ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১১ পৌষ ১৪৩১, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

ঈদ ও পূজার বিশেষ আয়োজন

অলঙ্কার | আলবার্তো মোরাভিয়া || অনুবাদ: রায়হান রাইন

দেশি-বিদেশি গল্প / শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮২১ ঘণ্টা, অক্টোবর ৩, ২০১৪
অলঙ্কার | আলবার্তো মোরাভিয়া || অনুবাদ: রায়হান রাইন অলঙ্করণ: খেয়া মেজবা

একসঙ্গে দলবেঁধে চলা ছেলেবন্ধুদের কোনো দলে যখন একটি মেয়ে এসে জুটে যায় তখন আপনি নিশ্চিত হয়েই বলতে পারেন, ওই দলটি কোনো বিষয়ে আর একমত হতে পারবে না এবং প্রত্যেকেই নিজের নিজের দিকটিই দেখবে। সেবার আমরা ক’জন তরুণ বন্ধু এসে জুটেছিলাম একটি দলে।

আমাদের মধ্যে ছিল গভীর সহমর্মিতা, সবসময়ে ছিল মতের মিল, আমরা ছিলাম পরস্পরের প্রতি সম্মত আর সবসময়ে থাকতাম একসঙ্গে। বেশ চলছিল দিনগুলো। তোওরের ছিল গ্যারেজ আর মাংস-ব্যবসায়ী দুই আদর্শ ভাই পিপ্পো মরগান্তির ছিল কসাইখানা, রিনালদোর ছিল বার এবং আমার হরেক কিসিমের কাজ; ওই সময়ে আমি রেজিন ও তার উৎপাদন বিষয়ে কাজ করছিলাম। যদিও সবাই ছিলাম তিরিশের নিচে আমাদের কারুরই ওজন বারো কি তের স্টোনের কম ছিল না। সবাই জানতাম চাকু ও শুকর মাংসের দক্ষ ব্যবহার। দিনের বেলা আমরা কাজ করতাম। কিন্তু সন্ধ্যা সাতটার পর সবাই থাকতাম একসঙ্গে— স্টেডিয়ামে ফুটবল ম্যাচ দেখতাম অথবা যেতাম কাসতেল্লি রোমানির অভিযানে কিংবা উষ্ণ জলহাওয়ায় অসতিয়া বা ল্যাডিস পোলিতে। আমরা ছিলাম ছ’জন, তবু বলতে হবে আমরা সবাই মিলে ছিলাম একজন। তাই আমাদের একজন খেয়ালি হয়ে পড়লে অন্য পাঁচজনও সঙ্গে সঙ্গে হয়ে পড়তাম খেয়ালি। অলঙ্কারের ব্যাপারটি তোওরই শুরু করেছিল। এক সন্ধ্যায় সে সোনার বড়সড় আকারের একটা হাতঘড়ি পরে রেস্টুরেন্টে এলো, ঘড়িটাতে বিনুনি করা সোনার বেষ্টনী প্রায় ইঞ্চিখানেক চওড়া। আমরা জিগ্যেস করলাম, সেটা তাকে কে দিয়েছে। ‘ইতালীয় ব্যাংকের পরিচালক’ তার জবাব। এ কথায় সে বোঝালো, নিজের গাঁটের টাকা খরচ করে ওটা কিনেছে। তারপর সে হাত থেকে খুলে ঘড়িটা আমাদের দেখালো; অন্য দশটা ঘড়ির মতোই, ডাবল কেস্ড, তবে হাত ফেরতা। বিনুনি করা শক্ত বেল্টটাসহ যথেষ্ট ভারিক্কী মেজাজের জিনিস। ঘড়িটা আমাদেরকে বেশ নাড়া দিলো। কেউ একজন বললো, ‘একটা বিনিয়োগ। ’ কিন্তু তোওরের উত্তর, ‘কী বলতেছো, বিনিয়োগ মানে? পছন্দসই একটা জিনিস পরছি, ব্যাস এই তো?’ পরদিন একই রেস্টুরেন্টে বসেছি আমরা, দেখলাম মরগান্তিরও যথারীতি নিজের একটা হাতঘড়ি, বিনুনি করা সোনার চেইনসহ, কিন্তু ততটা ওজনদার নয়। তারপর আদর্শ ভাইয়েরা প্রত্যেকে একটা করে, তোওরেরটা থেকে বড়, বিনুনি করা চেইন খুব বেশি পুরু নয় কিন্তু প্রশস্ত। তারপর রিনালদো এবং আমি। যেহেতু আমরা দুজন তোওরের ঘড়িটা পছন্দ করেছিলাম, আমরা তাকে জিগ্যেস করলাম সে ওটা কোথায় পেয়েছিল এবং একসঙ্গে গেলাম করসোর একটা ভালো দোকানে এবং প্রত্যেকে কিনলাম একটা করে।

মে’র প্রথমদিকে আমরা মাঝেমধ্যেই সন্ধ্যাবেলা মন্তেমারিওতে যেতাম এক কসাইখানায়— ওয়াইন, তাজা মটরশুঁটি আর ভেড়ার দুধে তৈরি পনির খেতে। এক সন্ধ্যার ঘটনা, তোওর মটরশুঁটি খাচ্ছে, তার আঙুলে আমরা দেখলাম একটা আংটি, ভারী এবং হীরে বসানো, খুব বড় আকারের না কিন্তু যথেষ্ট সুন্দর। ‘চমৎকার!’ আমরা আশ্চর্য হলাম। ‘এটা দ্যাখো...’ কিছুটা রূঢ়ভাবেই সে বললো, ‘কিন্তু বাঁদরের মতো অনুকরণ করতে যাইও না। আমি এইটা কিনছি কিছুটা আলাদা হইতে। ’ যাহোক সে ওটা খুলে আমাদের হাতে দিলো এবং আমরা সবাই দেখলাম— আদতেই একটা চমৎকার ডায়মন্ড, স্বচ্ছ আর বেশ মানানসই।   কিন্তু তোওরের ছিল অনমনীয় ও বড় আকারের চোয়াল এবং চওড়া তুলতুলে মুখাবয়ব, শুকরছানার মতো দুটো চোখ, একটা নাক, যা দেখে মনে হয় মাখন দিয়ে বানানো আর তার মুখটাকে দেখায় কব্জাভাঙা মানিব্যাগের মতো। তার ছোট এবং মোটা আঙুলে ওই রিং এবং গুঁড়ির মতো কব্জিতে ঘড়িটাসহ তাকে অনেকটাই রমণীদের মতো দেখালো। হীরের আংটি, সে যেমন চেয়েছিল কেউ তার অনুকরণ করলো না। যাহোক, আমরা প্রত্যেকে আমাদের জন্য নিজেদের ধরনে একটা করে আংটি কিনলাম। আদর্শ দু’ভাই কিনলো একই রকম দুটো অঙ্গুরীয়, লালচে সোনার বেষ্টনী কিন্তু তাতে আলাদা পাথর বসানো— একটা সবুজ, আরেকটা নীল; রিনালদো নিজের জন্য কিনলো বেশ প্রাচীনগন্ধী একটা অঙ্গুরি— খোদাই করা ও রেখাঙ্কিত, একটা বাদামি মণি বসানো যাতে নগ্ননারীর একটা আদল খোদাই করা। মরগান্তি, যে সবসময়ে একটা ফোঁড়ন কাটতে ব্যস্ত, সংগ্রহ করলো প্লাটিনামে তৈরি একটা রিং, কালো পাথর বসানো; আমি নিজে খুব প্রথাগত হবার কারণে নিলাম বর্গাকৃতির একটা রিং যাতে চওড়া একটা হলুদ পাথর বসানো, এরকম নেবার উদ্দেশ্যও ছিল, যখন পার্শেল সিল করতাম তখন ওটা ব্যবহার করা যেত। রিং-এর পর এলো সিগারেট কেস। যথারীতি এটাও তোওর-এরই প্রবর্তনা, একটা লম্বা চওড়া কেস দিয়ে শুরু— সোনার অবশ্যই, উপরে খোদাই করা ক্রশচিহ্ন, একদিন সে ওটা আমাদের নাকের ডগায় খুলে ধরলো। তারপর সবাই তাকে অনুকরণ করেছে, কেউ একই ধরনে, কেউ অন্যভাবে। সিগারেট কেসের পর আমরা সবাই নিজেদের খেয়ালের দিকে ফিরি— কেউ কিনলো পাথর বসানো ব্রেসলেট, হাতের অন্য কব্জিতে পরার জন্য; কেউ চাপ নিয়ন্ত্রিত ঝর্না কলম, কেউ ক্রসচিহ্ন দেয়া ও ম্যাডোনার নকশা খোদাই করা ছোট্ট চেইন কণ্ঠায় পরার জন্য আর কেউ কিনলো সিগার-লাইটার। তোওর, সবচেয়ে যে বেশি দাম্ভিক, কিনলো আরও তিনটি রিং; এখন তাকে আগের চেয়ে আরও বেশি রমণীয় দেখালো, বিশেষত যখন সে তার বড়সড় কোমল বাহু এবং অলঙ্কৃত হাতসহ তার জ্যাকেট ও হাফহাতা শার্ট পরে বেরোয়।

সে সময়ে আমরা ছিলাম অলঙ্কারে ভারাক্রান্ত; এবং জানি না কেন কিন্তু সেটা ছিল সেরকমই একটা সময় যখন কোনো কিছু ভুল পথে এগোয়। খুব বেশি পরিমাণে যদিও নয়, কিছুটা তিক্ত— তিক্ততার চেয়েও বেশি কিছু, কিছু তীক্ষ্ণ প্রক্ষেপ। তারপর এক সন্ধ্যায়, রিনালদো, যে বারের মালিক, রেস্টুরেন্টে এলো একটা মেয়েসহ, তার নতুন ক্যাশিয়ার। তার নাম লূক্রেজিয়া, বিশের মতো বয়স হবে কিন্তু তাকে দেখলে তিরিশ বছর বয়স্কা নারীর মতো মনে হয়। ত্বক দুধের মতো শাদা, কালো চোখ, বড়, দৃঢ় ও অভিব্যক্তিশূন্য, মুখ লাল, কালো চুল। তাকে দেখায় খোদাই করা মূর্তির মতো, সে বেশির ভাগ সময়েই ছিল নিশ্চল এবং প্রায় নির্বাক। রিনালদো আমাদেরকে বিশ্বাস করালো, সে তাকে পেয়েছে বাণিজ্যিক বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে এবং সে বললো, মেয়েটির সম্পর্কে সে কিছুই জানে না, এমন কি সে কোনো পরিবারভুক্ত কিনা কিংবা কার সঙ্গে বাস করে, এসবের কিছুই তার জানা নেই। ‘সেই ক্যাশটেবিলের জন্য সবচেয়ে বেশি উপযুক্ত’, সে যোগ করে, ‘একজন মেয়ে যে আকৃষ্ট করে তার সুন্দর চাউনি দিয়ে এবং তারপর দূরত্ব বজায় রাখে তার আচরণ দিয়ে। ’ একজন সাধারণ মেয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে ব্যর্থ হয়, সুন্দর কিন্তু চটপটেদের দিয়েও কাজ হয় না, তারা কেবল ঝামেলা বাঁধায়। লূক্রেজিয়ার উপস্থিতি ওই সন্ধ্যায় আমাদের মধ্যে খুব একটা বিব্রতকর অবস্থার কারণ ঘটালো। জ্যাকেট পরে সারাটা সময় আমরা ঋজু হয়ে বসে থাকলাম কোনো ধরনের চুটকি কিংবা স্থূল কথাবার্তা না বলে। আমরা কথা বললাম খুব সংযত থেকে, খাওয়া সারলাম ভদ্রভাবে, তোওর এমনকি ফল খেতে চাকু আর কাঁটা চামচ ব্যবহারের চেষ্টা করলো, খুব একটা সাফল্য দেখাতে না পারলেও। পরদিন আমরা লূক্রেজিয়াকে কর্তব্যরত দেখতে দৌড়ালাম। সে একটা ছোট টুলে বসে ছিল, তার পশ্চাদ্দেশ, বয়সের তুলনায় যা খুব বেশি চওড়া, উপচে পড়ছে দু’পাশে আর তার তুখোড় বুক চেপে রেখেছে ক্যাশ রেজিস্ট্রারের চাবি। আমরা সেখানে হা-মুখ দাঁড়িয়ে তাকে দেখছিলাম। সবকিছুর উপর সে চোখ রাখছে শান্তভাবে, মূল্যতালিকা ভাগ করছে কোনো দ্রুততা ছাড়া, বারবার যান্ত্রিক চাবি টিপছে, এমনকি সেদিকে না তাকিয়ে, তার নিশ্চল দৃষ্টি সোজা বার কাউন্টারের দিকে। সে শান্ত, নৈর্ব্যক্তিক স্বরে বারম্যানকে জানাচ্ছে, ‘দুটো কফি... একটা বিটার... একটা লেবুরস... একটা বিয়ার...’। সে কখনো হাসে না, সে কখনো খরিদ্দারের দিকে তাকায় না; এবং কেউ কেউ আছে যারা তার খুব কাছাকাছি হয়, সে তাকাবে এই আশায়। তার পরনে সংযত পোশাক, কিন্তু তা গরীব মেয়েদের মতোই— যেরকম সাধারণ হাতা ছাড়া শাদা পোশাক, কিন্তু তা পরিচ্ছন্ন, পরিপাটি আর ভালোভাবে ইস্ত্রি করা। সে কোনো অলঙ্কার পরেনি, এমনকি কানের দুলও না, যদিও তার কানের লতি ছিল ছিদ্র করা। আমরা, যা ছিল অবধারিত, বিদ্রূপ করা শুরু করলাম যখন দেখলাম সে কতটা সুন্দর, রিনালদোর সাহসেই, যে তাকে নিয়ে গর্ব করতো। কিন্তু সে প্রথম কিছু রসিকতা সহ্য করার পর বললো, ‘সন্ধ্যায় রেস্টুরেন্টে তো আমাদের দেখা হতেছে তাই না? তাই আপাতত শান্তভাবে ছাড়ুন এখন..., কাজের সময় বিরক্তি আমি পছন্দ করি না। ’ তোওর, তাকে সম্বোধন করেই কথাগুলো বলা কারণ সেই ছিল সবচেয়ে বেশি উঁকিঝুঁকিপ্রবণ আর সে বরাবরই অশোভন আচরণ করে যাচ্ছিল, সে কৃত্রিম বিস্ময়ে বললো, ‘দুঃখিত... আমরা হতদরিদ্রজন, জানি না ঠিক কিভাবে একজন রাজপুত্রীর সঙ্গে বাতচিৎ করতে হয়... আমি দুঃখিত... কোনো আক্রমণের ইচ্ছায় কিছু বলি নাই। ’ সে জবাব দেয়, শুষ্কভাবে, ‘আমি কোনো রাজপুত্রী নই, একজন দরিদ্র মেয়ে, বাঁচার জন্য যাকে কাজ করতে হয়, ... আর আমি আক্রান্ত নই... একটা কফি... আর একটা লেবুরস... ’। আমরা অনেকটা মনোযন্ত্রণা নিয়ে ফিরে গেলাম।

সন্ধ্যায় সবার দেখা হলো, যথারীতি রেস্টুরেন্টে। রিনালদো ও লূক্রেজিয়া পৌঁছুলো সবার শেষে; আমরা তখন খাবার দিতে বললাম। যখন আমরা খাবারের অপেক্ষা করছিলাম তখন অল্প সময়ের জন্য বিব্রতকর বোধটা ফিরে এলো; তখন বেয়ারা টমেটো আর লাল মরিচ কেটে বানানো ‘আলা রোমানো’র একটা বড় ডিশ দিয়ে গেল। আমরা সবাই পরস্পরের দিকে তাকালাম এবং তোওর আমাদের মিলিত অনুভবের প্রকাশ ঘটালো, ‘বলছিলাম কি, যখন খেতে বসি তখন আমি খোলাখুলি হইতেই পছন্দ করি... আমাকে অনুসরণ করো তাহলে তোমরাও ভালো বোধ করবা। ’ বলেই সে একটা মুরগির ঠ্যাঙে মনোযোগ দিলো এবং অলঙ্কৃত দু’হাতে তা মুখে তুলে খাওয়া শুরু করলো। এটা ছিল সঙ্কেত; বিব্রতকর কয়েক মুহূর্তের পর আমরাও হাতেই খাওয়া শুরু করলাম— সবাই, কেবল রিনালদো বাদে এবং অবশ্যই লূক্রেজিয়াও, যে বুকের একটা অংশ উঁচিয়ে আস্তে আস্তে কামড়াতে শুরু করলো। সে মুহূর্তগুলোর পর আমরা মুক্ত হলাম এবং খুব সহজভাবে ফিরে গেলাম আমাদের পুরনো যথেচ্ছ পথে। আমরা তখন বকছিলাম খুব যখন খাচ্ছিলাম, খাচ্ছিলাম আর কথা বলছিলাম। মুখভর্তি করে গবগব করে গিললাম গ্লাস ভরতি ওয়াইন, জবুথবু হয়ে ফিরে গেলাম চেয়ারে, বললাম সচরাচর বলা পরিহাসচটুল গল্পগুলো। আসলে এক অবজ্ঞা ভরা বিরোধিতা ছাড়াও স্বাভাবিকের চেয়ে খারাপ ব্যবহার করলাম আমরা; আমার মনে পড়ে না, যেমনটি ওই সন্ধ্যায়, ওরকম আনন্দের সঙ্গে এবং অত বেশি কখনও খেয়েছি কিনা। যখন আমরা খাওয়া শেষ করলাম, তোওর তার ট্রাউজার বাঁধবার বখ্লস খুলে দিলো এবং সঙ্গে সঙ্গে তুললো জমপেশ এক ঢেকুর, যা অবশ্যই সিলিং কাঁপিয়ে দিত কিন্তু আমরা দরজার বাইরে পাতাকুঞ্জে ছাওয়া আচ্ছাদনের নিচে ছিলাম, তাই সেরকম কিছু ঘটলো না। ‘আহ! খুব ভালো বোধ করতেছি এখন!’ সে ঘোষণা করলো। তারপর একটা খিলাল নিয়ে, যা সে সর্বদাই করে, দাঁতের ফাঁকফোকর খোঁচাতে শুরু করলো, সবগুলো, একটার পর একটা,  তারপর সবগুলো আবার এবং সবশেষে খিলালটা দাঁতের ফাঁকে রেখে যে গল্পটা সে ছাড়লো সেটা আদতেই অশ্লীল। এতে লূক্রেজিয়া উঠে দাঁড়ালো এবং বললো, ‘রিনালদো, আমি ক্লান্ত বোধ করতেছি... যদি কিছু মনে না করো, আমাকে কি এখন বাড়ি পৌঁছায়া দিবা?’ আমরা সবাই অর্থপূর্ণ দৃষ্টি বিনিময় করলাম; বড়জোর দুদিন মাত্র গেল সে রিনালদোর ক্যাশিয়ার হয়েছে, এরই মধ্যে চিরপরিচিতার মতো তাকে তার খ্রিস্টীয় নামে সম্বোধন করছে। কাগজে বিজ্ঞাপন, সত্যিই! তারা বাইরে গেল এবং তোওর দ্বিতীয় ঢেকুর তুললো, ‘সময়টা খেয়াল করো... যথেষ্ট খাইছি... তার মেজাজ দেইখছো? কেমন সুড়সুড়  করে চইলা যাইতেছিল পেছন পেছন, কি ভালো মানুষ, কি ভদ্র একেবারে ভেড়ার মতো। বাণিজ্যিক বিজ্ঞাপন! আমি বরং বলব বৈবাহিক বিজ্ঞাপন। ’

পরের দু’তিনদিন একই দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি ঘটলো; লূক্রেজিয়া নিঃশব্দে যন্ত্রচালিতের মতো খাচ্ছে এবং আমরা বাকিরা ভান করার চেষ্টা করছি যে সে সেখানে নেই। কিভাবে করতে হবে সেটা না জেনেই রিনালদো লূক্রেজিয়া এবং আমাদের মধ্যে একটা বিভাজন তৈরি করেছিল। একটা ফন্দি যে ছিল আমরা সেটা বুঝেছিলাম। যেভাবে জল গড়িয়ে যায় গভীরের দিকে, কোনো চিহ্ন না রেখে। কিন্তু মেয়েটি রিনালদোর কাছে চাচ্ছিল যে আমাদের সঙ্গে তার সুসম্পর্ক হোক। অবশেষে, এক সন্ধ্যায় কোনো যৌক্তিক কারণ ছাড়াই, সম্ভবত তখন খুব গরম পড়েছিল, আমরা জানি উত্তাপ মানুষের স্নায়ুতে প্রভাব ফেলে, রিনালদো খাওয়ার মধ্য পর্যায়ে, আমাদেরকে আক্রমণ করে বসলো। এভাবে, ‘তোমাদের সঙ্গে আমার খাইতে আসার এই শেষ। ’ আমরা সবাই হতভম্ব, তোওর প্রশ্ন করলো, ‘ওহ্, সত্যিই তাই নাকি? আমরা কি জিগ্যেস করতে পারি, কেন?’ ‘কারণ আমি তোমাদের পছন্দ করি না। ’ তুমি আমাদের পছন্দ করো না? ভালো কথা, আমি নিশ্চিত আমরা সবাই সেকারণে দুঃখিত— আদতেই ভয়ানকভাবে দুঃখিত। ’ ‘তোমরা একপাল শুয়োর। আমি এটা বলি এবং বার বার বলি... তোমাদের সঙ্গে খাইতে আমি অসুস্থ বোধ করতেছি। ’ এসময়ে ক্রোধে আমাদের সবার মুখ লাল হয়ে গেল এবং কেউ কেউ লাফিয়ে উঠল টেবিল ছেড়ে। তোওর বললো, ‘তুমি— তুমিই হতেছ সব থেকে ধাড়ি শুয়োর। কে তোমাকে আমাদের বিচার করার অধিকার দিছে? সবসময় কি আমরা একসঙ্গে ছিলাম না? সব সময়ে কি আমরা একই কাজ করতাম না?’ ‘তুমি থামো। ’ রিনালদো তাকে থামিয়ে দিলো, ‘তোমার অলঙ্কার সমেত তোমাকে ওইসব মহিলাদের মতো মনে হয়, অবশ্যই বুঝতেছ যে আমি কাদের কথা বলতেছি... আর যা দরকার তা হলো কিছু সুগন্ধী... তুমি কি কখনো কিছু সুগন্ধী মাখার কথা ভাবো নাই?’ শেষ এই ঝাপটা ছিল আমাদের সবাইকে লক্ষ করে; এবং এর উৎস কোথায় সেটা বুঝতে পেরেই আমরা লূক্রেজিয়ার দিকে তাকালাম; সে ছলনাপূর্ণভাবে রিনালদোর জামার হাতা ধরে টানছে যাতে সে থামে এবং চলে যায়। এরপর তোওর বললো, ‘তুমিও কি পরো নাই অলঙ্কার— ঘড়ি, রিং ব্রেসলেট সবার মতো?’ রিনালদো এখন তোওরের উপর চেপেছে, ‘কিন্তু আমি জানি, আমি এখন যা করতে যাচ্ছি, সেটা করার সাহস তোমার নেই। ’ সে চিৎকার করে, ‘আমি সব খুলে ফেলতেছি এবং তাকে সব দিয়ে দিতেছি... আসো লূক্রেজিয়া, এসব আমি তোমাকে দিতেছি। ’ যেমন সে বললো, আঙুল থেকে রিং, কব্জি তেকে হাতঘড়ি, ব্রেসলেট খুলে এবং পকেট থেকে সিগার-কেস বের করে সব ছুঁড়ে দিলো মেয়েটির কোলের উপর। ‘এটা করার সাহস তোমাদের কারুরই নেই’, সে অবজ্ঞা ভরে বললো। ‘জাহান্নামে যাও তুমি’—ক্রোধ প্রকাশ করে তোওর। কিন্তু এখন সে তার আঙুলে পরা রিংগুলোর জন্য লজ্জিত বোধ করছে। ‘রিনালদো’ লূক্রেজিয়া শান্তভাবে বললো, ‘তোমার এসব নিয়া নেও, চলো আমরা চইলা যাই। ’ রিনালদোর দেয়া সবগুলো জিনিস সে একসঙ্গে জড়ো করে তার পকেটে পুরে দেয়। রিনালদো তারপর আমাদের বিরুদ্ধে গিয়ে ক্রোধবশত যথেচ্ছ গালিগালাজ করতে লাগলো, এমন কি লূক্রেজিয়া যখন তাকে টানা-হেঁচড়া করে বাইরে নিয়ে যাচ্ছিল তখনও ‘শুয়োরের দল, ... কিভাবে খাইতে হয় সেটাও জান না তোমরা... শুয়োর। ’ ‘নির্বোধ’ তোওর এসময়ে ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে চিৎকার করে, ‘মূর্খ!...  তুমি নিজেই তোমাকে অন্য নির্বোধদের দিয়া চালিত হইতে দিছো, যারা তোমার পাশে এখনো দাঁড়ানো। ’ যদি আপনারা দেখতেন তখন রিনালদোকে! সে লাফিয়ে টেবিল পার হয়ে তোওরের শার্টের কলার আঁকড়ে ধরল। টেনে-হিঁচড়ে সরাতে হলো তাকে।

ওই সন্ধ্যায় তারা চলে যাবার পর আমাদের নিশ্বাস ফেলার শব্দটুকুও হতে পারছিল না। ক’মিনিট পর আমরাও চলে গেলাম। পরদিন সন্ধ্যায় আমার আবার দেখা করলাম, কিন্তু আমাদের মধ্যকার আগের চাঞ্চল্য তখন আর ছিল না। আমরা সেসময়ে লক্ষ করলাম, কিছু অঙ্গুরীয় আমাদের কাছ থেকে উধাও এবং কিছু ঘড়িও। দু’সন্ধ্যা পর তৃতীয় সন্ধ্যায় আমাদের কারুরই আর কোনো অলঙ্কার থাকলো না। সবাই কেমন নিষ্প্রভ হয়ে গেলাম। এক সপ্তাহ পার হলো, একটার পর একটা অজুহাত দেখিয়ে আমরা কেউ কেউ অনুপস্থিত হতে থাকলাম। একসময়ে বিষয়টার ইতি ঘটলো এবং অনেকেই সেটাকে জানে শেষ, আর নয়; কেউই গরম স্যুপ গরম করতে উৎসাহী ছিল না। পরে শুনেছি, রিনালদো লূক্রেজিয়াকে বিয়ে করেছে; কেউ বলেছিল আমাকে, চার্চে লূক্রেজিয়া ম্যাডোনার প্রতিমার থেকেও বেশি পরিমাণে অলঙ্কৃত ছিল। আর তোওর? কিছুক্ষণ আগেও আমি তাকে তার গ্যারেজে দেখেছি। তার হাতের আঙুলে একটা রিং আছে, কিন্তু তা সোনা দিয়ে বানানো না, ডায়মন্ডও বসানো নেই তাতে, ওটা সেরকমই একটা রুপার রিং যা মেকানিকদের পরতে হয়।



বাংলাদেশ সময়: ১৮২২ ঘণ্টা, অক্টোবর ৩, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।