ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১১ পৌষ ১৪৩১, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

ঈদ ও পূজার বিশেষ আয়োজন

এমনে আমরা বিশদবসনা | বর্ণালী সাহা

দেশি-বিদেশি গল্প / শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮১৫ ঘণ্টা, অক্টোবর ৩, ২০১৪
এমনে আমরা বিশদবসনা | বর্ণালী সাহা অলঙ্করণ: খেয়া মেজবা

নীল বোনচায়নার পিরিচের একটা কোণা মনে হয় ধুতে গিয়ে উঠে গিয়েছিল। আমার মাথায় আসছিল ‘চলতা ওঠা পিরিচ’।

বিশাখা আস্তে করে বললো ‘চিপ্‌ড প্লেইট’। আমরা কেয়ারটেকারকে আর কিছু বললাম না।

এইদিকে সম্ভবত মালয়ালম ভাষা চলে। যদিও আমরা হিন্দি বললেও বুঝতো ওরা। বিশাখা ব্যাঙ্গালোর থেকে কেরালা পর্যন্ত প্রায় পুরাটা রাস্তা কন্নড় ভাষায় ট্যাক্সিওয়ালা অটোওয়ালাদের সঙ্গে ঝগড়া করতে করতে, আর কেরালা আসার পর ইংলিশে ক্যামের সাথে ঝগড়া করতে করতে ভাষাক্লান্ত হয়ে গিয়েছিল ততক্ষণে। ঘেমে-ওঠা হটপটের ভিতর থেকে শাদা নুডলসের থোকার মতো মতো দেখতে ইডি-আপ্পাম ছিঁড়ে নিয়ে ও চোখ প্রায় বুঁজে আহা-উহু করে খেতে শুরু করলো। এত পানসে জিনিসটা! তাও ভালো, বড় বড় রুইমাছের টুকরা, ঢাকায় যেমন খাই, সেরকম হলুদ লবণ দিয়ে ভেজে দিয়েছে সাথে। ঐটা দিয়ে খাওয়া যাবে। চাপিলা টাইপের একটা ভঙ্গুর মাছের চচ্চড়িও ছিল। চিকেন কারি, চেট্টিনাড় স্টাইল— হটপটের পাশে থকথক করছিল। আমি একটু ভাত দিয়ে ওটা খাবো বলে প্লেইটে তুলে নিলাম।

“আমি ভাবতেছি, বুঝলি... এই লোকের ড্যাশিং ভাব আর মার-ডালা চেহারা দেখে প্রেমে পড়ছিলাম। কিন্তু নিজের মানসম্মানের বারোটা বাজায়া আর কত চলতাম? ভালো হইছে কুমারাকোম থেকে নিজেই আমারে ফালায়া নিজের দেশে চলে গেছে। আপ্পা আর আম্মা অবশ্য ব্যাঙ্গালোর ফিরার পরই বলবে, ‘ক্যাম কই গেল?’। এই আরেক জ্বালা। ”
“তো কী বলবি?”
“কী আর? ক্যামের আগে আর প্রেম আসে নাই নাকি আমার লাইফে? আজীবন মুখের উপর শক্ত কিছু উত্তর দিছি এইসব হাকুইল্লা প্রশ্নের। আর দরজা ভিজায়া কানছি... ক্যাম কই গেল ঐসব ওদের বইলা কী হবে?”

বিশাখার আপ্পা রিটায়ার্ড ব্যাংকার। কর্ণাটকের সরকারি ব্যাংকে কাজ করতেন। বিশাখার আম্মা মোটামুটি বীণা বাজান। সরস্বতীবীণা। উনি পৃথিবীর সর্বোত্তম কোকোনাট চাটনি বানান— ইডলি বা দোসা দিয়ে খেতে অসাধারণ। আর জাফরান দেওয়া বাদামের পায়েস। এত ঘন পায়েসকে পায়েস বলতে নাই। বলতে হয় প্রাণেশ। বিশাখাদের বাসায় যখন প্রথম যাই, ওদের গাড়িবারান্দায় ও কালো গাড়িটা পার্ক করছিল, তখন ফ্রন্টসিটে বসে ওকে খুব ঢং করে জিজ্ঞেস করেছিলাম, “এই, তোর মা কি সিনেমার সাউথ ইন্ডিয়ান মহিলাদের মতো খোঁপায় ফুলের মালা পেঁচায়? আর সারাদিন খালি স্টিলের থালায় ইডলি দোসা বড়া পরিবেশন করে?” বিশাখা বেশ বিরক্ত হয়েছিল। হ্যাঁ, ওর মা তা-ই করে। কেন বিরক্ত হয়েছিল আমি তখন পরিষ্কার বুঝি নাই। মনে হয় কৌতূহলী হতে গিয়ে অতিআগ্রহে ওদের জীবনটাকে এগ্‌জটিসাইজ করে ফেলেছিলাম খানিকটা। বিশাখা ট্রু-লি মাল্‌টিকালচারাল ছিল; কথায় কথায় ভিনদেশীদেরকে ‘পিজিয়নহোল’ করার যে চর্চা সবাই করে, তার বিরুদ্ধে ছিল। আমাদের ক্লাসে মিগেল লোপেজ বলে একটা কলম্বিয়ান ছেলে ছিল। কুনাল নামে এক ভারতীয় ছেলে, যাকে দেখলেই মনে হয় রোদের দিনে নিজের নাইকুণ্ডলীতে তেল মেখে মেখে এক্কেবারে খোক্‌সা করে দেয়, হাসতে হাসতে মিগেল লোপেজকে জিজ্ঞেস করেছিল, “তুমি কি ভাই জেনিফার লোপেজের আত্মীয়?” বিশাখা আমাকে পরে বলেছিল, “লজ্জাই লাগে এই ক্ষ্যাৎ ইন্ডিয়ানগুলার কারণে...”। ক্যামের সাথে ওর প্রেমটা যেন ক্ষ্যাৎ ইন্ডিয়ানদের খানিকটা শিক্ষা দেওয়ার জন্যই হয়েছিল। এক মহান, সীমানাহীন— এমনকী খানিকটা অস্তিত্বহীন প্রেমে ও ছিল। এই প্রেমের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দেখেছি, দিনকে দিন বিশাখা একটা শাদা পারিজাত-মার্কা ফুলের মতো হয়ে যাচ্ছিল। এইরকমের একটা প্রেমে আগ বাড়িয়ে অনেকদূর যাওয়া যায়; বিশাখা তাই বাকি সবাইকে, ক্ষ্যাৎ ক্ষ্যাৎ সব সংকীর্ণ হৃদ্‌কমলকে, এমনকী নরডিক অঞ্চলভূত ক্যামকেও পিছে ফেলে প্রেমে অনেকদূর এগিয়ে চলে গিয়েছিল একা একা বিধবার মতো।

ক্যাম দেখতে বেশ ছিল। কেমন যেন দুনিয়ার কয়েকশ’ হৃদয় মাড়িয়ে অভিমানে শুষ্ক দহনের পথ ধরে ফিরে যাওয়া মুসাফিরসুলভ একটা নাটুকেপনা ছিল ওর মধ্যে। ও খুব সুন্দর করে ওর বাড়ির কথা বলতো। একদম নাটকের স্ক্রিপ্টের মতো গুছিয়ে। একবার বলেছিল—
“We watched snow fall outside, as our Mom split firewood into pieces small enough to fit into our belchy stove.”
শব্দের মধ্যে কী ড্রামা! তাই না? ওদের পরিবারের প্রতিটা সদস্য চার বছর বয়স থেকে স্কি করা শিখেছে; কিন্তু ওরা নাকি জীবনে কখনো ভারতীয় বাদামী মেয়ে দেখে নাই। এই কথাটা ক্যাম যখন আমাকে আর বিশাখাকে বলতো, খুব সততার সাথে বলতো। নাটুকেপনাটা আর অতখানি কাঁচা লাগতো না তাতে। তো ঐ সততার মধ্যে একটা প্রত্যাখ্যানের সুর ছিল। “কেন দিলে এ কাঁটা যদি গো কুসুম দিলে? ফুটিত না কি কমল, ও কাঁটা না বিঁধিলে?” এই ধরনের একটা বক্তব্য নিহিত ছিল।

ধর্ম নিয়ে আলাপ হয়েছিল আমার আর ক্যামের। আমি মোটামুটি ধার্মিক। ক্যাম বলেছিল ও আমাকে একটুও বিশ্বাস করে না। যারা মদ খায় না, ওদের নাকি মন খুলে বিশ্বাস করা কঠিন। ও আরো বলেছিল যে ও জীবনেও বিশাখাকে বিয়ে করতে পারবে না।

হাউজবোটের ইঞ্জিন প্রথম কিছুক্ষণ শব্দ করেছিল। এখন কি শব্দ থেমে গেছে? নাকি আমাদের কান সয়ে গেছে? বোট থেকে জাল ফেলে দিলেই টোপা টোপা কচুরিপানা ধরা যাবে। আমি বিশাখাকে বললাম কচুরিপানা আমার দেখতে ভীষণ নোংরা লাগে। মনে হয় যত রাজ্যের মশা আর মশী ঐখানে ভালোবাসাবাসি করে যাচ্ছে; ডিম পাড়ছে; আবার ভালোবাসছে। লাগাতার শশকপ্রবৃত্তি। বিশাখা ওর ছোট্ট, চোখা ভুরুটা উঁচিয়ে বললো, “কী কস্‌? কী জোস দেখতে পানাগুলা! মনে হয় পানির উপর পদ্মফুল ভাসতেছে! এত ডেলিকেট...এত ঢলঢল!”

এরপর বিশাখা বেয়াদবের মতো ওয়াইন গ্লাস চাইল বোটের কেয়ারটেকারের কাছে। উনি “ভাইন গ্লেস্‌?” বলে ভুরু কুঁচকে একটু মরাল পুলিশিং করতে চাইছিলেন। বিশাখা নাকের পাটা ফুলিয়ে দ্বিগুণ বেয়াদবি করে আবার হুকুম দিলো। বিকাল গড়িয়ে যাচ্ছিল কেরালার ব্যাকওয়াটারের বোটতাড়িত ঢেউয়ে। পাড়ের দিকে কোথাও কোথাও বাজার বসেছিল; লোকেরা তাদের শাদা লুঙ্গি দুইদিকে দুইহাতে উঠিয়ে স্থলনৌকা হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন। এই ঘাটে, ঐ ঘাটে গ্রামের মহিলারা পেটিকোটের কষি আলগা করে মহীশূর স্যান্ডাল সোপ ডলে গোসল করছিলেন বেলা করে। কেউ কেউ কাপড় ধুচ্ছিলেন; লালনীল শাড়ি নিঙাড়ি নিঙাড়ি কুলকুল করে সূর্যাস্তের রঙের সরু রেখা ঢালছিলেন জল আর আকাশে। বাংলাদেশের গ্রামের মতোই লাগছিল; কিন্তু বাস্তব গ্রাম না— ছবির গ্রাম যেমন টুলটুলে; তাও আবার মোচ-উঠি-উঠি কিশোরদের হাতে আঁকা ছবির ডুবু-ডুবু গ্রাম যেমন। কালো কালো চকচকে মানুষেরা শেষবেলার রোদের নিচে নৌকাবাইচ প্রতিযোগিতা করছিল। নৌকাবাইচ। আমি আর বিশাখা জীবনেও এত জীবন্ত দৃশ্য দেখি নাই; শুধু শুনেছি। বিশাখা মুগ্ধ ছিল; আর আমি একদিকে ঠোঁট বেঁকিয়ে বলেছিলাম “আরে, এইসব খেলা তো বরিশালের গ্রামেই হয়! ভিয়েতনামে দেখছিলাম ওয়াটার পাপেট... ঐটা অনেক ভালো”। মানে আমি পয়সা খরচ করে কেরালা এসে দুঃখিত ও সিনিক্যাল। বিশাখা আমার কথা না শোনার ভান করলো। জলের তীরে দুইটা পাতিহাঁস সঙ্গম করছিল; আমি ক্যামেরা তাক করায় হাঁসীটা ভয়ার্ত হয়ে পালালো। তাই দেখে আমার মন আরো খারাপ হয়ে গেল।

বিশাখা মাতাল হতে চাইছিল। আমিও একটু নিলাম। এহ্‌! কষ আর তিতকুটে। এত বড় বিরহের পারাবারের উপর দিয়ে আমাদের নৌভবন যাচ্ছিল; কাছে দূরে আরো কয়েকটা ভাসছিল চারুশিল্পের মতো ললিত হয়ে। দেখি, একটু অন্যরকম লাগে কিনা এইসব দেখতে।

দুপুরবেলা কুমারাকোম থেকে হাউজবোটের জেটিতে যখন আসছিলাম আমরা দুই বন্ধু, আমাদের দুজনের মাঝে ট্যাক্সির কালো সিটের উপর শাদা ভেড়ার পালের মতো ছড়িয়ে ছিল বিশাখার নাকমোছা টিস্যুপেপার। কাঁদতে কাঁদতে বিশাখার চোখ ফুলে লাল হয়ে ছিল। ট্যাক্সি থামিয়ে রাস্তার পাশে কোনো এক ছিমছিমে আদর্শ গ্রামের ওয়্যারহাউজে ঢুকে ও স্পার্কলিং কিংবা রোজে ওয়াইন চেয়েছিল। লোকগুলি ছি-ছি-ড্যাব-ড্যাব ধরনের চোখ করে বাদামী কাগজে মুড়ে শস্তা রেড ওয়াইন ধরিয়ে দিয়েছে আমাদের। বিশাখা ‘বাস্টার্ড’ বলে বিড়বিড় করতে থাকলো ট্যাক্সিতে ওঠার পর। আমার অপরাধী লাগছিল; মনে হচ্ছিল টাইট টপ আর ঢিলা লিনেন পরে ওয়্যারহাউজে ঢুকে সত্যি সত্যি আমরা একটা সরল গ্রামের শান্তি নষ্ট করেছি।

এই বোটে ক্যামেরও আসার কথা ছিল। দুটো মাস্টারবেডরুমসহ আমাদের হাউজবোট বুক করা ছিল। একটায় থাকবে ওরা দুজন; আরেকটায় আমি, মানে তৃতীয় চক্র। কিন্তু কুমারাকোমের রিজর্টে ব্রেকফাস্টের টেবিলে ওদের দুজনের তুমুল ঝগড়া হলো। লবণ ছিটিয়ে আনারস খাওয়া মজার নাকি ‘অ্যানাদার স্টুপিড ইন্ডিয়ান প্র্যাকটিস’—এই বিষয়ে।
“তুই দেখলি? তোর সামনেই তো পুরা ঘটনা ঘটলো! ওর রক্তে আসলে রেসিজম। মনে নাই? আমাদের ক্লাসের চিন্‌ য়িহ্‌কে যে কথার মাঝখানে থামায়া দিয়ে বলছিল একবার, “ইয়্যু নো, ইট ইজ সাচ আ পেইনফুল এক্সপিরিয়েন্স টু লিসেন টু চাইনিজ পিপল স্পিক ইংলিশ”? ওর সঙ্গে আমার বনবে না। আর কেমন ছোটলোক! এই ট্রিপে তো আর শুধু ও আর আমি নাই; তুইও আছস্‌! তোর ট্রিপটাও দ্যাখ্‌ নষ্ট করলো! দুইটা বছর ধরে আমার জীবনটাও...”, বিশাখা আবার চোখ ভাসিয়ে নাক মুছতে থাকলো। থুতনিতে চুলে সর্দি-টর্দি লেগে একাকার।

আমরা হাউজবোটের ছাতখোলা ব্যালকনির কাউচে আধশোয়া হয়ে রইলাম। আমরা দুই মেয়ে আজকে দুইটা রাজসিক বেডরুমে যার যার মতো একা একা শোব। এই ভয়ে কাউচ ছেড়ে আমরা কেউই উঠছিলাম না। বিশাখা নেইলপলিশ দিতে শুরু করলো। আমাকেও সাধলো। আমি বললাম পিরিয়ডের সময় দিব। এখন দিলে ওজু হবে না। “ওহ্‌!” বলে হাঁটুর উপর থুতনি রেখে পায়ের নখে নেইলপলিশের তুলি বুলাতে লাগল বিশাখা, আর সমানে কাঁদতে থাকলো। চোখ থেকে নাক থেকে মিউকাসের লম্বা লম্বা তন্তু নামতে থাকল বেয়ে বেয়ে। ভাবলাম ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলে ভালো হবে। ভালো হলো না; আরো বেগে কাঁদতে লাগলো ও। আমার হাত জাপ্‌টে ধরে আমার টপের হাতায় গাল ঘষতে ঘষতে বললো, “আমি ওকে ছাড়া কিচ্ছু পারি না। কিচ্ছু পারি না। আমি কী করবো? এমন একটা লোকের জন্য আমার ভিতরটা আজকে এমন পুড়ে যাচ্ছে, দ্যাখ্‌! ও চলে যাচ্ছিল... ব্যাগট্যাগ সমস্ত নিয়ে। আমি বললাম প্লিজ ডোন্ট গো, ডোন্ট গো... এত কাঁদলাম... তাও চলে গেল এয়ারপোর্ট। নিজেকে মাটিতে লুটায়া দিয়ে মাফ কেন চাইতে পারলাম না? কেন?”

বিশাখার নখের রঙ আমার জামায় লেগে গেল। ওয়াইনের গ্লাস আরেকটু হলেই বেসামাল হয়ে মেঝেতে পড়ে যাচ্ছিল। আমরা একজন আরেকজনকে ম্যানেজ করতে পারছিলাম না এই বোটে।

হাউজবোট রাতের জন্য নোঙ্গর করার তোড়জোড় শুরু হয়ে গেল। বোটের খোলা ব্যালকনি আর ছাদে ঝপ্‌ ঝপ্‌ করে বিরাট নীলচে মশারি ফেলা হলো। ঘুলঘুলি পর্যন্ত বাদ গেল না। একটা আঁশটে পাড়াগ্রামের পাশে আমাদের রাত কাটবে। আমি বললাম, “বিশু, বাথরুমে যা। একটা গোসল দে। যাহ্‌! কেমন দেখা যাইতেছে! তোর চুলে পর্যন্ত সর্দি ঝুলতেছে...”
বিশাখা হাসতে হাসতে উঠলো। আমরা কেউ ডিনার করলাম না।
সকালবেলা বোট আবার শব্দ করে চলা শুরু করলো। বিশাখা দেখলাম আমার আগেই উঠে ব্যালকনিতে গিয়ে বসেছে। ইঞ্জিনের কাছে গিয়ে পানিতে কী যেন ভাসাচ্ছে মন দিয়ে। নৌকা না। চৌকা চৌকা কাগজমতো। কী? ফটো। কার যেন ফটো।

এক এক করে ফেলছে, আর সশব্দ স্রোতে এক এক করে সেইসব ভেসে যাচ্ছে কাল রাতে নোঙ্গর করে ছিলাম যে আঁশটে পাড়াগ্রামে, সেইদিকে। মুখে টুথব্রাশ-গোঁজা কোমরে-তাগাওয়ালা একটা নেংটা বাচ্চা জলের উপর থেকে একটা ফটো তুলে চোখ বড় করে ‘হেই হেই!’ করে আমাদের বোটকে ডাকছে। আমাদের বোট ওকে পাত্তা না দিয়ে এগিয়ে চলছে।

বিশাখার দিকে এগিয়ে গিয়ে ঝুঁকলাম। দেখলাম ওর হাতে একটা একটা করে কমতে থাকা খানত্রিশেক ন্যুড ফটোগ্রাফ। ওর নিজেরই। বেশ শিল্পিতভাবে তোলা। একফোঁটা ভালগারিটি নাই। ক্যামের জন্যই তুলেছিল বোধ হয়। মানে একটা সারপ্রাইজ দিতে চাওয়ার নির্লজ্জতা থেকে তুলেছিল। নদীর উপর ভালোবাসতে বাসতে হয়তো লোকটাকে দেখাতে চেয়েছিল। বেশ। খুব আদর আদর লাগছিল ছবিতে ওকে দেখতে। ছায়া-আবছায়া একটা ট্রিটমেন্ট ছিল ছবিগুলিতে— কোথা থেকে ওর থুতনি শুরু হয়ে কোথায় গিয়ে ওর বুক হয়ে গেছে সেটা ব্যবচ্ছেদ করতে পারা যাবে না, এমন বিমূর্ত ছিল ছবিগুলি।

কতটুকু নগ্নতাকে কেউ চোখ ঠারে, ভোগ করে? কতটুকু নগ্নতায় কেউ চোখ নামিয়ে নেয়? কতটুকু নগ্নতায় কেউ পুলিশ ডাকে? বা কতটুকু নগ্নতায় কেউ কিচ্ছু করে না? এখানে এই গ্রামের পিছে লুকানো কচ্ছ জলপ্রণালীতে কতটুকু নগ্নতা জায়েজ বিশাখার নিজের আকুল আবেগের বুকটা খুলে দেখানোর জন্য? আমি ভাবলাম, কেরালার মহিলারা গায়ে প্রথম ব্লাউজ চড়ানোর আগে তাদের একএকটা শরীর কতটুকু স্বভাবনগ্নতায় প্রতিভাত হতো? কতটুকু নগ্নতা প্রয়োজন নিজের নাকের-সিকনি-গড়ানো, কিংবা কোমরে-ঘুনসি-তাবিজ-বাঁধা রিক্ততা সাহস করে মেলে ধরতে?
“একী! এইগুলা পানিতে ফেলতেছিস্‌ কেন, বিশু?”
বিশু, এতটুকু নগ্নতায় কেউ বানিয়ে বানিয়ে কিচ্ছু ভাববে না। কারো মন গলবে না। কারো অনুভূতি আহত নিহত হবে না। কেউ প্রতিদানে কিছু চাইবে না। কারো ঢেকে রাখা বা খুলে ফেলা শরীর বিচলিত হবে না। কেউ ভয়ও পাবে না। কেউ এগিয়ে এসে হাত ধরবে না; কিংবা হাতে একখণ্ড কাপড় ধরিয়ে দেবে না। এতটুকু নগ্নতা চলবে এমনকী ঠোঁটের লিপস্টিক হাতের চেটোয় ঘষে মুছে ফেলে খিস্তি করে জানান দিতে “স্কিন ইজ দ্যা নিউ ব্ল্যাক”। এতটুকু নগ্নতা লাগবে বুকে পিঠে কিচ্ছু না লিখে, কোনো দুনিয়াবি ক্যাম্পেইন বা কোনো অ্যাকটিভিজমকে বেইল না দিয়ে নীরবে পথের কিনারে দাঁড়াতে, এবং দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নাক খুঁটতে। কিংবা দাঁতে ইলাস্টিক ব্যান্ড চেপে ধরে, বাহুমূল উন্মুক্ত করে দেহশীর্ষে চূড়া করে চুল বাঁধতে।

কিন্তু এতটুকু নগ্নতা দিয়ে মোটাদাগের নাটুকে ক্যাম কী করতো, বল্‌? আমি ভাবলাম।
“এইগুলা রেখে আর কী করবো? ভাবলাম যাক্‌, ভাসায়া দেই! শোন্‌...তুই কিন্তু আমাকে বেশি খারাপ ভাবিস্‌ না। মেয়ে ফটোগ্রাফারকে দিয়েই তুলাইছি ছবিগুলা”, বিশাখা আরেকহাতে রেড ওয়াইনের বোতল নিয়ে ঢক্‌ঢক্‌ সেরে আমাকে ব্যাখ্যা দিতে লাগলো।



বাংলাদেশ সময়: ১৮১৬ ঘণ্টা, অক্টোবর ৩, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।