ঢাকা, শুক্রবার, ১২ পৌষ ১৪৩১, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

প্রতিদিনের ধারাবাহিক

টানেল | এর্নেস্তো সাবাতো (২১) || অনুবাদ : আলীম আজিজ

অনুবাদ উপন্যাস / শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭৩০ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৯, ২০১৪
টানেল | এর্নেস্তো সাবাতো (২১) || অনুবাদ : আলীম আজিজ অলঙ্করণ: মাহবুবুল আলম

এর্নেস্তো সাবাতো (২৪ জুন ১৯১১-৩০ এপ্রিল ২০১১) আর্জেন্টাইন লেখক এবং চিত্রকর। লেখালেখির জন্য পেয়েছেন লিজিওন অফ অনার, মিগুয়েল দে সেরভেন্তেস পুরস্কার।

এছাড়াও তিনি ছিলেন লাতিন আমেরিকান সাহিত্য জগতের বেশ প্রভাবশালী লেখক। তাঁর মৃত্যুর পর স্পেনের এল পায়েস—তাঁকে উল্লেখ করেন ‘আর্জেন্টিনাইন সাহিত্যের শেষ ধ্রুপদী লেখক’ বলে।
‘এল তুনেল’ (১৯৪৮), ‘সবরে হেরোস ইয়া টুম্বাস’ (১৯৬১), ‘অ্যাবানদন এল এক্সতারমিনাদোর’ (১৯৭৪) তাঁর জগদ্বিখ্যাত তিন উপন্যাস।

২০তম কিস্তির লিংক

কিন্তু হায়! সুখের সময় এত দ্রুত ফুরিয়ে যায়... ওই দখলদারীর বোধ, প্রসঙ্গ হিসেবে, সবচেয়ে দুর্বল পর্যালোচনাও মোকাবেলা করতে সক্ষম হবে না। আমি এটা কী করে ভাবি যে ওর স্বামী ওকে শুধু মারিয়া বলে ডাকে না? আর এটা খুব নিশ্চিত করেই বলা যায় ওই হান্তের ব্যাটাও ওকে ওই নামেই ডাকে। আরও কোনো নামেও কি ডাকে? আর দরজা বন্ধ করে যাদের সঙ্গে কথা বলে ও, তারা? নিঃসন্দেহে বলা যায় বন্ধ দরজার আড়াল থেকে যাদের সঙ্গে কথা বলে ও—তারা ওকে সমীহ করে ‘সিনোরিতা ইরিবার্নে বলে ডাকতে যাবে না।

সিনোরিতা ইরিবার্নে! এখন আমার কাছে এটা পরিষ্কার হল প্রথম যেদিন ওকে ফোন করেছিলাম। কাজের মহিলাটা কেন ওরকম দ্বিধা করছিল। কি অস্বস্তিকর! এটা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, প্রথমবার যখন কেউ ফোন করে কুমারী ঠাউরে ‘সিনোরিতা ইরিবার্নেকে’ চেয়েছে বিস্মিত কাজের মহিলা স্বয়ংক্রিয়ভাবেই তাকে সংশোধন করে দিয়েছে, তার মালকিন বিবাহিতা, ‘সিনোরা। ’ কিন্তু বেশ কবার এরকম ঘটার পর, সে হয়তো মৃদু কাঁধ ঝাঁকিয়ে, সিদ্ধান্ত নিয়েছে আর গা না করার। আমার ফোনে সে কারণেই হয়তো ভৃত্যমহিলা ইতস্তত করছিল— এবং ওরকম করাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু কষ্ট করে সে আর আমার ভুল ভাঙানোর ঝামেলায় যায়নি।

চিঠিটা আবার মনোযোগ দিয়ে পরীক্ষার পর, আমি এই সিদ্ধান্তে পৌঁছুলাম— এই চিঠিতে যথেষ্ট ফাঁক-ফোকড় আছে। সবচেয়ে বড়টা দিয়েই আগে শুরু করি: যে কায়দায় আমাকে চিঠিটা দেওয়া হয়েছে। কাজের মহিলা যে অজুহাতের কথা জানিয়েছে সেটা আমার ভালোই মনে আছে: ‘আপনার ঠিকানা তার জানা নেই, উনি দুঃখিত এটা আপনাকে জানাতে বলেছেন। ’ এটা সত্যি কথা: আমার কাছে ও ঠিকানা জানতে চায়নি, আমারও ওকে ঠিকানা দেওয়ার কথা মাথায় আসেনি। কিন্তু ওর জায়গায় আমি হলে, প্রথম যে কাজটা করতাম তা হল টেলিফোন ডাইরেক্টরিটা নিয়ে ফোন নম্বরটা খুঁজে বের করতাম, এরপর বাকিটুকু তো খুবই সহজ। কিন্তু এখন এটা বিশ্বাস করা খুবই কঠিন যে, সে এতটাই অলস এই সামান্য পরিশ্রমটুকু করার ইচ্ছেও হয়নি তার; এই উপসংহার এখন এড়ানো যাবে না: মারিয়া নিজেই চেয়েছে আমি ওই বাড়িতে আসি এবং ওর স্বামীর মুখোমুখি হই। কিন্তু কেন? এই জায়গায় এসে, বিষয়টা আরও জটিল আকার ধারণ করেছে। একটা সম্ভাবনা হতে পারে স্বামীকে মধ্যস্থতাকারী বানানোটা মারিয়া উপভোগই করছে। উল্টোটা হতে পারে, যে স্বামীটিই হয়তো এটা করে আনন্দ পেয়েছে। আবার দুটোই হতে পারে। এর সঙ্গে রোগের প্রকৃতি নিণর্য়ের ব্যাখ্যা যোগ করা হলে, আরও একটা সাধারণ সম্ভাবনা বেরিয়ে আসছে: মারিয়া এভাবে হয়তো আমাকে জানাতে চেয়েছে যে সে বিবাহিতা, যাতে আমি বুঝে নেই যে, এই সর্ম্পক বেশি দূর গড়াবে না।

আমি নিশ্চিত যারা আমার এই পৃষ্ঠাগুলো পড়ছে তাদের কাছে তৃতীয় ব্যাখ্যাটাই বেশি গ্রহণযোগ্য মনে হবে, সঙ্গে এই উপসংহারেও পৌঁছাবে যে, কেবল আমার মতো লোকের পক্ষেই সম্ভব বাকি দুটো ব্যাখ্যা থেকে যে কোনো একটা পছন্দ করে নেওয়ার। জীবনের একটা সময়ে যখন আমার অনেক বন্ধুবান্ধব ছিল, তখন ওরা প্রায়ই হাসাহাসি করত সব সময় আমার জটিল দুরূহ পথ বেছে নেওয়ার প্রতি আগ্রহ দেখে। যে কারণে আমি নিজেকে জিজ্ঞেস করতাম, বাস্তবতা কেন এত সরল হবে। আমার অভিজ্ঞতা তো আমাকে সম্পূর্ণ উল্টো শিক্ষা দিয়েছে; এটা কখনোই তত সরল না, যখন কোনো একটা ব্যাপার অস্বাভাবিকরকম পরিষ্কার মনে হয়, যখন কোনো কাজ অতি সরল কোনো যুক্তি অনুসরণ করে চলে, তখন বুঝে নিতে হবে এর পেছনে জটিল একটা কোনো অভিসন্ধি রয়েছে। এটা অতি সাধারণ একটা উদাহরণ। আর যে সব লোক পরহিতে দান করে—সাধারণভাবে লোকজন তাদেরকে—যারা দান-খয়রাত করে না—তাদের চেয়ে অনেক সজ্জন আর উদার বলে মনে করে। অতি সরলীকরণ এই ধারণার ব্যাপারে আমার তীব্র ক্ষোভ রয়েছে। এটা যে কেউ জানে তুমি চাইলেই দুটো পয়সা কিংবা এক টুকরো রুটি দিয়ে ভিক্ষুক (সত্যিকারের ভিক্ষুক) সমস্যার সমাধান করে ফেলতে পারবে না। এতে কাজের কাজ যা হয় তা হল, লোকটার কিছু মানসিক সমস্যার সমাধান হয়, দান-খয়রাতের বিনিময়ে তার কিছু সুনাম জোটে, মনে খানিকটা শান্তি আসে, এটুকুই, প্রকৃতপ্রস্তাবে কিন্তু ফলাফল শূন্য। তুমি নিজেই একবার বিচার করে দেখো মনের শান্তি আর আত্মপ্রসাদ লাভের ওই লাভটুকুর জন্যও যখন এই মানুষগুলো স্বপ্রণোদিত হয়ে ওই এক পয়সার বেশি এক কানাকড়িও খরচ করতে রাজি হয় না তখন কি পরিমাণ কৃপণ তারা। এই ভণ্ডামির (আর কঞ্জুসপনার) চর্চা বাদ দিয়ে মানুষের এই দুর্দশা লাঘবে কী পরিমাণ নিখাদ ভালোবাসা আর সাহসের প্রয়োজন।

আমি চিঠিতে আবার ফিরে আসতে চাই।
একমাত্র অতি সরলমনা মানুষই কেবল তৃতীয় ব্যাখ্যাটার পক্ষে যুক্তি খাড়া করার চেষ্টা করবে, কারণ এটা সাধারণ দায়সারা গোছের কাছেও হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়বে। ‘মারিয়া আমাকে জানাতে চেয়েছে যে, সে বিবাহিত, এতে যাতে আমি বুঝতে পারি এই সম্পর্ক বেশিদূর এগোবো না। ’— চমৎকার। কিন্তু এটা বোঝাতে, সে কেন এরকম অতি দুরূহ আর নিষ্ঠুর পন্থার আশ্রয় নিতে গেল? সে নিজেই কি আমাকে জানাতে পারত না, সরাসরি সম্ভব না হলে টেলিফোন ছিল? মুখে বলতে যদি সাহসে না কুলাত, ও আমাকে দু’কলম লিখেও জানাতে পারত? এর চেয়ে আরও বিশ্বাসযোগ্য যুক্তি হল: ওর যদি আমাকে জানানোই উদ্দেশ্য হবে, তাহলে চিঠিতে কেন ও জানাল না যে বিবাহিত— আমি নিজে আরও যা বুঝতে পারছি; আমি যাতে ওর ঘনিষ্ঠ হতে না চেয়ে সাধারণ একজন বন্ধুর মর্যাদা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকি সে বিষয়েও একটা কোনো অনুরোধ নেই কেন? না, বন্ধু আমার। বরং এর ঠিক উল্টোটা, এই চিঠি আমাদের সর্ম্পককে আরও দৃঢ়তা দেওয়ার অভিপ্রায়ের চিঠি, এই চিঠি আগুনকে আরও উসকে দেওয়ার চিঠি, আর আমাদের আরও বিপদসঙ্কুল পথে পরিচালিত করার চিঠি।

(চলবে)

২১তম কিস্তির লিংক



বাংলাদেশ সময়: ১৭১৭ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৯, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।