ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১১ পৌষ ১৪৩১, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

লেক ওন্টারিওর নায়গ্রা দুর্গ | সাদিয়া মাহ্জাবীন ইমাম

ভ্রমণ / শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩২৯ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৬, ২০১৪
লেক ওন্টারিওর নায়গ্রা দুর্গ | সাদিয়া মাহ্জাবীন ইমাম ছবি: লেখক

সেনাপতির পরিচয় তার অস্ত্র ও পোশাকেই থাকে। কিন্তু এই দুর্গের সেনাপতি কিছুটা অন্যরকম বলেই প্রশ্ন এসেছে, সে আসলে যুদ্ধটা কাদের হয়ে করছে।

জানতে চাওয়ার পর তরুণ সেনাপতি হাসতে হাসতে বললো তার পোশাক ফরাসী, বন্দুক ব্রিটেনে তৈরি আর জন্মেছে যুক্তরাষ্ট্রে, এবার বুঝে নাও কাদের হয়ে যুদ্ধ করছি। এতটুকু খুদে পর্যটকও এমন জবাবে হেসে উঠেছে। সেনাপতির সাথে ছবি তোলার পর সে ব্ল্যাংক ফায়ার করে দেখালো কিভাবে বন্দুক চালাতে হয়। এই বন্দুকের শব্দ বেশি, কানে হাত দিলে সে নির্ভয় দিলো। আমরা এসেছি ওল্ড ফোর্ট নায়গ্রা নামের ঐতিহাসিক এক দুর্গ দেখতে। এখানে তিন দেশের পোশাক পরে তিনজন সেনাপতি দাড়িয়ে আছে। দর্শকরা তাদের সাথে ছবি তুলছে বিনা পয়সায়। যদিও এ জায়গার ইতিহাস কয়েক হাজার বছর আগের কিন্তু দুর্গটা তৈরি হয়েছে ১৭২৬ সালে। তবে প্রস্তুতিটা শুরু হয়েছিল মাত্র একজন মানুষের ইচ্ছে থেকে অথচ এই দুর্গই একসময় ইউরোপ-আমেরিকার ভাবনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাঁড়িয়েছে। ‘রেনে রভার ক্যাভিলার’ নামের এক ফরাসী পর্যটক ১৬৭৮ সালে এদিকটায় ঘুরতে আসেন। গ্রেট লেক, মিসিসিপি অঞ্চল ঘুরে ঘোষণা করেন এসব অঞ্চল ফ্রান্সের লোকালয় কেন্দ্র করে তৈরি হয়েছে। ব্যাস সেই থেকে শুরু হয়ে গেল নায়গ্রা দুর্গ তৈরির ইচ্ছে। তখনই দখল নিয়ে ফোর্ট কন্টি নামের এক ছোট দুর্গ এখানে তৈরি করে ফ্রান্স। এরও কয়েকবছর আগে ১৬২৬ সালে এ অঞ্চলে প্রথম এক ইউরোপীয় এসে নায়গ্রা দেখে মন্তব্য করেছিলো, ইউরোপের জন্য এ এক নতুন পৃথিবী। সে সময় ওনোনডাগা, সেনেকা, ইরোকয় নামের নেটিভ আমেরিকানরা এই লেকে মাছ ধরতো। যদিও বছরের প্রায় অর্ধেক সময় এই পানি জমে থাকতো বরফ হয়ে। এ অঞ্চল থেকে পাথর নিয়ে অস্ত্র বানাতো নেটিভরা, কালো পাথর আর পানি ছিল তাদের শক্তি। এ অঞ্চলের মালিকানা ছিল শুধুই নেটিভদের। কিন্তু তখন কি জানতো সেই পাথরের উপর দুর্গ হবে একদিন আর এখানকার বাতাসে ভাসবে শুধুই বারুদের গন্ধ! সুন্দর আর প্রয়োজন যে নিজেই নিজের জন্য বিপদজনক তারই উদাহরণ এই ওল্ড ফোর্ট নায়গ্রা।



সেনাপতির সাথে ছবি পর্ব শেষ হলে মূল দুর্গের দিকে গেলাম। আকারে খুব একটা বিশাল কিছু নয় কিন্তু এর ভেতর যে ইতিহাস—রাজনৈতিকভাবে তা গুরুত্বপূর্ণ। আসার সময় কামান ঘরের পাশে দেখেছি তিনটি পতাকা উড়ছে। এখানে রোজ নিয়ম করে ফরাসী, ব্রিটেন আর যুক্তরাষ্ট্রের পতাকা তোলা হয়। পাথর আর কাঠ দিয়ে তৈরি দুর্গের ভেতর প্রবেশ করে নিচের তলাতেই রয়েছে মূল চমকটা। ছোট ছোট প্যাসেজ দিয়ে অন্ধকার ঘরগুলোর দিকে এগিয়ে যেতে হয়। প্যাসেজের অন্ধকার আর নীরবতায় গা ছমছম করে উঠে। এখানে নাকি ন্যাশনাল জিওগ্রাফি চ্যানেল ঘোস্ট হান্টিংয়ের ওপর ডকুমেন্টরি বানিয়েছে। তাদের দাবি রাতের বেলা নানারকম ছায়া দেখা যায়, শব্দও শোনা যায়। অবশ্য হতেও পারে, এইত কয়েক বছর আগে নাকি দুর্গের একপাশ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে ২৬টি কংকাল। ধারণা করা হয় এখানে কোন এক গণহত্যার ঘটনা ঘটেছিল তবে সেই কংকালগুলো কোন দেশের সেনা বা যুদ্ধবন্দীদের তা এখনো জানা যায়নি।



এক একটা ঘর ২০ ফুট বাই ২০ ফুটের মতো। তার ভেতর শত শত বছর আগে ব্যবহার করা সৈন্যদের আসবাবপত্র। কাঠের খাটিয়াগুলো মার্কিন কাপড় আর বন্যপ্রাণীর চামড়া দিয়ে মুড়ে রাখা। সিন্দুকের মতো কাঠের নকশা করা বাক্স। পাশের টেবিলে লেখার সরঞ্জাম আর পানীয় পানের নানা মাপের পাত্র। চা, কফি খাবার কাপগুলো বেশ দর্শনীয়। আকারে বেশ ছোট আর এক একটা ভিন্ন ভিন্ন ধাঁচে তৈরি। পাথরের ফায়ার প্লেসের পাশে কয়লা তোলার হাতল আর এ্যালুমিনিয়ামের বালতি। বহু বছর আগের অর্ধ ব্যবহৃত জ্বালানিগুলো সাজিয়ে রাখা হয়েছে। আগুনে পুড়ে ফায়ার প্লেসের ছাদ কালো হয়ে আছে আর চারপাশটা লালচে রঙের। ফায়ার প্লেসগুলো রুশ গল্পের বর্ণনার মতো। এর পাশেই হ্যাঙ্গারে ঝুলছে সৈন্যদের পোশাক। সেইসব পোশাকে কোথাও কোথাও ধুলোর আস্তরণও অবশ্য রয়েছে। তবে এসব কিছু থেকে পর্যটকের চোখ চলে যাবে আগে জানালার দিকে। আর যদি পর্যটক ঘরের দরজার সামনে থেকেই জানালার ওপাশে রঙটুকু দেখেই ফিরে যায় তাহলে জানবেই না কি আশ্চর্য এক ভূগোল না দ্যাখা রইলো। এর মধ্যে একটা চড়ুই পাখি ফুরুৎ করে উড়ে বেড়িয়ে গেল জানালা দিয়ে। আমি কাঠের পাল্লা সরিয়ে আবিষ্কার করলাম কার্ণিশের দিকে পাখির বাসাটা। সেখান থেকে ঘরের ভেতর উড়ে আসছে পর্যটকদের দেখতে। দেখা শেষ হলে আবার উড়ে যাচ্ছে, যেন পাহারাদারের মতো সবার দিকে নজর রাখাই তার কাজ। জানালার কাচে নানা রকম রঙিন নকশা। এর পাল্লা এটে দিলে ওপাশ থেকে রোদ পড়ে ঘরের ভেতর আলপনা মতো হয়ে যায়। এবার নিচের দিকে তাকিয়ে হতভম্ব হয়ে গেলাম। এতক্ষণ ধরে দেয়ালের গায়ে পাথরে লেখা বিভিন্ন ফলক পড়ছি, গোলা-বারুদ, খাটিয়া দেখছি কিন্তু এ কি! জানলার বাইরে যেন এক সমুদ্র। লেক ওন্টারিও।



ভারতের জয়পুরে শিশমহলের সামনে জাফরানের বাগান বানানো হয়েছিল সুগন্ধের জন্য। আর সেই বাতাস বয়ে আসার জন্য খনন করা হয়েছিল জলাধার। যেন পাহাড় থেকে বাতাস সেই জলের সাথে মিশে শিশমহলে প্রবেশের সময় জাফরানের সুগন্ধ নিয়ে আসে। আর এখানে দুর্গের পাশে বইছে লেক ওন্টারিওর নীল স্রোত। সেই জল থেকে উঠে আসা শীতল বাতাস বয়ে যাচ্ছে পাথরের দুর্গের ভেতর। দুপুর বেলা রোদ উঠলে শিশমহলের কাচের দেয়ালে তার প্রতিফলন হয় আর এখানে ওন্টারিওর পানিতে রোদ পড়ে দুর্গের জানলার কাচে এসে দাঁড়ায়। ওন্টারিওর পানির সাথে মিশে আছে নায়গ্রা নদীর স্রোত। ইরি থেকে ওন্টারিও পর্যন্ত বইছে নায়গ্রা। নায়গ্রার নামকরণের সাথে জড়িয়ে আছে স্থানীয় আদিবাসীদের দুটি শব্দ ‘নায়েগাগারিগা’ ও ‘ওনিগুইহারা’। প্রায় হাজার বছর আগে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ওন্টারিও থেকে আদিবাসীরা এখানে যখন আসে তাদেরও আগে বসবাসরত নেটিভ আমেরিকানরা তাদের নাম দিয়েছিল ‘ওনিগুইহারা’। ধারণা করা হয় এই দুটি নাম মিলিয়ে হয়েছে নায়গ্রা শব্দ। ফরাসীরা এ অঞ্চলের দখল নেওয়ার পর এই আদিবাসীদের নাম দিয়েছিলো ‘নিউট্রাল’। নায়গ্রা জলপ্রপাতকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা এই আদিবাসীদের সংখ্যা ১৬ শতক পর্যন্ত ছিল প্রায় ৪০ হাজারের মতো। জলপ্রপাত থেকে এই দুর্গের পথ ৩০ মিনিটের। পথে পড়বে নায়গ্রা স্টেট পার্ক। সেই পার্কের রেলিং ধরে দাড়ালে দ্যাখা যায় স্রোত স্থির হয়ে এসেছে এপাশে। দুই পাশে পাথরের পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে বয়ে যাচ্ছে আরেক শান্ত নায়গ্রা। এর উপর টেনে দেয়া ব্রিজ দিয়ে আমেরিকা-কানাডা সড়ক পথের যোগাযোগ। একটা ব্রিজ পার হয়ে গেলেই অন্য দেশের মাটি। ১৬ শতক পর্যন্ত এ অঞ্চলের স্থানীয় নেটিভ আমেরিকানরা এ নদীকে ডাকতো ‘নায়েগাগারিগা’ নামে। এই জলপ্রপাত তৈরি হয়েছে চলার পথে বাধা থেকে। গ্রেট লেক ইরি থেকে পানি আরেক লেক ওন্টারিওতে প্রবাহের পথে কঠিন শিলার কারণে পানির প্রবাহ নদীর তলদেশে কোনো ক্ষয় করতে না পারায় তলদেশের উচ্চতায় তারতম্য হয়ে পানি প্রবাহ এক সময় পতনের মুখোমুখি হয়। পানির গর্জন তা থেকে তৈরি মেঘের জলকনা আর অনেক উপর থেকে পড়া প্রবাহই এর মূল আকর্ষণ। মূল জলপ্রপাত থেকে দুর্গে যাওয়ার পথে একটি জায়গা রয়েছে যাকে বলা হয় হোয়াইট হেভেন। এখানে পানি একেবারে সাদা আর স্রোতের মাঝে মাঝেও গাছ দাঁড়িয়ে থাকায় পানির ঘূর্ণন তৈরি হয়েছে। নায়গ্রার আরেক মজা হলো এর স্রোত। বিভিন্ন জায়গায় এর রং বদলেছে যেমন তেমনি বদলেছে চলার পথের গতি।

দুর্গের জানলা থেকে ঝুঁকে দাড়ালে নিচে পড়ে যাবার ভয় যেমন আছে তেমনি রয়েছে চোখের সামনে আশ্চর্য এক ভূগোল। বা দিকটাতে আমেরিকা, সামনে ওন্টারিও আর ডান দিকে শুরু হয়েছে কানাডার লোকালয়। পানির উপর দখল রেখে যুক্তরাষ্ট্র আর কানাডার মতো দু’ দেশের প্রবেশ দ্বারে নজর রাখতে এমন জায়গা আর দ্বিতীয়টি নেই। এই দুর্গে প্রবেশের পথটা খুব কৌশলী। ২৫০ একরের দুর্গে প্রবেশের পথ একটি মাত্র কাঠের পুল। সেটা আবার ভেতর থেকে চেন টেনে আটকানো থাকে। শত্রুপক্ষের আগমন আশঙ্কা দেখলেই সেই পুল তুলে নেয়া হতো। এতে মূল জনপদ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে যেত ওল্ড ফোর্ট নায়গ্রা। আড়াইশ একর জমিই ঘিরে রাখা হয়েছে কামান বসিয়ে। অর্থাৎ পুল টেনে দুর্গ বিচ্ছিন্ন করে গোলাকৃতির ভূমির চারপাশ থেকে কামানের গোলা ছুড়লে শত্রুর ফিরে যাওয়া ছাড়া গতি নেই। এখানে পাথরের প্রবেশদ্বারে খোদাই করা Porte Des Cinq Nations.1678-1759.



দুর্গের নিচতলায় সভাকক্ষ আর খাবার ঘর। হল ঘরের দীর্ঘ-লম্বা কাঠের টেবিলের চারপাশে চেয়ারগুলো একই রকম করে সাজিয়ে রাখা। ইচ্ছে করলে পর্যটকরা প্যাকেজে খাবার আয়োজন করতে পারে তবে সে ক্ষেত্রে আগে থেকে কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করতে হবে। রান্নার অনুমতি নেই। আসার আগে বলে রাখলে এখানকার কুকরা আদিবাসীদের খাবারের মেন্যু থেকে আপনার জন্য তৈরি করবে লাঞ্চ। অলাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসেবে রক্ষণাবেক্ষণ করা এই দুর্গ কর্তৃপক্ষ বিশেষ করে স্কুল শিক্ষার্থীদের স্টাডি ট্যুরের জন্য এ ব্যবস্থা রেখেছে। আমাদের দলের কেউ কেউ সভাকক্ষের টেবিল-চেয়ারে বসে ফটোসেশন করলো। পেছনে বাঁধাই করা বাফেলো অঞ্চলের ইতিহাসবিদ, সমাজ সংস্কারক ফ্রাঙ্ক এইচ সেভারেনের লাল জ্যাকেট পরা ছবি ঝুলছে।   দ্বিতীয়, তৃতীয় তলায় কাঠের পাটাতনের উপর হল ঘর, প্রার্থনার কক্ষ এবং ক্যাপ্টেনের থাকার বন্দোবস্ত। সবুজ বেদীর উপর প্রতিষ্ঠিত যিশু মূর্তিটির দিকে তাকালে বোঝা যায় এটি শত বছরের পুরনো। যুদ্ধবাজ, জমির দখল নেয়া সৈন্যরা যথেষ্ট ধর্মপ্রাণ ছিলেন বলেও প্রমাণ পাওয়া যায় দেখা যাচ্ছে। প্রতি তলায় যাবার জন্য কাঠের ঘোড়ানো সিঁড়ি ঘরের দু’পাশ দিয়ে উঠে গিয়েছে। এর একটি উপরে ওঠার জন্য অন্যটা নেমে আসার।

দুর্গের ভেতরে-বাইরে নানা রকম গোলা বারুদের স্তূপ। সৈনিকদের বিছানার উপর কোমরবন্ধনী, গ্লাভস, ব্যাগ এমন করে মেলে রাখা হয়েছে যেন যে কোন মুহূর্তে সে ফিরে এসেই যুদ্ধের জন্য তৈরি হবে। প্রবেশের মুখেই সেই সৈনিক যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল তার পেছনে বিশাল এক কামান। ১৮ থেকে ২০ শতক পর্যন্ত ৩ দেশের সেনারা বিভিন্ন পর্যায়ে ব্যবহার করেছে এই দুর্গ। দুর্গের ভেতর থেকে বের হয়েই ডান দিকে পড়ে ছোট ছোট দুটো কালো ক্যাসেল, সেটা রসদাগার আর রান্নার জায়গা। তার পেছনে পাথর কেটে বানানো চিকন সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেলেই  যুক্তরাষ্ট্রের বন্দর এলাকা। ধারণা করা যায় প্রতিদিন ব্যবহারের পানি ওই পথ দিয়ে নেমে সংগ্রহ করা হতো আবার সৈন্যরা ইচ্ছে করলে এ পথ দিয়ে নেমে নৌকায় করে লেক ওন্টারিওতে যেতে পারতো। আর দুর্গের ডান দিকে ওন্টারিওর গা ঘেঁষে গাছের নিচে বিশাল বেদী। সেই বেদীতে একসাথে অন্তত ৫০ জন বসতে পারে। বেদীর মতো দেখতে জায়গাটা আসলে স্মৃতিফলক। ১৮১২ সালে নায়গ্রা ফোর্ট দখল নিয়ে ব্রিটেন আর যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে যুদ্ধে নিহত সৈন্যদের স্মরণে তৈরি। বেদীর হেলান দেয়া দীর্ঘ পাথরের গায়ে খোঁদাই করা আছে দুইশ বছর আগের সেই ইতিহাস। বেদীর সামনে খোলা প্রান্তর যার এক কোনায় প্যারেড গ্রাউন্ড যেখানে উড়ছে তিন জাতীর পতাকা আর বেদীর পেছনেই বইছে লেক অন্টারিওর নীল স্রোত। এই বেদী আরেকটি কারণে বিখ্যাত। যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন ১৮১২ সালে যুদ্ধের পর লেক ওন্টারিও ব্যবহারে নিজেদের মধ্যে আইন তৈরি করে। এই জলসীমায় কার কতটা অধিকার আর কোন দেশ কী পরিমাণ অস্ত্র এখান দিয়ে আনা নেয়া করতে পারবে তা নির্ধারণ করেই এ চুক্তি। মার্কিন কূটনীতিবিদ রিচার্ড রুশ আর ব্রিটিশ কূটনৈতিক চার্লস ব্যাগোটের মধ্যে এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল বলে এর নাম রুশ-ব্যাগোট ট্রিটি। বেদীর দুপাশে দুজনের ছবি খোদাই করে লেখা আছে সেইসব কথা। পর্যটকরা কেউ কেউ ছবি তুলছে, কেউ বেদীতে বসে পড়ছে ইতিহাস। ১৮১২ সালের যুদ্ধটাই ছিল এই দুর্গ থেকে পরিচালিত শেষ যুদ্ধ। এরপর থেকে একে বর্ডার পোস্ট হিসেবে ব্যবহার করা হতো। আমি দেখলাম দূরের লাইট হাউজটা এখন অব্যবহৃত। আগাছা উঠেছে দেয়ালে গা জড়িয়ে। দু’একটা গাছ বেয়ারার মতো বেড়ে ঢেকে রেখেছে তার অনেকখানি সাদা দেয়াল।



আড়াইশ একর জায়গা প্রখর রোদের ভেতর হেঁটে ঘুরে দ্যাখা কম পরিশ্রমের কাজ নয়, পায়ের গতি শ্লথ হয়ে এলে দুর্গের দেয়ালের পাশে বসেই বিশ্রাম নিলাম। মনের ভেতর একটা কথাই ঘুরপাক করছে। একসময়ে নেটিভ আমেরিকানরা এই অঞ্চলের জল ব্যবহার করতো অবাধে, বনভূমি থেকে সংগ্রহ করতো ফলমূল। পাথর দিয়ে বানাতো বন্যপ্রাণী শিকারের অস্ত্র সেই জায়গা এসে দখল নিয়েছে ফরাসী, ব্রিটিশ তারপর যুক্তরাষ্ট্র সরকার। এই দুর্গে একসময় যুদ্ধের পরিকল্পনা হতো টেবিলের উপর চামড়ায় তৈরি মানচিত্রে দাগ কেটে কেটে। রাতের বেলায় বসতো পানীয় ও নাচের আসর। এখান থেকেই সেনেকা গোষ্ঠীদের প্রতিহত করার জন্য পরিচালিত হয়েছিল নির্মম হামলা। ফরাসীদের পর ব্রিটিশরা দুর্গ দখল করলে তাদের সাথে নেটিভরা সহযোগিতা করেছিল। তখন আমেরিকার সরকার ১৭৭৮ সালে নেটিভদের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান শুরু করে। তাদের ফসলের মাঠ পুড়িয়ে দেয় আর নারী-শিশুর সামনে ধরে এনে হত্যা করে তার স্বামী-পিতাকে। আবার ১৬ শতকের প্রথমার্ধে সেনেকারা নায়গ্রার পূর্ব উপকূল দখল করলে স্থানীয় এক ওয়েনরো  গোষ্ঠীর নেতা প্রাণভয়ে পালিয়ে এসে আশ্রয় নেয় ফরাসী সেনাদের কাছে। সেনেকারা অভিযোগ করে ‘নিউট্রাল’ নামে ফরাসীদের কাছে পরিচিত আদিবাসী গোষ্ঠি তাদের নেতাকে হত্যা করেছে। এরপর স্থানীয় আদিবাসীদের মধ্যে শুরু হয় দ্বন্দ্ব যুদ্ধ যার সুযোগটা গ্রহণ করে ফ্রান্স।



এই সেই নায়গ্রা দুর্গ যা ভৌগলিক কারণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল ফ্রান্স, ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্রের কাছে। আমেরিকা-স্পেন যুদ্ধের সময় এই দুর্গ ব্যবহৃত হতো সৈনিকদের প্রশিক্ষণের জন্য। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সময়ে এখানে রাখা হতো যুদ্ধবন্দী সৈনিকদের। কোরিয়ান যুদ্ধে এটি ব্যবহৃত হতো এ্যান্টি ক্র্যাফট আর্টিলারি ও মিসাইল রাখার জন্য। ৩শ বছরে লেক ওন্টারিওর পাশে এই ছোট্ট জায়গাটিতে কম পট পরিবর্তন হয়নি। প্রায় আড়াইশ বছর ধরে এই দুর্গের প্রতিটি জায়গায় ছিল শুধু দখল আর যুদ্ধের স্মৃতি। অথচ সাম্রাজ্যবাদ, লুণ্ঠন, হত্যা নির্মমতার এই স্মৃতিচিহ্নের কত কাছে বইছে পৃথিবীর আশ্চর্য এক জলপ্রপাত নায়গ্রা। ১০ হাজারেরও বেশি সময় আগে বরফ যুগে উইসকনসিন্স গ্লেসিয়ার গলে শুরু হয়েছিল এর প্রথম প্রবাহ। বর্ষাকালে নায়গ্রায় প্রতি সেকেন্ড ১ লাখ কিউবিক ফিট পানি পড়ে। তবে বেশিরভাগ পর্যটক নায়গ্রা দেখেই এ অঞ্চল থেকে ফিরে যান, তার সাথে যে আরো কত কত ইতিহাস আর কালের কথা রয়েছে অনেকেরই জানা হয় না। প্রবেশমূল্য মাত্র ১২ ডলার। দুর্গ ঘুরে দেখা ছাড়াও এখানে রয়েছে আর্কাইভের অডিও ও ভিডিও ক্যাসেটে ইতিহাস বর্ণনা। ঘোস্ট হান্টেড প্রোগ্রাম আর স্বেচ্ছা সেবায় অংশগ্রহণের সুযোগ। এই স্বেচ্ছা সেবা প্রোগ্রামে যে কেউ দুর্গের ইতিহাস সংরক্ষণে নানাভাবে অংশ নিতে পারে। রান্না করা, কাপড় সেলাই, অর্থ সংগ্রহ থেকে শুরু করে ট্যুর গাইড হিসেবেও কাজ করার সুযোগ পায় যে কেউ। আসলে পৃথিবীর সব দুর্গই হয়তো কোনো একদিন ধুলোর সাথে মিশে যেতে পারে কিন্তু এর ইতিহাসত বদলাবার নয়। এখানে ইতিহাস এমনভাবে তুলে ধরা রয়েছে, এই পাথরের দুর্গের মাটিতে পা রাখলে যে কোনো পর্যটকেরই মনে হবে, সে দাঁড়িয়ে আছে এর প্রথম নির্মাণ সময়, ফরাসী-ব্রিটিশ সেনাদের যুদ্ধের সেইসব দিন আর ওন্টারিও লেকের পাশের আদিবাসীদের স্বপ্ন ভঙ্গের ব্যথার সঙ্গে।



বাংলাদেশ সময়: ১৩৩০ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৬, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।