ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১১ পৌষ ১৪৩১, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

ঈদ ও পূজার বিশেষ আয়োজন

কয়েকটি জেনগল্প | অনুবাদ: রাজীব দত্ত

দেশি-বিদেশি গল্প / শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮০৭ ঘণ্টা, অক্টোবর ৩, ২০১৪
কয়েকটি জেনগল্প | অনুবাদ: রাজীব দত্ত অলঙ্করণ: খেয়া মেজবা

জেন শব্দটা নাকি ভারতীয় ধ্যান শব্দ থেকে আসা। কিন্তু আমরা ধ্যান বলতে যা বুঝি জেন ওইরকম কাঠখোট্টা কিছু না।

আবার সহজ কিছুও নয়। তাই না ধর্ম-না দর্শন এই জেন  নিয়ে কিছু  বলার চেয়ে, কিছু না বলাই ভালো। কারণ, বললে তা অন্ধের হাতি দেখার মতন হবে। কোনোটাই মিথ্যা হবে না। আবার ঠিক সত্যও হবে না। বরং চুপ করে যাই। মৌনতাকেই জেন সর্বাগ্রে মানে। তবে তার আগে কিছু কৈফিয়ৎ জরুরি। জরুরি, এ কারণে— পাঠকের প্রশ্ন জাগতে পারে, জেনগল্পের এত এত অনুবাদ থাকতে আবার আমি কেন? উত্তরে বিনীতভাবে বলবো: যে ইংরেজি থেকে এ অনুবাদ তা বেশ সহজ বলে বা স্রেফ কৌতূহলের কারণে অথবা যে কারণে একই গান অনেকেই গায়। প্রিয় পাঠক, আসলে আপনি পড়বেন বলেই সব— প্লিজ, শুরু করুন। - অনুবাদক


এক.
নান-ইন নামের এক গুরুর কাছে একবার এক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আসলেন জেন বিষয়ে কিছু জানার জন্য। নান-ইন তাকে নিয়ে চা খেতে বসলেন। অধ্যাপক দেখলেন, চা দিতে গিয়ে নান ঢালছেন তো ঢালছেনই। চা কাপ উপচে যখন বাইরে পড়ার অবস্থা, অধ্যাপক বাঁধা দিলেন ঢালতে। নান হাসলেন, অধ্যাপক আপনিও কাপের মতো ভরে আছেন। খালি হয়ে আসেন।

দুই.
অনেক বছর আগে এক কৃষকের একমাত্র ঘোড়াটা হারিয়ে গেল। পাড়াপ্রতিবেশী আসলো। সান্ত্বনা দিলো— আহা, বেচারার কপালটাই খারাপ।
হতে পারে— কৃষক উত্তর দিলেন।
পরদিন ঘোড়াটা তিনটা বন্যঘোড়া নিয়ে ফিরে আসলো। পাড়াপ্রতিবেশীরাও আসলো। পানে চুনা লাগাতে লাগাতে মেলা হাসলো— মিয়া, তোমার তো পুরা চানকপাল।
- হতে পারে।
দুইদিন পরেই বুড়ার ছেলেটা ঘোড়ায় চড়তে গিয়া খোঁড়াতে খোঁড়াতে ঘরে ফিরলো। লোকজন পানের পিক ফেলতে ফেলতে আফসোস করলো— বুঝলা কপালে থাকতে হয়।
- হতে পারে।
এর কয়দিন পরেই আর্মির লোক এসে গ্রামের সব জোয়ান ছেলেপিলেরে যুদ্ধের জন্য নিয়া গেল। বুড়ার খোঁড়া ছেলেটাই পাড়ায় রইলো। বুড়াবুড়ি এসে দেখে গেল। মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো, এইডারেই বলে কপাল।
- হতে পারে।

তিন.
একবার এক তরুণ ভিক্ষু যখন ফিরছিলেন, পথের মাঝখানে একটা  নদী পড়লো। বড়সড়। পার হওয়ার উপায় খুঁজতে খুজঁতে ঘণ্টাখানেক পরে যখন হাল ছেড়ে দেয়ার অবস্থা, ভিক্ষু দেখলেন, নদীর ওইপারে দাঁড়িয়ে আছেন বিখ্যাত এক শিক্ষক। তাড়াতাড়ি ডাক দিলেনে তাকে, ওইপারে কীভাবে যাবো বলবেন?
শিক্ষক নদীর দিকে তাকিয়ে কী যেন ভাবলেন। তারপর বললেন, দরকার কী? তুমি তো ওইপারেই আছো।

চার.
একবার নবুসিগে নামের এক সৈন্য আসে হেকুইনের কাছে। জিজ্ঞেস করে, এইখানে নাকি সত্যি সত্যি স্বর্গ-নরক আছে?
তুমি কে? হেকুইনের প্রশ্ন।
- আমি সৈন্য।
সৈন্য? কিন্তু তোমাকে দেখতে তো ভিখারীর মতো লাগে। তুমি আবার কী করবা? হেকুইনের মুখে বিদ্রূপ।
শুনে সৈন্যটা এতো ক্ষেপলো, তার হাত তলোয়ারে চলে গেল।
দেখে হাসলো হেকুইন, এইতো খুলে গেল দোজখ।
সাথে সাথে তলোয়ার পুরে ফেললো সৈন্যটা।
- আর, স্বর্গের শুরু এই এখান থেকে।

পাঁচ.
গুরু, দিব্যলাভ মানে কী
- ক্ষুধার পর খাওয়া আর ক্লান্তির পর ঘুম।

ছয়.
এক কৃষক এতোই বুড়ো হয়ে গিয়েছিলেন যে ক্ষেতে আর কাজ করতে পারতেন না। তাই সারাদিন ঘরের বারান্দায় বসে থাকতেন। দিনের পর দিন। বাপকে এভাবে বসে থাকতে দেখতে দেখতে ছেলেও খুব বিরক্ত। তাই সে বাপের জন্য একটা ভালো দেখে কফিন বানালো। কফিনটা বারান্দায় এনে বাপকে বললো তাতে ঢুকে যেতে। বাপও বিনা আপত্তিতে ঢুকে গেলেন। এরপর কফিনের মুখটা আটকে দিলো। ক্ষেতের পাশে যে উঁচু পাহাড়ের মতো ছিলো, ছেলে কফিনটা ওইখানে নিয়ে আসলো। ফেলতে যাবে এই সময় শুনলো, কফিনের দরজায় ঠুকঠুক শব্দ হচ্ছে। সে কফিনের মুখটা খুললো। দেখলো, বাপ বেশ আরাম করেই শুয়ে আছে। তাকে বলছে, ফেলার আগে তুরে একটা কথা বলি, হুনবি?
- কী? ছেলের মুখে বিরক্তি।
- তুই আমারে যেইভাবে ইচ্ছা ওইভাবে পাহাড় থাইকা ছুইড়া দিস। সমস্যা নাই। তয় এই কফিনের কাঠগুলা মনে হয় ভালা। রাইখ্যা দিস। তোর পোলাগো কাজে আসবো।

সাত.
সুজান নামের এক চীনা জেনগুরুকে তার ছাত্র জিজ্ঞেস করলো,
- গুরু, এই দুইন্যার সবচে দামি জিনিস কী?
- মরা বিলাইর মাথা।
- মরা বিলাইর মাথা! ছাত্র অবাক। ক্যান?
- কারণ, এই জিনিসের দাম এহনো ঠিক অয় নাই।

আট.
এক জেনস্কুলে চার ছাত্র ঠিক করলো, তারা তাদের ধ্যানের সুবিধার জন্য এখন থেকে নীরবতার অভ্যাস করবে। তারা সাতদিন সময় নিলো এই জন্য। প্রথমদিন দিনের বেলাটা তারা ভালোভাবেই পার করলো, রাতের বেলায় হারিকেনটা যখন নিভু নিভু হয়ে এলো, একজন খুব বিরক্ত হলো, জ্বালাইছে কে এটা?
আরেকজন অবাক, কী রে আমাদের না কথা না বলার কথা?
তোরা দুইটাই বলদ। যা, চুপ যা। তৃতীয়জন থামায় দিল ওদের।
এইবার চতুর্থজন মুখ খুললো— হা হা হা। শুধু আমিই কুনো কথা বলি নাই।

নয়.
এক পাহাড়ের নিচে রোকান নামে জেন গুরু থাকতেন। খুব সাধারণ, সহজ সরল জীবন যাপন করতেন তিনি।
একবার এক চোর ঢুকলো তার ঘরে। কিন্তু কিছুই পেল না। উল্টো ধরা পড়ে গেল রোকানের হাতে। রোকন তাকে এনে বসালো। বললো, আহা! কতো কষ্ট করে আসলা কিছুই তো পেলা না! রোকানের খুব আফসোস। আচ্ছা নাও, আমার এই কাপড়খানাই নিয়া যাও। বলে তার পরনের কাপড় খুলে চোরকে দিয়ে দিলো। চোর তো অবাক। তার তো বিশ্বাসই হয় না। রোকানও না দিয়ে ছাড়ে না। শেষে চোর কাপড় নিয়ে চলে গেল। নগ্ন রোকান গিয়ে বসলো উঠোনে। ধবধবে জোসনা। বিশাল চাঁদ। রোকান তাকিয়ে মুগ্ধ হয়ে গেলেন, আহা! লোকটারে যদি এই চাঁদটা দিতে পারতাম!!

দশ.
বাঙ্কেই’র কাছে এক শিষ্য আসলো।
- গুরু, আমি খুবই বদরাগী। এখন রাগ কমানোর জন্য কী করতে পারি?
দেখি, কী রকম রাগো।
- কিন্তু এই মুহূর্তে তো আর রাগতে পারবো না!
কখন পারবা?
- হঠাৎ করে রাগি। নিজেও বুঝি না।
দেখাইতে যখন পারো নাই, তাইলে সমস্যা নাই। সমস্যা থাকলে দেখাইতে পারতা। এটা তোমার জন্ম থেকে ছিল না। তোমার মা-বাপেরও নাই। যাও এইটাই মনে রাইখো।

এগারো.
একবার বানজান জেন শিক্ষার্থী এক বাজার দিয়ে যাওয়ার সময়কার ঘটনা।
এক ক্রেতা কসাইকে বলছে— মাংশ ভালো দেখে দিও।
- আমার দোকানে সবই ভালো। একটুকরা মাংশও খারাপ নাই।

এই কথাগুলো শুনে বানজান দিব্যজ্ঞান লাভ করেন।



বাংলাদেশ সময়: ১৮০৮ ঘণ্টা, অক্টোবর ৩, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।