ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ০২ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

গল্পটি অন্যরকম হতে পারতো | আহমেদ শরীফ শুভ

গল্প / শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮৪৭ ঘণ্টা, অক্টোবর ২১, ২০১৪
গল্পটি অন্যরকম হতে পারতো | আহমেদ শরীফ শুভ পেইন্টিং: সংগীতা চরণ

এই গল্পটি অন্যরকম হতে পারতো। হয়নি।

কারণ, আসিফ যেভাবে গল্পটি এগিয়ে নিতে চেয়েছিল মধুমিতা ঠিক সেভাবে চায়নি। গল্পটি তাই ‘অতঃপর তাহারা সুখে শান্তিতে প্রেম করিতে লাগিল’ এই টাইপের হয়নি। তাই বলে মধুমিতা যেভাবে চেয়েছে গল্পটি সেভাবেও লেখা হয়নি। হয়েছে তৃতীয় একটি ধারায়। এই গল্পে অযাচিতভাবেই নিশা চলে এসেছে। অথচ মধুমিতা এমনটা চায়নি, আসিফও না। কিন্তু মানুষের জীবন তো সব সময় নিজের কল্পনায় সাজানো গল্পের মতো হয় না, তাই ওরা না চাইলেও বাস্তবে অবধারিতভাবেই নিশা চলে এসেছে।

আসিফ চেয়েছিল এই গল্পে শুধু সে আর মধুমিতা থাকবে। মধুমিতা চেয়েছিল ওদের দু’জনের পাশাপাশি তৃতীয় আরেকজনও থাকবে। তার বর কিংবা বয়ফ্রেন্ড। কিন্তু তৃতীয়জন হয়েছে নিশা, সম্প্রতি আসিফের প্রাইভট টিউশানির ছাত্রী থেকে যার উত্তরণ হয়েছে প্রেমিকায়। মেয়েটি দেখতে আহামরি কিছু নয়। বিয়ের বাজারে ঘটক হয়তো উজ্জ্বল শ্যামলা বলে অতিরঞ্জন করবে। কিন্তু মধুমিতার কাছে ওকে শ্যামলাই মনে হয়েছে, উজ্জ্বলতার তেমন কিছু নেই। তবে চোখ দু’টোতে কেমন যেন মায়া আর মাদক কামুকতার একটা মিশ্রণ আছে। আকর্ষণ বলতে ওইটুকুই। আর তাতেই আসিফ কাত হয়ে গেল? আশ্চর্য! সব ছেলেরাই এক। ওদের কাছে যে মেয়ের দৃষ্টিতে শরীরের আমন্ত্রণ থাকবে তাকেই ভালো লাগবে। মধুমিতা ওকে আরেকটু ম্যাচিউরড ভেবেছিল। কিন্তু তাহলে কি আর অমন একটা মেয়ের প্রেমে পড়ে! মাত্রই তো ইন্টারমেডিয়েট সেকেন্ড ইয়ারে পড়ছে। এই বয়সেই প্রেমে গদগদ। আসিফ ওকে পড়াচ্ছে না ছাই, আসলে তো ওর চোখ দু’টোতে ডুব দিয়েছে। এই মেয়ের পরীক্ষায় গোল্লা মারা কেউ ঠেকাতে পারবে না। অবশ্য পরীক্ষায় গোল্লা মারলে নিশার হয়তো কিছুই যায় আসে না। ওর আসিফকে পেলেই হলো। তার বাবা মা’র ও নিশ্চয়ই অমত হবে না। এমন ছেলে তো সব সময় এতো অনায়াসে পাওয়া যায় না।

তবে মধুমিতা যতোটুকু অবাক হয়েছে ততোটুকু অবাক হওয়ার কথা ছিল না। এমন নয় যে সে কিছুই জানতো না বা আঁচ করতে পারেনি। কথাটা আসিফ আগেও কয়েকবার বলেছে বা বলার চেষ্টা করেছে। মধুমিতা পাত্তা দেয়নি। প্রথমে ভেবেছিল ছেলেটা ওকে রাগানোর জন্য হেঁয়ালী করছে। অথবা হয়তো মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করছে। তার প্রতি মধুমিতার অলরেডি যে রকম মনোযোগ বা দৃষ্টি আছে ঠিক সে রকম না। আসিফ তার চেয়েও কিছু বেশি, তার চেয়েও গভীর কোনো দৃষ্টি প্রত্যাশা করেছিল। মেয়েরা তো সব কৌশলই জানে। ভিন্ন প্রসঙ্গ অবতারণা করে তাই সে আসিফের মনোযোগ অন্য দিকে নিয়ে গেছে। তবে ও যে এই মেয়ের সাথে প্রেমের ব্যাপারে এতো সিরিয়াস বা সত্যি সত্যি এতো দূর এগিয়েছে তা বুঝতে পারেনি। আসিফ অবশ্য বলার চেষ্টা করেছে যে সে নিজে এগোয়নি। মেয়েটা এগিয়েছে, সে সাড়া দিয়েছে মাত্র। ফলাফল তো একই, তাই না?

অবশ্য তাতে মধুমিতার কীইবা যায় আসে! সে নিজে যা নিতে চায়নি তা যদি অন্য কেউ নিয়ে যায় তাতে আক্ষেপেরই বা কী আছে! তবুও আসিফের কথায় বুকটা একটু কেঁপে উঠে। এতোদিন যা হেঁয়ালী ভেবেছে তাহলে সত্যিই কি তা সত্যি?। আসিফ বলে রেখেছিল বিকেল পঁচটায় ক্যাফে ম্যাংগো’র দোতলায় থাকতে। সারপ্রাইজ দেবে। ধানমন্ডি একত্রিশের কোণায় এই কফিশপ প্রেমিক প্রেমিকাদের আড্ডা। ঠিক প্রেমিক প্রেমিকা না হলেও ওরা দু’জন ওখানে বেশ কয়েকদিনই গেছে। শেষ দিকে মধুমিতার ভালো লাগতো না। ওখানে যারা যায় সবাই তাদের প্রেমিক প্রেমিকাই ভাবে।

ধুর! ম্যাংগোতে না। অন্য কোথাও চল। আমি কি তোর গার্লফ্রেন্ড নাকি যে ম্যাংগোতে যাবো এক সাথে?

সে সুযোগ তো আর দিলি না। হা হা হা...। বিএফ জিএফ না হয়েও আমরা তো আগেও গেছি। এ আর নতুন কি? সত্যিই আজ ওখানেই সুবিধা। অন্য কোথাও যাওয়া যাবে না।

কেন, কী সারপ্রাইজ দিবি?

তুইতো দেখি এখনো মহা গাধাই রয়ে গেলি। সরি, গাধী। আগে যদি বলেই ফেলি তাহলে সারপ্রাইজ আর হলো কই? সেটা বিকেলেই দেখবি।

আলিয়ঁস ফ্রঁসেসে একটা আর্ট এক্সিবিশন দেখে দু’জন এক সাথেই বেরুচ্ছিল। প্ল্যান ছিল কোথাও এক সাথে লাঞ্চ সেরে মধুমিতা ফিরে যাবে রোকেয়া হলে আর আসিফ সূর্যসেনে। বিকেলে একসাথে লাইব্রেরি ওয়ার্ক। কিন্তু আসিফের সারপ্রাইজের কথা শুনে মধুমিতা দ্রুতই সিদ্ধান্ত পালটে নিল। ওর সাথে আর কোথাও যেতে ইচ্ছে করছে না। বুকের মধ্যে ধুক করে উঠেছে। মনে হয় সে সারপ্রাইজটা আঁচ করতে পেরেছে। মেয়েদের একটা সিক্সথ সেন্স আছে। এ ধরনের সময়ে ভালো কাজ করে। নিজেকে হঠাৎ ভীষণ একা মনে হচ্ছে। একেবারে লোনলি। এখন বরং আসিফকে এভোয়েড করাই ভালো। ওর সামনে কোনো ইমোশন এক্সপ্রেস করা যাবে না। সারপ্রাইজটা আগেভাগে টের না পাওয়ার কোনো কারণ নেই। মধুমিতা বুঝতে পারে। কিন্তু সে বুঝেও না বোঝার ভান করার অভিনয়টা ঠিকমতো করতে পারছে কিনা তা বুঝে উঠতে পারে না। এই প্রথম তার আত্মবিশ্বাসের ভিত নড়ে উঠে। আসিফের সাথে থাকা এই সময়ে ভীষণ অস্বস্তিকর লাগবে।

তুই বরং হলে যা। আমি একটু পিয়াদের বাসা থেকে ঘুরে আসি। ও কয়দিন ধরে বারাবার যেতে বলছে। যাই যাই করে যাইনি। বিকেলে দেখা হবে ম্যাংগোতে।

হঠাৎ?

হঠাৎই মনে হলো। আগে ভুলে গিয়েছিলাম।

মধুমিতা ফিরে তাকায় না। একটা রিক্সা ডেকে উঠে পড়ে। পিয়াদের বাসা কাছেই। সাতাশের কোণায়। অবশ্য ঘুরে যেতে হবে ধানমন্ডির ভেতর দিয়ে। মিরপুর রোড দিয়ে তো রিক্সা চলে না।

ওদের সম্পর্কের বয়স প্রায় চার বছর । ফার্স্ট ইয়ার থেকে থার্ড ইয়ার। হওয়ার কথা তিন বছর। কিন্তু ছাত্র সংঘর্ষের সূত্রে বিভিন্ন সময়ে ইউনিভার্সিটি বন্ধ থাকায় আর সেশন জটের সূত্রে এটুকুতে চার বছর ছুঁয়ে যায়। এই চার বছরে ওদের সম্পর্ক যে ভাবে এগিয়েছে তাকে ঠিক কিভাবে সংজ্ঞায়িত করা যায়? নিছক ক্লাশমেট সুলভ বন্ধুত্বও নয় আবার প্রেমও নয়। বন্ধুত্বের অধিক, কিন্তু তাই বলে প্রেমের সমান ঠিক তা বলা যাবে না। প্রথম দিকে ক্লাশমেটদের অনেকেরই ধারণা ছিল হয়তো ওদের প্রেম হয়ে গেছে বা এক সময় হয়ে যাবে। ওরা দু’ জনই বন্ধুদের বুঝিয়েছে, আসলে ব্যাপারটা তেমন কিছুই নয়। কেউ কেউ নিজেদের মতো করে উপলব্ধি করেছে, কেউ করেনি। অবশ্য ক্যাম্পাসে ইদানীং ওদের মতো বেশ কিছু যুগলই দেখা যায় যারা ঠিক প্রেমিক প্রেমিকা নয়, কিন্তু বন্ধুর অধিক। তবুও শাহানা একদিন বলেছিল ‘একজন ছেলে আরেকজন মেয়ের মধ্যে কখনোই নিছক বন্ধুত্ব হতে পারে না’। মধুমিতা শুধু হেসে বলেছে, ‘দেখিস’।

শাহানা কিংবা অন্য কারোই দেখা হয়নি তেমন কিছুই। এই চার বছরেও ওরা প্রেমিক প্রেমিকা হয়ে ওঠেনি। ইউনিভার্সিটিতে প্রথম দিনের পরিচয়ের পর থেকে বন্ধুত্ব গাঢ় থেকে গাঢ়তর হয়েছে। কিন্তু কোথায় যেন এসে থমকে গেছে। আর এগোয়নি।

পরিচয়ের পর্বটা ছিল মফস্বল থেকে আসা আর পাঁচজন সাধারণ ছাত্রছাত্রীর মতো।

আমি আসিফ। বগুড়ার ছেলে।

আমার নাম মধুমিতা। কাগজে কলমে ‘জান্নাতুল ফেরদৌস’। জয়পুরহাট থেকে এসেছি।

আরে তুমি দেখছি আমার দেশি। ভালোই হলো। আমাদের ওদিককার তেমন কারো সাথে এখনো পরিচয়  হয়নি। সূর্যসেনে এক বড় ভাইয়ের রুমে উঠেছি। তুমি?

রোকেয়া হল।

দু’জনই বন্ধুত্ব বিকাশে বেশ সাবলীল। সেমিনারে যাওয়া, লাইব্রেরি ওয়ার্ক, টিএসসি’র আড্ডা, ক্লাশের ফাঁকে চায়ের কাপে চুমুক, ছুটির দিনে এখানে সেখানে ঘুরে বেড়ানো, রবীন্দ্র সরোবরে গান শোনা, ইউনিভার্সিটি বন্ধে বাড়ি যাওয়া সবকিছুই এক সাথে চলে। অবশ্য প্রায় সময়ই অন্য বন্ধুরাও সাথে থাকে। তবুও ওরা দু’জন সবার সাথে থেকেও নিজেদের নিয়ে আলাদা। একদিন কাশেম মোল্লার ছাপড়ায় চায়ের কাপে ধোঁয়া উড়িয়ে ওরা ‘তুমি থেকে ‘তুই’ হয়ে যায়।

দেখেছিস, আমরা কী সহজেই ‘তুমি’ থেকে ‘তুই’ এ নেমে গেলাম?

এটা কি নেমে যাওয়া নাকি উঠে আসা?

মানে কী?

এটাতো ফ্রেন্ডশিপের পরবর্তী ধাপে উত্তরণ। কোনো কিছুতে উত্তরণ হলে ‘নেমে যাওয়া’র বদলে ‘উঠে আসা’ বলাটা মোর এপ্রোপ্রিয়েট হবে না?

বাহ! তোর থট দেখি হাইলি ফিলোসফিক্যাল। ব্রাভো। তাহলে ‘তুই’ এ নামিনি, উঠে এসেছি। চমৎকার!

সেই থেকে ওদের সম্পর্কটা আরো কাছাকাছি হয়েছে অনেক। মধুমিতাও একদিন নামের ‘মধু’ ঝরিয়ে দিয়ে শুধু মিতা হয়ে উঠেছিল। নাম সংক্ষিপ্ত হওয়ার গল্পটা অবশ্য একটু ভালগার। টিএসসি’র এক কোণে বসে আড্ডা দেয়ার এক ফাঁকে আসিফ এক বিকেলে প্রস্তাব দেয়।

আচ্ছা, তোর নামটা ছোট করে ডাকি? ‘মধুমিতা’, এতো বড় নাম ডাকতে ভালো লাগে না।

ন্যাকামি করছিস কেন? চার অক্ষরের নাম, তাই ডাকতে তোর এতো কষ্ট! তুইকি তোতলা নাকি? তোর বউয়ের নাম যদি হয় খাদিজাতুল কোবরা বিনতে তোসাদ্দেক, তাইলে কী ডাকবি?

ধুর, হেঁয়ালী রাখ। ডাকবো কিনা বল।

কি ডাকবি, ‘মিতা’? চাইলে ডাকতে পারিস।

না, মধু।

ধুর! এটাতো গেঁয়ো শোনাবে। এই যুগে ‘মধু’ কারো নাম হয়?

কেন হবে না? সুস্বাদু জিনিসের নাম মধু হলেই তো এপ্রোপ্রিয়েট হবে। আমি তো না খেয়েই সার্টিফাই করছি। তোর জামাইও তো না খেয়ে সার্টিফাই করবে না। একবার চেখে দেখতে পারলে না হয় জাস্টিফাই করা যাবে। দিবি নাকি চান্স একটা, চেখে দেখি?

এক থাপ্পড় দেবো। তোর সাহস তো মন্দ না।

মধুমিতা কপট রাগটা চেহারায় বেশিক্ষণ ধরে রাখতে পারে না। খানিক পর দু’জনই হেসে কুটিকুটি হয়। ‘মধু’তে সন্ধি না হলেও ‘মিতা’য় আপত্তি হয় না। সেই থেকে অন্যদের কাছে ‘মধুমিতা’ থেকে গেলেও সে আসিফের কাছে ‘মিতা’ হয়ে ওঠে। কিন্তু ওই পর্যন্তই। সম্পর্কটা ওই খোলামেলা আড্ডাবাজির গণ্ডি অতিক্রম করতে পারেনি কখনোই।

দু’জনই এই সম্পর্কের ডাইমেনশন নিয়ে নিজেরা নিজেরা অনেক ভেবেছে। নিজেরা এতো কথা শেয়ার করে। কিন্তু নিজেদের এই ভাবনাটুকু খোলামেলা শেয়ার করেনি পরস্পরের সাথে। আসিফ জানে, দিনে দিনে তার একটা দুর্বলতা জন্মে গেছে মধুমিতার প্রতি। আকর্ষণ ধীরে ধীরে বাড়ে। মেয়েটি সুন্দরী, স্মার্ট এবং বুদ্ধিমতি। চোখের দৃষ্টি ভীষণ সুন্দর। তারো চেয়ে সুন্দর কথা বলার ঢং। এমন চাহনি আর আহ্লাদি কথা বলার ঢং আসিফের বুকের ভেতর কেবলি উথাল পাথাল ঢেউ তোলে। আসিফ এই ঢেউটুকু ধরে রাখতে চায়। আসিফের সবচেয়ে পছন্দ মধুমিতার ব্যক্তিত্ব। কিন্তু এই ব্যাক্তিত্বই কাল হয়েছে। আসিফ মধুমিতার প্রেমে পড়লেও তাকে বলতে পারে না। তার ব্যক্তিত্ব তাকে আকর্ষণ করে, আবার ভয়ও পায়। ভাবে, ও তাকে ফিরিয়ে দেবে। আসিফ যদিও জানে মধুমিতা তাকে খুব কাছের বন্ধু মনে করে, অন্য বন্ধুদের চেয়ে আলাদা করে ভাবে। কিন্তু কোথায় যেন একটা দেয়াল দাঁড়িয়ে আছে। সে বুঝতে পারে, মধুমিতা সম্পর্কটা ঠিক প্রেম অবধি টেনে নিতে চায় না। হয়তো তার ব্যক্তিত্বটাই লাগাম হিসেবে কাজ করে। হয়তো বা সে লাগামটা অন্য কোথাও। আসিফ প্রপোজ করতে সাহস পায় না। সে মোটামুটি নিশ্চত যে এই প্রস্তাব মধুমিতা গ্রহণ করবে না। আর একবার রিফিউজড হয়ে গেলে তখন আবার স্বাভাবিক সম্পর্কটাও বিঘ্নিত হবে। বন্ধুত্বের অপমৃত্যু না হলেও সম্পর্কের সাবলীলতা নষ্ট হতে বাধ্য। আসিফ সেই ঝুঁকি নিতে চায়নি। প্রেমের প্রস্তাব দিতে গিয়ে বন্ধুতটাই নষ্ট হয়ে যাক তা সে চায় না। তার চেয়ে অন্তত এমন একটা সুন্দর বন্ধুত্বই বরং টিকে থাক। মধুমিতাকে ছাড়া নিজের সকাল দুপুর সন্ধ্যা আপাতত ভাবতে পারে না আসিফ। ভবিষ্যতের কথা না হয় ভবিষ্যতেই ভাবা যাবে। এই সুন্দর সাহচর্যটা অন্তত টিকে থাক।

আসিফের সাহচর্য মধুমিতাও উপভোগ করে ভীষণ। সে যে তার ওপর ইমোশনালি অনেকটাই নির্ভরশীল তাও মধুমিতা বোঝে। আসিফের এই নির্ভরতা মধুমিতাকে অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসী করেছে। নিজের ওপর অন্য কেউ নির্ভর করে, আশ্রয় চায় এমনটা ভাবতে কার না ভালো লাগে! এমন ছেলের সাথে সময় কাটাতে ভালো লাগে। ডমিনেট করা যায়। নিজেকে বড় বড় মনে হয়, কখনো অভিভাবক ভাবও চলে আসে। এমন ছেলেদের বিশ্বস্ত অন্তরঙ্গ বন্ধু বা সহচর হিসেবে অনায়াসেই ভাবা যায়। কিন্তু তাদের বর বা বয়ফ্রেন্ডের ভূমিকায় ভাবা যায় না। বর বা বয়ফ্রেন্ড হবে এমন কেউ যার উপর নির্ভর করা যায়, যার কাছে আশ্রয় নেয়া যায়। সে হবে বন্ধুত্বে উদ্দাম আবার কিছুটা অভিভাবকত্বের ছোঁয়াও থাকবে সময়ে সময়ে। আসিফ এই দ্বিতীয় ভূমিকায় তেমন মানানসই নয়। এমন ছেলের প্রতি মমতা থাকে, তার ভালোবাসায় নিজেকে ঋদ্ধ করা যায়, ভালোও বাসা যায় অনেকটুকু। কিন্তু প্রেমিকের জন্য ধরে রাখা সবটুকু প্রেম তাকে দেয়া যায় না। আসিফের মতো চমৎকার বন্ধুবৎসল ছেলে সচরাচর খুব একটা দেখা যায় না। মানবিক গুণাবলীর উচ্চতায় সে হয়তোবা কিলিমানজারো কিংবা কে-টু, কিন্তু মাউন্ট এভারেস্ট থেকে একটু দূরেই থেকে যায়। মধুমিতা প্রেম শিকেয় তুলে রাখে স্বপ্নের রাজপুত্তুরের জন্য। ও নিশ্চিত জানে সে আসবে একদিন এভারেস্টের সমান উচ্চতা নিয়ে, ভালোবাসার সব পাহাড় ছাড়িয়ে। সেদিন হয়তো আসিফ অনেক কষ্ট পাবে। আসিফের কষ্টে তার নিজেরও কষ্ট হবে। যদিও আসিফ সেই রাজপুত্র নয় তবুও তার দৃষ্টিতেই মধুমিতা নিজের নারীত্বকে প্রথম আবিষ্কার করেছিল, এ কথাইবা অস্বীকার করে কিভাবে! এই সব মনে হলেই ওর আসিফের জন্য অনেক কষ্ট হয়। নিজেকে অপরাধী মনে হয়। কিন্তু তার অপরাধই বা কি? আসিফের অন্তরঙ্গ বন্ধুত্বকে প্রশ্রয় দিয়েছে বটে, তার বেশি তো কিছু নয়। সে তো নিজে থেকে কোনো আমন্ত্রণ জানায়নি।

পিয়ার সাথে আড্ডা জমেনা মোটেও। তেমন কিছু দরকারও ছিল না। আসিফকে কিছুটা সময় এভোয়েড করার জন্যই এই অজুহাত বের করেছিল। মনের মধ্যে সেই সারপ্রাইজের কথাই ঘুরে ফিরে খোঁচা দিতে থাকে। ক্যাফে ম্যাংগোতে যেতে হবে পাঁচটায়। অস্বস্তি নিয়ে হলেও মধুমিতা এই সময়টা পিয়ার সাথেই পার করে। তারপর চারটার একটু আগেই বের হয়ে যায়। আসাদগেটের আড়ং হয়ে ঘুরে যাবে। সে যতোই চাক তার আশংকা মিথ্যে হোক, আসিফ অন্য কোনো সারপ্রাইজ দিক, কিন্তু মন বলছে টুডে ইজ দ্যা ডে। আজই আসিফ সেই মেয়েটার সাথে পরিচয় করিয়ে দেবে। আজ থেকে তার আর আসিফের সম্পর্ক নতুন একটা ডাইমনশনে প্রবেশ করবে। সে হয়তো আবারো ‘মিতা’ থেকে ‘মধুমিতা’ হয়ে উঠবে। কিছুই আর স্বচ্ছ্বভাবে ভাবতে পারছে না। এতোদিন শুনেছে আর নিজেও বিশ্বাস করেছে প্রেম থেকেই পজেসিভনেস হয়। কিন্তু আজ মধুমিতা ভীষণ পজেসিভ ফিল করছে। তবে কি সে খানিক হলেও আসিফের প্রেমে পড়েছিল? ‘খানিক প্রেম’ বলতে আছে নাকি কিছু? এতোদিন যে তার নিরঙ্কুশ দখলে ছিল সে কি আজ থেকে তবে...

আসাদ গেটের আড়ংয়ে নেমে ঝটপট একটা সুন্দর দেখে ফতুয়া কিনে নেয়। খালি হাতে তো আর আশির্বাদ করা যায় না। যদিও মেয়েটার দৈর্ঘ্য প্রস্থ কিছুই জানা নেই, তবুও যেহেতু ফ্রি সাইজ, মাপ মতো হয়ে যাবে নিশ্চয়ই। আচ্ছা, এমন তো হতে পারে যে সে ভাবছে মোটেও তা নয়। হয়তো নিশা পুরোপুরি একটা কাল্পনিক চরিত্র। হয়তো তাকে চাপে রাখার জন্য আসিফের উর্বর মস্তিষ্কের আবিষ্কার মাত্র। হয়তো এতো দিনের গল্পগুলো বানোয়াট, হয়তো হেঁয়ালী। এমনও তো হতে পারে আজ আসিফ তাকে প্রপোজ করবে। চার বছরে যে কথা মুখ ফুটে বলেনি আজ তা বলবে। হতে পারে না? আসিফ যে তার প্রমে পড়েছে সেই কবেই তাতো ওরা দু’জনেই জানে। একজন বলে না, আরেকজন না বোঝার ভান করে এই যা। মধুমিতার মস্তিষ্ক বলছে আজ নিশার সাথে পরিচয় হবে, হৃদয় বলছে আসিফ ওকে প্রপোজ করবে। প্রপোজ করলে মধুমিতা ‘হ্যাঁ’ বলবে না সেটা তো পুরোনো সিদ্ধান্ত। কিন্তু ‘না’ বলবে কিভাবে, কোন কারণ দেখিয়ে সেই সিদ্ধান্তও তো কোনোদিন নেয়া হয়নি!

এসব ভাবতে ভাবতেই ক্যাফে ম্যাংগো চলে আসে। ততক্ষণে সোয়া পাঁচটা বেজে গেছে। রিক্সা বিদায় করে সরাসরি দোতলায় উঠে আসে। এক কোণের একটা ছোট্ট টেবিলের সামনে আসিফ বসা। একা। তবে কি মস্তিষ্ক ভুল? তবে কি হৃদয়ের ধারণাই ঠিক? এতোদিন তবে কি আসিফ শুধু হেঁয়ালীই করেছে নিশা নামের কাল্পনিক চরিত্রটি নিয়ে?

কী রে, তোকে এতো বিধ্বস্ত বিপর্যস্ত দেখাচ্ছে কেন? পিয়ার সাথে ঝগড়া করেছিস নাকি কুস্তি করেছিস?

বাজে কথা রাখ। কী সারপ্রাইজ দিবি দে। না হয় হলে যাচ্ছি। টায়ার্ড লাগছে।

আচ্ছা বাবা, মাত্রই তো এলি। পাঁচ মিনিট বোস। এক কাপ কফি অন্তত খা।

আসিফ কফির অর্ডার দেয়। ঠিক সেই সময় মেয়েটি ঢোকে। শ্যামলা মতো। চোখ দু’টো ছাড়া আর কোনো বিশেষত্ব নেই।

এই হচ্ছে নিশা। তোকে তো ওর কথা আগেই বলেছি। যদিও তুই বিশ্বাস করিসনি।

কে বলেছে বিশ্বাস করিনি? তবে এতো যে সুন্দর আর মায়ামায়া চেহারা সেটাতো বলিসনি। তুই ভীষণ লাকি।

ঠিক প্রশংসা করতে না চাইলেও মধুমিতার মুখ ফসকে একটু অতিরঞ্জন বের হয়ে যায়। আসিফ আর নিশা আজ না হয় একটু খুশিই হলো। হোক না।

নিশা কপট লজ্জায় চোখ নিচু করে। আসিফ মধুমিতাকে পরিচয় করিয়ে দেয়।

এই হচ্ছে তোমার মিতা’পু। ওর কথা তো শুনেছো অনেক। আমার বেস্ট ফ্রেন্ড, গার্জিয়ানও বলতে পারো।

তিনজন মুখোমুখি বসে। এ কোনো ত্রিভূজ প্রেমের উপাখ্যান নয়, আবার স্ট্রেটকাট ট্র্যাডিশনাল প্রেম কাহিনীও নয়। তবে এই কাহিনীর কোথাও একটা ত্রিভূজ আছে। চুপচাপ তিনজন নিজের মতো করে সেই ত্রিভূজের পরিসীমায় পায়চারি করে। মধুমিতা ভেবেছিল যদি কোথাও কোনো ত্রিভূজ থাকে তবে সে নিজেই তার কেন্দ্র হবে। কিন্তু এই ত্রিভূজের কেন্দ্রে আসিফ, যদিও তাকে প্রথাগত ত্রিভূজ প্রেম বলা যাবে না। সে তো কখনো আসিফের প্রেমে পড়েনি। সত্যিই কি পড়েনি?

মধুমিতা কী বলবে কী দিয়ে কথা শুরু করবে বুঝতে পারে না। ওর অস্বস্তি বাড়তে থাকে। কফির কাপ হাতে নিয়ে নিশা নিস্তব্ধতা ভাঙে।

আপু, আপনার এতো কথা শুনেছি যে আপনাকে আমার অপরিচিত মনে হয়নি মোটেও।

তাই? এই শয়তানটা কী আর বলবে? নিশ্চয়ই গাদায় গাদায় বদনাম করেছে।

মোটেও না আপু। আপনার এতো প্রশংসা করে যে আমারতো মাঝে মাঝে হিংসেই হয়। সত্যিই আমার মনে হয় ওর চেয়ে বড় কোনো ফ্যান নেই আপনার। আমি তো গল্প শুনেই আপনার ফ্যান হয়ে গেছি।

মধুমিতা আড়ং থেকে কেনা ফতুয়ার প্যাকেটটা বের করে নিশার হাতে দেয়।

দেখো তো পছন্দ হয় কিনা। মনে হচ্ছে মাপে হয়ে যাবে।

থ্যাঙ্কস আপু। কিন্তু আপনি কেন আনতে গেলেন?

বোকা মেয়ে। বেস্ট ফ্রেন্ডের ফিয়ান্সিকে কি খালি হাতে আশীর্বাদ করতে হয়?

আসিফের অবাক হবার পালা। প্যাকেটটা আগেও দেখেছিল। ভেবেছে, হয়তো মধুমিতারই কিছু হবে।

তুই এটা ওর জন্য কিনেছিস? কই আমি তো আগে থেকে তোকে কিছুই বলিনি। কী করে বুঝলি যে আজ ও আসবে?

তুই কি আমাকে এতোই গাধা ভাবিস? তোর সারপ্রাইজটা কী হবে তা বোঝার জন্য কি আইনস্টাইন হবার দরকার আছে? আর জানিস না, মেয়েদের একটা সিক্সথ সেন্স থাকে? কী বলো নিশা?

বিভিন্ন প্রসঙ্গে কিছুক্ষণ কথা হয়। শেষ অবধি আড্ডা তেমন জমে না। মধুমিতার একা থাকতে ইচ্ছে করছে। এই সময়টায় একাই থাকা উচিত, ওদেরও নিজদের মতো করে সময় কাটাতে দেয়া উচিত।

আজ তাইলে যাই রে! সারা দিন বাইরে ঘোরাঘুরি করে ভীষণ টায়ার্ড লাগছে। তোরা গল্প কর। কাল ক্লাশে দেখা হবে। নিশা, তুমি কিন্তু যখন তখন চলে এসো হলে। চুটিয়ে গল্প করা যাবে। সারাদিন এই শয়তানটার সাথে সময় কাটিয়ে যখন বোর হয়ে যাবে তখনই না হয় এসো।

আসিফ বাধা দেয় না। এখন মধুমিতার একটু একা থাকা দরকার তা বুঝতে পারে।

সিএনজিতে উঠে কিছুতেই ভাবনাটা দূর করতে পারে না। আসিফ শেষ পর্যন্ত এই এভারেজ মেয়েটার প্রেমেই পড়লো? চোখ দু’টো ছাড়া আর কীইবা আছে মেয়েটার? এ ধরনের মেয়ের প্রেমে পড়ার মতো ছেলে তো আসিফ নয়। তবে কি মধুমিতার নির্লিপ্ততায় এটা আসিফের প্রতিশোধ স্পৃহা? ওকে কষ্ট দিয়ে আসিফের লাভ কী? ছেলেটা কি সত্যিই নিশাকে মধুমিতার মতো করে ভালোবাসতে পারবে? নাকি কি মেয়েটা কেবলি একটা ইগো’র বলি? আসিফ হয়তো মধুমিতাকে পায়নি। নিশা কি পাবে আসিফকে? নিশা হয়তো আসিফের ঠোঁট পাবে, আঙুল পাবে, নাভীমূলে তার আদিম স্পর্শ পাবে। কিন্তু আসিফের পূর্ণাঙ্গ সত্তাটুকু পাবে কি?

সিএনিজি থামিয়ে ফার্মেসী থেকে দশটা ভ্যালিয়াম নিয়ে এসেছে। খাবে কিনা এখনো বুঝতে পারছে না। ঘুম না এলে তো খেতেই হবে। আজ যে ঘুম আসবে না তা বোঝার জন্য তো আর রকেট সায়েন্টিস্ট হতে হবে না। রুমে আজ সে একা। তিথি গেছে মামার বাসায়, স্বপ্না দেশের বাড়িতে। রুমে ঢুকে কোনো রকমে দরোজা বন্ধ করে বিছানায় এলিয়ে পড়ে। বালিশে মুখ গুঁজে ফুপিয়ে কেঁদে ওঠে। মধুমিতার অনেক কষ্ট হয়। নিজের জন্য, আসিফের জন্য, নিশার জন্য। ভেজা চোখে ভেসে উঠে তিনজন পরাজিত মানুষের মুখচ্ছবি। মধুমিতা কেঁদেই চলে। হাতে ভ্যালিয়ামের স্ট্রিপ। স্বপ্নের রাজপুত্রের কথা আর মনে থাকে না তার।

অথচ এই গল্পটি অন্য রকম হতে পারতো। আসিফ কিংবা মধুমিতা কেউই এমনটি চায়নি।



বাংলাদেশ সময়: ১৮৪৮ ঘণ্টা, অক্টোবর ২১, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।