উপক্রমণিকা.
গানের সাথে আমার সম্পর্ক জটিল, গানের স্কুলে মা যখন দুষ্ট পোনির মতো টানতে টানতে নিয়ে যেত, পিটি টিচার আর গানের টিচারে আমি কোনো তফাত বুঝতাম না, এই দুইধরনের শিক্ষকই ভাবেন (বা আমার মনে হতো তাঁরা ভাবতেন) এঁরা যা শেখান তা ছাড়া জীবন ষোল আনাই মিছে। বিকেলের কার্টুন ছেড়ে কে চায় গান সাধতে যেতে, হাঁপরের মতন হারমোনিয়ামে বাতাস দিতে দিতে ‘আঁখিয়াআআআ লাগি’ করতে? গানের শিক্ষকের সুগ্রীব দোসর তবলচি স্যার, তান করতে চাওনা, আপনা থেকেই ঝড় তুলে দেবেন তবলায়, সে ছুটন্ত ঘোড়ার পিঠে চড়ে তান শুরু না করে উপায় থাকবে না।
যা হোক, গানের ইস্কুলে রোজার মাসে ‘নিখিলের চির সুন্দর সৃষ্টি আমার মুহাম্মাদ রাসুল’ শিখে, বাকি বছর লক্ষণগীত গেয়ে, নজরুলের বনের হরিণ আর বৈঁচিমালা নেড়েচেড়ে আমার সকল শুদ্ধস্বরের বিলাবল শৈশব শেষ হয়ে গেল, আর সব নাগরিক শিশুদের মতোই গানের ক্লাস ছেড়ে আমি ঢুকে পড়লাম টেক্সটবুক বোর্ডের অনন্ত টানেলে।
কৈশোর যেইমাত্র স্বরগুলিকে কড়ি করে দিতে থাকলো, গান হয়ে উঠলো স্মারক ডাকটিকেট, শুদ্ধ শৈশবের, যা কিছু শুদ্ধ-পুরাতন-নিঃসংকোচ-অসহায়-গভীর তার সবই যেন গানেই ধরা, আরেকটা মা। তার নিবিড় কোলে বহু কবির পুষ্পার্ঘ্য। বাঙালি বলেই সেই পুষ্পচয় থেকে অভ্যস্ত হাতে যা তুলে নিতাম, তা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গান। সকল সাফাইয়ে রবীন্দ্রনাথ, মন ভালো, মন খারাপ, বৃষ্টি, বসন্তোৎসব, পরীক্ষা, হৃদয়হীনতার সম্মুখীন হওয়া, অভ্যাস, মনোনিবেশ, প্রবাস— সবকিছুতে পরিত্রাণ মিলতো রবীন্দ্রনাথের গান শুনে। সম্বচ্ছর আমার প্রেক্ষাগৃহে একজনই মুখ্য নায়কের অভিনয়।
মাঝখানে ছোট্ট একচিলতে সময়ের জন্যে বুয়েটে আমরা ক্লাস করতে যেতাম ওয়াহিদুল হক স্যারের, ‘মিউজিক অ্যাপ্রিসিয়েশন’ পড়াতেন তিনি, আমার মায়ের মতো তিনি উচ্চকিত ঘোষণা দিতেন না যে, যেদিন শিখবে সেদিন বুঝবে। গভীর অভিমানে এবং দৃঢ়তায় ক্লাস নিয়ে যেতেন, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা প্রকাশ্যেই অনীহাপ্রকাশ করে যেত, কেন তাদের ‘আমার বাঁশি তোমার হাতে, ফুটোর পরে ফুটো তাতে’ শিখতে হচ্ছে, স্রোতের বিপরীতে আজীবন চলে বেড়িয়েছেন স্যার, গ্রাম্য এবং অনাবশ্যক কোলাহলের ভিতরেই তিনি দিব্যি আমাদের নিয়ে যেতেন ‘নিভৃত প্রাণের দেবতা, যেখানে জাগেন একা’— সেখানে। নিজের ভিতরে গভীর সত্য থাকলেই হয়তো বাইরে এমন খোলা হাওয়া লাগিয়ে পালে অবিচল থাকা যায়।
দুই.
‘আনন্দ ধ্বনি জাগাও’ শুনে বছরখানেক আগে চমকে উঠেছিলাম আমি, বহুকাল আগে এমন হৃদয়জারিত সুরে সুবিনয় রায় হাহাকার করে উঠেছিলেন ‘কত দিন আসে কত যুগ যায়’, মিলনায়তনের নাটকীয় অন্ধকারে আলোর চুমকি ফুটছিল, আমার ভুবন ভরে উঠেছিল ‘সোনালী-রূপালী-সবুজে-সুনীলে’। মানুষ কথা বলবার সময় তার পিঠে বা বুকে কান পাতলে যেমন দেহগহ্বরে ধ্বনির আহ্বান শোনা যায়, শোনা যায় গভীর প্রতিধ্বনি, আত্মার বাজনা, দীর্ঘশ্বাসে যেমন থাকে অখ্যাত হৃদয়পুরের বাঁশির নিবিড় ফুঁ, তেমনি গলা। গান ফুরালে মঞ্চ থেকে নেমে এলেন গায়ক, ইমতিয়াজ আহমদ। গান তাঁর উপাসনা। সুরের সাধনাকে কেন্দ্রে রেখে আপূর্যমান তাঁর বাকি জীবন। গুরু ওয়াহিদুল হক স্বয়ং। আমার বড় অল্প সময়ে পাওয়া শিক্ষক, কেমন ভাঙা গলায় উচ্চারণ করতেন ‘মন মন রে আমার’, কেমন অনায়াসে বন্ধু হয়ে যেতেন, তর্ক করতে গেলেও এতটুকু রুষ্ট হতেন না, নিজের ঝুলির ভিতরে হাত ঢুকিয়ে বের করে দিতেন চকোলেট, ‘তাহলে একখানা চকলেটই খাও। চা তো খাবে না। ’ মনটা বড় নড়েচড়ে ওঠে সেইসব স্মৃতি মনে করে, এই পরবাসে। সুবিনয় রায়ের গায়কীর কথা উঠতেই সংকোচে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন ইমতিয়াজ, অত বড় নই আমি...
তিন.
ইমতিয়াজের গান এরপরে আরো বহু অবসরে শুনেছি, অনুষ্ঠানগুলিতে— ছোট বড় নানা পরিসরে। রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানগুলিতে, সামাজিক সম্মেলনগুলিতে, আড্ডায়। কখনো এমনিই বয়ে গেছে তাঁর সুরের নির্ঝরিনী, কখনো অনুরোধ-উপরোধ-আর্জিতে কাজ না হলে হুমকি দিয়ে শুনেছি তাঁর গান। (মা, ভাগ্যিস তুমি জোর করে গানের স্কুলে নিয়ে যেতে, গান শুনবার আনন্দকে আমার করে দিয়েছ এজীবনে। শিখিনি কিছুই, শুধু আনন্দ বুঝেছি, বুঝে পেয়েছি। ) তিনটি সিডি বের হয়েছে তাঁর, তিনটি সিডিরই সঙ্গীতায়োজনে-পরিচালনায় ছিলেন দূর্বাদল চট্টোপাধ্যায়। প্রথম সিডি ‘মোরে বারে বারে ফিরালে’, দ্বিতীয়টি ‘অধরা মাধুরীর ছন্দোবন্ধন’ আর তৃতীয়টি অতি সম্প্রতি বেরিয়েছে ইমপ্রেস অডিওভিশন লিমিটেডের প্রকাশনায়, নাম ‘হৃদয় আমার প্রকাশ হলো’। শেষ সিডির দশটি গানের দশটিই বৈতালিক। এই সিডি শুনবার পর থেকে এই লেখা লিখবার শুরু—
রবীন্দ্রনাথের কিছু গান সজল অন্ধকারের, কিছু গান প্রাণের শ্রবণে শুনবার, কিছু গান মুখর আকাশ আর বিষণ্ন সন্ধ্যার, কিছু গান নিঃসীম শূন্যের, কিছু গান জনান্তিকের। সে গান শুনবার মুহূর্তগুলি আহ্বান, ক্ষমা, ঘাতসহনীয়তা, প্রত্যয় এবং নিভৃত বিস্ময় দিয়ে রক্তিম করে তুলেছেন ইমতিয়াজ আহমদ। সামান্য যন্ত্রানুসঙ্গের এই গানগুলি শুনলে সহসা কবির স্বগতোক্তির মতো মনে হয়, আরাধ্যের প্রতি সংরক্ত অভিমানের, সনির্বন্ধ মিনতির। তালযন্ত্রের বাগাড়ম্বরহীন (সেই লাফ মেরে ধরে মোরগের লাল ঝুঁটি নেই!!) এই গানগুলি শ্রোতাকে একরকমের বন্ধনহীন গ্রন্থিতে বাঁধবার জন্যে প্রস্তুত, তার হৃদয়ও অনন্ত আকাশে প্রকাশ হয়ে পড়ে শুনবার পর।
‘অশান্তির এই দোলার ’পরে বোসো বোসো লীলার ভরে’— যখন গেয়েছেন তিনি, আমার মনে পড়েছে শান্তিহীনতার ভীষণ দোলাচলের উপরেও লীলাচ্ছলে বসা যায় তাহলে। বড় মর্ম্মভেদী এই পুনরাবিষ্কার। ভাগ্যিস রবীন্দ্রনাথ জন্মেছিলেন, তাঁরই গানের আশ্রয়ে কিনা আমরা ব্যক্তিগত এবং জাতীয় জীবনে অগ্নিবাণে ভরা তূণ সইতে শিখেছি, আরো আঘাত সইবার দীক্ষা নিয়েছি। ‘মনে হলো যেন পেরিয়ে এলেম অন্তবিহীন পথ আসিতে তোমার দ্বারে’ তাঁর ব্যক্তিগত আরাধনা এবং প্রাত্যহিক চর্যাকে ঠিকরে দেয় শ্রোতার প্রাণের শ্রবণ অব্দি, শুদ্ধ উচ্চারণে ঝকঝক করে ওঠে বাণী আর সাধা গলাটি সঠিক পরিমাপে সুরের দাবী শোধ করে দেয়। ‘মেঘছায়ে সজল বায়ে’ বা ‘শ্রাবণের পবনে আকুল বিষণ্ন সন্ধ্যায়’ ফিরিয়ে আনে স্মৃতি, বর্ষণক্ষান্ত সন্ধ্যার স্মৃতি, সন্ধ্যামেঘের স্তূপে পূঞ্জ পূঞ্জ সোনার স্মৃতি, সজল অন্ধকারের স্মৃতি, সত্যিই প্রবাসী পাখি এই মন তখন ফিরে যেতে চায় দূরকালের অরণ্যছায়াতলে, শেষে ইমতিয়াজ রচনা করেন আর্তি, ‘হায়, জানি সে নাই জীর্ণ নীড়ে, জানি সে নাই নাই’।
তাঁর সিডির শেষটুকু অবশ্যই ‘বড়ো বিস্ময় লাগে’ দিয়ে। একদা ‘শাপমোচন’ শুনতাম ক্যাসেট বাজিয়ে, ‘জনশূন্য দেওদারবনের দোলায়িত শাখায় দক্ষিণ সমুদ্রের হাওয়ার হাহাকার’-এর কথা শুনে, নিমফুলের গন্ধে অন্ধকার ঘরে অনির্বচনীয়ের আমন্ত্রণের কথা শুনে, আকাশে অন্তহীন অভিসারের পথ খুলে দেবার কথা শুনে রক্তে নাচন লাগতো আমার, মহিষী কমলিকা যার কুরূপ সহ্য করতে না পেরে পালিয়ে এসেছিল, সেই কমলিকা সবিস্ময়ে সেই রাজাকেই বলছে ‘প্রভু আমার, প্রিয় আমার, এ কী সুন্দর রূপ তোমার!’ রসবিকৃতির পীড়া কমলিকা পরে কী করে সইতে পারলো এই নিয়ে সে বয়েসে আমার দ্বন্দ্ব কাটতো না, সেজন্যেই কমলিকার এই সংলাপের পরপরই ‘বড়ো বিস্ময় লাগে’ শুনে সত্যি বিস্ময় জাগতো মনে। সৌন্দর্য্য নির্বাপিত হয়ে গেলে আর কি বাকি থাকে তবে? ‘তোমারে হেরিয়া যেন জাগে স্মরণে/তুমি চিরপুরাতন চিরজীবনে’, কেউ কি আজকাল আর ‘হেরে’, বিস্ময় মানে পুরাতনের চিহ্ন চিরজীবনে সঞ্জীবিত হতে দেখে? তাঁদের নিশ্চয় দ্রব করবে ইমতিয়াজের গানগুলি।

বাংলাদেশ সময়: ১৪২১ ঘণ্টা, জুলাই ১, ২০১৪