এর্নেস্তো সাবাতো (২৪ জুন ১৯১১-৩০ এপ্রিল ২০১১) আর্জেন্টাইন লেখক এবং চিত্রকর। লেখালেখির জন্য পেয়েছেন লিজিওন অফ অনার, মিগুয়েল দে সেরভেন্তেস পুরস্কার।
‘এল তুনেল’ (১৯৪৮), ‘সবরে হেরোস ইয়া টুম্বাস’ (১৯৬১), ‘অ্যাবানদন এল এক্সতারমিনাদোর’ (১৯৭৪) তাঁর জগদ্বিখ্যাত তিন উপন্যাস।
৬ষ্ঠ কিস্তির লিংক
৬.
ওই মেয়েকে কোনো আর্ট এক্সিবিশনে খুঁজে পাওয়া যাবে এই সম্ভাবনা মন থেকে যে করেই হোক বাদ দিতে হবে আমাকে। বরং এভাবে ভাবা যায় কিনা, এমনও তো হতে পারে, হয়ত ওর এমন কোনো বন্ধু আছে যে একই সঙ্গে আমারও বন্ধু। সেক্ষেত্রে সাধারণ একটু পরিচিতি পর্বই তো যথেষ্ট। আমি মরমে প্রায় মরে যেতে যেতে, এই সম্ভাবনাটাকেই আঁকড়ে ধরলাম। শুধু সাদামাটা একটা পরিচয়পর্ব! এ রকম কিছু একটা ঘটলে সব কিছু কত সহজ হয়ে যেত, কি যে দারুণ আনন্দের হত ব্যাপারটা! মরমে প্রায় বিবেচনাশূন্য হয়ে পড়া আমি চট করে এ পরিকল্পনার প্রাথমিক খুঁতটা ধরতে পারলাম না, ওর কোনো বন্ধুকে খুঁজে বের করা আর ওকে খুঁজে বের করা তো সমান কষ্টের, কারণ ওর পরিচয়ই যদি আমি না জানি তাহলে ওর বন্ধুদের খুঁজে বের করব কিভাবে? আর ওকে যদি আমি আগে থেকে চিনিই তাহলে শুধু শুধু তৃতীয় পক্ষের খোঁজ করতে যাব কোন দুঃখে? তবে একটা ব্যাপার অবশ্য এখানে বাদ থেকে যাচ্ছে, এটা ঠিক, কারো সঙ্গে পরিচিত হওয়ার মধ্যে ছোট কোনো সুবিধা হলেও আছে, সেটা তাচ্ছিল্য করলে হবে না। এটা তো পরিষ্কার যে, একাজের প্রথম গুরুত্ব হচ্ছে মেয়েটাকে আগে খুঁজে বের করতে হবে, তারপর এমন একজন কাউকে খুঁজে বের করতে হবে যে দুজনেরই বন্ধু এবং সে আমাদেরকে পরস্পরের কাছে পরিচয় করিয়ে দেবে।
অথবা আমি সম্পূর্ণ উল্টো পথও ধরতে পারি: খোঁজ নিয়ে দেখতে পারি ঘটনাচক্রে আমার বন্ধুদের মধ্যেই এমন কেউ আছে কিনা যে ওই মেয়েটারও বন্ধু। এই কাজটা আমি শুরুতে ওকে না খুঁজেই করতে পারি। এ কাজে, করার মধ্যে আমাকে শুধু যা করতে হবে তা হল, আমার বন্ধুদেরকে জিজ্ঞেস করতে হবে যে তারা এ ধরনের কোনো মেয়েকে চেনে কিনা যে দেখতে অনেকটা এ রকম, যার উচ্চতা এত, যার চুলের রঙ এ রকম। কিন্তু যা হয়, এ পরিকল্পনাও আমার কাছে খুব একটা জোরদার ঠেকল না, ফলে এটাও বাতিল। আমার বন্ধু মাপেলি কিংবা লারতিগেকে আমি এ ধরনের কোনো প্রশ্ন জিজ্ঞেস করছি এটা মনে হতেই আমার সব উৎসাহ জল হয়ে গেল।
তবে একটা ব্যাপার এখানে পরিষ্কার করে বলি এই পরিকল্পনাটা যে বাতিল করলাম, এটা শুধু যে অবাস্তব সেজন্যে নয়, বাতিল করলাম এইমাত্র যে কারণগুলো উল্লেখ করলাম, সেই কারণে। এখান কেউ কেউ এমনও ভাবতে পারে যে আমার বন্ধুরাও যে মেয়েটাকে চিনবেই এমন তো নাও হতে পারে। ঠিক এভাবে দেখলে ব্যাপারটাকে ভাসাভাসা আর অগভীর মনে হতেই পারে, কিন্তু মানুষের প্রকৃতি বিচার করা যাদের স্বভাব তাদের কাছে কিন্তু এমন মনে হবে না। কারণ আমি জানি, একই রুচির বেশ কিছু মানুষ নিয়ে আমাদের সমাজে আনুভূমিকভাবে কতগুলো স্তর বা শ্রেণি গড়ে ওঠে, আর ওই শ্রেণির মধ্যেই, অভাবিতভাবে কিছু মানুষের মধ্যে কোনো কারণ ছাড়াই হঠাৎ দেখা-সাক্ষাত হয়ে যাওয়াটা (এমন কিছু কি আসলেই আছে?) একেবারে অস্বাভাবিক না, বিশেষ করে কোনো বিষয়ে পুরোপুরি সন্তুষ্ট হয় এমন মানুষ যেখানে প্রকৃত প্রস্তাবেই অল্প। আমার নিজের এ রকম অভিজ্ঞতা হয়েছে যে, বার্লিনে এক লোকের সঙ্গে দেখা হল, তারপর তার সঙ্গে আবার দেখা ইতালির একেবারে দূরপ্রান্তের কোনো এক গ্রামে, তারপর তার সঙ্গে আবার চূড়ান্ত দেখা বুয়েন্স আয়ার্সের এক বইয়ের দোকানে। এখন আমাদের এই যে বারবার দেখা হয়ে যাওয়া, এটা শুধু ঘটনাচক্রে হয়েছে এ রকম কিছু চাপিয়ে দেওয়া কি যুক্তিসঙ্গত হবে? আসলে আমি বোধহয় একটু বেশিই পেটাচ্ছি: যে কোনো লোকই যে সঙ্গীত, কিংবা আর্ন্তজাতিকভাবে ব্যবহারের জন্য যে কৃত্রিম ভাষা, এসপারান্তো, কিংবা আধ্যাত্মিকতার প্রতি অনুরক্ত যারা তারা কিন্তু এ বিষয়টা ভালোই জানে।
এখন, আমি এখন বাধ্য, আমাকে আমার জন্য সবচেয়ে আতঙ্কজনক সম্ভাবনাটার পেছনে এসে দাঁড়াতেই হচ্ছে: সেটা হল দৈবক্রমে ওর সঙ্গে রাস্তায় দেখা হয়ে যাওয়ার। আমি বুঝি না, কিছু লোক এটা কিভাবে পারে রাস্তায় একটা মেয়েকে থামিয়ে, দিব্যি তার সঙ্গে আলাপ জুড়ে দেয়, এমন কি প্রেমও করে? কিন্তু আমি, আমার নিয়ন্ত্রণের বাইরে কোনো ঘটনাপ্রবাহে, যেখানে আমাকেই আগে কোনো আলোচনার প্রস্তাব করতে হবে এ ধরনের ব্যাপারে আমি একদম নাই, আর এ জন্য দায়ী: রাস্তায় অচেনা লোকের সঙ্গে আমার পরিচিত হওয়ার জ্ঞানের ঘাটতি, আর আমার চেহারা, আর আমাকে বেঁধে ফেলা এই দুঃখজনক কিন্তু অবিচল সিদ্ধান্তটি।
এর ফলে আমার সামনে এখন আর কিছুই রইল না, শুধু সৌভাগ্যজনক একটা কিছু ঘটার আশাবাদটুকু ছাড়া, এই সৌভাগ্য অনেকটা অমাবস্যায় চাঁদ দেখার মতোই: যাতে সাক্ষাতের শুরুতে মেয়েটাই প্রথম কথা বলছে। কাজেই এটা বলতে পারি, আমার সুখ বাঁধা ওই এক লক্ষবারে একবার লটারি জিতে যাওয়ার মতো ঘটনার সঙ্গে, যে জয়ে আমি দ্বিতীয়বার খেলার সুযোগ অর্জন করবো, এবং যাতে আমি লক্ষ্যহীন এক গুলির ফলশ্রুতিতে পুরস্কৃত হব দ্বিতীয় দিনে। সংক্ষেপে, আমার একমাত্র আশা বলতে দৈবক্রমে আমাদের ওই দেখা হওয়ার ঘটনা, যাতে অভাবনীয়ভাবে আমার সঙ্গে ওর প্রথম কথা বলার কথা। ভাবতেই আমার মাথা কেমন ঝিমঝিম করতে শুরু করল, কেমন মনখারাপ করা আর হতাশা মেশানো এক অনুভূতি। তারপরও, আমি আমার পরিকল্পনা বিছাতে শুরু করলাম।
(চলবে)
৮ম কিস্তির লিংক
বাংলাদেশ সময়: ১৪১০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৮, ২০১৪
শিল্প-সাহিত্য
প্রতিদিনের ধারাবাহিক
টানেল | এর্নেস্তো সাবাতো (৭) || অনুবাদ : আলীম আজিজ
অনুবাদ উপন্যাস / শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।