পূর্ববঙ্গে ১৯৫৬ সালে তৈরি হয় বাংলা ভাষার প্রথম সবাক পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘মুখ ও মুখোশ’। পরের বছরই যাত্রা শুরু হয় চলচ্চিত্র উন্নয়ন সংস্থার যা এখন বিএফডিসি নামে পরিচিত।
রাজধানীর কাকরাইল ও আশপাশের এলাকায় ছোটো বড় মিলিয়ে রয়েছে অনেক চলচ্চিত্র প্রযোজনা সংস্থা। এদের কেউ কেউ ব্যবসাসফল, কেউ বা বাজার দখলের লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। কিছু প্রযোজনা সংস্থা আবার বন্ধও হয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে অশ্লীলতাবিরোধী অভিযানের পরই বহু প্রযোজনা সংস্থার দিনকাল ভালো যাচ্ছে না। মন্দের মধ্যে কিছুটা ভালো ছবি যারা নির্মাণ করে তারাও টিকে আছে কোনো রকম। কারণ ঢাকাসহ পুরো দেশেই হলের সংখ্যা কমছে। মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো না। বাজার সামলাতে গিয়ে সাধারণ মানুষ প্রায়শই জলাঞ্জলি দিচ্ছেন সিনেমার মতো বিনোদনকে।
সংকটময় সময়ের মধ্যে মানুষের জীবন ও জীবিকা এখন অনিশ্চিত। তাদের না আছে সঞ্চয়, না আছে ভবিষ্যতের আশা। বেকারত্ব, নিরাপত্তাহীনতা, দারিদ্র্য, বাসস্থানের অভাব সব মিলিয়ে সমাজের সাধারণ খেটে মানুষগুলোর এক পা এখন কবরের দিকে। এমন চরম দুর্দিনে সিনেমা হলে বিশ-ত্রিশ টাকা খরচ করে ছবি দেখা তাদের পে শুধু বিলাসিতা নয়, একবেলা না খেয়ে থাকার সমান। তারপরও কিছু মানুষ হলে গিয়ে ছবি দেখছেন। বিনোদনের প্রতি দুর্নিবার আকর্ষণ থেকেই হলে যাচ্ছেন তারা। অভিজাত দু-একটি সিনেমা হলের কথা বাদ দিলে এই হলমুখী মানুষের একটা বড় অংশ নিম্নবিত্ত শ্রেণী থেকে আসা।
বাংলাদেশে নিম্নবিত্ত মানুষের যৌনতা ছাড়া বিনোদনের আর তেমন কোনো বিকল্প নেই। থাকলে, ওই এক সিনেমা। নিম্নবিত্ত মানুষের জন্য তৈরি এফডিসিভিত্তিক চলচ্চিত্র। মধ্যবিত্ত ও উচ্চমধ্যবিত্ত মূলত এর ভোক্তা নয়। তাদের বিনোদনের অনেক বিকল্প আছে। নিম্নবিত্তের সেই বিকল্প নাই। আবার তাদের এই বিকল্প না থাকার জন্যই যে শুধু ‘বাংলা সিনামা’ তৈরি হয় তা নয়। বাংলাদেশে জনগোষ্ঠীর একটি বিরাট অংশ যেহেতু সিনেমা বোঝে না, বা সিনেমা-শিতি নয়, সেটাকেও কাজে লাগিয়ে প্রযোজকরা তৈরি করেন ‘বাংলা সিনামা’। তবে এর মধ্যেও মন্দের ভালো হচ্ছে। ‘চাটনি’ কম দিয়ে ছবি তৈরিকেই এখন মন্দের ভালো বলা হয়। কিন্তু ছবির গল্প বা ভেতরের উপাদান ঐ একই, থোড়-বড়ি-খাড়া, খাড়া-বড়ি-থোড়; শুধু বৃষ্টি ভেজা নায়িকার নাচ, ধর্ষণদৃশ্য এবং অন্যান্য যৌন সুড়সুড়ি দেওয়া দৃশ্য ও সংলাপ কমে এসেছে। এক-আধটু ‘চাটনি’ তো রাখতেই হয়, নইলে ‘নিম্ন’ শ্রেণীর দর্শকদের পয়সা উসুল না হওয়ার দায় কে নেবে?
এভাবেই চলছে, একে অন্যের ওপর দায়ভার চাপিয়ে, অর্থাৎ প্রযোজকরা বলছেন ‘নিম্ন’ শ্রেণীর দর্শকের কথা আর মধ্যবিত্ত দর্শকরা বলছেন ‘নিম্ন’ শ্রেণীর পরিচালক-প্রযোজকদের কথা। মাঝে দিয়ে ভালো সিনেমা তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা অধরাই থেকে যাচ্ছে।
বাংলাদেশে নির্মিত ছবির বিষয়বস্তু কমবেশি একই : প্রেম। বিষয় নিয়ে খুব একটা সমস্যা নাই কিন্তু সমালোচনা যে বিষয়কে ঘিরে তা হলো নির্মাণ, কাহিনী ও ভেতরকার উপাদান নিয়ে। অভিযোগ, এগুলোর বেশির ভাগই পার্শ্ববর্তী দেশের নকল ও নিম্নরুচির পরিচায়ক। তবে নির্মাতাদের দাবি : যে শ্রেণীকে উদ্দেশ্য করে ছবি নির্মিত হয় তাদের কাছে এটাই ‘যুৎসই’ বিনোদন। দর্শকদের জন্য নির্মাতারা সংজ্ঞা নির্মাণ করে যেসব ছবি হাজির করছেন তা যেমন একটি সামাজিক ব্যবস্থার বলয়ভুক্ত, তেমনি এটা দর্শকের সঙ্গে এক ধরনের ঠগবাজিও বটে। কারণ নকল ও জোড়াতালি দিয়ে হলে সিনেমা চালানোর মধ্যে কোনো বাহাদুরি নাই। উচ্চবিত্ত এই আলোচনার বাইরে। তাদের বিনোদনের বহু মাত্রা আছে। সেখানে সুস্থ ও ব্যয়বহুল বিনোদন আছে, আছে বিকৃত বিনোদন। পুঁজিবাদী এই সমাজে ব্যয়বহুল বা দামী বিনোদন বাদ দিলে ‘নিম্ন’ শ্রেণীর মানুষদেরও বিকৃত বিনোদনের প্রয়োজন হয়।
বহুদিন আগে সিগমুন্ট ফ্রয়েডই বলে গেছেন আমাদের মনের ভেতর অচেতনের খবর, কামনা-বাসনার গভীরতর বাসস্থানের খোঁজ। আমাদের ইগো এবং সুপার ইগো বাধা দিয়ে রাখে সেসব কামনা-বাসনাকে। অযাচারী হতে চায় অচেতন মন। কিন্তু সচেতন মন তাকে অবদমিত করে। আরেক মনোবিশ্লেষক ফরাসি মনীষী জাক লাকাঁ বলছেন, ওই অবদমিত ইচ্ছা বা বাসনা (যৌনবাসনা) মানুষের কর্তিত হয় মিরর স্টেজ বা ‘আয়না পর্বে’। সেখানে মানবশিশু নিজেকে আলাদা করে চিনতে পারে, নিজেকে অপর (মায়ের কাছ) থেকে আলাদা করতে পারে। এর মধ্য দিয়ে যেমন তার ছেদ ঘটে আবার এক ধরনের মজাও সে পায়। লাকাঁ একে বলছেন, ‘জুইসস’। এর মধ্য দিয়েই মানবশিশু প্রবেশ করে সিম্বলিক অর্ডার বা সাঙ্কেতিক বিন্যাসে। এরপর লাকাঁ বলেন শিশু ধীরে ধীরে নিজেকে আবিষ্কার করতে থাকে ভাষা-সংসারে। সেখানে সে দেখতে পায় ‘কী যেন নাই’। সারাণ একটা অনুসন্ধিৎসু মনোভাব তার মধ্যে কাজ করে। ওই যে ছোটোবেলার ছেদন-- মানবের জন্য হয়ে দাঁড়ায় চিরকালের রোদন। যা চাই তা পাই না, আর যা পাই তা ভুল করে চাই-- পরাণ কী চায়, কেন চায়, কেন সে তা পায় না-- সেসব প্রশ্নের উত্তরই মনোবিশ্লেষকরা দেবার চেষ্টা করেছেন। অভাববোধ মানুষের যেন জমজ সত্ত্বা, জন্মের পর থেকেই সঙ্গ নেয়, আর পিছু ছাড়ে না। তাই মানুষ খুঁজে বেড়ায়, নিরন্তর চলে সেই খোঁজা। কাকে খোঁজে, কী খোঁজে মানুষ নিজেও জানে না। মনের এই অবস্থা নিয়ে যুগে যুগে রচিত হয়েছে বহু সাহিত্য, নির্মিত হয়েছে শত শত চলচ্চিত্র। সেসব নির্মাণের কোনো কোনোটি ছুঁয়েছে সাফল্যের পরাকাষ্ঠা আবার কোনো কোনোটি নিপ্তি হয়েছে সময়ের অন্ধ গলিতে।
বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে যে ধরনের বিকৃত যৌনদৃশ্য দেখা যায় সেটার মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা উপরে উল্লিখিত কথাগুলো হতে পারে। আবার অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক চাপে দিশেহারা মানুষের আফিম খাওয়ার বদলে এ ধরনের বিকৃত বিনোদন ‘গেলার’ ঘটনাও ঘটতে পারে। মানুষ কী চায়? অশান্তি থেকে নিস্তার চায়, অর্থনৈতিক মুক্তি চায়, জীবন-জীবিকার নিশ্চয়তা চায়। কিন্তু সেগুলোর কোনো একটা কি আছে এই দেশে? সেই সুযোগটাই গ্রহণ করছেন চলচ্চিত্র ব্যবসায়ীরা, মার্কসের ভাষায় বললে বুর্জোয়া সমাজের মুনাফালোভীরা। চলচ্চিত্র তাদের কাছে শিল্প নয়, মানুষের সামাজিক ও মানসিক অসহায়ত্বকে কাজে লাগিয়ে পয়সা কামানোর উর্বর ভূমি। তারা আরো বহু কিছু করতে পারতেন যেমন আলু-পটলের ব্যবসা কিন্তু তারা এখানেই পটল তুলতে এসেছেন। কী আর করা! প্রত্যেক সংস্কৃতিতেই কমবেশি এমন আগাছা গজিয়ে ওঠে। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে স্বাধীনতার পর নব্বই দশকের মধ্যে সেসব আগাছাই হয়ে ওঠে প্রধান বৃ। এরপর ‘অশ্লীলতা খ্যাদাও’ মনোভাব নিয়ে এগিয়ে আসেন অনেকেই। পত্রিকায় একতরফা লেখা হতে থাকে বিশেষ জনরার ঐসব সিনেমার বিরুদ্ধে। রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও সাংবাদিকরা কালি মাখেন রাজধানীর দেয়ালে সাঁটানো অর্ধনগ্ন নারীর ছবি সম্বলিত সিনেমার পোস্টারে। টনক নড়ে নীতি-নির্ধারকদের। কঠোর হয় সেন্সরবোর্ড। তাতে ‘অশ্লীলতা’ কিছু দূর পালিয়ে আবার ফিরে আসে। আবার দূরে সরে যায় পুনরায় ফিরে আসে। এভাবে চলতে থাকে চোর-পুলিশ খেলা। মফস্বলে কাটপিস যোগ করা থেমে না থাকলেও অনেকটা নিয়ন্ত্রিত হয় নাচ-গান-ধর্ষণে ভরপুর ঐসব ছবি। এই ফাঁকে কিছু ছবি হতে থাকে, যেগুলোকে বলা যায় ‘মন্দের ভালো’ ছবি। নাম নিতে চাইলে ‘মনের মাঝে তুমি’ থেকে শুরু করে হুমায়ূন আহমেদের ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’ পর্যন্ত আসা যায়। কিংবা নাম নেয়া যেতে পারে ‘নিরন্তর’ বা ‘অন্তর্যাত্রা’র। এসব ছবির ল্য মধ্যবিত্ত ও কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। সাধারণ খেটে খাওয়া, শ্রমজীবী মানুষের কথা ভাবনার বাইরে রাখেন এসমস্ত ছবির নির্মাতা। যাদের কথাই মাথায় রাখুক কিংবা ফেলে দিক শেষ বিচারে এই ছবিগুলোও ধ্রুপদী হয়ে ওঠে না।
তাহলে ভালো ছবি কাকে বলে? যে ছবি আন্দোলিত করে। যে ছবি একটি বিশাল জনগোষ্ঠীর কাছে আবেদন তৈরি করতে পারে, যে ছবি শুধু যৌনতাকে পুঁজি করে না। যে ছবি সমাজের অসঙ্গতি, অন্যায়ের চাপে পিষ্ট আমজনতার কথা বলে, যে ছবি প্রোগৃহে একসঙ্গে শতশত দর্শককে আবেগতাড়িত করতে পারে। যে ছবি অন্ধকার ও অনাবি®কৃত জীবনের কথা বলে, যে ছবি সময় ও স্থানকে ধারণ করে, যে ছবি নিজস্ব ভাষায় সফল যোগাযোগ স্থাপন করে-- সেটাইকেই তো আমরা ভালো ছবি বলি। মোদ্দা কথা যে ছবি দর্শককে পর্দার সঙ্গে সেলাই করে দেয় সেটাই ভালো ছবি। এ ধরনের কাজ করতে গেলে ঝুঁকি নিতে হবে। ব্যবসায়িক তির বিষয়টা আগে থেকে মেনে নিয়েই নামতে হবে মাঠে। ময়দানে নামার পর তি যে অবধারিত তা কিন্তু নয়, লাভের সম্ভাবনাও রয়েছে। এটাই জুয়া। পরিচালক ও প্রযোজকরা জুয়া খেলছেন তবে সেটা স্বরস্বতীকে নিয়ে নয়, দুর্গাকে নিয়ে।
এ দেশের চলচ্চিত্র জগতে শিল্পের খাতিরে কেউ এখনো জীবন উৎসর্গ করেননি। অন্তত সেরকম উদাহরণ নেই আমাদের সামনে। উদাহরণ যাঁরা হয়ে উঠতে পারতেন, যাঁদের সবরকম সম্ভাবনা ছিলো তাঁরা হয় অকালে মারা গেছেন কিংবা নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছেন। জহির রায়হান কিংবা আলমগীর কবিরের নাম আমরা সকলেই জানি। ‘ঘুড্ডি’র সালাউদ্দিন জাকির কথাও কারো অজানা নয়। আবার অনেকে সক্রিয় থেকেও বারুদে স্ফুলিঙ্গ যোগ করতে পারছেন না। এমন অনেক সম্ভাবনার ভেতর দিয়েই বাংলাদেশী চলচ্চিত্র তৈরি হচ্ছে। ইদানীং তৈরি হচ্ছে ‘শ্লীল’ চলচ্চিত্র। ‘অশ্লীলতা বিরোধী আন্দোলনে’র কথা তো আগেই বলেছি।
এফডিসি-কেন্দ্রিক ছবিগুলো মাঝে মধ্যে অশ্লীল কাটপিস ছাড়া মুক্তি পায়, চারদিকে আলোচনা হয়, এবার বুঝি চলচ্চিত্র শিল্প শ্লীল হলো। কিন্তু ব্যাপারটা শ্লীল আর অশ্লীলের মধ্যে আটকে গেলে এই শিল্প ডুবতে শুরু করবে। চলচ্চিত্রকে রপ্ত করতে হবে তার নিজস্ব ভাষা, প্রতিযোগী ভাবতে হবে বিশ্ব সিনেমাকে। কোন ছবিতে আইটেম গান আছে কি নেই, কোথায় শরীর প্রদর্শন বেশি হলো বা কম, এসব নিয়ে বহু হয়েছে, এখন ধ্যান দেওয়া দরকার বিশ্বের অন্যান্য ছবির দিকে। কী তাদের কাহিনী বিন্যাস, কী তাদের নির্মাণ শৈলী, কীভাবেই বা তারা শিল্পকে টিকিয়ে রেখেছে নিজস্ব ঐতিহ্যের উপাদান সহযোগে-- এসবই হওয়া উচিত বিবেচ্য। কথা উঠতে পারে, আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ তো অত শিতি নয়। কথা ঠিক। এক্ষেত্রে একটা গল্প বলা যায়, মোরশেদুল ইসলামের ‘চাকা’ প্রদর্শিত হচ্ছিলো ঢাকার পাবলিক লাইব্রেরিতে। সেখানে সাধারণত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এবং মধ্যবিত্ত শিতি মানুষরাই যান ছবি দেখতে। কিন্তু সেবার এক রিকশাচালক টিকিট কেটে ভেতরে ঢোকেন। আয়োজকরা ব্যাপারটা খেয়াল করলেন। ছবি শেষে রিকশাচালক যখন বেরিয়ে এলেন তখন তাকে জিজ্ঞেস করা হলো, কী ভাই, কেমন লাগলো? রিকশাচালক খুব মন খারাপ করে বললেন, ‘বুঝলাম মানুষ মইরা গেলে তার দাম নাই’।
গল্পটা মোরশেদুল ইসলামের মুখ থেকে শোনা। যে বিষয়টি পরিষ্কার করতে চাইছি, তা হলো পরিচালক তার রুচি ও মেধা দিয়ে ছবি বানাবেন এবং এমনভাবে বানাবেন যেন তাতে একাধিক স্তর থাকে। চিহ্নবিদ্যার মাস্টার নোম চমস্কির কাছ থেকে ধার করে বলা যায়, চলচ্চিত্রে একটা সারফেস স্ট্রাকচার বা পরিকাঠামো এবং একটি ডিপ স্ট্রাকচার বা অন্তর্বিন্যাস থাকবে (যেহেতু চলচ্চিত্রও ভাষার মতো)। তাহলে সমাজের এক শ্রেণী পরিকাঠামো দেখেই সন্তুষ্ট ও খুশি থাকলো আর আরেক শ্রেণী অন্তর্বিন্যাস বুঝতে পেরে ভিন্ন মাত্রায় বিনোদন পেলো। তাতে চলচ্চিত্র শিল্প বাঁচলো আবার শিল্পও করা হলো। কিন্তু এ ধরনের চলচ্চিত্রের বড় অভাব এই অভাবের দেশে। এফডিসিতে যেসব ছবি হয়, সেখানে গল্প বলার যে ঢং ও কায়দা আমরা দেখি, তা কিন্তু চমকপ্রদ। এই ঢংটাকেও যদি কোনো মেধাবী পরিচালক কাজে লাগাতে পারতেন, মনে হয় বিশ্ব চলচ্চিত্রে বাংলাদেশের ছবি আলাদা স্বার রাখতে পারতো। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় আফ্রিকার বর্ণনাধর্মী চলচ্চিত্র। আফসোস, এই দিকটা নিয়ে কোনো নির্মাতা আজো ভাবেননি। আগেই বলেছি কিছু ছবি হচ্ছে, যেখানে তেমন অশ্লীলতা নেই, সেসব ছবি নিয়েই আমরা আত্মতুষ্টিতে আছি।
ভালো তারকা থাকলে ছবি চলার একটা সম্ভাবনা তৈরি হয়। সেই সঙ্গে যদি কৌশল জানা পরিচালক হন তাহলে তিনি যোগ করেন বাজার কাটতি উপাদান। ফলে ছবি বাজারে ‘হিট’ হয়ে যায়। এই ‘হিট’ করার বা করানোর প্রবণতা অর্থের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকেই। মানুষ বা শিল্পের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে নয়। সে তর্ক এখন থাক যে, শিল্পের জন্য শিল্প, না মানুষের জন্য শিল্প। বরং এখন বলা যায় এ দুটোর যে কোনো একটি হওয়া শুরু করলেই অপরটিও তার পথ বের করে নেবে। কিন্তু দায়বদ্ধতা যখন থাকে অর্থের প্রতি, তখন ঐ দুটোর একটিও সম্ভব নয়, মানে শিল্পের জন্য শিল্প যেমন হয় না, মানুষের জন্য শিল্পও হয় না। শিল্প হয়ে ওঠে ডুমুরের ফুল!
মুনাফা অর্জনে অশ্লীলতা বেশ কাজে দিলেও যেহেতু এখন একটা ‘অশ্লীলতাবিরোধী’ পরিবেশ বিরাজ করছে তাই অনেকে বেছে নিচ্ছেন ভিন্ন পন্থা। অশ্লীলতাকে পাশে সরিয়ে রাখলে তথাকথিত হাসির চলচ্চিত্র এবং তারকাদের নিয়ে অতি সাধারণ প্রেমের ছবি, বাজার কাটতির এই তো সম্বল। একটা ছবি যদি হাসির হয় তাহলে সেটা কার কাছে হাসির? কোন শ্রেণীর কাছে? সিনেমা হলে ছবি দেখার সময় দেখা যায়, যে দৃশ্যে সাধারণ দর্শক পুলকিত হচ্ছেন বা আনন্দ পাচ্ছেন, হাসছেন, সেই দৃশ্য শিতি মধ্যবিত্তের রসবোধের অনেক বাইরে অবস্থান করে। তাতে কি? প্রযোজক ও পরিচালকের উদ্দেশ্য মধ্যবিত্তের মন তুষ্ট করা নয়, তাদের উদ্দেশ্য পোশাক শ্রমিক, দিনমজুর, রিক্সা-ভ্যান চালক-- এরকম ‘নীচু’ তলার মানুষের মনে আনন্দ দেয়া। ছবি দেখে তারা যদি সেই আনন্দ পান তাহলে প্রযোজক ও পরিচালক সার্থক। ছবির প্রযোজক আরেকটি ছবি তৈরি করতে মাঠে নেমে পড়েন। আরেকটি ‘হিট’ ছবি। আরেকবার দর্শক আসবে প্রোগৃহে। শ্রমে-ঘামে মেশানো পয়সা দিয়ে কিনে নেবে ‘বিনোদন’। ব্যবসা হবে প্রযোজকের। এই তো চলছে।
দেশের ‘নীচু’ তলার মানুষেরা, যারা গায়ের জামা তৈরি করেন এবং নিজেরা সেটা কেনার সামর্থ্য রাখেন না, যারা মাথা গোঁজার জন্য ভবন নির্মাণ করেন এবং সেখানে কখনোই তারা থাকতে পারেন না, যারা গন্তব্যে পৌঁছে দিতে তিন চাকার গাড়ি টানেন এবং কখনোই নিজে সওয়ার হতে পারেন না, তাদের জন্য তৈরি হয় ছবি। কী থাকে ছবিতে? হয় যৌনসুড়সুড়ি, নয় মারামারি, বীভৎসতা। আর এগুলোর একটিও না থাকলে মজুদ থাকে স্বস্তা ভাঁড়ামো। যেনতেন একটা জিনিস দিয়ে লোকেদের বোকা বানানো। এটা তো বিনোদনের নামে গরিব মানুষের কষ্টার্জিত টাকা দিয়ে নিজের পকেট ভারি করা, ঘুরিয়ে বললে বুর্জোয়া সমাজের মনস্তাত্ত্বিক গঠন থেকে ‘আফিম’ গেলোনো? রবীন্দ্রনাথের ‘রক্তকরবী’তে যেমন?
অনেক ছবিতে আবার কাহিনীই থাকে না। কোনো রকম একটা কিছু বানানো হয়, এরপর পরিবেশন করা হয় দর্শকের সামনে। কোনো ছবিতে কাহিনী থাকলেও তা পরিচিত কয়েকটি হিন্দি ছবির কাট-কপি-পেস্ট। ভারতের বহু চলচ্চিত্র নির্মিত হচ্ছে হলিউড থেকে ধার করে। যেমন রাম গোপাল ভার্মার ‘সরকার’, যা বিশ্ব চলচ্চিত্র ইতিহাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ছবি ‘দি গডফাদার’-এর ছায়া অবলম্বনে নির্মিত। কিন্তু ভার্মা পুরো ছবিতে এমনভাবে ভারতীয় আবহ এনেছেন, যে কেউ ছবিটি উপভোগ করবেন। বলছি না, ছবিটি খুব ভালো, যা বলতে চাইছি তা হলো গ্রহণ করার সীমা, পরিমিতিবোধ ও আত্তীকরণের ব্যাপারে।
আশির দশক থেকেই বলিউডি ছবি নকল করার হিড়িক পড়ে। সে সময় ঢাকাসহ সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে ভিসিআর ও ভিসিপি। ভিডিও ক্যাসেটে সয়লাব হয়ে যায় বাজার। পাড়ায় পাড়ায় গড়ে ওঠে ভিডিও কাব। সকলেই হিন্দি ছবি দেখেন। ইংরাজি ছবিও দেখেন, তবে খুব কম। তখন বাংলাদেশের একদল পরিচালকের মাঝে একটা প্রবণতা দেখা যায়। তাদের সব ছবিই ঐ হিন্দি ছবি থেকে হয় হুবহু নেওয়া, নয় তো বিভিন্ন ছবির জোড়া দেওয়া এক বিচিত্র বস্তু। তাদের ছবির নায়ক-নায়িকার পোশাক, গানের দৃশ্য, মারামারি- সবকিছুই হয় বলিউডি কায়দায়। কিন্তু নকল করাটাও পুরোপুরি হয় না। একটা বিশাল ফাঁক থেকে যায়। ফলে বাংলাদেশের ছবি হয়ে পড়ে বলিউডি ছবির নকল করতে যাওয়া কিন্তু সফল না হওয়া ‘আধাখেচড়া’ একটা জিনিস। পরিতাপের বিষয়, নতুন শতাব্দীতে এসেও ঐ একই জিনিসের পুনরাবৃত্তি হচ্ছে।
প্রশ্ন জাগে, এ দেশে কি কেউ ভালো ও মৌলিক চিত্রনাট্য লিখতে পারেন না? যদি উত্তর হয় ‘পারেন’, তাহলে বলতে হয় যাদের নিম্নবিত্ত বলা হচ্ছে তাদের জীবন নিয়েও তো ভালো ছবি তৈরি হতে পারে। ইতালিতে ‘দি বাইসাইকেল থিফ’-এর মতো ছবি তৈরি হয়নি? ইতিহাস তো আমাদের সামনেই আছে। ইতিহাস থেকে শিক্ষা না নিয়ে আমরা হাত পাকাচ্ছি পার্শ্ববর্তী দেশের ছবি ব্যর্থ-নকল করে। একটি ছবিতে যদি পোশাক শিল্পের একটি মেয়ের গল্প উঠে আসে, যদি তার জীবনের টানাপোড়েন, অভিজ্ঞতা উঠে আসে, সেই ছবি কি ‘হিট’ হবে না? অবশ্যই হবে। যে দোহাই দেওয়া হয়-- দর্শকদের এমন অলীক স্বপ্ন দেখাতে হবে, যেটা তারা কখনোই হাতের নাগালে পায় না। তবেই তারা ছুটে যাবে ছবি দেখতে। যেমন রিকশাওলা প্রেম করছে কোটিপতির মেয়ের সঙ্গে। এটি বাস্তবে অসম্ভব। আর তাই রিকশাওলা ঐ ছবি দেখে মজা পাবে। স্বপ্ন দেখিয়ে মজা তো অন্যভাবেও দেওয়া যায়। অন্য স্বপ্নও তো দেখানো যায় তাদের। সুন্দর মানুষ হওয়ার স্বপ্ন, সুন্দর সমাজ গড়ার স্বপ্ন, অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার স্বপ্ন, শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হয়ে ওঠার স্বপ্ন, কত কত স্বপ্ন! সরকার চাচ্ছে না প্রতিবাদী ছবি প্রচারিত হোক? তাহলে রূপকধর্মী ছবি বানানো যেতে পারে। যে ছবিতে গান থাকবে, কথা থাকবে আবার বার্তাটাও থাকবে। বার্তা যে দিতেই হবে তাও নয়, তাহলে একটু সুস্থ বিনোদন থাক। যেখানে দেখানো হবে না, নায়ক নায়িকাকে বিরক্ত করছে, ইভ টিজিং করছে আর কিছুণ পরই নায়িকা ঐ ইভ টিজারের প্রেমে পড়ছে। যেখানে দেখানো হবে না, পরিষ্কার আকাশের নিচে ঝকঝকে রোদের মধ্যে হঠাৎ ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি হচ্ছে আর নায়িকা শরীর দেখিয়ে নাচছে। বিনোদন যে সব সময় বার্তাপ্রধান হতে হবে তা নয়, নির্মল বিনোদনও হতে পারে। হতে পারে বিশ্বাসযোগ্য সেট, পোশাক-আশাক ও অভিনয় সমন্বয়ে একটি লোককাহিনীর চলচ্চিত্রায়ন। ছবির বিষয় হতে পারে কোনো খেটে মানুষের জীবনের চড়াই-উৎরাইয়ের আখ্যান।
যাদের জন্যই ছবি বানানো হোক না কেন, অনুধাবন করতে হবে তাদের প্রতি নির্মাতারা কতটা শ্রদ্ধাশীল ও সহানুভূতিশীল। নয় তো উদ্ভট পোশাকের নর-নারীর কিছু হাস্যকর ও বিকৃত কর্মকাণ্ড দেখিয়ে ঐ মেহনতী মানুষের পকেটই কাটা হবে কেবল। সত্যিকারের ছবি হবে না। এতটুকু যত্নের ছাপ যদি থাকে ওসব ছবিতে! ছবির কাহিনী ও শটে কন্টিনিউটি থাকে না, সংলাপের সুষ্ঠু বিন্যাস হয় না, প্রপসগুলোতে থাকে কোনো রকম কাজ শেষ করার ছাপ, মেকাপে থাকে চরম অবহেলা। নায়ক নায়িকা আর ভিলেন-- প্রথমে প্রেম, শেষে ভিলেন বধ-- এই গতেই চলছে। তাও নিজেদের তৈরি গৎ হলে একটা কথা ছিলো, সেটাও ধার করা এবং অনুকরণ করতে গিয়ে লজ্জাজনকভাবে ব্যর্থ হওয়া। চলচ্চিত্রে কম পয়সাতে ভালো জিনিস করা সম্ভব সেটা ইউরোপের বিভিন্ন সময়কার চলচ্চিত্র আন্দোলনগুলোর দিকে তাকালেই বোঝা যায় এবং উদাহরণ পাওয়া যায় ভুরিভুরি।
কাউকে ছোটো বা হেয় করা বর্তমান প্রবন্ধের উদ্দেশ্য নয়। এ রচনার উদ্দেশ্য স্পষ্ট, সেটি হলো যেই শ্রেণীবৃত্তের জন্য চলচ্চিত্র নির্মিত হোক না কেন, সেটিতে যত্নের ছাপ থাকতে হবে, অঙ্গীকার থাকতে হবে, কেবল অর্থের প্রতি নয় সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা থাকতে হবে। তাহলে চাইলেও কেউ দায়সারা গোছের ছবি বানাতে পারবে না।
বেশি দূরে নয়, আমাদের কাছের ইসলামি রাষ্ট্র ইরানের চলচ্চিত্রকে এখন পুরো বিশ্ব ঈর্ষা করে। তাদের ছবিতে নেই হাইটেক কোনো অ্যনিমেশনের কাজ, নেই বিশ্বমানের তারকা বা কোটি কোটি ডলারে নির্মিত কোনো সেট। তাদের আছে দায়বদ্ধতা, ভালো কাজ করার বাসনা আর আপোস না করার মানসিকতা। তাদের সরকারও এ ব্যাপারে দারুণ উৎসাহী। সাধারণ গল্প যে কত অসাধারণ হয়ে উঠতে পারে তা ইরানি ছবি দেখলে বোঝা যায়। সরকারের মৌলবাদী ও অগণতান্ত্রিক কার্যকলাপের জবাব দিতেও ইরানি পরিচালকরা তৈরি করছেন চমৎকার সব সিনেমা। জাফর পানাহিকে সেজন্য কারাভোগও করতে হয়েছে। সেই আলোচনায় বিস্তৃত না হয়ে ইতি টানা যাক। শেষের কথা এই, বাংলাদেশের চলচ্চিত্র সব সম্ভাবনা নিয়ে স্বাধীনতার প্রায় চার দশক পরও কেন ধুঁকছে, কেন বিশ্বমানের হয়ে উঠছে না, পুরো দেশে কেন একে একে সিনেমা হল ভেঙে শপিং মল গড়ে উঠছে, সেই উত্তর পাওয়া যাবে এই দেশের আত্মঘাতী রাজনীতি ও চলচ্চিত্রসংশ্লিষ্ট মানুষদের জীবন-যাপনে।
বাংলাদেশ সময় ০০০০, ডিসেম্বর ৬, ২০১০