছাপানো হলেও শিগগিরই আরও ৫০ হাজার বই বাজারে ছাড়া হবে বলে কিউবার গণমাধ্যম সূত্রে জানা গেছে।

একঝাঁক সহযোদ্ধা আর প্রবীণ বিপ্লবী নিয়ে মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে কিউবার সাবেক প্রেসিডেন্ট কাস্ত্রো বলেন, ‘সেদিনের অজানা কথাগুলো জানিয়ে দেওয়ার মাঝে রয়েছে ভিন্ন মাপের গুরুত্ব। ’

কিউবায় স্বৈরাচার উৎখাতের সশস্ত্র সংগ্রামে যারা নিজেকে উৎসর্গ করেছেন, তাদের অমর-অমলিন স্মৃতির উদ্দেশে বইটি নিবেদন করেছেন বিংশ শতাব্দীর অসাধারণ এই গেরিলা ও রাষ্ট্রনায়ক।

২০০৬ সালে অসুস্থতার কারণে ছোট ভাই রাউল কাস্ত্রোর হাতে সাময়িকভাবে তিনি মতা ছেড়ে দেন। পরে ২০০৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে আনুষ্ঠানিকভাবে মতা ত্যাগ করেন। কিন্তু কাজপাগল আর নিজের সম্পর্কে অত্যন্ত বিশ্বাসী কাস্ত্রো কি খালি খালি বসে থাকতে পারেন? না। আর তাই তিনি সিদ্ধান্ত নেন আত্মজীবনী লিখবেন। ২০০৯ সালের জুন থেকে তিনি বইটি লেখায় হাত দেন।

কাস্ত্রোর এই জীবনীগ্রন্থে যা লেখা হয়েছে তার মধ্যে নতুন ঘটনা বেশি নেই। এর আগে কাস্ত্রোকে নিয়ে লেখা বিভিন্ন বইয়ে এসব ঘটনার কথা উল্লেখ আছে। তবে তিনি এরপর কিউবার বিপ্লবের পুরো ইতিহাস লেখার কথা ঘোষণা দিয়েছেন। বিপ্লবী গেরিলাদের পাল্টা আঘাতের কাহিনীগুলোই তাতে প্রাধান্য পাবে।

বইয়ের শিরোনাম নিয়ে দ্বিধায় ছিলেন কাস্ত্রো। প্রথমে ঠিক করেছিলেন শিরোনাম দেবেন ‘বাতিস্তার শেষ হামলা’ অথবা ‘তিনশ যেভাবে ১০ হাজারকে হারায়’। পরে শিরোনাম পাল্টে রাখলেন ‘কৌশলগত বিজয়’। এ শিরোনামের যৌক্তিকতা তিনি লিখেছেন বইটিতে, ‘টানা ৭৪ দিনের রক্তরাঙা লড়াইয়ের পর পরাক্রমশালী শত্রুর পরাজয় এটাই প্রমাণ করেছে, যুদ্ধটি শেষ পর্যন্ত কৌশলগত লড়াইয়ের দিকে মোড় নিয়েছে। লড়াইয়ের এ হারই স্বৈরশাসকের ভাগ্য নির্ধারণ করে দিল। ’

বইটির বেশিরভাগ জুড়ে রয়েছে কীভাবে বিপ্লবী গেরিলারা সিয়েরা মাস্ত্রা পর্বতমালা থেকে স্বৈরশাসকের অনুগত যোদ্ধাদের প্রাণপণ লড়াইয়ের মাধ্যমে খতম করে দিয়েছে। শত্রুর প্রতিরা ব্যূহ ভেঙে অস্ত্র উদ্ধারের বুক হিম করা কাহিনীগুলো এতে ঠাঁই পেয়েছে। ট্যাংক, মর্টার, বাজুকা আর ৩০ ক্যালিবারের মেশিনগান ফেলেই শত্রুরা কীভাবে প্রাণ বাঁচাতে দিগি¦দিক ছুটেছে, তার প্রাণবন্ত বর্ণনা দিয়েছেন এ বিপ্লবী নেতা। বইতে লড়াইয়ের দিনগুলোর কথা ফুটিয়ে তুলতে তিনি মানচিত্র, ছবি আর ডায়াগ্রামের আশ্রয় নিয়েছেন।

ব্রিটেনের রানী ভিক্টোরিয়া এবং থাইল্যান্ডের রাজা ভূমিবলের পর সবচে বেশি সময় ধরে মতায় ছিলেন ফিদেল কাস্ত্রো। এর কারণ তার অসাধারণ জনপ্রিয়তা আর দেশপ্রেম। চার দশক ধরে আমেরিকার অবরোধ আরোপের পরও তিনি কিউবাকে নিয়ে গেছেন উন্নয়নের শিখরে। মার্কিন প্রশাসন ও গণমাধ্যমকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে জনপ্রিয় আর মডেল হয়ে উঠেছেন পৃথিবীর বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মানুষের কাছে। হয়ে উঠেছেন আধুনিক যুগের বিপ্লবের আইকন।

ক্যাস্ত্রো দাবি করেন, সিআইএ তাকে হত্যার জন্য ৬৩৮টি উদ্যোগ নিলেও প্রতিবারই তিনি বেঁচে গেছেন।

একটানা সবচেয়ে বেশি সময় ধরে ভাষণ দেওয়ার রেকর্ড আছে তার ঝুলিতে। ১৯৬০ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে টানা ৪ ঘণ্টা ২৯ মিনিট ভাষণ দিয়ে তিনি গিনেস রেকর্ড বুকে নিজের নাম লেখান। এর চেয়ে বড় রেকর্ড হচ্ছে ১৯৮৬ সালে হাভানায় তৃতীয় কমিউনিস্ট পার্টি কংগ্রেসে টানা ৭ ঘণ্টা ১০ মিনিটের ভাষণ।

১৩ আগস্ট জীবনের ৮৪ বছর পূর্ণ করছেন বিপ্লবী এই নেতা।

বাংলাদেশ স্থানীয় সময় ২১০২, আগস্ট ১১, ২০১০

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।