বউয়ের ডাকে গভীর ঘুম ভেঙে গেলে ধড়ফড় করে ওঠে আলফু। পুরনো টিনের চালের ফুটো দিয়ে আবছা আলো পড়ে জানান দিচ্ছে রাত প্রায় শেষ হতে চললো।
- কিতা অইছে তর?
আলফুর কথায় জায়দা যেন হুঁশ ফিরে পায়।
- আরবার বড়ো খারাপ স্বপ্ন দেখছি।
- ধুর, বাদ দে চাই। রাইত রইছে, ঘুমাইতে দে। বিয়ানে অনেক কাম আছে! ইতা হুনার সময় আছে নি আমার?
- বড়ো কুলক্ষ্মী স্বপ্ন দেখছি যে?
- কইলাম-তো, ইতা কুন্তা নায়। খামোখাই দেখছছ। বিয়ানে হকলতা হুনমুনে, ঘুমা!
জায়দা ঘুমাতে চেষ্টা করে, কিন্তু ঘুম তার আসে না। পাশের ঘরে রাতা মুরগা বাঙ দিয়ে উঠলে উগার-তলের ডেকি মুরগি পাখা ঝাপটায়। দূর থেকে আজান ভেসে আসে। ভোর হতে চললো। আলফু আবার নাক ডাকতে শুরু করেছে। জায়দা ভরা-পেটে আলগোছে হাত রাখে। জানালার তেরছা আলোয় ঘর এবার পরিষ্কার হয়ে উঠলে ভয় তার কমতে শুরু করে। এপাশ-ওপাশ করে আরেকটু ঘুমাতে চেষ্টা চালায়, কিন্তু স্বপ্নের আবছা রেশ, ভোরের আলো, আর তলপেটের গভীর চাপ এক সময় তাকে বিছানা ছাড়তে বাধ্য করে। নিঃশব্দে দরজা খুলে বাইরে এসে দাঁড়ায়। পুব আকাশের শীতল সূর্য বাঁশঝাড় ভেদ করে উপরের দিকে হাঁটা দিয়েছে। তার কেমন শীত শীত লাগে। আশ্বিনের শেষ হলে কী হবে, শীত এবার আগেই যেন নামতে শুরু করেছে। কুয়াশার আবছা পর্দা পড়ে আছে চারপাশে, গাছগাছালিও ভিজা-ভিজা দেখায়। ভোর বেলাটা তার মন্দ লাগে না। শেষরাতের দুঃস্বপ্ন ধীরে-ধীরে চারপাশে মিইয়ে যেতে থাকে।
উত্তর-পাড়ার মুতালিব এসেছে— বউয়ের এই খবরে আলফু আর ঘুমাতে পারে না। তাকে এবার উঠতেই হয়। জায়দাকে চা-পানির ব্যবস্থা করতে বলে পুবের পুকুরের দিকে গামছা নিয়ে হাঁটা দিলে মুতালিবও তার পিছু ধরে। তাকে বড়ো উৎফুল্ল দেখায়।
- ব্যবস্থা একটা করি লাইছি, আলফু ভাই।
- কিতা করছো?
- ইতা হকলতা হুইন্যা তোমার লাভ নাই। চলো, আজমিরীগঞ্জ যাইগি, ভইষ কিইন্যা আনি। ছাগল বেচতাম আর ভালা লাগে না। ইতা কইর্যা কুন্তা অইতো নায়!
- হাছাই কইছো মুতালিব, ছাগলর পাইকারি কইরা কুন্তাই করা গেল না। ইবার দুই জনে মিইল্লা কুন্তা একটা করা লাগবো।
- তাইলে তুমিও তোড়া টাকা জোগাড় করি লাও।
- কবে রওয়ানা দিতায় চাও?
- তরশু, কিতা কও, ঠিক আছে নি?
আলফু সম্মতি দেয়। হাটে যাবার আনুষাঙ্গিক বিষয়-আশয় নিয়ে কথা বলতে-বলতে আবার ঘরের দাওয়ায় ফিরে আসে তারা। জায়দা চা দেয়, সাথে কয়েক জাতের পিঠা। মুতালিব চোখ তুলে তাকায়। আলফু তার কৌতূহল বুঝতে পেরে জানায়, কাল জায়দার বাপের বাড়ি থেকে হাদা নিয়ে এসেছিল তার ছোটশালা। পয়লা মেয়ের ঘরে পয়লা নাতি-নাতনি আসবে তাই হাদার পরিমাণও হয়েছে দেখার মতো। মেড়া পিঠা, নারকেল, গুড় ও নুনের পিঠা নিয়ে এসেছিল সে। সাথে তাদের জন্য শাড়িলুঙ্গিও বাদ পড়েনি। জায়দা এ সকালবেলা বাপের দেওয়া নায়া শাড়ি পরে আছে। বড়ো মানিয়েছে তাকে। ছাগলটাকে বাইরে নিয়ে উঠানের খুটিতে বেঁধে কাঁঠাল পাতা খেতে দেয় সে। ঘরের কোণায় বস্তা বিছিয়ে তাকে থাকতে দেওয়া হয়েছিল। লেদে-ছেনায় একেবারে একাকার করে ফেলেছে। এবার তা পরিষ্কার করতে হবে। জায়দাকে ব্যস্ত দেখায়।
মুতালিব বলে— তোমার তো এবার ভালা বছর। পয়লা বাপ অইবায়। ভাবিও পাইছো ভালা। ইবার ব্যবসাও মনে অয় জমবো। কিতা কও?
- পাইকারর আরবার কপাল! ওই দেখো না, ছাগলটা কিনলাম পরশু, সেবাযত্নও কম করলামনি? কিন্তু হালাক অরতো অরই! আইজ বাজারো নিলে কতো যে পাইমু, আল্লায় জানইন!
- আলফু ভাইয়ে যে কিতা কও! তোমার হাতো পড়লে বুলে ছাগল তাজা অইতো নায়, ছাগলর বাপ তাজা অইবো! ইতা খামোকা চিন্তা বাদ দেও চাই। কথা তাইলে ঠিক রইলো, কিতা কও?
আলফু মাথা নাড়ে। মাধানে বাজারে দেখা হবে বলে মুতালিব উঠে যায়। আলফুও আর বসে থাকে না। ছন-বাঁশের জোগাড় করতে হবে। পুবের ভিটায় ছোটখাট একটা ছনবাঁশের ঘর না-করলে আর চলছে না। এভাবে ঘুমানোর ঘরে ছাগল রাখা কি আর ঠিক হবে? তাছাড়া গরু মহিষের পাইকারি করতে হলেও তো আলাদা ঘর চাই। কোনোমতে মাঝখানে পার্টিশন দিয়ে দুই কোঠা করে ফেলতে পারলে, এক কোঠায় গরু-মহিষ রাখা যাবে, আর অন্য কোঠায় মেহমানখানা করা যাবে। কাল হাদা নিয়ে-আসা ছোট শালাকে একঘরে থাকতে দিতে না-পারায় পাশের বাড়ি পাঠাতে হয়েছিল। নয়া শ্বশুর-বাড়িতে আর মান থাকলো কই? তাছাড়া গেল বোশেখের ঝড়ে পুরনো দিনের নড়বড়ে ঘর পড়ে যাবার পর থেকে শুধু ভিটা নয়, বাড়িটাই কেমন বে-আব্রু হয়ে আছে। কিছু একটা করা দরকার। আলফু তাই ছন-বাঁশের খোঁজে বেরিয়ে পড়ে।
আগ-বাজারেই সে আজ রওয়ানা দিতে চায়। এমনিতেই ছনবাঁশের খোঁজে দিন শেষ হয়ে গেছে। হাতে আর সময় নাই। কিন্তু ছাগলটাকে দেখে চিন্তা তার বেড়ে যায়। কেন যে শালার পেট উঠছে না—আলফুর তা বোধগম্য হয় না। সকাল থেকে কতো কাঁঠালপাতা এনে খাওয়ালো, ধান ক্ষেতের পাশে ডিগড়া দিয়ে এলো, তারপরও পেট ভিতরে ঢুকে কার্তিক মাসের হাড় বের হওয়া কুত্তার মতো বিমারি দেখায়। আলফু ব্যস্ত হয়ে ওঠে। প্রথমেই বুর-গোসল দিয়ে পয়পরিষ্কার করা দরকার। দুএকটা আঁটাল উলুনে লটকে আছে। কানের ভেতরেও বেশ কটি। গা থেকে আঁটাল ছাড়াতে-ছাড়াতে বউকে বালতি-সাবান নিয়ে আসতে হাঁক দেয় সে। ছাগলটা আঁটাল বাছতে দিচ্ছে ঝিম মেরে, আরাম পাচ্ছে মনে হয়। আমগাছের নিচে জায়দা পানি নিয়ে এলে আলফু দেখে চুঙ্গা হাতে নাই।
- চুঙ্গা আনলে না কেনে?
- কাইল বড়ো কুলক্ষ্মী স্বপ্ন দেখছি! কইছলাম কিতা...
- বাদ দে চাই তোর স্বপ্নর কথা। আমি আছি লাভক্ষতি লইয়া আর তাই আছে তাইর স্বপ্ন লইয়া। রাইতকুর স্বপ্ন রাইতকু দেখছছ, এল্লগে চুঙ্গার সম্পর্ক কিতা হুনি?
- আইজ বাদ দিলাও নানে...
- কিতা বাদ দিলাইতাম?
- পানি খাওয়ানি।
- তাইলে-তো কেউ মাগনাও নিতো নায়। পেটর বায় একবার চাইয়া দেখছছনি?
জায়দা আর কিছু বলতে সাহস পায় না। মানুষটা কখন ক্ষেপে না-ক্ষেপে তার কি কোনো মাথামুণ্ডু আছে? সে বেজার মনে চুঙ্গা আনতে ফিরে যায়। আলফু সাবান ঘষে ছাগলকে গোসল করাতে শুরু করে। ছাগলটার ডাকাডাকি শুনে তাড়াতাড়ি চুঙ্গা নিয়ে ফিরে আসে জায়দা। ছাগলকে শক্ত করে ধরতে বললে আমতা আমতা করে সে।
- কাইল আরবার স্বপ্নে দেখলাম...
- ইতা-তো আগেও হুনছি। এক স্বপ্ন আর কতো বার হুনতাম? আগে ধর চাই, বাজারর সময় হই যার।
- আমার যে বড়ো ডর লাগের!
- ডরর কিতা অইলো? খামোকা রাগ তুলিছ না তো, আগে ধর কইলাম...
জায়দা ভয়-পাওয়া হাতে আমগাছের লগে বাঁধা ছাগলটাকে শক্ত করে ধরে। তার চিৎকারে বার কয়েক সে কেঁপে কেঁপে ওঠে। আলফু মুলি বাঁশের তেল-চিকচিক পুরনো চুঙ্গা ছাগলের গলায় ঢুকিয়ে দেয়। ছাগলটা মোচড়া-মুচড়ি করে বটে কিন্তু আলফুর শক্ত হাতের চাপে চুপ মেরে যেতে বাধ্য হয়। বদনার নাল দিয়ে চুঙ্গায় পানি ঢালতে থাকে আলফু। ছাগলটা এমন ভাবে ছটফটায়, চোখ দুটি যেন বের হয়ে আসবে এখনই। ছাগলটার মতোই জায়দাকে বড়ো অসহায় লাগে। রাতে-দেখা স্বপ্ন আবার ফিরে আসে। সে চোখ বুঁজে থাকে।
আলফুকে বড়ো খুশি দেখায়। ছাগলটাকে সে বেশ লাভে বিক্রি করতে পেরেছে। তেমন বেগ পেতে হয়নি! হবেই বা কেনো? বুর-গোসল করিয়ে, পানি দিয়ে পেট দুটোকে সমান করে নেওয়ার পর কী তরতাজাই না দেখাচ্ছিল! বাজারে আনার পরপরই বিক্রি হয়ে যায়। চিন্তামনির মজই লন্ডনি সপরিবারে পরশু দেশে এসেছে। বাচ্চারা তো আর গ্রামের আলু-মুলা, মাছ-শুঁটকি খেয়ে বড় হয়নি যে বাপের মতো মাছ হাটায়, সবজি হাটায় হাঁটাহাঁটি করবে? দুধ-মাংস না-হলে তাদের চলবে কেন? আর মেহমানও তো এই সুযোগে ঘর ছাড়া হচ্ছে না। বাজারে এসেই মজই লন্ডনির চোখ পড়েছিল। মনে ধরায় দরদাম-তো করেইনি, বরং আলফুকে কাল একবার খেয়ে আসতে বলে দিয়েছে। রাতেই তাকে জবাই দেবে। যে-কারণে আশেপাশে ছাগল বেচতে চায় না, তা নিয়ে আর ভাবতে হবে না বলে আলফুকে নিশ্চিন্ত দেখায়। আর যাই হোক ঝামেলা বাঁধবে না। পেট ফোটা হবার আগেই সে খতম হয়ে যাবে। আসার কালে পেটের ব্যথায়, পানির চাপে যেভাবে ছাগলটা একটু পরপর দাঁড়িয়ে চেনাবার ব্যর্থ চেষ্টা করছিল, রাতে থাকলে আর তাকে পাওয়া যেতো কি না, বলা মুশকিল।
মুতালিবকে নিয়ে সে চা-স্টলে ঢুকে চা-সিঙ্গাড়ার অর্ডার দেয়। আজ আর আলুর সিঙ্গাড়া নয়, কলিজার সিঙ্গাড়ার লগে ডাবল মালাই চা দিতে বলে। এতে করে মুতালিবকে তো বটেই কালু মাড়াকেও খুশি দেখায়। যাই হোক বাকির কিছুটা হলেও আজ আদায় হবে। আজমিরীগঞ্জ যাওয়ার কথা মুতালিব এই ফাঁকে মনে করিয়ে দেয়। আলফু রাজি থাকে।
আনাজি উরি সবেমাত্র বাজারে উঠেছে। আলু-মুলাও। শীতের সবজি আগাম হওয়ায় দাম একটু বেশি, তাতে কী! আলফু তার তোয়াক্কা করেনি। আনাজ হাটায় গিয়ে দমাদম তা কিনে ফেলেছে। আগাম বাখর পাতা কিনতেও সে ভুল করেনি, তবে টমেটো এখনো ওঠেনি বলে আফসোস থাকে। তবে মাছ উঠেছিল বড়ো! হাওর-বিলে পানি কমে যাওয়ায় মাছ ধরা পড়ছে বেশি, যদিও দাম ঠিক কমছে না! তাতে কী! আলফুর আজ পকেটভর্তি টাকা! আগে খাওয়া-দাওয়া তারপর হিসাব-নিকাশ। বাবাই কইতো— আলফুরে, খাইয়া মরিছ, মইরা পস্তাইছ না। এতে করে অবশ্য বাবা খেয়েছিল ঠিকই, উসুলটা দিতে হচ্ছে তাকে। তা না হলে কি আর চাষার ছেলে পাইকার হয়? অবশ্য তাতে আর দুঃখ পেয়ে লাভ নাই। খেয়ে দেয়েই মরা ভালো, যা থাকে কপালে। তাছাড়া বউটাও পোয়াতি। এটা-ওটা খেতে চায়। আজ তাই মন মতো বাজার-সওদা করে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে সে।
ঘরের মেঝেতে বাজারের থলে ঢেলে মাছ-পান, শাকসবজি, মরিচ-রসুন আলাদা করতে থাকে জায়দা। থলে উপুড় করতেই একদিকে আলু গড়িয়ে যাচ্ছে-তো, অন্যদিকে পেঁয়াজ-রসুন। আর দেখো ছোট মাছের দঙ্গল থেকে ইছাটাও বিছানার দিকে রওয়ানা দিয়েছে। আলফু বউয়ের পাশে বসে এই আলু আটকায় তো, সুপারি দৌঁড়ায়। সুপারি আনে তো রসুন গড়ায়। তাছাড়া পাটের বস্তায় একসাথে সওদা অনেকক্ষণ থাকায় যে গন্ধ এসে নাকে লাগছে— তাতে কি তার কম আনন্দ হইছে! বাজার-সওদার এই গন্ধ তো সেই কবেই মায়ের হাতের গন্ধে মিশে গেছে। বাবা বাজার নিয়ে ফিরেছেন, আর বাবার সাথে মায়ের পাশে গোল হয়ে বাজারের গন্ধ এক করে নেয়নি— এমন দিন কি আর মনে পড়ে? বাজারের পাশে বসা তাই তার নিয়মিত হয়। কিন্তু বউটার মুখের মলিন ভাব আজ আর যেন কাটতেই চাচ্ছে না!
- তোমার শরীল কিতা বেশি খারাপনি, বউ?
- স্বপ্নটা যে আরবার দেখলাম! হাইনজাবেলা বিছনাত মাথা রাখছি, চোখ বন্ধ করতাম পারছি কি পারছি না, দেখি কিতা...
জায়দার ফর্সা মুখ ভয়ে কালো হয়ে যায়। স্বপ্নটি সে অনেকবারই শুনেছে। তাই তেমন আগ্রহ দেখায় না, তবে বাঁধাও দেয় না। গেল কমাস থেকে দেখে-আসা স্বপ্নটি তাই বলতে থাকে জায়দা।
স্বপ্ন নয়, যেন বাস্তব— শেষ রাতের আবছা আলোয় ঘরের সব কিছু দেখা যায়। তার ব্যথা ওঠে, কিন্তু এতো ডেকেও আলফুকে সে জাগাতে পারে না। সে ককায়, মোচড়া-মুচড়ি করে, গোঙ্গায়; তলপেট ছিঁড়ে আসার ব্যথায় উঠে বসতে চায়, পারে না। কাছেই কার যেন কথা শোনা যায়। আলফু নয়তো? সে ঠাহর করতে চেষ্টা করে, কিন্তু এর আগেই তলপেটের ব্যথা তাকে কাবু করে ফেলে।
স্বপ্নের এখানে এসে জায়দার মুখ এমন হয়ে ওঠে, আলফু তাকে জড়িয়ে ধরে স্বপ্ন বলা থামিয়ে দেয়। জায়দাও ফোঁপাতে-ফোঁপাতে বলে— তুমি ইতা বাদ দিলাও নানে, তোমার আল্লার দোয়াই...
আলফু আজ আর রাগে না, নরম সুরে বলে— হকলেই কয়, আলফু পাইকার ইতা করে, ওতা করে কিন্তু একবার চিন্তা করি দেখো চাই, ইতা যদি না করি কেউ আমরারে খাইতে দিবোনি? জানদার প্রাণীরে কষ্ট দেই নিজের কষ্ট কমাইবার লাগি, আল্লায় মাফ করতা; কিন্তু মানুষ-তো মানুষরেও কষ্ট দেয়, দেয় না-নি? আমি-তো অবুঝ পশুরে দিরাম!
জায়দা আর কোনো উত্তর করতে পারে না, চুপ মেরে যায়। স্বপ্ন বলাও আর শেষ করতে চায় না। আলফুও শোনা-স্বপ্ন বারবার শুনতে না-চেয়ে বরং বউকে রান্নাবান্না সেরে ফেলতে তাড়া দেয়। কাল দূরের আজমীরিগঞ্জ যাওয়ার কথা, ভোরে উঠতে হবে। ছাগলের পাইকারি ছেড়ে গরু-মহিষের পাইকারিতে কী পরিমাণ লাভ হবে তা বলে জায়দাকে খুশি করতে চায় সে। তবুও জায়দাকে বড়ো ম্লান দেখায়।
আজমীরিগঞ্জ থেকে কিনে-আনা মহিষ পুকুর পাড়ের আমগাছের নিচে বেঁধে রাখা হয়েছে। মহিষটার চোখে গেল ক’দিন ধরে জল গড়াচ্ছে থেমে-থেমে। হয়তো গেলো মালিকের জন্য তার মন কাঁদে। লোকটা যে তাকে যত্নআত্মি করতো, অভাবে পড়েই বিক্রি করেছে—দেখলেই তা বোঝা যায়। মুতালিব, আলফু তো যত্ন করছেই, জায়দাও নিজের অবস্থার তোয়াক্কা না-করে সেবা-যত্নের কমতি করছে না। তবুও খাওয়া-দাওয়ায় তার মন নাই। কম দামে কিনে-আনা মহিষ নিয়ে আলফুর তাই চিন্তা বাড়ছে তো বাড়ছেই। খাইয়ে-দাইয়ে কিছুটা তরতাজা করতে পা-পারলে লাভ তো দূরের কথা, ক্ষতির আশঙ্কাই বেশি। মুতালিব-তো তার কাঁধে ভার দিয়েই খালাস, বলে কি না— আলফু ভাই, তোমার হাতো কতো মরা ছাগী জিন্দা হইছে, আর ভইষ বুলে অই-তো নায়, তার বাপ অইবো! আলফু এখন কী করে! আর দেখো, বউটাও পেছনে লেগে আছে। নিজের দিকে খেয়াল রাখ, তা না, খালি ঘ্যানর-ঘ্যানর। আলফু কড়া কিছু বলতেও পারছে না। বউটার এখন কী তখন! কিন্তু কিছু একটা তো করতেই হবে। জায়দা পেট টেনে টেনে তার পাশে এসে দাঁড়ায়।
- তোমার আল্লার দোয়াই লাগে, জানদার প্রাণীরে আর কষ্ট দিও না। আমি আইজও স্বপ্ন দেখছি!
একহাত পেটে, অন্যহাত কোমরে রেখে ভরা-পেট টানতে-টানতে জায়দা মহিষের দিকে হাঁটা দেয়। আলফুও উঠে পড়ে। মুতালিব সেই যে গেছে হাট থেকে পাহাড়ি ঘাস কিনে আনতে, এখনও ফেরেনি। আলফু খইল-চিটার জোগাড় করতে বেরিয়ে যায়। মহিষটার সামনে শুকনা খড় এগিয়ে দেয় জায়দা। বেশিক্ষণ আর দাঁড়াতে পারে না সে। সময় মনে হয় ঘনিয়ে আসছে। পেটে ঘনঘন নড়াচড়া টের পাচ্ছে আজ। মহিষের গায়ে বার কয়েক হাত বুলিয়ে ঘরের দিকে হাঁটতে থাকে সে।
মুতালিব ঘাস নিয়ে ফিরে এসে দেখে আলফু বাড়ি নাই। সে সেবাযত্নে লেগে যায়। পাহাড়ি লকলকে ঘাস পেয়ে ক’দিনের উপাসি মহিষটা খেতে শুরু করে। একসময় আলফুও খইল-চিটা নিয়ে ফিরে আসে। সকাল ঘনিয়ে রোদ বাড়তে শুরু করেছে। দুপুরের পরপরই খইল-চিটা মিশিয়ে খড় খাওয়াতে হবে। এর ভিতর একবার বুর-গোসলও করানো দরকার। আগ-বিকালে রওয়ানা দেওয়া চাই। দেরি করে আর লাভ নাই। বাবুবাজারেই নিয়ে যাওয়া উচিত। বাড়ির পাশে এভাবে বিক্রি করা ঠিক হবে না। মুতালিবও তাতে একমত।
এই ভরদুপুরে আলফুকে এরকম চিন্তিত দেখার কোনো মানে খুঁজে পায় না মুতালিব। সময় মতোই সে বালতি-চুঙ্গা নিয়ে হাজির হয়। দড়িদাড়াও। পুরনো কাপড়ের তেনা আনতেও ভুল করেনি। এ-তো আর ছাগল নয় যে হাত দিয়ে ধরলাম আর গলগল পানি গলা দিয়ে পেটে নেমে গেল। মহিষটাকে আগে পা বেঁধে কাবু করতে না-পারলে বিপদও তো হতে পারে। তার জন্য হুঁশিয়ার হওয়া জরুরি। সবই তো ঠিক আছে, তাহলে?
এবার খালি পানি খাইয়ে ভরসা পায় না আলফু। এ-তো আর ছাগলের পেটে নয় যে অনেকক্ষণ পেটপেটা হয়ে থাকবে। তাছাড়া বাবুরহাটও তো বাড়ির পাশে নয়। যেতে যেতে, আর খরিদদারের অপেক্ষা করতে করতেই যদি মহিষটা লেদে পেট খালি করে ফেলে, তাহলে তো সব মাঠে মারা যাবে। আলফু এই ভুল করতে চায় না। আগভাগেই সতর্ক সে। মহিষটা যাতে লেদে পেট খালি করতে না-পারে, তার ব্যবস্থাও সে বের করেছে। কিন্তু তারপরও তাকে এতো চিন্তিত দেখায় কেন?
মুতালিবের তা বোধগম্য হয় না।
বান্দির বান্দি কিতা একটা স্বপ্ন দেখছে, আর আমারেও ইতায় আঁচড় করছে, খালি মাথার মাঝে ঘুরে, আর ঘুরে— আলফুর মেজাজ চড়তে থাকে। জায়দা ঘরের মাঝে চুপ মেরে আছে। মুতালিব দুপা বেঁধে হেচকা টানে মহিষকে শুইয়ে ফেললে গলায় চুঙ্গা ঢুকিয়ে পানি ঢালতে শুরু করে আলফু। মহিষটা ঝাপটা-ঝাপটি করে বটে, তাতে সামান্য বাঁধা আসে ঠিকই, কিন্তু লাভের লাভ কিছুই হয় না। আলফু পানি খাওয়ানো শেষ করে পায়খানার পথে কাপড়ের তেনা হাত দিয়ে ঢুকাতে থাকে। মাহিষটা চোখ উল্টিয়ে বার কয়েক চিক দেয়। তার চোখ গড়িয়ে জল নামে।
মুতালিবকে ঝরঝরা দেখায়। এবার আল্লা-আল্লা করে রওনা দেওয়া চাই। আলফুর তবু চিন্তা থাকে। বউটার অখন-তখন। বাবুর হাট তো আর বাড়ির কাছের বাজার নয় যে, গেলাম আর আইলাম। তাছাড়া মহিষ নিয়া যাচ্ছে— লাভ হোক আর না-হোক, ক্ষতি তো আর হতে দিতে পারে না। দুদিকের দুচিন্তায় আলফুকে বড়ো বেছইন দেখায়। বউকে আর ধমকা-ধমকি না-করে নিজের খেয়াল রাখতে বলে। পাশের ঘরের চাচিকে তো রেখে যাচ্ছেই, আগে আল্লা বাদে!
লাভ তেমন হয়নি বটে, ক্ষতিও হয়নি। তাতেই খুশি। পরেরবার মহিষ কিনতে গিয়ে আরো হিসাব-নিকাশ করতে হবে— সেসব কথা না হয় পরে করা যাবে, আগে বাড়ি যাওয়া দরকার। মুতালিবকে সে তাড়া দেয়। মন তার এতোক্ষণ বাবুবাজারের মহিষ-হাটায় পড়ে ছিল, বিক্রি হয় কি হয় না— তা নিয়েই উত্তেজনার কম ছিল না। তাছাড়া মহিষটা যেভাবে পেটের ব্যথায় মুচড়াচ্ছিল, তেনা বেরিয়ে আসলে একটা কাণ্ড ঘটে যেতো হাটেই। এমনিতেই রুশনপুরের পাইকারদের প্রতি মানুষের তেমন বিশ্বাস নাই। তাছাড়া অপরিচিত ক্রেতাই তারা চাচ্ছিল। বাড়িতে গিয়ে রাতে যা হয় হোক, বাজারটা পার হলেই হলো। এতসব উত্তেজনায় বউয়ের কথা তার তেমন মনেই হয়নি। কিন্তু এখন তো ভারমুক্ত, মহিষটা অপরিচিত একজনের কাছে গছানো গেছে, নিশ্চিন্তে বাড়ি ফিরা যায়। এতোক্ষণে বউয়ের কথা তার মনে আসে। বউটা তার ঠিক আছে তো? অবশ্য পাশের ঘরের চাচিকে রেখে এসেছে। ব্যথা উঠলে উঠুক, তাতে কী!
বউয়ের প্রিয় ভেটের খৈ নিয়ে বাড়ি ফিরে সে।
দাওয়ায় পা রাখতেই জায়দার চাপা গোঙানি তার কানে আসে। আলফুর উপস্থিতি টের পেয়ে বেরিয়ে আসে বুড়ি। জায়দার ব্যথা উঠেছে সেই বিকালে, পানি ভাঙছে না, বাচ্চাও খালাস হচ্ছে না। বউটার অবস্থা অখন-তখন, টাউনে নেওয়ার ব্যবস্থা করা দরকার। আলফু দরজা ঠেলে ঘরে ঢোকে। জায়দার বহুবার বলা সেই স্বপ্ন হঠাৎ তার চোখের সামনে জ্যান্ত হয়ে ওঠে। সে দেখে— বউ তার বিছানায় নাই, পুকুর-পাড়ের আমগাছে বাঁধা। কঁকাতে কঁকাতে এক সময় সে আর মানুষ থাকে না, সেই মাখরা-ছাগল হয়ে যায়— গেল হাটবারে আলফু যাকে চুঙ্গা দিয়ে পানি ঢেলে তাজা করেছিল। ছাগলটা বাজারের দিকে আর যেন যেতেই চাচ্ছে না। পেটের ব্যথা, আর পানির চাপে বারবার সে চেনাবার চেষ্টা করছে। আলফু দড়িতে টান দিলে আরো জোরে কঁকাতে-কঁকাতে হাঁটতে থাকে সে। তার চিৎকারে আলফু কোনো পথ বের করতে পারে না। বুড়ির কোনো কথাও তার কানে আসে না।
বাংলাদেশ সময়: ১৮২৫ ঘণ্টা, অক্টোবর ৩, ২০১৪