এর্নেস্তো সাবাতো (২৪ জুন ১৯১১-৩০ এপ্রিল ২০১১) আর্জেন্টাইন লেখক এবং চিত্রকর। লেখালেখির জন্য পেয়েছেন লিজিওন অফ অনার, মিগুয়েল দে সেরভেন্তেস পুরস্কার।
‘এল তুনেল’ (১৯৪৮), ‘সবরে হেরোস ইয়া টুম্বাস’ (১৯৬১), ‘অ্যাবানদন এল এক্সতারমিনাদোর’ (১৯৭৪) তাঁর জগদ্বিখ্যাত তিন উপন্যাস।
১২তম কিস্তির লিংক
৯.
পরের দিন বেশ সকাল সকাল টি কোম্পানির সামনের প্রবেশদ্বারের ঠিক সামনেই দাঁড়িয়ে গেলাম আমি। একে একে আমার সামনে দিয়েই দালানের শেষ কর্মচারিটিও ঢুকে পড়ল, কিন্তু ওদের মধ্যে নেই ও। তারমানে কি, ও এখানে কাজ করে না, তারপরও মনে হল, ক্ষীণ হলেও এই সম্ভাবনা তো থাকতেই পারে যে, ও হয়তো অসুস্থ, যে কারণে আজ ও কাজে আসেনি।
সম্ভাবনাটা পুরো উড়িয়ে দিলাম না, কিন্তু ক্যাফে থেকে নড়লাম না, পুরো সকালটা এখানে থেকে দালানের ওপর নজর রাখার সিদ্ধান্ত বহাল রাখলাম।
যখন মনে হচ্ছিল আর কোনো আশা নেই, সব ইচ্ছাশক্তি নিঃশেষিত প্রায় (সাড়ে এগারোটার মতো বাজে তখন ঘড়িতে) তখুনি দেখলাম সাবওয়ে থেকে বেরিয়ে আসছে ও। আনন্দে, লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ালাম, দৌড়ে গেলাম ওর দিকে। আমাকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল ও, যেন পাথর বনে গেছে; পরিষ্কার বোঝা গেল, আমার এই অপচ্ছায়া যে সামনে এসে দাঁড়াতে পারে, এটা ও কল্পনাও করেনি। এটাকে কৌতুহলোপদ্দীক বলা যায়, কিন্তু অতশত ভাবার সময় নেই আমার, ওকে দেখেই আমার ভেতরের ইস্পাত কঠিন দৃঢ়তা বিরল এক উদ্দীপনা শক্তির সঞ্চার করল দ্রুত। নিজেকে অতি বলশালীদের একজন বলে মনে হল: পুরুষের চূড়ান্ত লড়াইয়ের ইচ্ছা আমাকে যেন পুরো অধিকার করে ফেলেছে, যে কোনো কিছুর জন্যই আমি এখন প্রস্তুত।
আমি এতোটাই কতৃর্ত্বপরায়ণ হয়ে উঠলাম যে, বর্বরের মতো ওর বাহু খামচে ধরে, একটা কোনো কথা না বলে কালে স্যান মারতিনের প্লাজার দিকে ওকে টেনে নিয়ে চললাম। ও বাধা দিল না, ওর যেন ইচ্ছাশক্তি বলে কিছু নেই, নীরবে এগিয়ে চলল আমার সঙ্গে সঙ্গে।
দালানের দুটো সারি পেরিয়ে আসার পর, ও আমাকে জিজ্ঞেস করল:
‘আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন?’
‘প্লাজা স্যান মারতিনে। তোমার সঙ্গে অনেক কথা আছে, ‘জবাব দিলাম আমি, দৃঢ়পায়ে এগুচ্ছি সামনে, তখনও ওর এক হাত শক্ত করে ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছি।
বিড় বিড় করে টি বিল্ডিং নিয়ে কিছু একটা বলল ও, কিন্তু আমি গা করলাম না মোটেও, তখনও ওকে টেনে নিয়ে যাচ্ছি আমি। একটু পরে, প্রতি উত্তরে আমি বললাম:
‘অনেক কথা বলার আছে আমাদের। ’
এখনও প্রতিরোধের কোনো চেষ্টা করল না ও। নিজেকে আমার মনে হলো, আমি হঠাৎ ফুঁসে ওঠা কোনো নদী, গাছের কোনো ডাল ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছি। প্লাজায় পৌঁছার পর খালি কোনো একটা বেঞ্চের খোঁজ করলাম আমি।
‘তুমি পালিয়ে গেলে কেন?’ প্রথম প্রশ্ন আমার। ‘ওটাকে কখনই আমার মাথা থেকে তাড়াতে পারিনি’ আগের দিন একথা বলার সময় যে রকম চেহারা হয়েছিল ওর, এখনও ঠিক সেই একই চাহনিতে আমার দিকে তাকাল ও। অদ্ভুত এই চোখের দৃষ্টি, নিষ্কম্প, তীক্ষ্ণ; যেন অতীতের কোনো সুদূরলোক থেকে তাকাচ্ছে। এই দৃষ্টি আমাকে অন্য কোনো কিছুর কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে, ওই চোখ যেন আমি আগেও দেখেছি, কিন্তু কোথায় মনে করতে পারছি না।
‘আমি জানি না,’ শেষ পর্যন্ত মুখ খুলল ও। ‘আমার এখন যেতে হবে। ’ আমি আরও শক্ত করে হাত চেপে ধরলাম ওর।
‘আমাকে কথা দাও তুমি কক্ষনো আমাকে ছেড়ে যাবে না। তোমাকে আমার দরকার। তোমাকে আমার খুব দরকার। ’
আমাকে আবারও নিয়ে স্থির চোখে দেখল ও, কিন্তু মুখে কিছু বলল না। তারপর, দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে দূরের একটা গাছের দিকে তাকাল।
ওর পাশ মুখ দেখে, আমি ঠিক বুঝতে পাললাম না। কিন্তু সুন্দর মুখশ্রী ওর, তবে খেয়াল করেছি, ওর অভিব্যক্তির মধ্যে কেমন একটা ভাবলেশহীনতা মিশে আছে। লম্বা, বাদামী রঙের চুল ওর। শারীরিক গঠনে, ওকে দেখে ছাব্বিশের বেশি মনে হয় না, কিন্তু ওর মধ্যে অন্য এমন একটা কিছু আছে যার কারণে ওকে আরও বেশি বয়সী মনে হয়, যেন দীর্ঘজীবন পাওয়া কোনো মানুষের স্মৃতি ও বহন করে চলেছে। এমন নয় যে ওর চুলে সাদা রঙ ধরেছে, কিংবা শরীরে বয়সের ছাপ পড়েছে, কিন্তু সব ছাপিয়ে এমন একটা কিছু আছে যার ঠিক ব্যাখ্যা করা মুশকিল, এটা নিশ্চিতভাবেই অপার্থিব কিছু একটা। হতে পারে ওর ওই অভিব্যাক্তিই এর কারণ, কিন্তু প্রশ্ন হল, কারো শারীরিক ব্যাপার কিভাবে অভিব্যাক্তি হবে? তাহলে ওর চেহারার কোনো কিছুর কারণে কি এমনটা মনে হচ্ছে ? যদিও মুখ, ঠোঁট এগুলোও তো শরীরি অংশেই পড়ে, তারপরও ওর মুখের গড়ন, মুখের নির্দিষ্টি কিছু রেখা, একটু যেন অপার্থিবই। কিন্তু ঠিক কি কারণে ওকে বয়সী মনে হচ্ছে, এ ব্যাপারে আমি আসলে এখনও নিশ্চিত না, এর কোনো ভালো ব্যাখ্যাও আমার কাছে নেই। হয়তো ওর কথা বলার ধরনের কারনেও এমনটা মনে হতে পারে।
‘তোমাকে আমার খুব দরকার’, আবারও বললাম আমি।
ও কোনো জবাব না দিয়ে গাছের দিকে তাকিয়েই রইল।
‘তুমি কিছু বলছ না কেন?’ জিজ্ঞেস করলাম আমি।
গাছের দিক থেকে দৃষ্টি একটুও না সরিয়ে, জবাব দিল ও: ‘আমি কে, আমি তো কেউ না। আপনি কত বড়ো একজন আর্টিস্ট। আমাকে আপনার কেন দরকার আমি বুঝতে পারছি না। ’
আমি প্রায় হিংস্রভাবে চেচিয়ে উঠলাম:
‘আমি তো তোমাকে বলেছি তোমাকে আমার প্রয়োজন। তুমি বুঝতে পারছ না কেন?’
তার চোখ তখনও দূরের গাছের ওপর, সে বিড়বিড় করে বলল:
‘কেন?’
হঠাৰ আমি কেমন যেন চুপসে গেলাম, সঙ্গে সঙ্গে কোনো জবাব দিতে পারলাম না। হাত ছেড়ে দিলাম ওর, তাই তো, সত্যিই তো, ওকে আমার কেন দরকার? এখনকার আগে এই প্রশ্ন তো আমি নিজেকে কখনও করিনি, স্রেফ সহজাত প্রবৃত্তির ডাকে সাড়া দিয়ে গেছি শুধু। ছোট্ট একটা কাঠি কুড়িয়ে নিয়ে মাটিতে অকারণ কিছু জ্যামিতিক নকশা আঁকলাম।
‘আমি জানি না,’ দীর্ঘ বিরতির পর বললাম আমি বিড় বিড় করে। ‘আমি এখনও জানি না। ’
বাংলাদেশ সময়: ১৫১৩ ঘণ্টা, অক্টোবর ৯, ২০১৪
শিল্প-সাহিত্য
প্রতিদিনের ধারাবাহিক
টানেল | এর্নেস্তো সাবাতো (১৩) || অনুবাদ : আলীম আজিজ
অনুবাদ উপন্যাস/শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।