মা সন্ধ্যা হয়ে আসছে। দেখ, লাইটটা চার্জ হয়েছে কিনা? ‘হ, অই গেছে’।
প্রথমে আমি শোল মাছটিকে দেখিনি। আমার গন্তব্য শুধু কই মাছের দিকে। আর একটি ছালার ব্যাগ নিয়ে আমার সাথে সাথে প্রীতম হাঁটছে। নিশ্চিন্ত মনে মাঠের স্বচ্ছ জলের মধ্যে কচু গাছের ভিতর শোল মাছটি লুকিয়ে আছে। কিন্তু তার খানিক দূরে একটি কই মাছও দেখা যাচ্ছে। শোল মাছ আমার খুব প্রিয়। হাতের টেন্ডাকে শক্ত করে ধরলাম। এটি একুশ শিকের তৈরি টেন্ডা। কুরার মোটা অংশের দিকে গোল করে কেটে তার দিয়ে ছোট ছোট চিকন লোহার শিককে ধারালো করে বানানো হয় টেন্ডা। খুব ধীরেসুস্থে পা ফেলে আর এক পা এগিয়ে শোল মাছের মাথা বরাবর আমার টেন্ডার পজিশন নিয়ে অতি জোরে ঘাঁই দিলাম। জল নড়ে উঠলো; মাছও নড়ছে। ‘মামা কি অইছে?’— ধরো নাও। এই বলে টেন্ডার চিকন শিক থেকে মাছটি মাটিসহ আস্তে আস্তে খুলে ভাগিনার ব্যাগে দিলাম। মাঝারি ধরনের শোল মাছ এটা। ভাগিনা মহাখুশি। মাছ পাওয়াতে তার ভয়ার্ত ও মলিন চেহারায় চাঁদের আলোর সৌন্দর্য ছড়াচ্ছে। ‘মামা আরো মাছ মারেন’। মারতেছি। চুপ করো—এই বলে আমি অতি ধীরে মাঠের জলে নেমে গেলাম। পরনের লুঙ্গিটা গোছ দিয়ে নিলাম। প্রীতম দাঁড়িয়ে রইলো ডাঙ্গায়। ওর হাতেও একটি টর্চলাইট। বারবার আমার চোখে টর্চলাইটটি মারছে, আর মামা-মামা বলে চিৎকার দিচ্ছে।
আমি থামতে বললেও থামলো না। বলে— ‘মামা আঁর ডর লাগে, আমনে আইয়েন’। আমি মাঠে নেমে কোনোমতে একটা কই মাছ মেরেই উঠে পড়লাম। এখন কার্তিক মাস, মাঠের জলে টান ধরেছে। শুকিয়ে যাচ্ছে, হারিয়ে যাচ্ছে সব জল, যেন মাঠের মাটিগুলো ব্যাপক তৃষ্ণার্ত। মাঠের পাশেই গ্রামের রাস্তা ঘেঁষে সাপের বাঁকানো ফণার মতো বয়ে গেছে বিল। বিলের জলও শুকিয়ে যাবে কিছুদিন পরেই। গাঢ় অন্ধকারে আমারও ভয় ভয় করছে। তবে আমি কখনও ভূতে বিশ্বাস করিনি। প্রীতম তো আবার ভূত বলতেই অজ্ঞান। তাই তাকে আর আমার মনের কথা বললাম না। কারণ, চোখেমুখে তখনও লেগে আছে ডালা শিকারের নেশা; মাছ শিকার করার নেশা। আমি হাতের টেন্ডাটাকে অনেকটা নিস্পৃহভাবে ডানহাতে নিয়ে, ভাগিনাকে নিয়ে আস্তে আস্তে বিলের ধার ঘেঁষে হেঁটে চললাম। সাথে প্রীতম থাকায় বিলের জলে নামার বিন্দুমাত্র সাহস কিংবা ইচ্ছাবোধ আমার ভিতর কাজ করেনি। ও মাঝেমাঝেই ইচ্ছা করে আমার সামনে চলে আসে। তাতে আমার মাছ মারতে খুব অসুবিধা হয়। হঠাৎ করে বিলের জলে টর্চলাইট মারতেই দেখি এক বোয়াল মাছ। কি অবাক কাণ্ড! আমি ভীষণ সতর্ক হয়ে গেলাম। অতি সাবধানে এক পা প্রসারিত করে দাঁড়িয়ে লক্ষ্য স্থির করলাম, কিভাবে মারবো—কখন মারবো ইত্যাদি। টর্চলাইটটি বিলের জলে তাক করে দেখলাম মাছটি জলের হালকা স্রোতের সাথে ভেসে যাচ্ছে। মনে হয় যেন কবিতার আঁকাবাঁকা ছন্দের মতো। যেন ওই মাছেরও একটি ছন্দ আছে। আমি কোনোরূপ দেরি না করে অতি সাহসের সহিত ডান হাতের মুষ্ঠিতে শক্তি সঞ্চয় করে মাছের গায়ে টেন্ডাটি নিক্ষেপ করলাম। টেন্ডা আমি প্রায় ছেড়েই দিয়েছি। কিন্তু সেটি নড়ছে বিলের জলে। আমি উপর থেকে একটু নিচে নেমে মাছসহ টেন্ডা উপরে ওঠাতেই মাছটি চলে গেল, টেন্ডার একটি শিক বাঁকা করে। ক্ষণিক সময়ের জন্য আমার মনটি খারাপ হয়ে গেল। প্রীতম জিজ্ঞেস করলো— ‘মাছ হড়ে ন, মাছ কই?’ কোনো উত্তর আমি দিলাম না।
শহর থেকে গ্রামের বাড়িতে গেলে আমার কাজই মাছ শিকার, বই পড়া আর বিভিন্ন পেশার মানুষের জীবনকে এক পলক দেখে নেওয়া। তবুও ভাবি জীবনের আর কতটুকু বোঝা যায়, অনুমান করা যায়! ভাগ্য ভালো যে, আজ যদি আমবস্যা না হয়ে পূর্ণিমা হতো! তাহলে মাছ লুকিয়ে যেত বিলের কিনারা থেকে গভীর জলে। ওদিকে প্রকৃতি ঘুমানোর সাথে সাথে পশু পাখীরাও ঘুমিয়ে পড়েছে। ওদিকে যেন কালো আঁচল টেনে টেনে অন্ধকারের ভূতটা আরো গাঢ় হতে লাগলো। কুলুকুলু ধ্বনি তুলে স্রোতের সাথে পাল্লা দিয়ে বয়ে যাচ্ছে সময়। অল্পদূরে লাইট মারতেই একটি মাছ ‘ডাফ’ দিলো মনে হয়। আমি এগিয়ে যাই কিছু দূর। আমার পিছু পিছু ছুটছে প্রীতম। এগিয়ে যেতে যেতে অনেক পথ পেরিয়ে গেলাম। ভাবতেই পারিনি কখন যে এত রাস্তা অতিক্রম করেছি। এ বিলের মাঝখানে কালিকাপুর গ্রাম— ওই গ্রামের সবচেয়ে নির্জন ও নীরব জায়গা এটি। সামনে এক গহীন বন, মনে হয় যেন ভাপসা একটা গন্ধ চারিদিক ছেয়ে ফেলেছে। মাছ শিকার করতে করতে, মারতে মারতে অনেক মৃত ও অর্ধমৃত মাছ ব্যাগের ভিতর জায়গা করে নিলো। টেন্ডা থেকে মাছ খুলতে খুলতে হাত ভরে যায় কাঁদায়। ভাগিনা ভীষণ খুশি হয় মাছ পেলে। আর না পেলে বলে— ‘কই, পান ন?’ তার হাতে ব্যাগ যেন আনন্দের একরাশ ছোঁয়া। আমি ভাবছি বড় হলে ও হয়তো অনেক সাহসী হবে। আমার মধ্যে কেমন ভয় ভয় কাজ করছে কিন্তু সে বলে— ‘আরো ধরেন’।
দুই.
অনেক রাত হয়ে গেছে। মাছ মারতে মারতে এই প্রথম একটি লোভ হলো আমার। এই লোভ কেউ সামলাতে পারে না। যখন কারো মধ্যে মাছ পাওয়ার, ধরার আকাঙ্ক্ষা অতি তীব্র হতে থাকে, তখন এরকম ঘটনা ঘটে। এবার আঁকাবাঁকা এই পথ পেরিয়ে বিলের বিপরীতে নান্টুদের পুকুরে আমার হাতের লাইটটি মারলাম। দ্বিধা, সংকোচহীন মনে। গন্তব্যের কাছে পৌঁছতেই হাঁটার গতি ধীর করি। ততক্ষণে লাইটের আলো আগের চেয়ে কিছুটা কমে এসেছে। দেখলাম ওদের পুকুরের ঘাটলার পাশে জলের নিকট নিচে দুটি বড় মাছ। একটি রুই মাছ, অন্যটি মৃগেল হবে হয়তো। নান্টুরা এলাকার সবচেয়ে বিত্তশালী। মনে মনে ভাবি, আর দেরি করা ঠিক হবে না— টেন্ডাটাকে শক্ত হাতে ধরে খুব জোরে লক্ষ্য বস্তুর ওপর নিক্ষেপ করলাম। ‘জপ’ করে একটি আওয়াজ হলো। খানিক জায়গা ঘোলা হয়ে গেল। আমি ধরে নিয়েছিলাম মাছ পড়বে না, পড়লেও থাকবে না, চলে যাবে। কিন্তু কিছু না ভেবেই আমি পুকুরের জলে নেমে গেলাম। আমার হাঁটু পর্যন্ত ভিজে গেল। তবে হাত থেকে তখনও টেন্ডাটি ছাড়িনি। পুকুরের মাটিতে মাছের নিশানার ওপর জোর করে চেপে ধরে আছি। যখন অনুভব হলো, টেন্ডাটি হালকা নড়ছে; তার মানে কিন্তু মাছটি টেন্ডার মধ্যেই আছে। ডান হাত থেকে টেন্ডাটি বাম হাতে নিলাম আর ডান হাতকে কাজে লাগালাম টেন্ডার শিকের মধ্যে থাকা মাছটিকে শক্ত করে ধরার জন্য। যাতে মাছটি চলে যেতে না পারে। টেন্ডাসহ মাছটি ওঠাতে না ওঠাতে হঠাৎ পাশেই কিসের যেন একটা শব্দ হলো। ভয়ে বুকে থু থু দিতে শুরু করলাম। অন্যদিকে প্রীতম ভয়ে ‘মামা-মামা’ চিৎকার। ‘আরে ভয় করিস না— মামা আছি তো’। রাস্তা ঘাটে তখন কোনো লোক নেই। রাতের ঘড়িতে আটটা বাজলেই এই গ্রাম যেন মরুভূমি।
অবশেষে কর্দমাক্ত হাত, পায়ের সাথে মাছ নিয়ে পুকুরের ঘাটলায় এসে দাঁড়ালাম। প্রীতমের ব্যাগে কাঁদাসহ মাছটি ঢুকাই। ‘মাছটি আবাত্তি নয়, বাতি মাছই মনে হলো। ’ যে মাছগুলো আমি পেয়েছি তারমধ্যে সবচেয়ে বড় মাছ এটি। স্বপ্নেও ভাবিনি এরকম একটি মাছ আমি আজ পেয়ে যাবো। খুঁজতে শুরু করলাম কী পড়েছে। প্রীতম বলছে— ‘মামা আর ডর করে, চলেন বাড়ি চলি যাই; মাছ আর ধরন লাগতো ন’। আমি বললাম— ‘দাঁড়াও দেখি কী পড়ছে। খানিক দূরে যেতেই গাছ থেকে একটি নারিকেল ঝরে পড়লো। নারকেলটিও নিয়ে নিলাম হাতে করে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই প্রীতম বললো— ‘মামা আর আত ব্যথা অই গেছে, আঁই আঁর হাইতাম-ন ব্যাগ লইতে, চলেন বাড়ি চলি যাই’। আমি ওর হাত থেকে ব্যাগটা নিয়ে ওকে নারকেলটি রাখতে দিই। না হলে তো আর মাছ শিকার করতে পারবো না। কিন্তু আমি তাকে এই বলে সান্ত্বনা দিলাম— ‘তাইলে আরেট্টু, আর একটু দেখি লই, কি কও বল ভাগিনা। ’ ‘সমস্যা নাই দেহেন তাইলে’। যে বিলে মাছ শিকার করেছি সে বিল নিয়ে কয়েকবার মারামারিও হয়েছে দু’গ্রামবাসির মধ্যে। যদিও এতে আমাদের গ্রামের মানুষই জিতেছে বারবার। যেহেতু আমাকে সবাই চেনে তাই রাতে মাছ মারতে আমার কোনো সমস্যা হয় না। ঘরে বাজার থেকে কেনা মাছ থাকলেও, ডালা শিকারের মাছের আলাদা স্বাদ, আলাদা আনন্দ, আলাদা উত্তেজনা। এই মাছ ধরাটা আমার কাছে একটা নেশার মতোই মনে হয়। প্রীতম নারকেলটিকে বুকের থেকে উঁচু করে, উচকাইয়া দুহাত দিয়ে ধরলো। আর আমাকে অনুসরণ করতে লাগলো। নান্টু বাড়ি পার হয়ে অল্পক্ষণ মাছ মারার পর, হঠাৎ করে একটা কাইজ্যা-ঝগড়ার শব্দ কানে আসে। এটা মনে হয় ‘মাদহালি’ বাড়ির ঝগড়ার শব্দ। ওই বাড়িতে প্রতিনিয়ত কাইজ্যা-ঝড়গা লেগে থাকে। আমাদের গ্রামের সবচেয়ে গরীব ও অশিক্ষিত মানুষের বাস এই বাড়িতে। রহিমের ঘরে। ও রিকসা চালক। প্রতিদিন অন্তত একবার করে বউ পেটানো ওর স্বভাব। এসব নিয়ে অনেক কিছু হয়েছে। কিন্তু মারাধর থামে না। তার ওই একই কথা— ‘আঁর বৌরে আঁই মারি কার কী আইয়ে যায়’।
আমরা আর কোনোরূপ দেরি না করে ঘরের উদ্দেশ্য রওনা হই। যেতে যেতেও কয়েকটা খইয়া আর কই মাছ মারলাম। তবে প্রীতমের চাপাচাপিতে আর বেশি সময় অতিবাহিত করা গেল না। ঠাণ্ডার আরাম মেশানো বায়ু তখনও আমাদের সারা শরীর বেয়ে ছড়িয়ে পড়ছে চারিদিক। ওইদিনের মতো বাড়ি ফিরে এলাম। ঘরের সামনে এসে মাকে ডাক দিই— ‘মা, মা দরজা খুলেন’। ততক্ষণে মা বোনেরা সব গভীর ঘুমি। তাদের ঘুম থেকে জাগাই।
এত দেরি অইছে কিল্লাই?’
দেরি তো অইবোই মা, এখন যাও মাছগুলো কুটে নাও।
আচ্ছা, আই মাছ কুইট্যা লই তুই হাত-মুখ ধুই ল।
এবার মাছ রান্নার পালা— তারওআগে গুনবার। প্রীতম মাছ গুনতে শুরু করে। মা রান্না ঘরে গিয়ে দা নিয়ে মাছ কুটতে শুরু করে। আমি টেন্ডাটাকে ঘরের টিনের চালের উপর রেখে দিয়ে প্রীতমসহ হাত-পা ধুয়ে নিই টিউবওয়েলের জলে। ঘরে প্রদীপের আলো জ্বলছিল অকস্মাৎ পল্লীবিদ্যুতের কারেন্টও ফিরে এলো। প্রীতম খুশিতে মাছ গোনা ফেলে দিয়ে বড় ঘরে এক দৌড় দেয়। বাবা তখনও ঘরে ফেরেনি। রুগি দেখতে গেছে। অন্যদিকে ‘মাদহালি’ বাড়ি থেকে কান্নাকাটির শব্দ বাতাসের সাথে খেলতে খেলতে আমাদের বাড়ির উঠানে এসে পাক খেতে লাগলো।
বাংলাদেশ সময়: ১৬০০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৩, ২০১৪