১.
চারসালে টিউলিপ বাগানে তোমাকে দেখলাম। ছয় সালে দেখলাম স্ট্রবেরি বাগানে।
২.
মধু ও লবণ নিয়ে বসে আছি। কী হবে? যদি আমি চেয়েই থাকি মরে যাক ওই ছোট কামিনী গাছ। যদি কোনো সরীসৃপ এসে বসে থাকে ডালে তবে সেও মরুক। মানুষ কখনো গাছেরও মৃত্যুকামনা করে। দুর্যোগের জন্য বসে থাকে। মাটিতে কান পেতে শোনে জাভাদ্বীপে জাগছে সুনামি। জাপানে উঠে আসছে জল। গুলি হচ্ছে। কেউ না কেউ তো মরছেই অপঘাতে। কোথাও না কোথাও জাগছে পুরনো আগ্নেয়গিরি। জেগে উঠছে পুরনো মারী। নতুন মারণযন্ত্র। কী হবে এই মধু ও লবণ দিয়ে। তপ্ত লাভার ওপর বৃষ্টি দিয়ে। পাহাড়ের ওপর উঠে আমি মৃত্যু কামনা করি প্রতিদিন। হয়তো কোনো গাছ। হয়তো কোনো মানুষ। বেজে উঠছে সাইরেন দূরে কোনো আরব শহরে। এত আনন্দ নিয়ে মানুষ কি কখনো মানুষ মেরেছে? মৃতের আত্মা হাতে নিয়ে উল্লাস করেছে কখনো? অযথাই বৃষ্টি হচ্ছে। পুরনো দিনের চীনা গানের মতো বৃষ্টি। অযথাই রোদ উঠছে। আমরা কামনা করছি ভিন্নমতাবলম্বীদের মৃত্যু। যদি আপসে আপ না মরে তবে অস্ত্র আছে। এক ভাণ্ড দুধ নিয়ে বসে আছি। আমরা কি ভেসে এসেছি এই পৃথিবীতে। শুধু দুধ খেয়ে আছি? মানুষের স্তনের দিকে দেখি, মানুষের সন্তানের দিকে। কী হবে এই দুধ দিয়ে, মধু ও লবণ দিয়েই বা কী হবে। অগুনতি বৃষ্টি ফোঁটা অহেতুক ঝরে পড়ছে। অহেতুক গান হচ্ছে।
৩.
সবুজ গোলাপের পাতাগুলো কেমন। এই প্রশ্নে থমকে আছি। স্বপ্নে আমি গোলাপই দেখেছি। মনে করতে পারিনি পাতাগুলো কেমন। ছবির মতো একটা দেশ। উঁচু থেকে সেতু নেমে এসেছে ঘনবনানীতে। বৃষ্টি হচ্ছে। সবুজ গোলাপবাগানে। হয়তো নাগাল্যান্ড। গোলাপের পাতার আড়ালে লুকিয়ে আছে গেরিলা। সেতু বিভাগের পাশ দিয়ে বনানীতে এসে মনে হলো একটা বিভক্ত নদীর ওপর দিয়ে সেতু বয়ে গেছে। আম গাছও আছে দেখলাম। নদীর ধারে ঘনঘাসের ওপর শুয়ে স্বপ্নটা দেখলাম। তারপর বৃষ্টি শুরু হলো। হয়তো স্বপ্নের ভেতর এখনও বৃষ্টি হচ্ছে সবুজ গোলাপ বাগানে। বড্ড লোভ হলো। আবার ঘুমাতে পারলে হয়তো দেখে আসতে পারতাম গোলাপের পাতাও। পাতার আড়ালে সতর্ক চোখ। সবুজ গোলাপের আড়াল থেকে আমার দিকে অস্ত্র তাক করে আছে আততায়ী। পুরনো পুরনো উঁচু উঁচু গাছ। পুরনো স্মৃতির মতো লতা নেমে এসেছে মাটিতে। কচুরিপানার পাশে শুয়ে থেকে মনে হলো। একদিন সবই ফিরে আসে। গল্পের ছলে। পুরনো কবিতা থেকে উদ্ধৃতিও একদিন মিলে যায়। আমার সবুজ গোলাপ বাগান ফিরে এলো। দেখলাম সবই ঠিক আছে। গোলাপ এখনও সতেজ। আড়ালে আততায়ীর চোখ এখনও সমান সতর্ক। এত বছর পরও আমার অপেক্ষায় বসে আছে। হয়তো মিজোরাম। খুব অচেনা ল্যান্ডস্কেপ। এশিয়ার কোনো দেশ হবে। স্বপ্নে আবারও যে নিমফুলের গন্ধ পেলাম।
৪.
শান্তির সময়ে আমি পাহাড় থেকে ভেসে আসা গান শুনি। মূলত এটা গান নয়, একটা শহরের নাম। ওরকম নামের একটা শহরেও বৃষ্টি হয়। মূলত এটা কবিতাই। ওই যে বৃষ্টি হয় সেটা মূলত কবিতাই। কেননা বৃষ্টি তো ঝরে পড়ে বৃষ্টিবাগানে, রেইনট্রিতে। এশিয়া ভরে যায় ছাতিমের গন্ধে। ফুল ফোটে, মেঘও করে। শান্তির সময়ে আমি বের করে আনি ন্যাপথলিনের গন্ধভরা একটা বিবর্ণ স্যুটকেস। ভেতরে হাজারো উলের গোলা। আমরা বুনে চলি সোয়েটার। মূলত আমার মা-ই বোনেন, আমার বোন বোনে— আমি তো বোনাই শিখিনি। যারা যুদ্ধ করছে পৃথিবীর নানা অঞ্চলে, তাদের নামে আমরা বুনে রাখি সোয়েটার। কোনপক্ষে আমি আমি, আমরা? মিলিশিয়া নাকি সৈনিক। কাকে দেব এইসব সোয়েটার। ভাদ্রমাসে বৃষ্টি হলে পুরনো অভ্যাসমতো আমরা ন্যাপথলিনের গন্ধমাখা সোয়েটার বুনে রাখি। কেননা শীত তো এলো বলে। তুমিও আসবে, শীতের আগে। ভোরবেলা একটা অকেজো ট্যাংকের সামনে আমি অপেক্ষা করবো। মূলত আমি একটা শিউলিফুল। বলতে গেলে আমি অনেক শিউলিফুল। জাফরান দেয়া ভাতের মতো ঘাস। তুমি একটা লম্বা ঠোঁটের দিশি বক। অনেক দূর থেকে ভেসে আসা সাইরেন তুমি শোনো। আমি একটা পাতা— বহুদিন ধরে অপেক্ষায় আছি। দেখবো কীভাবে চুমো খায় লম্বা ঠোঁট অলা দেশি বক। আসলে তো পাতার আড়ালে আমিও একটা দেশি বক। এশিয়ায় যেখানে আছে বাঁশবাগান। সেখানেই আছে সহস্র দেশি বক। যখন কোনো দেশি বক নিজেকে একলা ভাবে। তখন তো আসলে সে প্রেমই চায়। কিন্তু কীভাবে প্রেম সম্ভব বলো, আমাদের এত লম্বা ঠোঁট। যতই চেষ্টা করি মানুষের মতো আমাদের হবে না। কেননা আমরা মূলত মানুষ। মানুষের কাছাকাছি থেকে, নিজের অলক্ষে সকলে মানুষ হয়ে গেছি। যেমন ওই লম্বা নারকেল গাছ।
৫.
তনিমার সব প্রেমিককেই আমি চিনি। ঘটনাচক্রে। যখন পিয়াবাসন্তী। যখন সেদিন তোমরা নাকি। যখন অরুন্ধতী রায়। ছোট ছোট জিনিশের ঈশ্বরের সাথে তনিমার একগাদা ছবি হাতে ঘুরতো প্রথম প্রেমিক। বলতো তনিমা মেয়েটা কেমন। তনিমার দ্বিতীয় প্রেমিক একদিন ঘোরলাগাবর্ষার সন্ধ্যায় আমাকে একা ভিজতে দেখে বলেছিল, তুমিও কি প্রেমে পড়েছো। তনিমার তৃতীয় প্রেমিক ঘাড়ে চুমো খেয়ে এসে আমাকে বলেছিল। চতুর্থ প্রেমিক বলেছিল, আমি তো নিকষকালো। তনিমা আসলে লম্বা আর ফর্সা ছেলেদের পছন্দ করে। একদিন হাতিরপুলে মাহতাব প্লাজার নিচে দাঁড়িয়ে দেখলাম পঞ্চম প্রেমিককে চুমো খেতে খেতে পরিবাগের দিকে যাচ্ছে তনিমা। ভেবেছিলাম এই ছেলেটির সাথে দেখা হবে না। তারসাথেও কথা হলো তেরো সালে। কীভাবে বলি যে তাকে চিনি। চুমো খেতেও দেখেছি। তনিমা বিয়ে করেছিল, আমারই শহরের ছেলে। সম্ভবত সেও প্রেমিক ছিল। বিয়ে ভেঙে যাবার পর তনিমাকে যে ছেলেটি সিএনজিতে আঁকড়ে ধরেছিল সে তো আমার সাথেই থাকতো বহুকাল। তনিমার সব প্রেমিককেই আমি চিনি। শুধু তনিমাকে চিনি না। মানে নিজেকে আমি চেনাতে পারি না। তনিমার কাছে। তাই তনিমার এত কিছু জানি একথা তনিমাও জানে না। প্রেমিকেরা না। সকলে আলাদা আলাদা করে জানে। কিন্তু ঘটনাচক্রে আমি তনিমার সব প্রেমিককেই চিনি। এমনকি যে ছেলেটিকে ঘিরে তনিমার চিন্তা কিছুটা থিতু হয়ে এলো। মনে মনে যার সাথে বাকীজীবন কাটিয়ে দেবে বলে ভাবছে তনিমা। তার সাথে হঠাৎ পরিচয় হলো গতকাল। এখন মেঘলাদিন, বৃষ্টিহীন। এখন শান্তসন্ত্রাসের চাঁদমারি। মাঝে মাঝে আমারও ইচ্ছা হয়, কোনো এক ব্যাকুল বিকালবেলা তনিমার কাছে যাই। আমার স্থানে থেকে তৃতীয় কেউ গুনে রাখুক তনিমার দ্বাদশ প্রেমিকের নাম। হলো কই। তনিমা তো বাইরে চলে গেল। প্রেমিকটিও যাবে। তনিমার প্রেমের দিওয়ানা ছেলেটি এখন দূতাবাসে দূতাবাসে ঘুরছে।
৬.
অশান্ত বুনোজলে ভেসে ভেসে কোথায় এসে জেগে উঠলাম ভাই। তোরা তো এখানেই ছিলি। কবে থেকে। তোরা কি জানিস। কীভাবে ভেসে এলাম এ শুকনো শহরে। ময়লার জঞ্জালে আমার দেহ এসে ঠেকলো। তখনও কি ঘুমিয়েই ছিলাম। তোরা কি ভুলে আমাকে মৃত মনে করেছিলি। আসলে তো মরি নাই। বেঁচে আছি। আমার সাথে যারা কাল ভেসে এলো তাদের দেখে আজ কে আর বলবে এরা ভেসে এসেছে। মনে হয় আমরা সবাই চিরকাল আছি এই শুকনো শহরে। মাটি কামড়ে পড়ে থাকবো। কে হেঁটে এলো। কে ভেসে এলো। কে ভিনগ্রহের যান থেকে নেমে এসে আমাদের জীবন বাঁচালো। কে রাখে সে খবর। সকলেই শরণার্থী। বস্তির শয়তান থেকে শুরু করে নির্বাচিত ফেরেশতা। ফুলের মতো পবিত্র যাদের জীবন। মধু খায়। ফুলের রেণু মেখে ঘোরে। ফুলের গন্ধ মাখে। তারাও। সবাই মাটি কামড়ে পড়ে আছে। তবু মাটিটাই খাবে না। ব্যতিক্রম শুধু ওই মাটিখোর উন্মাদ। মাঝে মাঝে টিভিতে আসে না? টিভির মেয়েরা ক্যামেরার দিকে হাসে। ক্যামেরাম্যানের দিকে হাসে। আমি ভাবি, আমার দিকেই হাসে। আমরা তো ক্যামেরাম্যান। আমরা জানি ওই সতর্ক বাঁকাহাসির মানে। আমরা অনেক নদীর বাঁকে ঠেকে ঠেকে। ঘুমিয়ে, জিরিয়ে, মরে মরে তবেই না এসেছি। সব জানি। তোরা কেন মাটি কামড়ে পড়ে আছিস। ওরা কেন মাটি কামড়ে পড়ে আছে। আমরাও থাকবো। যখন এসেই পড়েছি। একদিন এখানেও ঠেকবে বুনোজল, বেনোজল। দরকার হলে আবার ভাসবো। তোদের পাশে ভাসতে ভাসতে দেখবো। তোদের সদ্যকামড়ছাড়ামলিনমুখ। মাটিমাখা। পানি খেতে খেতে প্রথম প্রথম একটু কষ্ট হবে। তারপর সয়ে যাবে ভাই। আমরা তো আছি ভাসানের দলে। ভাসমান শরণার্থী। তোরা এলে। দলভারী হবে।
৭.
সাতানব্বই সালে। দোসরা ডিসেম্বরের ভোররাতে যে বাতাস সহসা জানালা দিয়ে ঢুকে আমাকে চমকে দিয়েছিল। তেমনি একটা উদভ্রান্ত বায়ুস্রোত কাল আমার কানের কাছ শিষ দিয়ে গেল। মনে পড়লো, পুরনো ঘর। ঝুলবারান্দা। রাস্তায় দাঁড়ানো রাতজাগা নেশাখোরের মুখটাও হুবহু মনে পড়ে গেল। জুয়া খেলে খেলে নিঃস্ব তাড়িখোরের নির্ঘুম চোখ আমার জানালার দিকেই ফেরানো। আসলে সে দেখছিল ভোরের আলো পড়া শাদা দেয়াল। লাল শাপলাভরা পুকুরে একটা বিষহীন সাপ ঘুরছে। ভোর হলো। এবারের গরমে একটা তরমুজে কামড় দিয়ে মনে হলো খেত থেকে চুরি আনা সেই ফল। কলেজের ছাদে লুকিয়ে রেখেছিলাম। কুড়িবছর পর মনে হলো। খেতে খেতে বললাম, এতদিন পর কোথা থেকে এলি। কীভাবেই বা এলি রে লাল তরমুজ। অনেক পুরনো একটা ভ্যাপসা গন্ধের বৃষ্টিতে ভিজলাম খুব। জুনে কোথা থেকে যে ফিরছে এরা। ফিরে আসছে সুদূর অতীত থেকে কোনো ছোট ঘাসফুল। দেখলাম ঢোল মামুনের একটা লতা শাখা ছড়িয়েছে মেঝেয়। পুরনো প্রেমিকা এসে ঠোঁটে চুমো খেয়ে যাচ্ছে। একাশি সালের আশ্বিনের ঢাকের শব্দ শুনলাম বাসে বসে বসে। কথা শুনে মনে হচ্ছে, আগেও শুনেছি। চেনাস্বর। সন্ধ্যাবেলা। একথা স্পষ্ট মনে পড়ে। হয়তো সময় থমকে দাঁড়ালো। কোনো এক গুরুতর ভুলে। অতীত মিশে যাচ্ছে বর্তমানে। খণ্ড খণ্ড অতীত এসে বর্তমানের ফাঁক ও ফোকর গলে ঢুকে যাচ্ছে। খুব ভালো ফিউশন হচ্ছে। অথবা ফিরে আসছে আসলেই হুবহু অতীত।
৮.
কোথাও শোক নাই। শুধু শোকের দীর্ঘ ছায়া পড়ে আছে। হয়তো কোথাও রয়েছে শোক। হয়তো কোনো গাছের নাম। যেমন অশোক। হয়তো রাজা অশোকের মতো কোনো প্রাচীন রাজা। শোকও। গান্ধারের। হয়তো কোনো খ্যাতিমান সাধু। চিরবিষণ্ণ, হতাশ ও আপ্লুত সেই সাধু কেন শোক নামে পরিচিত হয়েছিলেন? শোক নামে কেউ হয়তো কোনোদিন জন্মানওনি এই পৃথিবীতে। খুব সম্ভব কোনো বড় গাছ। কারো মৃত্যু হলে তার ছায়া পড়ে। শুধু মানুষের মধ্যে নয়, মানুষের পৃথিবীতে নয়, ইতিহাসজুড়েও কখনো পড়ে থাকে শোকের দীর্ঘ দীর্ঘ ছায়া। একদিন মানুষ শোক ভুলে যায়। শোকের ছায়ায় বসে আরাম করে। ঘুমায়। ভুলে যায় কোনা গাছের নাম অতীতে শোক ছিল। কোন ঋষির নাম ইতিহাসে শোক ছিল। কী ছিল তার শিক্ষা। বাণীবিহীন সেই ঋষির কথাও ভাবি। দীর্ঘ চুলদাড়ি। খালিগায়ে বসে আছে। গাছের তলায়। যার কথা মানুষ ভুলে গেছে। চেহারাটুকুও মনে নাই। ছায়া আছে। দেখা যায় না। আবছা শোকের ছায়া দেখে বোঝা যায় না কিছু। মানুষ না গাছ। নাকি কোনো বিল্ডিং? ওইটুকু ছায়া আছে বলে এখনও শোক আছে। ছোট বড় দীর্ঘ দীর্ঘতম শোকের ছায়ায় এখনও ঘুমায় মানুষ। দুপুর বেলা।
বাংলাদেশ সময়: ২০২০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৫, ২০১৪