ঢাকা, শুক্রবার, ১২ পৌষ ১৪৩১, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

প্রতিদিনের ধারাবাহিক

টানেল | এর্নেস্তো সাবাতো (৬) || অনুবাদ : আলীম আজিজ

অনুবাদ উপন্যাস / শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪২৯ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৭, ২০১৪
টানেল | এর্নেস্তো সাবাতো (৬) || অনুবাদ : আলীম আজিজ অলঙ্করণ: মাহবুবুল হক

এর্নেস্তো সাবাতো (২৪ জুন ১৯১১-৩০ এপ্রিল ২০১১) আর্জেন্টাইন লেখক এবং চিত্রকর। লেখালেখির জন্য পেয়েছেন লিজিওন অফ অনার, মিগুয়েল দে সেরভেন্তেস পুরস্কার।

এছাড়াও তিনি ছিলেন লাতিন আমেরিকান সাহিত্য জগতের বেশ প্রভাবশালী লেখক। তাঁর মৃত্যুর পর স্পেনের এল পায়েস—তাঁকে উল্লেখ করেন ‘আর্জেন্টিনাইন সাহিত্যের শেষ ধ্রুপদী লেখক’ বলে।
‘এল তুনেল’ (১৯৪৮), ‘সবরে হেরোস ইয়া টুম্বাস’ (১৯৬১), ‘অ্যাবানদন এল এক্সতারমিনাদোর’ (১৯৭৪) তাঁর জগদ্বিখ্যাত তিন উপন্যাস।

৫ম কিস্তির লিংক

আমার প্রশ্নে প্রাতো তাকাল আমার দিকে, খানিকটা অবাক হয়েছে সে, কিন্তু আমি পুরো নিষ্পাপ মুখ করে তার দৃষ্টি ফিরিয়ে দিলাম।

‘কেনো, সাইকোঅ্যানালাইসিস সোসাইটি, কাস্তেল, ‘সন্দেহের তীরে বিদ্ধ করতে করতে জবাব দিল সে, আর আমি শুনেছি, এই পেশার জন্য ফ্রয়েডের মনঃসমিক্ষণের ত্বত্ত্ব মতে, এরকম দৃষ্টি নাকি খুব জরুরি, একইসঙ্গে তাকে দেখে এও মনে হচ্ছে সে যেন নিজেকেই প্রশ্ন করছে, ‘এটা আবার এই লোকের নতুন কোন পাগলামী?’

আমার মনে পড়ল ড. বার্নাড, কিংবা বার্টর‍্যান্ডের পরিচালনায় একটা কোনো সভা কিংবা সিম্পোজিয়ামের কোনো খবর পড়েছিলাম কোথাও, নিঃসন্দেহে বলতে পারি এটা সেই সভা না, তারপরও আমি জিজ্ঞেস করলাম আমরা ওখানেই যাচ্ছি কি-না। অবজ্ঞার হাসি হেসে আমার দিকে তাকাল প্রাতো।

‘আরে ওরা হাতুড়ে’—তার মন্তব্য। ‘আমাদেরটা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত একমাত্র সাইকোঅ্যানালাইটিক সোসাইটি। ’

বলে আবার ডেস্কে বসে পড়ল সে, ড্রয়ার খুলে কাগজ ঘাটতে শুরু করল, তারপর ড্রয়ার থেকে ইংরেজিতে লেখা একটা চিঠি বের করে ধরিয়ে দিল আমার হাতে। সৌজন্যের খাতিরে আমি চিঠিটায় চোখ বোলালাম।
‘আমি ইংরেজি পড়তে পারি না’—জানালাম ওকে।

‘এটা শিকাগো থেকে পাঠানো চিঠি। এই চিঠির বক্তব্য হলো গোটা আর্হেন্তিনায় আমরাই একমাত্র সাইকোঅ্যানালিস্ট সোসাইটি। ’

আমার মুখে-চোখে বিস্ময় ফুটিয়ে তুললাম, সঙ্গে প্রগাঢ় শ্রদ্ধা।

অফিস থেকে বেরিয়ে ককটেল পার্টির উদ্দেশে রওনা দিলাম, পৌঁছে দেখলাম বেশ এক দঙ্গল লোকের জটলা। এদের কাউকে কাউকে আমি নামে চিনিও, একজন হল ড. গোল্ডেনবার্গ, সাম্প্রতিক সময়ে এক মহিলা রোগীর চিকিৎসা করতে গিয়ে সে ব্যাপক নাম কামিয়েছে। কারণ ওই ঘটনায় শেষ অবধি চিকিৎসক রোগী দুজনেরই ঠিকানা হয়েছিল মানসিক হাসপাতাল। কিছুদিন হয় ড. গোল্ডেনবাগ ছাড়া পেয়েছে। আমি লোকটাকে বেশ নিবিড়ভাবে খেয়াল করলাম, কিন্তু ওকে অন্যদের চেয়ে খারাপ মনে হল না। বরং তাকে অন্যদের চেয়ে অনেকখানিই শান্ত-সৌম্য মানুষ বলেই মনে হল আমার, হতে পারে এটা তার সাম্প্রতিক নির্জনবাসেরই ফল। আর যেভাবে সে আমার ছবির প্রশংসা করছিল, তাতে আমার মনে হল সে আসলে আমাকে প্রকারান্তরে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যই করছে।

৫.
এখানকার সব কিছু এতটাই অভিজাত যে নিজের পরনের পুরনো ঢোলাঢালা প্যান্টে খানিকটা অস্বস্তিই হতে লাগল আমার। কিন্তু ঠিক, পুরনো প্যান্টটাই আমার অস্বস্তির মূল কারণ না, যাহোক, ঠিক কী কারণে যে অস্বস্তিটা হচ্ছে তাও আমি ঠিকভাবে ব্যাখ্যা করতে পারব না। এবং এটা আরও চরম অবস্থায় পৌঁছাল যখন অতি সুন্দরী এক মহিলা মূল খাবার বা মেইন কোর্সের আগে অ্যাপটাইজার পরিবেশনের মতো করে তার এক সহকর্মীর সঙ্গে পায়ুপথে যৌনক্রিয়ায় অকল্পনীয় এক সমস্যা নিয়ে আলোচনার সূত্রপাত করল।

আমি ঘরের কোথাও একটু নিরিবিলি জায়গা খুঁজে বের করার চেষ্টা করলাম, কিন্তু সেটা এক রকম প্রায় অসম্ভব। ঠাসাঠাসি করে থাকা ঘরভর্তি একই ধরনের লোকজন সব প্রায় একই রকম অন্তহীন কথাবার্তা আউরে চলেছে। আমি শেষে ওখান থেকে পালিয়েই বাইরের দুনিয়ায় চলে এলাম, বাইরে এসে স্বস্তির সঙ্গে দেখা পেলাম কিছু সাধারণ লোকজনের (খবরের কাগজের হকার, এক তরুণ, কারো গাড়ির ড্রাইভার), এ অ্যাপার্টমেন্টের এতো কাছেই এ ধরনের লোকজনের উপস্থিতি কেমন যেন অবাস্তব ঠেকল।
যাই হোক, অন্য আর যে কারোর চেয়ে, আমার খুবই অপছন্দ চিত্রশিল্পীর দলকে। এর কারণ খানিকটা অবশ্য, ওই আঁকাআঁকি, যে জিনিসি আমি সবচেয়ে ভালো জানি, আর আমরা সবাই এটা জানি, যে জিনিসটা আমরা সবচেয়ে ভালো জানি তা অপছন্দ করার পেছনেও যথেষ্ট কারণ থাকে। তবে আমার বেলায় ওসব কারণের বাইরেও একটা কারণ আছে: তা হল সমালোচকের দল। তাঁরা হল মরকের মতো যা আমি শুরুতে কখনই বুঝতে পারিনি। আমি যদি দক্ষ একজন শল্যবিদ হই, এবং পাশাপাশি অন্য কোনো এক ব্যক্তি, যে জীবনে কোনোদিন শল্যবিদদের ওই ছোট ছুরিটা পর্যন্ত হাতে নিয়ে দেখেনি, যে আসলে কোনো ডাক্তারও না, যে কিনা তার সারা জীবনে বিড়ালের ধাবায় সামান্য স্প্রিন্টও লাগিয়ে দেখেনি, সে রকম কেউ যদি আমার মতো শল্যবিদকে এসে এটা বোঝাতে চায় যে আমি অপারেশনের কোথায় কোথায় ভুল করেছি, তাহলে লোকজন কী ভাববে? পেইন্টিংয়ের ক্ষেত্রেও সমালোচকদের বিষয়টা এ রকম।

বিস্ময়কর হল লোকজন কিন্তু এটা বুঝতেই পারে না যে, যে কারণে শল্যবিদের সমালোচনাকারী লোকটার দাবি শুনেও তারা হাসে, আবার চিত্রকলা নিয়ে মন্তব্যকারী হাতুড়ে লোকের কথা শুনেও তাদের মধ্যে বিবমিষা মেশানো শ্রদ্ধা তৈরি হয়। এক সময় আঁকাআঁকি করত, যার কাজ সবই মাঝারিমানের, এমন কেউ যদি হয় কৈফিয়ত হিসেবে তার সমালোচনা অন্তত সহ্য করা যেতে পারে। কিন্তু এটা একেবারেই নিরর্থক, অযথা; কারণ একজন ভালো অর্টিস্টের কাছে মাঝারিমানের একজন পেইন্টারের উপদেশ কতখানি যৌক্তিক মনে হবে?

আমি আমার বিষয় থেকে দূরে সরে এসেছি। এটা আসলে জোর করে আমার সব কিছুকে ন্যায্যতা দেওয়ার চেষ্টার ফলেই হয়েছে। নয়তো আমার কিসের এমন ঠেকা পড়েছে যে আমি কেন প্রদর্শনীতে যাই না তার ব্যাখ্যা দিতে হবে? আমার তো মনে হয় প্রত্যেক ব্যক্তিরই অধিকার আছে সে কোথায় যাবে কি যাবে না, বা আদৌ যাবে কিনা, সেটা তার খুশি মতো সিদ্ধান্ত নেওয়ার, কোথাও যাওয়ার আগে সে নিশ্চয়ই সইসাবুদ করে মুচলেকা দিয়ে যাবে না। আর তা নয়তো, এ ধরনের বাতিক কোথায় নিয়ে যেতে পারে ভাবা যায়? যাক, অনেক হয়েছে, যদিও আর্ট গ্যালারি নিয়ে আমি আরও অনেক কিছুই বলতে পারতাম: কূটকচালে একেকজন সহকর্মী, পাবলিকের বিবেচনাহীনতা, গ্যালারিগুলোয় ছবি ঝুলানো ও দায়িত্বে থাকা লোকজনের নির্বোধ কার্যকলাপ, অনেক কথা বলা যায়। সৌভাগ্যজনকভাবে (অথবা দুর্ভাগ্যজনকভাবে) এসব ব্যাপার এখন আর আমাকে আগ্রহী করে তোলে না। যদি করত, তাহলে হয়তো আমি দীর্ঘ এক প্রবন্ধই ফেদে বসতাম, যার শিরোনাম হত ‘বন্ধু চিত্রকরদের কাছ থেকে আত্মরক্ষার উপায়’।

(চলবে)

৭ম কিস্তির লিংক



বাংলাদেশ সময়: ১৪৩০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৭, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।