ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১১ পৌষ ১৪৩১, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

প্রতিদিনের ধারাবাহিক টানেল | এর্নেস্তো সাবাতো (১২) || অনুবাদ : আলীম আজিজ

অনুবাদ উপন্যাস / শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২৫৮ ঘণ্টা, অক্টোবর ৮, ২০১৪
প্রতিদিনের ধারাবাহিক টানেল | এর্নেস্তো সাবাতো (১২) || অনুবাদ : আলীম আজিজ অলঙ্করণ: মাহবুবুল হক

এর্নেস্তো সাবাতো (২৪ জুন ১৯১১-৩০ এপ্রিল ২০১১) আর্জেন্টাইন লেখক এবং চিত্রকর। লেখালেখির জন্য পেয়েছেন লিজিওন অফ অনার, মিগুয়েল দে সেরভেন্তেস পুরস্কার।

এছাড়াও তিনি ছিলেন লাতিন আমেরিকান সাহিত্য জগতের বেশ প্রভাবশালী লেখক। তাঁর মৃত্যুর পর স্পেনের এল পায়েস—তাঁকে উল্লেখ করেন ‘আর্জেন্টিনাইন সাহিত্যের শেষ ধ্রুপদী লেখক’ বলে।
‘এল তুনেল’ (১৯৪৮), ‘সবরে হেরোস ইয়া টুম্বাস’ (১৯৬১), ‘অ্যাবানদন এল এক্সতারমিনাদোর’ (১৯৭৪) তাঁর জগদ্বিখ্যাত তিন উপন্যাস।

১১তম কিস্তির লিংক


এই যুক্তিটাকে আমার কাছে এক দম লৌহকঠিন মনে হল, এতে আমার উত্তেজনাও কমল খানিক, ফুটপাথের কর্নারের একটা ক্যাফেতে ঢুকে মোটামুটি স্বস্তি নিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম, ওখান থেকে অফিসের কেউ বেরিয়ে এলে সহজেই দেখতে পাব আমি। বিয়ারের অর্ডার দিয়ে ঘড়ির দিকে তাকাই: তিনটা পনের বাজে।

যত বেশি সময় যাচ্ছে আমি তত বেশি নিশ্চিত হচ্ছি আমার শেষ যুক্তিটার ব্যাপারে: ও এখানেই কাজ করে। ছয়টার দিকে আমি টেবিল ছেড়ে উঠে পড়লাম; প্রবেশ মুখের কাছে অপেক্ষা করাটাই সুবিবেচনার কাজ হবে বলে মনে হল। একসঙ্গে প্রায় একই সময়ে অনেক লোক বেরিয়ে আসবে, কাজেই ক্যাফেতে থাকলে ওই ভিড়ের মধ্য আমার নজর এড়িয়েও যেতে পারে।   

ঠিক ছয়টার কয়েক মিনিট পর থেকেই কর্মচারীরা বেরুতে শুরু করল।

সাড়ে ছয়টার মধ্যে মোটামুটি সবাই যেন বেরিয়ে এল— এরপর যত সময় পাড় হতে লাগল: আর কেউ অবশিষ্ট নেই— এই এই অনুমানটা তত পরিষ্কার হতে শুরু করল। ছয়টা পয়তাল্লিশের দিকে মনে হল শুধু কর্মকর্তা গোছের এক-দুজন ছাড়া আর কেউই হয়তো নেই। এখন...! ও-ই হয়তো কর্মকর্তা ধরনের কেউ একজন ‌‘অসম্ভব’ সঙ্গে সঙ্গে মনে হল আমার), তাহলে কোনো নির্বাহীর সেক্রেটারি (‘এটা হতে পারে। ’ মুহূর্তের জন্য যেন আবার আশার আলো দেখতে পেলাম। )
সাতটার দিকে সব কিছুর অবসান হয়ে গেল।


বাসায় ফিরে যাচ্ছি আমি, গভীর হতাশায় ভেতরটা বিদীর্ণ হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু তারপরও পরিস্কারভাবে একবার চিন্তা করে দেখার চেষ্টা করলাম। মাথার ভেতরটা টানা উত্তেজনায় দপদপ করছে, এরকম তীব্র— স্নায়ুবিক উত্তেজনার সময় আমার চিন্তাভাবনা সব কেমন মাতাল নাচিয়ের মতো দুলতে থাকে। তারপরও হয়তো এখনকার এই কঠিন পরিস্থিতির কারণেই— আমি চিন্তাভাবনাকে যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণে রাখার প্রাণান্ত করছি, নানাভাবে উল্টেপাল্টে দেখে সম্ভাবনাগুলোকে কঠোরভাবে একটার পর অরেকটাকে সাজানো রপ্ত করছি। কারণ, এরকম যদি করতে না পারি, আমার ধারণা খুব দ্রুতই পাগল হয়ে যাবো আমি।

যে রকম বলেছি, গভীর হতাশা নিয়ে বাসায় ফিরলাম ঠিক, মনে মনে চিন্তাগুলোকে নেড়েচেড়ে সুবিন্যস্তভাবে সাজানোর চেষ্টা অব্যাহত রাখলাম, খেয়াল রাখলাম কোথাও কোনো শূন্যতা থাকলে তা পুরণ করার যথাসাধ্য করতে হবে; কারণ আমি জানি আমাকে এখন খুব পরিষ্কারভাবে চিন্তা করতে হবে, আর তা যদি করতে না পারি, তাহলে আমার ছবি বোঝে এরকম একমাত্র মানুষটিকেও আমার হারাতে হবে।

আবার ভাবি: ওই দফতরে হয় ও কোনো কাজে গিয়েছিল, আর নয়তো ওখানেই কাজ করে ও; এছাড়া এর বাইরে অন্য কিছু হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। হ্যাঁ, আমার দ্বিতীয় ব্যাখ্যাটাই বেশি পছন্দ। এবং এটা যদি সত্যি হয়, তাহলে বুঝতে হবে ও আমার কাছ থেকে চলে যাওয়ার পর হয়তো মানসিকভাবে এতটাই বিপর্যস্ত বোধ করেছে যে, কাজ শেষ না করেই বাসায় চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কাজেই আমার এখন উচিত হবে পরবর্তী দিনের অপেক্ষা করা, কাল গিয়ে দালানের ঠিক প্রবেশমুখের উল্টোদিকটায় অবস্থান নেব আমি।

তবে অন্য ব্যাখ্যাটাও আরেকবার খতিয়ে দেখলাম আমি: ওই দফতরে যদি ও কাজে এসে থাকে, এবং যদি ধরি আমাদের আকস্মিক সাক্ষাতে বিপর্যস্ত হয়ে বাড়ি ও ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্তটা নিয়েছে, সেক্ষেত্রে কাজটা ওর অসমাপ্তই থেকে গেছে, এদিক থেকেই কাল ওর ফিরে আসার প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে। কাজেই, আমার জন্য সেরা বাজি হবে কাল সদরমুখে দাঁড়িয়ে ওর ওপর নজর রাখা।

দুটো সম্ভাবনাই মোটামুটি গ্রহণযোগ্য। কিন্তু তৃতীয়টার কথা মনে হতেই আতঙ্কে বুকটা খামচে ধরল আমার: ওই দালানে আমি ফিরে আসার আগেই, কিংবা আমি যখন এলিভেটর অভিযান করছি হয়তো তখনই কাজ সেড়ে চলে গেছে ও। এর মানে দাঁড়াচ্ছে, আমরা দুজনেই একই সময়ে ভেতরে গেছি ও বেরিয়ে এসেছি, কিন্তু কেউ কাউকে দেখিনি।

খুব অল্প একটা সময়ের জন্য শুধু আমি ছিলাম না, এখন ওই সময়টুকুর মধ্যেই এটা ঘটার কথা না, তবে ঘটাটা আবার একেবারে অসম্ভবও না, কিন্তু মন কু ডাকছে, ওটাই, ওটাই হয়তো ঘটেছে। ওর কাজটাকে যদি উদাহরণ হিসেবে নেই, ধরলাম ও হয়তো কোনো একটা চিঠি পৌঁছে দিতে এসেছিল। সেটা ডেলিভারি দেওয়া হয়ে গেছে এই সম্ভাবনা যদি বিবেচনায় নেই, তাহলে কাল ফিরে গিয়ে ওর জন্য অপেক্ষা করার কোনোই মানে হয় না।

অন্য দুটো সম্ভাবনাই আমার জন্য বরং অনুকুল, কাজেই যাই হোক ওই দুটোকেই, আমি প্রাণপণে আকড়ে ধরে থাকব।
কিন্তু বাসায় যত সময় যেতে লাগল আমার মানসিক অবস্থা ততই নানাভাগে বিভক্ত হতে শুরু করল। একদিকে, আমি যতবারই ভাবছি ওর ওই কথাটা (‘আমার মাথা থেকে ওটাকে কখনই তাড়াতে পারিনি’), আমার বুকের মধ্যে প্রচণ্ড হাতুড়ির ঘা পড়ছে আর আমার চোখের সামনে, টের পাচ্ছি খানিকটা অস্পষ্ট কিন্তু অতি বিস্তৃত আর শক্তিশালী এক দৃশ্য ধীরে ধীরে উন্মোচিত হচ্ছে। সঙ্গে আমি, আমার ভেতরে অন্তর্গত অসীম এক শক্তির উপস্থিতিও টের পাচ্ছি, যে সুপ্তি ভেঙে বাধন খুলে দেওয়ার অপেক্ষা করছে শুধু। অন্যদিকে, আমার এ রকম সন্দেহও হচ্ছে এরপর আবার হয়তো ওর দেখা পেতে লম্বা একটা সময় কেটে যাবে। কিন্তু ওকে যে আমার খুঁজে পেতেই হবে। আমি টের পেলাম স্বগতোক্তির মতো বেশ জোরে জোরে এই কথাটাই শুধু আওড়ে যাচ্ছি আমি,‘ওকে পেতেই হবে, ওকে আমার পেতেই হবে!’

(চলবে)

১৩তম কিস্তির লিংক



বাংলাদেশ সময়: ১২৫৭ ঘণ্টা, অক্টোবর ৮, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।