ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১১ পৌষ ১৪৩১, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

অনুতাপ | জুলিয়ান সিদ্দিকী

গল্প / শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭১৫ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৪, ২০১৪
অনুতাপ | জুলিয়ান সিদ্দিকী পেইন্টিং: যতীন দাস

প্রথম দিকে পাত্রী সম্পর্কে যা জেনেছিল, তার সবকিছু মোটামুটি ঠিক হলেও দুটো ব্যাপারে মনের ভেতর কেমন জানি খটকা লেগেছিল সেরাজুদ্দিনের। একে তো মেয়েটা দেখতে লম্বা, হালকা পাতলা গড়নের।

তার ওপর গায়ে যেন চামড়ার ছানিটার নিচে হাড়-হাড্ডির খাঁচা ছাড়া কিছু নেই। স্ত্রীদের গায়ে-গতরে কম বেশি মাংস না থাকলে ছুঁয়ে-ছেনে শান্তি নেই। রসকষহীন শুকনো আর কাঠখোট্টা শরীর দেখলে মনের ভেতরে জন্ম নেয়া যাবতীয় ভালোমন্দ আকাঙ্ক্ষারাও আত্মগোপন করে অনাগ্রহের অন্ধকারে।

দেখানোর জন্যে খানিকটা সাজগোজ করিয়ে আনবার পর নাম জিজ্ঞেস করতেই পাত্র সেরাজুদ্দিনের দিকে তাকিয়ে ফিক করে হেসে উঠে মুখ আড়াল করেছিল রাশেদা। হয়তো তার চেহারা সুরতও রাশেদার কাছে হাস্যকর মনে হয়েছিল বা ভিন্ন কোনো কৌতুককর ব্যাপার ফুটে উঠেছিল যা দেখে হাস্য সম্বরণ কঠিন হয়ে উঠেছিল তার পক্ষে। আর তা থেকেই সেরাজুদ্দিনের মনে ধারণা জন্মেছিল মেয়েটি সত্যিই বোকা কিসিমের। যদিও আগেই পরকানা যা ও খানিকটা শুনেছিল এ ব্যাপারে তা যেন পুরোপুরিই সত্যি হয়ে ধরা দিয়েছিল তার বিবেচনায়। মনে মনে বলে উঠেছিল যে, মেয়েটিকে বোকা বললেও কম বলা হবে। তবু এ পর্যন্ত আশপাশের দু চারটা গ্রামে যে কটি বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছিল, তার কোনো পক্ষ থেকেই সম্মতিসূচক জবাব পাওয়া যায়নি বলে তার মনে কিঞ্চিৎ ভরসা ছিল যে, স্বামী পরিত্যক্তা আর বর্তমান বিয়ের বাজারে দীর্ঘদিন ধরে অচল রাশেদার সঙ্গে দেখাদেখির সময়ই হয়তো বিয়েটা হয়ে যাবে।
যদিও ঘরজামাই হবার ইচ্ছে তার নেই, তবু প্রায় সহায়-সম্পদহীন বলে না চাইতেই পাওয়া সম্পদের অধিকার সামান্য হলেও ঠেলে ফেলা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। নিজের বাড়ি আর শ্বশুর বাড়ি মিলিয়ে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেয়া যাবে অনায়াসেই। বউ পাবার সম্ভাবনাহীনতা দূর হবার সঙ্গে সঙ্গে খানিকটা সম্পদের মালিকও হওয়া যাবে পরোক্ষভাবে। কিন্তু শরবত পানের পরপরই পান-সুপারি নিয়ে এলে তার প্রত্যাশার চেরাগের তেলও যেন ফুরিয়ে যায় সহসা।

মুরুব্বী বা ঘটক হিসেবে সঙ্গে করে নিয়ে আসা তোরাব আলি মুন্সিকে আড়ালে ডেকে নিয়ে রাশেদার বাপ ঝাড়ু ব্যাপারীর ফিসফাস যেন আরো নিরাশার অন্ধকারে ঠেলে দিয়েছিল তাকে। বিরস মুখের তোরাব আলি মুন্সির উদাস চোখের দিকে তাকিয়ে সে জানতে চেয়েছিল, মাইয়ার বাপ কী কইলো অইরাম ফুসুর ফুসুর কইরা?
শুষ্ক কণ্ঠে তোরাব আলি প্রতি উত্তরে জানিয়েছিল, পরে জানাইবো।
- তাইলে আর হইছে!
হতাশ কণ্ঠে বলে উঠেছিল সেরাজুদ্দিন।
হাঁটতে হাঁটতে বেশ কিছুটা পথ চলে আসবার পর তোরাব আলি মুন্সি খানিকটা কেশে বলে উঠেছিল, ব্যাপারী কইলো তর বয়স বেশি। চাপাচুপা ভাঙ্গা। তার উপরে রাখছস দাড়ি। তাও যদি চুল-দাড়িতে এক আধ বার কালি-কলপ লাগাইতি!
তোরাব আলি মুন্সি যেন সম্পূর্ণ কথা না বলে মাঝ পথেই থেমে যায়। বা খানিকটা দম নিতেই থেমেছিল। কিছুক্ষণ পর আবার বলেছিল, শেষে দিয়া কইলো, বাড়ির মানষ্যের লগে বুঝ-পরামিশ কইরা দিন-তারিখ জানাইবো।
- কবে জানাইবো কইছে কিছু?
অস্থির কণ্ঠে বলে উঠেই কেমন সন্দেহ ভরা দৃষ্টিতে সে তাকিয়েছিল তোরাব আলি মুন্সির বয়সের বলিরেখা ফুটে থাকা মুখের দিকে।
- হইতে পারে কাইল-পরশু। এক-দুই হপ্তা আবার এক-দুই মাস।
তোরাব আলির দায়িত্বহীন কথাবার্তায় বেশ বিরক্ত বোধ করছিল সেরাজুদ্দিন। তেমন বিরক্ত স্বরেই বলেছিল, তার মাইনে এমন কোনো দিন-তারিখ দেয় নাই?
- নাহ!
বলে, ঘন ঘন মাথা নেড়েছিল তোরাব আলি মুন্সি।

সেদিন বাড়ি ফিরে বেশ কিছুক্ষণ গুম হয়ে বসেছিল ঘরের পেছনকার খড়ের স্তূপের ওপর। বড় মেয়ে নীলু বাপের মন-মর্জি বুঝতেই হয়তো পাশ থেকে কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করে বলে উঠেছিল, আব্বায় দেহি চুপ চাপ, খবর-বার্তা কিছু কইলেন না?
মেয়ের দিকে একবার রূঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে সে মৃদু স্বরে বলেছিল, কী কইতো? খবর বার্তা থাকলেই না!
- তাও কেমন দেখলেন, কতা-বার্তা কী হইলো?
- কইছে পরে জানাইবো।
কথাটা শুনেই যেন নীলুর মুখেও ছায়া ঘনিয়ে এসেছিল। বিয়ে-শাদির ব্যাপারে পরে জানানোর কথা বলা মানেই সম্পর্কের ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তা। বিয়ের ক্ষেত্রে প্রস্তাবনার পক্ষে বিপক্ষে সরাসরি হ্যাঁ বলা গেলেও নেতিবাচক অর্থে সরাসরি না বলার প্রচলন নেই তেমন। তাই হয়তো ঝাড়ু ব্যাপারী নিজের অসম্মতি প্রকাশের ক্ষেত্রে কৌশলের আশ্রয় নিয়েছে। সংকেত হিসেবে সেরাজুদ্দিনের বয়সের বাড়তি দিকটা ধরিয়ে দিয়েছে।

আর কিছুক্ষণ চুপচাপ বসেছিল সে। আড় চোখে মাঝে মাঝে মেয়ের দিকে তাকালে প্রাক্তন স্ত্রী সালেহার রাগি আর শক্ত-পোক্ত চেহারা ভেসে ওঠে মনের দেয়ালে।

২.
দাঁত থাকতে দাঁতের কদর নাই। প্রচলিত কথাটি মনে থাকলেও বিগত সময়ে সে কথার গুরুত্ব ততখানি অনুধাবন করেনি সে। এখন যেন হারানো দাঁতের মতোই আরো বেশি করে উপলব্ধি করতে পারছিল স্ত্রীর প্রয়োজনীয়তা। অথচ সংসারে কত টানাটানি, কত ঝগড়া-ঝাটি, মারামারি সত্ত্বেও মনে কখনো ঘুণাক্ষরেও জাগেনি যে, সালেহা সত্যি সত্যিই সন্তান-সংসার ছেড়ে চলে যেতে পারে চিরতরে বা শ্বাস-প্রশ্বাসের মতো হালকা-পাতলা হুমকি ধমকিকে কখনো কঠিন সত্যে পরিণত করে ফেলবে।

বিয়ের এক বছর না যেতেই যে অশান্তি শুরু হয়েছিল, দীর্ঘ পঁচিশ বছর ধরে যে মুখ বুজে ঘর সংসার করে গেছে, হঠাৎ করে কী এমন শক্তিতে বলীয়ান হয়ে উঠেছিল যে, শেষ পর্যন্ত সংসার ছেড়ে না যাবার সুদীর্ঘকালের জেদকেও বিসর্জন দিতে পারলো? সবার কাছে মোটামুটি শান্ত বলে পরিচিত মানুষটি যে আচমকা এমন একটি বড় সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলতে পারে এমন কোনো সন্দেহ কারো মনে অস্পষ্টভাবেও ধরা দেয়নি। যদিও প্রতিবার মার খেয়ে বলেছে এই সংসারে আর থাকমু না। কিন্তু অসারের তর্জন-গর্জন সার কথাটিকেই সত্যি প্রমাণ করে ফিরে এসেছে বারংবার। দু-চারদিন গম্ভীর থেকে ফের আস্তে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে। কিন্তু এবারই ব্যতিক্রম। সেই যে মার খেয়ে কেঁদেকেটে বাপের বাড়ি গেল, ফিরে আসবার বদলে পুরো সিদ্ধান্তের সরকারি দলিলই পাঠিয়ে দিয়েছে চেয়ারম্যানের দফতরে।

আগেরবার তার ভাইবোনেরা এসে শালিস বসাতে চেয়েছিল। এমনকি তাদের বোনকে আর এ বাড়িতে পাঠাবে না বলে হুমকি দিলেও তা পাত্তা দেয়নি সেরাজুদ্দিন। বরং কিছু একটা হলে সে বাপের বাড়ি ছুটে যায় সে অজুহাতে আরেক দফা পেটানোর উদ্দেশ্যেই শক্ত-পোক্ত একটি লাঠি বানিয়েছিল। ঘরের কোণে দাঁড় করিয়ে রাখা আড়াই হাত মাপের ঘন গাঁইটঅলা বাঁশের লাঠিটি ঘনঘন চিমটি কাটবার মতো করেই যেন উপহাস করছিল তাকে।

ছেলে-মেয়েরা বড় হয়ে গেছে। বড় মেয়ে দুটিরও বিয়ে হয়ে গেছে। এমন অবস্থায় স্বামীর ঘর ছেড়ে গিয়ে নতুন করে সংসার পাতবার সুযোগ নেই বলতে গেলে। মধ্য বয়স অতিক্রান্ত কোনো নারীর প্রতীক্ষায় কেউ শূন্য সংসার নিয়ে বসে থাকে না। তবু কোন সাহসের ওপর ভর করে এমন একটি কাজ করে ফেলতে পারলো সে, তাই যেন ভেবে কুলিয়ে উঠতে পারে না সেরাজুদ্দিন। সালেহার বাপ-ভাইয়েরা এমন কোনো অবস্থা সম্পন্ন নয় যে, একটা মানুষকে বছরের পর বছর খাওয়া-পরা যুগিয়ে যেতে পারে।

প্রথম প্রথম সে ভেবেছিল যে, সপ্তাহ খানেক বা দিন পনের পর থাকা-খাওয়ার সংকট এমনকি প্রতিবেশীর টিপ্পনী সহ্য করতে না পারলে এমনিতেই ফিরে আসবে সালেহা। কিন্তু একমাস অতিক্রমণের পর চেয়ারম্যানের দফতরে বিবাহ বিচ্ছেদের দলিল এসে পৌঁছেছিল সালেহার পক্ষ থেকে। ভাইয়ের বউরা এ সংবাদ শুনে মুখ বাঁকিয়ে বলেছিল, এইডা তোমারে ডর দেখায়। নীলুর মা’র বাপ-ভাইয়ের নিজেগোই চলে না, তারে পালবো কয়দিন?

তারপরও যেন আরো খানিকটা অবাক হওয়া বাকি ছিল তার। তাদের এলাকার আত্মীয়-স্বজনের মাধ্যমে শোনা কথা শুনছিল, সালেহার গায়ে নতুন গয়না। আগের তুলনায় আরো কয়েকগুণ দামি কাপড়। চেহারার সেই ঝলসানো ভাবও আর নেই। বাপের বাড়ির কাছেই ভাড়া করেছে নতুন ঘর। কথাগুলো শুনলেও নানা হিসেব কিতাবের পরও যোগে মেলাতে পারে না সেরাজুদ্দিন।

মেয়েরা লুকিয়ে চুরিয়ে তাদের মাকে টাকা পয়সা দিলেও আর কয়টা টাকা দিতে পারবে? তা দিয়ে ঘর ভাড়া আর নিজের যাবতীয় ব্যয়ভার মেটানো অতটা সহজ নয়। সে কি অন্য কিছু করে বা ঘন ঘন শহরে যায়? কোথাও কোনো কাজ-কর্ম নিয়েছে? গার্মেন্টস বা বাসা-বাড়ি? যেহেতু লেখা-পড়া জানা নেই তাই খুব ভালো কিছু করা তার পক্ষে সম্ভব নয়। নাকি জড়িয়ে গেল দেহ বিক্রির নতুন নেশায়। আজকাল এটা চলছে খুব। ছোট-বড়, ধনী-গরীব বা শিক্ষিত-অশিক্ষিত বলে কথা নেই। কড়কড়ে টাকা, নিত্য-নতুন পুরুষ। চকচকে মোবাইল ফোন। নানা প্রশ্ন এসে মনের জানালায় ভীড় করে তাকে এলোমেলো করে দেয় যেন। বয়সের দিক দিয়ে অনেক পিছিয়ে পড়া এমন নারীর পক্ষে কারো আশ্রিত না হয়ে উপায় নেই। তাকে আশ্রয় দেবে এমন কারো কথা জানা নেই তার। তেমনটা না হলে বাসা-বাড়িতে বা পোশাক কারখানায় কাজ জুটিয়ে নেবার সম্ভাবনাকেও উড়িয়ে দিতে না পারলেও তার আরেক মন সায় দেয় না এতেও।

কিন্তু আরো কিছুদিন পার হয়ে যেতেই ভুল ভেঙেছিল তার। কানা ফজলুর মেয়ে সফুরার মুখে খবর পেয়েছিল যে, এমন কোনো কাজ-কর্ম বা চাকরি-বাকরিও সে করে না। বাড়ি ছেড়ে একাকী শহরের দিকেও তার যাওয়া আসা নেই। প্রতিবেশীদের ধারণা সত্যি সত্যিই সে বিয়ে করেছে এমন কাউকে, যে তার যাবতীয় খাই-খরচ তুলে নিয়েছে নিজের কাঁধে। কিন্তু শারীরিকভাবে প্রায় সামর্থ্যহীন সালেহাকে কে বিয়ে করতে আসবে? পুরুষ মানুষ বিনা সুখে কেবল মুখ দেখে রাখবে না। তবে কেউ কেউ এমন হতেও পারে। তবে কোনো রকম যুক্তিতে উপনীত হতে না পারলেও এমনটা বিশ্বাস করতে বাধ্য হয়েছিল যে, যে গেছে সে ফিরে আসবার জন্যে যায়নি। সালেহার প্রত্যাবর্তনের আশা ত্যাগ করবার পরও নতুন করে আবার বউ পাবার সম্ভাবনাগুলোও যখন আস্তে আস্তে বিলীন হয়ে যাচ্ছিল, তেমন এক সংকটের মুহূর্তে তার ভরসা ছিল বোকাসোকা আর সংসারে প্রায় অনভিজ্ঞ রাশেদার পাণি গ্রহণে তেমন বড় কোনো বাধা থাকবে না। কিন্তু অবস্থা দৃষ্টে মনে হচ্ছে বাকিটা জীবন তাকে একা একাই কাটাতে হবে।

৩.
মাস ছয়েক হতে চললো নারীদেহ বঞ্চিত সেরাজুদ্দিন বেশ অস্বস্তিতে আছে। ঘরে বিবাহিতা কন্যা নীলুর ওপর চোখ পড়লে তার অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠে থরথর করে। অজ্ঞাত পাপের আশঙ্কায় তার মাথা হেঁট হয়ে আসে। পুনর্বার তাকাতে সাহস হয় না কন্যার দিকে। কিন্তু তার এমন অদ্ভুত আচরণে হয়তো ভুল বোঝে মেয়েটি। সে ধরে নেয় বিয়ের ব্যাপারে কোনো অগ্রগতি দেখাতে পারছে না বলেই হয়তো তার বাবা রুষ্ট হয়ে আছে। এমন এক দোটানায় পড়ে নীলু তাকে পরামর্শ দেয় যে, যৌতুকবিহীন বিয়ের ক্ষেত্রে পাত্রী পাওয়া তেমন কঠিন হবে না। কিন্তু সেরাজুদ্দিনের মত হচ্ছে বিয়ের মাধ্যমে যদি খানিকটা অর্থ-সম্পদ হস্তগত হয় তাহলে কিছু একটা ব্যবসাপাতি শুরু করে দাঁড়ানোর চেষ্টা করতে পারতো। দিনমজুরি দিয়ে যা আয় হয়, তা চাল-ডাল-তেল-নুনেই খরচ হয়ে যায়। সঞ্চয়ের সুযোগটা কোথায়? তারপরও তো আরো কত রকমের খরচের কাজ পড়ে থাকে। তা ছাড়া নতুন মানুষটি যদি দেখতে শুনতে আগের স্ত্রীর মতো খানিকটা না হয়, তাহলে সম্পর্কের দিক দিয়েও সমস্যা তৈরি হতে পারে।

মেয়ে বিরক্ত হয়ে বলে, যারে ধইরা রাখতে পারলেন না, তার লাইগা অখন হায় আফসোস করলে লাভ আছে? মরা পুত লইয়া কানলে আর কী হইবো? আপনে মন ঠিক করেন আগে। যা চান একটা চাইবেন। লাভও চাইবেন আবার বেডির ভালা-মন্দ দোষও খুঁজবেন এমন বাছাবাছি কইরা কে মাইয়া দিবো আপনেরে? এ ছাড়া আমিও তো ঘর-সংসার ফালাইয়া আপনের এহানে পইড়া থাকতে পারমু না সারা বছর!

মেয়ের মুখে খই ফুটলেও সেরাজুদ্দিনের মুখে কোনো কথা আসে না। মেয়ে তো ভুল বা মন্দ কিছু বলেনি। কিন্তু তার নিজের তেমন আর্থিক সঙ্গতি আর বয়স নেই। নিজে নিজে কিছু একটা করে ফেলতেও পারে না। তবু কিছু একটা বিহিত হয়ে যেত যদি তাহলে বিগত সময়ের ভুলগুলো যাতে আবার না হয় সে চেষ্টাটাই করতো জোরেশোরে। কিন্তু ভুল শোধরানোর পথে যে অনেক ধরনের কাঁটা বিছিয়ে রেখেছে তার পরিবেশ আর সমাজ।

সন্ধ্যার দিকে হাঁটতে হাঁটতে সে কুটিলা স্টেশনের দিকে যায়। কালাগাজীর চায়ের স্টলে বসে দুধ-চিনি বেশি দিয়ে চা খেতে খেতে স্টেশনে অপেক্ষমাণ যাত্রীদের দেখে। তবু তাদের মাঝেই কিছু কিছু নিরুদ্বেগ মুখ দেখা যায় গালে-ঠোঁটে রঙ মেখে চোখে মোটা করে কাজল দিয়ে কখনো সুন্দর ঘোমটা নয়তো বোরখা পরে ইতস্তত ঘুরছে। যদিও মনে হবে তাদের উদ্দেশ্য ট্রেনে চড়া। কিন্তু তারা চাঁদপুর বা কুমিল্লাগামী কোনো ট্রেনেরই যাত্রী হয় না। মাঝে মাঝে তাদের কেউ হাঁকডাক করে টয়লেট অনুসন্ধান করে। কখনো বা স্থির ট্রেন নয়তো বা পরিত্যক্ত বগির আবছা অন্ধকারে মিশে যায়। তাদের গ্রাম বা ঠিকানা কেউ জানে না। অন্তত তার পরিচিত কালাগাজী বা স্টেশনের ঝাড়ুদার বিশ্বজিৎ সাহা অপারগতা প্রকাশ করলেও তাদের পেশা আর নিরাপদ স্থানের সংবাদ জানাতে ভুল করে না। সামনে বিয়ে করা স্ত্রী-সঙ্গ লাভের সম্ভাবনা যখন নিভুনিভু তেমনই একটা দোদুল্যমান অবস্থায় তার দেহ যেন ক্রমশ দুর্নিবার হয়ে উঠতে থাকে। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে তার চোখ পড়ে ঠোঁটে গাঢ় করে লাল রঙের লিপস্টিক লাগানো শ্যামলা একটি মেয়ে পাশের দোকানের নিরাপদ আড়ালে সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে ধোঁয়াগুলো যেন তার মুখের ওপরই ছুঁড়ে দিচ্ছিল।

চা খাওয়া হয়ে গেলে সেরাজুদ্দিন উঠে রেল লাইনের দুদিকে তাকিয়ে দেখে কোনো ট্রেন আসছে কি না। তখনই ফের মেয়েটির চোখে চোখ পড়ে তার। আর মেয়েটিও যেন তখন পা বাড়ায় তার দিকে। মনে মনে কিছুটা শঙ্কিত হয়ে পড়ে সে। মেয়েটা না আবার তাকে কোনো ঝামেলায় ফেলে দেয়। সঙ্গে প্রায় এক সপ্তাহের কাজের পুরো টাকাটাই আছে। আর সে ভাবনা থেকেই যেন তার একটি হাত আলগোছে উঠে যায় কোমরে রক্ষিত টাকাগুলোর কাছে। কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে পাশ কাটিয়ে যেতে যেতে মেয়েটি মৃদু স্বরে বলে ওঠে, দুইশ দিলে আছি, সামনের পুরান বগির কাছে।

খুব মিষ্টি কণ্ঠস্বর। পুরো দেহ যেন ঝনঝন করে ওঠে তার। সে বিশ্বাস করতে পারে না যে, সত্যি সত্যিই মেয়েটি ও কথা বললো কি না। মাথা ঘুরিয়ে মেয়েটির হাঁটার ভঙ্গি দেখে কেমন ঘোর লাগা চোখে তাকিয়ে থাকে সে। তার সঙ্গে সঙ্গে ভেতরে ভেতরে যেন সদ্য জাগ্রত অজগরের  মতো মোচড় খেতে আরম্ভ করে পুরো দেহ। কেউ দেখে ফেললে কী না কী ভাবে তাই সে দৃষ্টি ঘুরিয়ে কালাগাজীর স্টলের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে ফের আড় চোখে তাকায় মেয়েটির দিকে। দেখা যায় সত্যি সত্যিই এদিকে দৃষ্টি রেখে পরিত্যক্ত বগিটির সামনে দাঁড়িয়ে আছে সে।

৪.
মনের ভেতর যতটা পুলক নিয়ে অন্ধকারাচ্ছন্ন পরিত্যক্ত রেলের বগি থেকে মাটিতে পা রেখেছিল সেরাজুদ্দিন, বাড়ির পথে অগ্রসর হতে হতে তা যেন দূর হয়ে যাচ্ছিল ভাসমান কার্পাসের মতোই। দীর্ঘ দিনের অস্থিরতা দূর হয়ে সাময়িক সুস্থিরতা এলেও অন্য আরেকটি ভয় তার ভাবনার সিন্দুকে নড়াচড়া করতে আরম্ভ করেছিল। বহুবার শুনেছে যে, এসব মেয়েদের সবারই কোনো না কোনো কঠিন ব্যাধি থাকে। যা এক শরীর থেকে আরেক শরীরে স্থানান্তর হতে এক পলক সময়ও লাগে না। আর সে সব রোগ-বালাইয়ের খুব সহজ আর সস্তায় নিরাময়ের সুযোগ নেই। এমনও হতে পারে যে দুশো টাকার আনন্দের সঙ্গে সঙ্গে বাকি জীবনের জন্য ক্লেশ আর দুর্নামও কেনা হয়ে গেছে একই মূল্যে।

পথ চলতে চলতে তার মনে পড়ে, সদ্য কৈশোরত্তীর্ণ বয়সে সুতা ব্যাপারী খালেকের ছেলে মোহনের সঙ্গে প্রায়ই রাতের অন্ধকারে খাল পেরিয়ে যেতো মন্তির মেয়ের ঘরে। তার নামটা যে কী ছিল তা আজ আর মনে নেই। হয়তো কখনো তার নামই শোনেনি। তার প্রসঙ্গ উঠলে সবাই নামের বদলে বলতো মন্তির ঝি। জনশ্রুতি ছিল যে, সেই মন্তির ঝি একই রাতে বিশ থেকে পঞ্চাশজন পুরুষকে তৃপ্ত করতে পারতো। কিন্তু মোহনের মতো অতটা সাহস আর আর্থিক সঙ্গতি ছিল না বলে যৌবনের পালে হাওয়া লাগাতে পারেনি চাহিদা মতো। পরে মোহনের শিশ্নের মাথায় প্রথমে একটি ফুস্কুড়ির দেখা দিয়েছিল। কদিন পর সেটার মুখ দিয়ে অনবরত পানির মতো একটা বর্ণহীন তরল বের হতো। বাজার থেকে মলম আনিয়ে লাগালে কদিন ভালো থাকতো। সে অবস্থায় সে আবার উপনীত হতো মন্তার ঝির দোর গোঁড়ায়। কিন্তু এক সময় মলমেও আর কোনো কাজ হচ্ছিল না। সব সময় পানির মতো কষ বের হতে হতে শিশ্নমুণ্ড পুরোটাই ক্ষত হয়ে গেলে শহরের হাসপাতালে বড় ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হয়েছিল তাকে। প্রায় মাস ছয়েক চিকিৎসার পর নিরাময় ঘটলে বিপদজনক সে আকর্ষণ থেকে মুক্ত হয়েছিল মোহন। এখন মোহনের মতোই তেমন কোনো বিপদ ঘটে কিনা সে আশঙ্কায় তার কলজে পর্যন্ত শুকিয়ে যাবার অবস্থা হয়।

বাড়ি ফিরতেই নীলু তাকে দেখতে পেয়ে খানিকটা বিরক্ত কণ্ঠে বলে ওঠে, আব্বায় এতক্ষণ কই আছিলেন? মুন্সি জ্যাডায় কতক্ষণ বইয়া থাইক্যা গেল!
তোরাব আলি মুন্সির আগমন নিঃসন্দেহে ইতিবাচক। তবু কেন যেন খুশি হতে পারে না সেরাজুদ্দিন। কিন্তু কিছু একটা না বললেও মেয়ে ভুল বুঝতে পারে ভেবে বললো, কী কইলো মুন্সি?
- দিন তারিখ ঠিক করনের কথা কইলো।
মেয়ের কথা প্রসঙ্গে কিছু বলতে ইচ্ছে হয় না তার। এখন শরীরটা পরিষ্কার না করলেই নয়। মেয়ের কথার ধারে কাছে না গিয়ে সে বললো, লুঙ্গি আর গামছাডা দে চাইন! বাংলা সাবানডাও দিস।

লুঙ্গি-গামছা আর বাংলা সাবান নিয়ে অন্ধকারেই সে পুকুর ঘাটে যায়। খুঁটির ওপর লুঙ্গি গামছা রেখে পানিতে নামে। একটি ডুব দিয়ে উঠে ফিরে আসে ঘাটলার কাছে। অন্ধকারে হাতড়েই বাংলা সাবান হাতে নিয়ে পুরো দেহে ভালো করে ঘষে ঘষে ফেনা তুলতে আরম্ভ করে। বাংলা সাবান সাধারণত শরীরে মাখার জন্য তৈরি করা হয় না বলে তাতে ক্ষার বা সোডার পরিমাণ বেশি থাকার কারণেই হয়তো নাজুক চামড়ায় লাগলে কুটকুট করে। সেরাজুদ্দিনের শরীরের বিশেষ বিশেষ অংশে কুটকুটানোর অনুভূতি হলেও সে হাতে পানি নিয়ে গায়ে দিয়ে সাবানের ফেনা বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে শরীরও ডলে। শেষে পানির আরো গভীরতার দিকে নেমে গিয়ে পরনের লুঙ্গি খুলে তা দিয়ে পুরো শরীর ডলতে থাকে। কাপড়ের ঘষায় শরীরের কোথাও কোথাও জ্বলুনি হলেও গা করে না সে। আরো জোর দিয়ে চেপে চেপে ডলতে থাকে পুরো শরীর। স্টেশনের অন্ধকারাচ্ছন্ন বগিতে বিসর্জন দিয়ে আসা শুচিতার বদলে আহরণ করা পাপের কালিমা পুরোপুরিই নিশ্চিহ্ন করে ফেলতে চায় ঘষে ঘষে।



বাংলাদেশ সময়: ১৭১৬ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৪, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।