এর্নেস্তো সাবাতো (২৪ জুন ১৯১১-৩০ এপ্রিল ২০১১) আর্জেন্টাইন লেখক এবং চিত্রকর। লেখালেখির জন্য পেয়েছেন লিজিওন অফ অনার, মিগুয়েল দে সেরভেন্তেস পুরস্কার।
‘এল তুনেল’ (১৯৪৮), ‘সবরে হেরোস ইয়া টুম্বাস’ (১৯৬১), ‘অ্যাবানদন এল এক্সতারমিনাদোর’ (১৯৭৪) তাঁর জগদ্বিখ্যাত তিন উপন্যাস।
১০ম কিস্তির লিংক
৭.
‘ওর দফতর। ’ আমি প্রায় চিৎকার করে উঠলাম, আরও একবার টের পেলাম হাঁটু বেয়ে আমার সমস্ত শক্তি নিঃশেষিত হয়ে যাচ্ছে। কে বলেছে এই দালানে কাজ করে ও? সবাই যারা এই দালানের ভেতরে ঢুকছে বেরুচ্ছে তারা সবাই কি এখানে কাজ করে? আহা, আবার কত মাসের জন্য ওকে হারিয়ে ফেললাম, নাকি চিরকালের জন্যই, এই চিন্তাটা মনে আসতেই আমার মাথা ঘুরতে শুরু করল, কোনো সমাধানে না পৌঁছেই আমি একজন মরিয়া মানুষের মতো দৌড়াতে শুরু করলাম। দ্রুতই টি কোম্পানির ফটকের কাছে ফিরে এলাম। কিন্তু কোথাও খুঁজে পেলাম না ওকে। ও কি এলিভেটর ধরে উপরে উঠে গেছে? এলিভেটরের লোকটাকে জিজ্ঞেস করার কথা ভাবলাম একবার, কিন্তু কি বলব লোকটাকে? এই সময়ের মধ্যে হয়তো আরও অনেক মহিলাই এলিভেটর ধরে উপরে উঠে গেছে, সুনির্দিষ্টভাবে ওর বর্ণনা দিতে হবে অপারেটরকে। লোকটা কী ভাববে? সিদ্ধান্ত নিতে না পেরে দালানের সামনে কিছুক্ষণ এদিক-ওদিক পায়চারি করলাম। তারপর রাস্তা পার হয়ে চলে এলাম উল্টো দিকের ফুটপাতে, ওখান থেকে জরিপ করে দেখলাম দালানের সামনের দিকটা, কেন এটা করলাম বলতে পারব না। মেয়েটাকে দালানের কোনো একটা জানালায় দেখতে পাবো এই ক্ষীণ আশাতেই কিনা? তবে এটা গাধার মতো একটা চিন্তা যে, কোনো একটা জানালায় ও এসে দাঁড়াবে এবং বাইরে তাকিয়ে আমাকে দেখতে পেয়ে হাত নেড়ে ডাকবে বা ইশারা করবে। কোনো জানালায় ওর দেখা পাওয়ার বদলে, আমার চোখে পড়ল শুধু টি কোম্পানির নাম ঘোষণাকারী বিশাল বিশাল অক্ষরের সাইনবোর্ডটা।
চোখের বিচারে, আমার অনুমান ভুল না হলে দালানের সামনের খালি জায়গার প্রায় পঞ্চাশ মিটার জুড়ে আছে সাইনবোর্ডটা; এই হিসেবটা কেন যেন আমার অস্বস্তি আরও বাড়িয়ে দিল। কিন্তু এখন এসব অনুভূতি বিচার করতে বসার সময় একদমই নেই । এক্ষুণি দালানের ভেতরে ঢুকে ওর খোঁজ করা ছাড়া এই মুহূর্তে আমি আর কোনো সমাধান খুঁজে পেলাম না।
বেশ একটা উদ্দীপনা নিয়ে, লম্বা লম্বা পা ফেলে দালানের ভেতরে ঢুকে পড়লাম আমি, তারপর উপরে ওঠার জন্য এলিভেটরের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। কিন্তু টের পেলাম, ওটা যতই এক একটা করে তলা নিচে নেমে আসছে আর ততই আমার মনোবল ক্রমশ কমজোর হয়ে আসছে, যাকে বলে পুরো উল্টোমুখি অনুপাতে, এবং এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে আমার স্বভাবের লাজুক ভীরুতা।
এলিভেটরের দরজা যখন খুলল ততক্ষণে আমি পরিস্কার বুঝে গেছি আমাকে ঠিক কি করতে হবে: একটা টু শব্দও করা যাবে না। সঙ্গে সঙ্গে মনে হল সেক্ষেত্রে আর এলিভেটরের দরকার কি? আছে, এখন ফেরা যাবে না, কারণ এখন এলিভেটরে না চড়লে লোকজনের চোখে পড়বে ব্যাপারটা, বেশ কিছু লোক আমাকে দেখেছে আমি এলিভেটরের জন্য অপেক্ষা করছি। ওরা কি ভাববে আমি যদি এলিভেটরে না উঠি? কাজেই এটাই ঠিক আছে, এলিভেটরে উঠো চুপচাপ, একদম মুখ খোলা যাবে না: মুখ বন্ধ রাখাটা খুব কষ্টকর হবে না, যেহেতু এখনকার দিনে কথা বলার চেয়ে কথা না বলাটাই স্বাভাবিক। তাছাড়া এলিভেটরে কথা বলতে কেউ বাধ্যও নয়, একমাত্র কেউ যদি অপারেটরের বন্ধু হয় সেটা ভিন্ন কথা, সেক্ষেত্রে তাদের মধ্যে আবহাওয়া নিয়ে কিংবা অসুস্থ বাচ্চার খোঁজ-খবর নিয়ে আলাপ হতেই পারে। তবে আমার সঙ্গে যেহেতু ওই লোকের কোনো সর্ম্পকই নেই, আজকের আগে ওকে আমি কোনোদিন দেখিনি পর্যন্ত, কাজেই আমার কথা না বলার সিদ্ধান্তে কোনো রকম জটিলতা তৈরি করবে না। তাছাড়া এলিভেটরে আমি তো শুধু একলা প্যাসেঞ্জার নই, আরও লোকজন আছে। কাজেই আমার সিদ্ধান্ত মানাটা আরও সরল হয়ে যাবে যখন: আমাকে কেউ খেয়ালই করবে না।
শান্ত ভঙ্গিতে, আমি এলিভেটরে পা রাখলাম, এবং আমি যেভাবে চিন্তা করেছিলাম সব ঠিকঠাক মতো সেভাবেই ঘটল, কোনো রকম ঝামেলা হল না। কেউ একজন ভ্যাপসা গরমের কথা বলল অপরেটরকে, এতে আমার আরামবোধটা আরও পোক্ত হল, সব যে ঠিকঠাক আছে আমি নিশ্চিত হলাম। ‘আট’ তলার কথা জানাতে গিয়ে মুহূর্তের জন্য আমার গলা কেঁপে গেল, একটু সন্ত্রস্ত হয়ে পড়লাম ঠিক, কিন্তু যেহেতু আমার পরিকল্পনার কথা কেউ জানে না কাজেই কারো মনে কোনো সন্দেহের উদ্রেক হল না।
আট তলায় পৌঁছার পর খেয়াল করলাম আমার সঙ্গে আরেকজন প্যাসেঞ্জার নামল, এতে ব্যাপারটা কিঞ্চিত জটিল হয়ে পড়ল অবশ্য। তবে আমি ধীর পায়ে হলের দিকে এগুলাম, অপেক্ষায় থাকলাম লোকটার এই তলারই কোনো একটা অফিসে ঢুকে যাওয়া পর্যন্ত। তারপর নিশ্চিন্তে নিঃশ্বাস নিলাম। করিডোরের স্বল্প জায়গায়তেই বারকয়েক পায়চারি করলাম, থেমে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখলাম বাইরের বুয়েন্স আয়ার্সের দৃশ্য, তারপর ফিরে গিয়ে এলিভেটরের জন্য বেল টিপলাম। আমি যে ভয় করেছিলাম (অপারেটরের অস্বাভাবিক কোনো প্রশ্ন, উদাহরণ হিসেবে বলা যায়) সে রকম কিছুই ঘটল না, কয়েক মিনিটের মধ্যেই কোনো রকম অপ্রীতিকর ঘটনা ছাড়াই দালানের প্রবেশমুখে আবার ফিরে এলাম। সিগারেট ধরালাম একটা। আমার হাতে ধরা তখনো জ্বলন্ত ম্যাচের কাঠি, তক্ষুণি মনে হলো, আমি এতো নিশ্চিত হচ্ছি কেন: অপ্রীতিকর কোনো কিছু ঘটেনি ঠিক; কিন্তু একই সঙ্গে এটাও তো সত্যি ফলদায়ক কোনো কিছুও ঘটেনি। কাঠখোট্টাভাবে যদি বলি, মেয়েটার দেখা পাইনি, কাজেই ও যদি এই অফিসে কাজ না করে, তার অর্থ হল ওকে আমি হারিয়ে ফেলেছি। যদি ছোটোখাটো কোনো কাজে এসে থাকে ও, এতক্ষণে হয়তো কাজ সেরে চলেও গেছে। ‘অবশ্য,’ আমি যুক্তি খাড়া করার চেষ্টা করি আবার, ‘ও যদি কোনো কাজে এসে থাকে তাহলে এখনও সম্ভাবনা আছে, হয়তো এখনও কাজ শেষ করে চলে যায়নি। ’ এই চিন্তায় নতুন করে যেন আবার জীবন পেলাম, ঠিক করলাম প্রবেশমুখের উল্টো দিকেই অপেক্ষা করব।
কোনো রকম ফলাফল ছাড়া একটা ঘন্টা কেটে গেল। আমি সম্ভাবনাগুলো নতুন করে আবার যাচাই করে দেখতে শুরু করলাম:
১. ওর কাজ শেষ হতে হয়ত বেশি সময় লাগছে; সেক্ষেত্রে আমার তাই আরও অপেক্ষা করাই ঠিক হবে।
২. আমার সঙ্গে যা ঘটেছে, তাতে হয়তো বেশ মুষড়ে পড়েছে ও, তাই কাজটা করার আগে হয়তো কিছুক্ষণ হাঁটাহাটি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে; এর মানেও দাঁড়ায় আমার অবশ্যই অপেক্ষা করা উচিত।
৩. ও নিশ্চিতভাবেই এখানে কাজ করে, সেক্ষেত্রে অফিস ছুটি পর্যন্ত আমাকে করতে হবে।
‘আমি যদি অফিস ছুটি পর্যন্ত অপেক্ষা করি,’ আমি যুক্তি দেওয়ার চেষ্টা করি, ‘তাহলে অন্য সম্ভাবনা তিনটাও এমনিই পূরণ হয়ে যাচ্ছে। ’
(চলবে)
১২তম কিস্তির লিংক
বাংলাদেশ সময়: ১৩১১ ঘণ্টা, অক্টোবর ৪, ২০১৪
শিল্প-সাহিত্য
প্রতিদিনের ধারাবাহিক
টানেল | এর্নেস্তো সাবাতো (১১) || অনুবাদ : আলীম আজিজ
অনুবাদ উপন্যাস/শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।