এর্নেস্তো সাবাতো (২৪ জুন ১৯১১-৩০ এপ্রিল ২০১১) আর্জেন্টাইন লেখক এবং চিত্রকর। লেখালেখির জন্য পেয়েছেন লিজিওন অফ অনার, মিগুয়েল দে সেরভেন্তেস পুরস্কার।
‘এল তুনেল’ (১৯৪৮), ‘সবরে হেরোস ইয়া টুম্বাস’ (১৯৬১), ‘অ্যাবানদন এল এক্সতারমিনাদোর’ (১৯৭৪) তাঁর জগদ্বিখ্যাত তিন উপন্যাস।
১৩তম কিস্তির লিংক
বিদ্যুৎ গতিতে কাজ করছে আমার মাথা, মাটিতে একর পর এক জটিল সব নকশা এঁকে চলেছি আমি।
‘আমার মন জটিল এক গোলকধাঁধার মতো। কোনো কোনো সময় আলোর ঝলক খেলে যায় ওখানে, বিদ্যুৎ চমকের মতো, ওই আলোয় কিছু ব্যাপার উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। আবার কিছু কিছু ব্যাপার আছে যা আমি কেন করি কখনই বলতে পারব না। না, এটাও ঠিক না...’
নিজেকে প্রায় একজন মূর্খের মতো মনে হতে লাগল আমার। আমি মোটেও এরকম না। মানসিকভাবে নিজেকে দ্রুত গুছিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলাম। আমি কি বলেছি, আমি কি বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন একজন মানুষ না? কিন্তু, আমার মন তো কাজ করে প্রায় একটা গণনাযন্ত্রের মতো, অবিরত হিসেবনিকেশ করছে। উদাহরণ দেই, এই এখানকার কথাই বলি, যা কিছু ঘটছে সেসব কি আমি মাসের পর মাস নানাভাবে যুক্তিতর্ক দিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ করে দেখিনি, এবং সেই মতে পরিকল্পনা সাজাইনি? আর, আরেকভাবে দেখলে, আমার যৌক্তিক চিন্তা-শক্তির বলেই কি শেষ অবধি আমি মারিয়া পর্যন্ত পৌঁছায়নি?
আমার মন বলছে আমি সত্যের কাছাকাছি পৌঁছে গেছি প্রায়, খুব কাছাকাছি, কিন্তু ভয় হচ্ছে আমি হয়তো একে হারিয়ে ফেলব। আবার সমস্ত মানসিক শক্তি একত্র করার চেষ্টা করলাম আমি। কেঁদে ফেললাম আমি:
‘এটা এমন না যে আমি যুক্তি বুঝি না। বরং পুরো এর উল্টো, আমার মন কখনই থেমে নেই। কিন্তু একজন জাহাজের কাপ্তানের কথা ভাবো যাকে প্রতিমুহূর্তে তার অবস্থান নির্ণয় করে, নিখুঁতভাবে একটা নির্দিষ্ট লক্ষ্যকে অনুসরণ করে এগিয়ে যেতে হচ্ছে। কিন্তু এটাও চিন্তা করে দেখো যে, সেও জানে না কেন সে ওই লক্ষের পানে ছুটছে। এখন কি তুমি বুঝতে পারছ?
মুহূর্তের জন্য আমার দিকে ফিরে তাকাল সে, হতভম্ব দেখাচ্ছে, তারপরই দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে গেল গাছের ওপর।
‘আমার কিছু একটার জন্য তোমাকে আমার দরকার, কিন্তু কেন সে ব্যাপারে আমি এখনও নিশ্চিত না। ’
দ্রুত চিন্তা করার জন্য আবারও কাঠি দিয়ে মাটিতে আঁকিবুকি করতে শুরু করলাম আমি। কয়েকমুহূর্ত পর আমি যোগ করলাম:
‘এখনকার ব্যাপারটার সঙ্গে ওই জানালার দৃশ্যটার সর্ম্পক আছে: তুমিই একমাত্র ব্যক্তি যে ওটা খেয়াল করেছ। ’
‘আমি কোনো চিত্রসমালোচক না,’ নরম গলায় বলল ও।
এটা ক্ষিপ্ত করে তুলল আমাকে, চেচিয়ে উঠলাম আমি:
‘ওই বিকলাঙ্গদের কথা আমার কাছে কক্ষনো বলবে না!’
চমকে উঠে, ফিরে দাঁড়াল ও। গলা নামিয়ে নিয়ে ওকে আমি ব্যাখ্যা করলাম কেন চিত্রসমালোকদের ওপর আমার কোনো আস্থা নেই, আমার শল্যবিদের ছুরি তত্ত্বের কথাও বললাম, এ পর্যন্তই।
আমার কথা শুনল ও, কিন্তু তখনও আমার দিকে তাকাচ্ছে না, অন্যদিকেই ঘুরে দাঁড়িয়ে আছে, আমার কথা শেষ হওয়ার পর, ও মন্তব্য করল:
‘আপনি অভিযোগ করছেন, কিন্তু সমালোচকরা তো সব সময়ই আপনার প্রশংসা করেছে। ’
রাগ চড়ছে আমার।
‘এটা আমার মন্দ কপাল! তুমি বুঝতে পারছ না? এই একটা ব্যাপার আমার মধ্যে তীব্র বিরক্তি তৈরি করে, আর আমার এই বোধ হয় যে আমি ভুল পথে আছি। আমার এবারের এই প্রদর্শনীর বেলায় কি ঘটেছে চিন্তা করার চেষ্টা করো। ওই হাতুড়েদের মধ্যে একজনকেও পাবে না যে আমার জানালার দৃশ্যটির গুরুত্ব ধরতে পেরেছে। তুমিই একমাত্র ব্যক্তি যে ওটার গুরুত্ব যে কতখানি ধরতে পেরেছ— একমাত্র তুমিই। আর তুমি তো চিত্রসমালোচক নও। না, ভুল বললাম। ওই জানালা নিয়ে আরও একজন প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে, কিন্তু সেটা নেতিবাচকভাবে। আমায় তিরস্কার করেছে সে। ওটা তাকে শঙ্কিত করেছে, খুবই বিতৃষ্ণার সঙ্গে জানিয়েছে সে। এর বিপরীতে, তুমি...’
সামনের দিকে সোজাসুজি তাকিয়ে, শান্ত গলায় বলল ও:
‘কিন্তু...এরকম হতে পারে না যে...যে আমারও একই মতামত?’
‘একই মতামত?’
‘ওই লোকটার মতামত। ’
স্নায়ু টান টান হয়ে উঠল আমার। ওর অভিব্যক্তি দেখার চেষ্টা করলাম শক্ত মুখে, পাশমুখ দেখে বুঝলাম না কিছুই, শুধু দৃঢ়বদ্ধ চোয়াল নজরে পড়ল। আমি আত্মবিশ্বাসী গলায় জবাব দিলাম:
‘তোমার যা খুশি ভাবতে পারো। ’
‘তোমার নিজের ধারণা কি?’
‘আমি জানি না। তাছাড়া, আমি এই প্রশ্নের জবাবও দেব না। আমি হয়তো বলব তোমার যে অনুভূতি আমার অনুভূতিও সেরকম। তুমি যেভাবে দৃশ্যটা দেখেছ, তোমার জায়গায় থাকলে আমিও সেভাবেই দেখতাম। তুমি কি ভেবেছ আমি জানি না, আমি কি ভেবেছি তাও আমি জানি না, কিন্তু আমি জানি আমি যেভাবে ভেবেছি তুমিও সেভাবেই ভেবেছ।
‘তার মানে কি আপনার ছবি নিয়ে আপনি কোনো পরিকল্পনা করেন না?
‘খুটিনাটি সব পরিকল্পনা করেই ছবি আঁকি আমি। যেভাবে তোমরা বাড়ি বানাও। কিন্তু ওই দৃশ্যটা বাদে। আমার মনে হয়েছে আমার ওভাবেই আঁকা উচিত, কেন ওরকম মনে হয়েছে আমি জানি না। আমি এখনও জানি না কেন। এটা সত্যি বাকি ছবিগুলোর সঙ্গে এর কোনো সর্ম্পক নেই। আমাকে এটাকে স্বীকার করতে হবে ওই গর্দভগুলোরই একজন এটা আমাকে ধরিয়ে দিয়েছে। আমি অন্ধকারে পথ হাতড়ে বেড়াচ্ছি, তোমর অবস্থা আমার মতোই আর এ কারণেই তোমার সাহায্য আমার দরকার।
(চলবে)
১৫তম কিস্তির লিংক
বাংলাদেশ সময়: ১৭৩০ ঘণ্টা, অক্টোবর ১১, ২০১৪
শিল্প-সাহিত্য
প্রতিদিনের ধারাবাহিক
টানেল | এর্নেস্তো সাবাতো (১৪) || অনুবাদ : আলীম আজিজ
অনুবাদ উপন্যাস/শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।