মেয়েটা আদিবাসী— আমাদের দেশের ছোট ছোট টিলার মতো পাহাড়গুলির নিচের একটা গ্রামে তার জন্ম। মিশনারীদের কাছে সে বড় হয়েছে, লেখাপড়া শিখেছে তারপর শহরে এসেছে কাজ করতে।
এই বিউটি পার্লারেরই কোনো এক কর্মদিবসে আদিবাসী মেয়েটি যখন সাজাচ্ছে এক সৌন্দর্যপ্রার্থীনিকে— সে সময় একটা ঘটনা ঘটলো। সৌন্দর্যপ্রার্থীনি তখন বগলের লোম সাফ করার জন্য উম্মুক্ত করেছে তার বাহুমূল। ফর্সা উত্তেজক সেই বগলের দিকে তাকিয়ে আদিবাসী মেয়েটি একেবারে মুগ্ধ হয়ে গেল। অবশ্য এই মুগ্ধতা কোনো পুরুষের মুগ্ধতার মতো না বরং মেয়েলি অনুসদ্ধিৎসাই ছিল এর সূচনা বিন্দু। যদিও এর আগেও অনেক মেয়ের বগল সাফ করে দিয়েছে এই মেয়েটি কিন্তু এইরকম অসাধারণ বগল এর আগে সে কোনোদিন দেখেনি। পাউরটির উপর লাগানো মাখনের নিখুত প্রলেপের মতো— যে প্রলেপ কোথাও এতটুকু উঁচুনিচু না— এই মেয়েটির বগল। আর সেই বগলের উপরে অবস্থিত কালো চুলগুলি যেন নুডুলস। এলোমেলো বিশৃঙ্খল অথচ কোনো একটা অসাধারণ সাম্যে যেন পরিপূর্ণ। আর চুলগুলির কালো রঙ— হায়! পৃথিবীতে এইরকম কোনো অন্ধকারের জন্ম হয়নি আজো।
দৃশ্যটা আটকে রইলো আদিবাসী মেয়েটার চোখে—এই বগলের দৃশ্য। তার রঙের ঔজ্জল্য, চামড়ার নম্রতা, তার কালো চুলগুলি সব যেন একটা চিরস্থায়ী ভাস্কর্যের মতো স্থাপিত হলো তার মনের মিউজিয়ামে। যেন একটা উদাহরণ যেন অনুসরণযোগ্য কোন আদর্শ— যার মতো হতে চাওয়া যায়।
সেইদিন থেকে মেয়েটা অপেক্ষায় থাকে কখন আবার সেই সৌন্দর্যপ্রার্থীনি আসবে কখন আবার সে দেখতে পাবে সেই মসৃণ বগল— নুডুসের মতো কালো চুল। এবার বেশ খুটিয়ে খুটিয়ে দেখতে হবে। তারপর তার নিজের বগলের সাথে মিলিয়ে দেখতে হবে পার্থক্য। তার বগলটাও ওইরকম একটা বগল হোক— এটাই এখন তার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য। এর ফলে সে প্রতিদিনই আয়নার সামনে দাঁড়ায়, সন্তর্পণে সরায় জামার হাতাটাকে তারপর হাতের নিচ থেকে নিজের বগলটাকে বের করে আনে— বিউটি পার্লারে শেখা কৌশলগুলি, ওষধিগুলি বগলে লাগায় আর অপেক্ষা করে পরের দিনের। তার মনে হয় পরের দিনই সেই দিনটা— যে একটা অপরূপ বগলের জন্ম দেবে— মসৃণ, কালো নুডুলসের মতো চুলে ভরা।
অথচ পরের দিনটাও আগের দিনের মতো একইরকমভাবে আসে। একটা দেখতে দেখতে বিবর্ণ হয়ে যাওয়া বৈশিষ্ট্যহীন দৃশ্যই অপেক্ষা করে থাকে উম্মোচনের। বিরক্তিতে রী রী করে তার শরীর। ঘৃণা করতে ইচ্ছা করে নিজের বগলটাকে— নিজেকে।
এর মধ্যেই একদিন আবার সেই অসাধারণ বগলের সৌন্দর্যপ্রার্থীনি এলো। আবার সে উম্মুক্ত করলো তার বাহুমূল এবং আবার দেখা গেল সেই সমতল মাখনের মতো মসৃণ বগল তার নুডুলসের মতো চুল। এবার আদিবাসী মেয়েটা বগল সাফ করার সময় খুটিয়ে খুটিয়ে দেখলো ওই অপরূপ বগলের সমস্ত বৈশিষ্ট— সেই সঙ্গে তার নিজের বগলের যা কিছু ঘাটতি সেগুলিকেও মনে করার চেষ্টা করলো। ভাবলো কোথায় কোথায় সংশোধন করতে হবে। তার মনে হলো তার বগলে মাংসের অভাব ফলে একটা গর্ত যেন সারাক্ষণ স্পষ্ট হয়ে আছে। আর গর্তের মধ্যে অন্ধকার। এত তীব্র সেই অন্ধকার যে তার চুলগুলি আর চোখেই পড়ে না। অথবা মনে হয় যেন চুল ছাড়া আর কিছুই নেই ওই গর্তে। অথচ অপরূপ বগলটা যেন ফুলে থাকে— যেন স্পষ্ট করতে চায় নিজেকে। আর চুলের অন্ধকার সেখানে যেন আলোর সহযোগী।
তার মনে হলো নিজের বগলের গর্তটা তাকে ভরাট করতে হবে।
সেইদিন থেকে সে বগল ভরাটের কাজে লেগে গেল। টানটান করে হাত দুইটিকে মেলে দিয়ে সে চিৎ হয়ে শুয়ে থাকে বিছানায়— টেলিভিশনের অনুষ্ঠানে খোঁজে বগলের গর্ত ভরাট করার উপায় সম্বলিত ব্যায়ামের কৌশল আর বিউটি পার্লারে আগত ম্যাগাজিনগুলির পৃষ্ঠায় দেখে বগলশিল্পের উম্মোচন। এখন তার সময়গুলি আত্মকেন্দ্রিক ফলে পার্লারের কাজকর্মে কেমন যেন যান্ত্রিক দৈনন্দিনতার ছায়া। তার বিষণ্ন শরীরের অন্য প্রত্যঙ্গগুলি এখন তার বগলকে হিংসা করে অপমানিত প্রেমিকের মতো।
কিন্তু এতসব কিছুতেও তার বগলের গর্ত যেন ভরাট হচ্ছিল না। মাটি ফেলতে ফেলতে পুকুর ভরে গেল অথচ বাড়ি তৈরি করতে গেলেই কোত্থেকে যেন হুস হুস করে বেরিয়ে আসছে জল আর পণ্ড করে দিচ্ছে সব উদ্যোগ, কাজ। তাহলে কিভাবে সম্ভব একটা পূর্ণগঠিত বগলের মালিক হওয়া— যেন বগল পাউরুটির উপরে লাগানো মাখনের মতো নরম বেলুনের মতো স্ফীত আর যার স্বর্ণলতা নুডুলসের মতো কালো চুলের ঝাড়। ভাবতে ভাবতে সে শুকিয়ে গেল, ফুরিয়ে গেল অথচ অধরা বগল লুকিয়ে রইলো সেই গুপ্তধনের মতো— মানচিত্রে যে আছে কিন্তু দ্বীপের কোথাও নেই। এখন সে হতাশ, হলুদ, বিবর্ণ, আশাহীন। এখন সে ধরে নিয়েছে ওই বগল আর পাবে না— ওই মাখন, বেলুন, নুডুলসের ইটকাঠে তৈরি চমৎকার বাড়িটি যেন পুকুরের বিশ্বাসঘাতকতায় মাথা তুলতে পারলো না আর।
তখন সকাল। বিউটি পার্লারের বারান্দায় সে বসে ছিল ভারাক্রান্ত মনে। এমন সময় সেই সৌন্দর্যপ্রার্থীনি মেয়েটি এলো— যে তাকে মুগ্ধ করেছিল নিজের বগলের মোহময়তায়। আদিবাসী মেয়েটি সেদিন পড়েছিল একটা হাতকাটা জামা যা বগল সন্ধানের দিন থেকেই তার শরীরে আছে সহজ উম্মোচনের প্রয়োজনে। সৌন্দর্যপ্রার্থীনির পরিচর্যা করতে করতে হঠাৎ সে খেয়াল করলো মেয়েটি অবাক চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে।
‘কী দেখছেন। ’ লজ্জায় কিছুটা সংকুচিত হয়ে মৃদুকণ্ঠে জিজ্ঞাসা করলো সে।
‘আপনার বগল তো অদ্ভুত সুন্দর। আমাকেও এইরকম বগল বানিয়ে দিন না। আমার স্বামী আজকাল আর একটুও তাকাচ্ছে না আমার বগলের দিকে। ’ ম্রিয়মান কণ্ঠে বললো সেই সৌন্দর্যপ্রার্থীনি।
বাংলাদেশ সময়: ১৮৩২ ঘণ্টা, অক্টোবর ৩, ২০১৪