ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১১ পৌষ ১৪৩১, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

প্রতিদিনের ধারাবাহিক

টানেল | এর্নেস্তো সাবাতো (১৫) || অনুবাদ : আলীম আজিজ

অনুবাদ উপন্যাস / শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২৫০ ঘণ্টা, অক্টোবর ১২, ২০১৪
টানেল | এর্নেস্তো সাবাতো (১৫) || অনুবাদ : আলীম আজিজ অলঙ্করণ: মাহবুবুল হক

এর্নেস্তো সাবাতো (২৪ জুন ১৯১১-৩০ এপ্রিল ২০১১) আর্জেন্টাইন লেখক এবং চিত্রকর। লেখালেখির জন্য পেয়েছেন লিজিওন অফ অনার, মিগুয়েল দে সেরভেন্তেস পুরস্কার।

এছাড়াও তিনি ছিলেন লাতিন আমেরিকান সাহিত্য জগতের বেশ প্রভাবশালী লেখক। তাঁর মৃত্যুর পর স্পেনের এল পায়েস—তাঁকে উল্লেখ করেন ‘আর্জেন্টিনাইন সাহিত্যের শেষ ধ্রুপদী লেখক’ বলে।
‘এল তুনেল’ (১৯৪৮), ‘সবরে হেরোস ইয়া টুম্বাস’ (১৯৬১), ‘অ্যাবানদন এল এক্সতারমিনাদোর’ (১৯৭৪) তাঁর জগদ্বিখ্যাত তিন উপন্যাস।

১৪তম কিস্তির লিংক 

‘আপনি ঠিক কি ভাবছেন আমি বুঝতে পারছি না। ’
আমি অধৈর্য হয়ে উঠলাম। কেঠো গলায় আমি জবাব দিলাম:
‘আমি তোমাকে বলিনি, আমি কি ভাবছি তা নিজেও জানি না? কি ভাবছি তা যদি অক্ষরে অক্ষরে বলতে পারতাম, তাহলে তো আমি চিন্তাও করতে পারতাম পরিষ্কারভাবে। তাই না?’
‘হ্যাঁ, তা ঠিক। ’
আমি এবার চুপ করে রইলাম। মাথা দ্রুত কাজ করছে, সব কিছু পরিষ্কারভাবে একবার বোঝার চেষ্টা করলাম।
শেষে যোগ করলাম:
‘তুমি আমার গত কাজটাকে কৃত্রিম বলতে পারো। ’
‘গত কাজ মানে?’
‘জানালার আগের কাজটা। ’
আমি পুরো মনোযোগ এক জায়গায় কেন্দ্রীভূত করার চেষ্টা করলাম, চিন্তাগুলোকেও চেষ্টা করলাম নতুন করে গুছিয়ে নেওয়ার।
‘না, না, এটা না। ঠিক এটা না। ’ ছটফট করে বলে উঠলাম আমি। ‘আমার কাজ খুব বেশি যে কৃত্রিম তা ঠিক না। ’
বলেই মনে হল: আমি ঠিক কি বোঝাতে চাইলাম এটা বলে, সত্যিই তো? এর আগে কক্ষনো, এটা বলার এক মুহূর্তও আগে এই সমস্যাটা আমার মনেই আসেনি। আমার মনে উপলব্ধি হতে শুরু করল, জানালার ওই দৃশ্যটা আঁকার সময় আমি কেমন একজন নিদ্রাচর মানুষের মতো হয়ে গিয়েছিলাম, ঘুমের মধ্যে হেঁটে বেড়ানো ওই সব মানুষের কত কাছাকাছি না পৌঁছে গিয়েছিলাম আমি।

‘না, ওটা খুব বেশি কৃত্রিম ছিল না,’ আগের কথারই পুনরাবৃত্তি করলাম, যেন জোরে জোরে চিন্তা করছি আমি। ‘আমি জানি না। তবে, যদি সাধারণভাবে বলি আমার এসব কিছুই কোনো না কোনোভাবে মানুষ বা মানবজাতির সঙ্গে সম্পর্কিত, তুমি বুঝতে পারছ সেটা? আমার মনে পড়ছে জানালার ওই ছবিটা আঁকার মাত্র কয়েক দিন আগে, আমি কনসেট্রেশন ক্যাম্পে বন্দি এক লোকের কথা পড়েছিলাম যে, ক্ষিধে নিবারণে খাবার চাওয়ায় তাকে জীবন্ত ইঁদুর খেতে বাধ্য করা হয়েছিল। আমি এমন কিছু সময়ের মধ্যে দিয়ে গেছি যখন মনে হয়েছে কোনো কিছুরই কোনো অর্থ হয় না। লক্ষ লক্ষ বছর ধরে বিস্মৃতির দিকে অগ্রসরমান, ছোট্ট এই গ্রহে আমাদের জন্মই হয়েছে আসলে শুধু দুঃখ পাওয়ার জন্য, আমরা জন্মাই, আমরা সংগ্রাম করি, আমরা অসুস্থ হই, আমরা কষ্ট পাই, আমরা অন্যদের কষ্ট দেই, আমরা কাঁদি, আমরা মারা যাই, অন্যরাও মারা যায়, এবং, নতুন করে আবার জন্ম হয় মানবশিশুর আবার গোড়া থেকে শুরু হয় ওই একই হাস্যকর নাটকের। ’

এটাই কি সত্য? আমি বসে বসে জীবনে অর্থময়তার অনুপস্থিতি নিয়ে গভীর এক চিন্তায় ডুবে যাই। জীবন কি তাহলে তারকাপঞ্জির বিশাল এক মরু প্রান্তরে নামহীন চিৎকারের দৃশ্য ছাড়া আর কিছুই না?

মারিয়া আমার কথার কোনো মন্তব্য করল না।

‘সমুদ্রতীরের দৃশ্য আমাকে আতঙ্কিত করেছে’; দীর্ঘ নীরবতা ভেঙে যোগ করলাম আমি। ‘আমি জানি এটা নিছক একটা ভয়ের ব্যাপার না এটা তার চেয়ে গভীর গুঢ় কোনো কিছু। না, তাও না, আমি  বোধহয় বলতে চাই যে এটা আমার সম্বন্ধেই কোনো গভীর কিছু জানাতে চেয়েছে... মানে... দাঁড়াও, আমি বোধহয় মূল জায়গার চাবিতে হাত রেখেছি। বার্তাটা ঠিক এখনো পরিষ্কার না, কিন্তু আমাকে নিয়েই গুঢ় কোনো কথা বলতে চেয়েছে। ’
আমি ওকে নিচু গলায় বলতে শুনলাম:
‘হয়তো হতাশারই কোনো কথা হবে?’
চোখ সরু করে চিন্তিত মুখে ওকে দেখলাম আমি।

‘হ্যাঁ,’ বললাম। ‘আমারও তাই ধারণা, ওটা হতাশারই কোনো বার্তা। দেখেছো, আমাদের চিন্তায় কি মিল। ’
এক মুহূর্ত ভাবল ও, তারপর জিজ্ঞেস করল:
‘হতাশা কি কখনও প্রশংসা হতে পারে?’
এরকম কোনো প্রশ্ন আমি আশা করিনি।

‘না,’ জবাব দিলাম আমি। ‘আমার তা মনে হয় না। তোমার কি ধারণা?’
কোনো জবাব দিল না ও, উল্টো অনুভবে নাড়া দিয়ে যায় এমন দীর্ঘ এক নীরবতায় ডুবে থাকল ও। অবশেষে ফিরল ও আমার দিকে, তারপর সরাসরি চোখে চোখ রাখল আমার।
‘প্রশংসা শব্দটা এখানে প্রাসঙ্গিক না’— বলল ও, যেন নিজের প্রশ্নেরই জবাব দিচ্ছে। ‘প্রাসঙ্গিক যা তা হল সত্য। ’
‘তোমার কাছে কি দৃশ্যটাকে সত্যনিষ্ঠ মনে হয়েছে?’ জিজ্ঞেশ করলাম আমি।
মাথা নাড়ল ও, তারপর এক রকম ধারালো গলায় বলল:
‘আমার বিশ্বাস ওটা সত্য। ’

ওর মুখচোখের কাঠিন্য আমাকে অস্বস্তিতে ফেলে দিল। ‘ও এত শীতল কেন?’ নিজেকেই প্রশ্ন করলাম আমি। ‘কেন?’ হয়তো আমার দুশ্চিন্তা ওকেও স্পর্শ করেছে, আমার বুভুক্ষা সংক্রমিত হয়েছে ওর মধ্যেও, কারণ এক মুহূর্তের জন্য হলেও মনে হল ওর অভিব্যক্তি কোমল হয়ে এসেছে, আর ওর দিক থেকে একটা কোনো সেতুবন্ধন তৈরির আমন্ত্রণ যেন পাচ্ছি। কিন্তু পরক্ষণেই আমি টের পেলাম এই বন্ধুত্বের সেতু অতিব ক্ষণস্থায়ী, আর ভঙ্গুর এই সেতু দোল খাচ্ছে অতল এক গহ্বরের ওপর। এরপর কথা বলার সময় ওর কণ্ঠস্বর পুরো পাল্টে গেল:
‘কিন্তু আমি জানি না আমার সঙ্গে দেখা হলে আপনার কি লাভ। আমার কাছাকাছি যারা আসে তাদের সবাইকেই আমি আঘাত দেই। ’

(চলবে)

১৬তম কিস্তির লিংক



বাংলাদেশ সময়: ১২৫০ ঘণ্টা, অক্টোবর ১২, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।